১
সাহিত্য ও বাজার শুনলে প্রথমেই মনে হয় যেন তেল আর জল। অর্থাৎ, আপাতদৃষ্টিতে এদের মেশানো মুশকিল। কিন্তু আবার রান্নার উপকরণের রূপক দিয়েই যদি বলতে হয়, তাহলে এমন রান্নার কথা ভাবা মুশকিল, যেখানে কোনো না কোনো সময় তেল ও জল দুই-ই লাগে না। কবির ভাষায় তাই বলাই যায়, ‘মেলাবেন তিনি, মেলাবেন।’ কিন্তু প্রশ্ন হল, ‘তিনি’ কে, তিনি কীভাবে মেলাবেন, এবং যা তৈরি হবে সেটা সুস্বাদু ও সুপাচ্য হবে তো?
তারও আগে প্রশ্ন জাগতে পারে, সাহিত্য হল উচ্চমার্গের ব্যাপার, তার সাথে বাজার— যে কথাটার মধ্যেই একটা আঁশটে গন্ধ আছে— তার মধ্যে যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা কেন? শিল্প তো ভাবজগতের ব্যাপার, আর বাজার বস্তুজগতের। এদের মধ্যে সম্পর্ক কী?
কিন্তু ভাবুন, বিমূর্ত শিল্পও তো বিক্রি হয়। তার শৈল্পিক মূল্য একটা ব্যাপার, আর মানুষের হাতে বিনিময় হবার সময় একটা আর্থিক অঙ্ক যুক্ত হয়ে যায়— সেটা আরেকটা ব্যাপার। আসলে মূল্য (value) আর দাম (price)— বা মার্ক্সের ভাষায় ব্যবহার-মূল্য আর বিনিময়-মূল্য— অনেক সময়ে একই অর্থে ব্যবহৃত হলেও, ব্যাপার দুটো সম্পূর্ণ আলাদা। মূল্য মানুষের মনে, যে মনের গহন রহস্য অনেক সময় বোঝা মুশকিল। আর দাম হল চাহিদা আর জোগানের ঠোকাঠুকিতে ঠিক হওয়া একটা অঙ্কমাত্র, যাতে কোনো জিনিসের বিনিময় হয়। আপনার প্রিয় কোনো ব্যক্তিগত জিনিস আপনার কাছে অমূল্য (প্রিয়জনের দেওয়া উপহার), কিন্তু তার বাজার-দাম বেশি না-ও হতে পারে। আবার বাজার-দাম খুব বেশি মানেই সেই জিনিস আপনার রুচি অনুযায়ী খুব মূল্যবান না-ও হতে পারে, বা পয়সা দিলেও আপনি নেবেন না এরকম অনেক উদাহরণই ভাবা যেতে পারে।
আসলে বাজার কথাটা অনেক অর্থে ব্যবহার হয় এবং আমাদের ‘সাহিত্য’ ও ‘বাজার’ একসাথে শুনলে যে অস্বস্তি হয় তার পেছনে সেটা একটা বড় কারণ। প্রথমত, বাজার একটা বণ্টনব্যবস্থা। ঠিক যেমন জলের কল দিয়ে যাতে জল আসে তার জন্যে একটা জলবণ্টন ও জলনিকাশ ব্যবস্থার পরিকাঠামো থাকে, সেরকম পাঠকের হাতে পছন্দমতো বই আসার জন্যেও একটা বণ্টনব্যবস্থা প্রয়োজন। বাজার না থাকলে আপাতদৃষ্টিতে বাজারি মানসিকতা-মুক্ত বইগুলোই— যেমন কবিতার বা প্রবন্ধের বই— বা আমাদের হাতে আসবে কোথা থেকে? রেশনের দোকান বা সরকারি দপ্তর থেকে তো নয় (সরকারি দপ্তর থেকে যে বই বেরোয় না তা নয়, কিন্তু তা হাতে পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না)। একই বাজারে নীহার গুপ্তের জমজমাট ডিটেকটিভ বই পাওয়া যায় আবার মণীন্দ্র গুপ্তের ‘অক্ষয় মালবেরি’— যার যেমন রুচি সেই অনুযায়ী লেখক ও পাঠককে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটাও বাজারই করে। এমনকী বাজার-বিরোধী, বা বৃহত্তর অর্থে ধনতন্ত্র-বিরোধী বইও আমাদের হাতে আসে বইয়ের বাজার থেকেই— বাজার ছাড়া মার্ক্স বা সার্ত্র থেকে চমস্কি বা অধুনা ভারুফাকিস আবার ওই দিকে সুকান্ত ভট্টাচার্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সমর সেন থেকে নবারুণ ভট্টাচার্য, কার বই আমরা হাতে পেতাম?
পাঠকের হাতে বই আসে বইয়ের দোকান থেকে এবং বইয়ের দোকানে বই যায় প্রকাশকের কাছ থেকে, ছাপাখানা থেকে বই এসে জমা পড়ে প্রকাশকের দপ্তরে, লেখকের কাছ থেকে পাণ্ডুলিপি যায় প্রকাশকের কাছে— অর্থাৎ, পাঠক আর লেখকের মধ্যে যে যোগাযোগ স্থাপিত হয় তার মধ্যে কিন্তু একাধিক পর্যায়ে বাজারের মধ্যস্থতা আছে। এখন ই-দুনিয়ায় গোটা ব্যাপারটা আন্তর্জালের ইন্দ্রজালে হয় খানিক— কিন্তু প্রযুক্তি আলাদা হলেও মূল যুক্তিটি একই রকম। আসলে সাহিত্য কেন, সংস্কৃতির অন্যান্য ধারাতেও বাজার, বা বৃহত্তর অর্থে বাণিজ্যিক দিককে অগ্রাহ্য করা মুশকিল। জনপ্রিয় ছবি হোক বা আর্ট ফিল্ম, ছবি তৈরির প্রক্রিয়া থেকে দর্শকের কাছে পৌঁছনো অবধি অনেকগুলো ধাপ পেরোতে হয়, যেখানে অর্থের লেনদেন আবশ্যক এবং বইয়ের জগতের তুলনায় প্রযুক্তিগত ফারাকের জন্যে অনেক মানুষ তাতে জড়িত থাকেন এবং আর্থিক বিনিয়োগের দিকটা সাহিত্যের জগতের থেকে অনেক বেশিমাত্রায় প্রয়োজন হয়।
২
তাহলে সমস্যা কোথায়? ‘সাহিত্য’ ও ‘বাজার’ একসাথে শুনলে কেন অস্বস্তি হয়? প্রথম সমস্যা হল, বাজারে সাফল্য আর উৎকর্ষের মধ্যে কোনো আবশ্যক সম্পর্ক নেই। বিনোদনমূলক সাহিত্য বাজারে বেশি বিক্রি হয়— যেমন, ড্যান ব্রাউনের বই যত বিক্রি হয়, হারুকি মুরাকামির বইয়ের বাজার তার তুলনায় খুবই সীমিত। বরং শিল্প বা সাহিত্যের ক্ষেত্রে যা জনপ্রিয়, তা অনেকসময়েই নিম্নমানের বলে মনে করা হয়। আর সমঝদার পাঠক যার কদর করেন, তার বাজারদর বা জনপ্রিয়তা অনেকসময়ই খুব বেশি হয় না। আবার সাহিত্যগুণের দিক থেকে যা উচ্চমানের, তা অনেক সময়েই ক্ষুদ্র প্রকাশক বা লিটল ম্যাগাজিনের সূত্রেই আমাদের হাতে আসে। আসলে যেখানে ব্যবসা বেশি হবে, বাজারের স্বাভাবিক প্রবণতা সেদিকে ধাবিত হওয়া, কারণ বাজারের একটা বড়ো চালিকাশক্তি হল মুনাফার উদ্দেশ্য। সেই জন্যেই ‘বাজার’ বা ‘বাজারি’ শব্দগুলো নিয়ে আমাদের অস্বস্তি— যেহেতু আমজনতার রুচি আর বিদগ্ধ ও রুচিশীল পাঠকের রুচি খুব অল্প ক্ষেত্রেই মেলে, তাই কোনো বই ‘বাজার-সফল’ বা ‘বেস্টসেলার’ শুনলে অনেকেরই সন্দেহ জাগে, পড়ার যোগ্য তো?
কিন্তু বাজার মাছেরও হয়, আবার বিমূর্ত শিল্প বা গবেষণার বইয়েরও হয়। বাজার মানেই সব তরল করে দেওয়া সহজ করে দেওয়া, এটা একটু অতিসরলীকরণ। হয়তো বাজার বলতে আমরা গণ-বাজার (mass market) ভাবি, যেখানে সহজপাচ্য ও বিনোদনমূলক লেখা বেশি কাটবে। কিন্তু বাজারের মধ্যে তো বিশেষ পাঠকের উদ্দেশ্যে লেখা বইয়ের বাজারও (যাকে ‘niche market’ বলা হয়) পড়ে, যাকে ‘পছন্দসই বাজার’ বলা যেতে পারে। এখানে বাজারের মূল ভূমিকা হল, পাঠক ও তার রুচি অনুযায়ী বইয়ের ‘যোগ’ (অর্থাৎ, match) করে দেওয়া ।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে এই পছন্দসই বাজার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুটো জিনিসের উপযোগিতা যদি একদম এক হয়— যেমন চাল, যা দিয়ে ভাতই তৈরি হবে— তখন মূল প্রশ্ন হল, কোনটা ‘ভাল’ আর কোনটা ‘খারাপ’ এবং সেই নিয়ে অধিকাংশ লোকই একমত হবেন। কিন্তু যে জিনিসের উপযোগিতা বিভিন্ন লোকের কাছে আলাদা— কেউ চা বেশি পছন্দ করেন এবং কেউ কফি এবং এদের মধ্যেও গন্ধ ও স্বাদের হাজার রকমের পার্থক্য আছে— সেখানে এরকম ভাল-মন্দের তালিকা করার অর্থ হয় না। এইখানে বাজারের মূল ভূমিকা হল: যার যেরকম রুচি তাকে তার পছন্দের জিনিসের সন্ধান দেওয়া। পছন্দের জিনিসের মধ্যে নিশ্চয়ই গুণমানের তফাৎ আছে— ডিটেকটিভ গপ্পে আমার প্রিয় ব্যোমকেশ-ফেলুদা, আর বিকল্পধারার কবিতায় তুষার রায় বা অনন্য রায়— কিন্তু এই দুটো শ্রেণির সাহিত্যকে মেশানো উচিত নয় ।
এইভাবে ভাবলে সাহিত্য ও বাজারের মধ্যে যে আপাত-দ্বন্দ্ব, তার খানিক নিষ্পত্তি হয়। এটা ঠিকই যে, খুব অভিনব বা উচ্চমানের সাহিত্যকীর্তির পাঠকসংখ্যা অন্তত প্রথমদিকে বেশি হয় না, আর তাই অনেকসময়ই তা বাজারের নিক্তিতে দ্রুত সাফল্য পায় না। আবার বিনোদনমূলক সাহিত্যের বাজার মোটামুটি সবসময়েই একটা নির্দিষ্ট গতিতে চলে। এইভাবে দেখলে বাজার-সাফল্য ও সাহিত্যিক গুণমানের মধ্যে অবশ্যই দ্বন্দ্ব আছে। কিন্তু বিভিন্ন ধরনের সাহিত্যের শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে সচেতন থাকলে— জনপ্রিয় মানেই তা নিম্নমানের, আবার বাজারে কাটেনি মানেই তা কালজয়ী সাহিত্য: এরকম সরল সমীকরণ করার কোন অর্থ হয় না।
আরেকটা বড় সমস্যা হল, বাজারের সাথে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একচেটিয়া ক্ষমতা এবং ‘পুঁজি যার মুলুক তার’ গোছের প্রবণতা জড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ সাহিত্যের বিভিন্ন শ্রেণি বা বিভাগের মধ্যে তফাৎ করার সমস্যাটা (যেটা নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম) যদি সরিয়েও রাখি, যা বাজারে আসে তা সেই শ্রেণির সাহিত্যের মধ্যেও সর্বশ্রেষ্ঠ— তা ভাবার কোনো কারণ নেই। বড় কোনো প্রতিষ্ঠানের সুনজরে এলে সেই লেখকের যে প্রচার হবে, তা সমান বা অধিকতর প্রতিভাবান কোনো লেখক যিনি এই সুযোগ পাননি বা চাননি, তাঁর হবে না।
বাজারে সাফল্য ও উৎকর্ষের মধ্যে তাই কোনো সোজা সম্পর্ক নেই, আর এই সমস্যার কোনো সোজা সমাধানও নেই।
তবে এখানে আধুনিক প্রযুক্তির একটা সদর্থক ভূমিকা থাকতে পারে বলে মনে হয়। নতুন উদ্ভাবনার কাজই হল সাবেকি ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দেওয়া। ডিজিটাল বিপ্লব (যেমন, ডিটিপি, অনলাইন বিপণন, ই-রিডার) বাংলা সাহিত্যের বাজারকে নাড়িয়ে দিতে পারে কি?
৩
এটা ঘটনা যে, গত কয়েক দশকে প্রকাশনার পৃথিবীতে প্রযুক্তিগতভাবে আমূল পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন তুলনায় ক্ষুদ্র বা অনামী প্রকাশনার থেকেও যে গুণমানের বই বেরোয়, তা আগে ভাবা যেত না। আমার ছোটবেলার স্মৃতি হল, একটু অনামী প্রকাশনার বই কেনার কিছুদিন বাদে ‘লুচিভাজা’ হয়ে যেত। এখন প্রচ্ছদ, বাঁধাই, ছাপার গুণমান সবদিক থেকে বড় এবং ছোট প্রকাশনার বইয়ের মধ্যে তফাৎ করা শক্ত হয়ে গেছে এবং বই প্রকাশনার গুণমানের আগের থেকে অনেক উন্নতি হয়েছে।
আরেকটা কথা হল, ডিজিটাল এবং ছাপার মাধ্যম— এগুলো কি পরস্পরের বিকল্প না সম্পূরক? আমি ব্লগ পড়ি বা ই-রিডারে বই পড়ি বলে কি আমি আর পত্রিকা বা ছাপা বই কিনে পড়ি না? আমার ক্ষেত্রে আমি যত পড়ি (বা গান শুনি, বা সিনেমা দেখি) তত পড়ার ইচ্ছে বাড়ে, তাই আমার কাছে এগুলো সম্পূরক। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল দুনিয়ায় বইয়ের অনেক খবর পাওয়া যায়— যাঁদের মতকে গুরুত্ব দিই তাঁরা কোনো বইয়ের উল্লেখ করলে ভাবি, এটা পড়তে হবে। আর অনলাইন অর্ডার দিলাম দু-একদিনে বাড়িতে এসে গেল বই, সেই সুবিধের দিকটা তো আছেই। আগে কলকাতায় না থাকলে, কফি হাউসের আড্ডাতে অংশগ্রহণ না করলে, বা পাতিরামে না গেলে, বিকল্প জগতে কী লেখা হচ্ছে— সে লিটল ম্যাগাজিন হোক বা মূলধারার বাইরে প্রকাশনাগুলোর ছাপা বই— তাদের সম্পর্কে জানতে পারতাম না। এইসব ভাবেও ছাপা বইয়ের ব্যবসার পক্ষে ডিজিটাল বিপ্লব সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে।
কিন্তু তার সাথে চোরাই ডিজিটাল-কপি অনায়াসে হাতে এসে যাচ্ছে, সেটা বইয়ের ব্যবসার পক্ষে ভাল হতে পারে না। আর, যে-জিনিসটা ‘ফ্রি-তে’ পাওয়া যাচ্ছে যা তার জন্যে পয়সা দেব কেন— সেই মনোভাবও আছে। এটা একটা বিষচক্রের মত। লেখালেখি যেহেতু শখ, উপার্জনের একমাত্র পথ নয়, তাই বইয়ের ‘ফ্রি’ ডিজিটাল কপি আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে পাঠকেরা ততটা নৈতিক অস্বস্তি বোধ করেন না, যতটা দোকানে পয়সা না দিয়ে জিনিস তুলে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে (আশা করা যায়) কাজ করত। আবার এই কারণেই লেখালেখিকে পেশা করার কথা লোকে সহজে ভাবেন না, কারণ উপার্জনের সম্ভাবনা অন্য বাঁধাধরা চাকরির তুলনায় সীমিত।
৪
তবে বাজার, সাহিত্য বা সাফল্য— কোনো ক্ষেত্রেই ঘুরেফিরে বাঙালি মানসকিতার বিশেষ ভূমিকা না দেখলে চলবে না। সাফল্য আর উৎকর্ষের মধ্যে কোনো আবশ্যক সম্পর্ক নেই, কিন্তু তাহলেও বাংলায় মূলধারাকে একটু অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। বিদেশেও কোনটা বেশি মধ্যরুচির আর কোনটা উচ্চরুচির (যেমন, New York Times বনাম New York Review of Books), কোনটা মূলস্রোতের আর কোনটা বিকল্পধারার, কোনটা বামপন্থী কোনটা মধ্যপন্থী— এই নিয়ে পরিষ্কার শিবির-বিভাজন আছে। কিন্তু ‘আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে’ এই নিয়ে গর্ব করার মানসিকতা চোখে পড়েনি। এমন কী র্যাডিকাল প্রকাশনাও চায়, তাদের বই বিক্রি হোক।
শিল্পীর বস্তুগত সাফল্যের প্রতি, অর্থাৎ বাজার-সফলের প্রতি সাধারণ মানুষের অনীহা, বা অন্তত সেই অনীহার প্রতি শ্রদ্ধা— এটা বাঙালির দোষ এবং গুণ দুটোই। দোষ: কারণ উৎকর্ষ ফাঁকি দিয়ে হয় না। এবং ব্যর্থতা মানে ‘আমার প্রতিভা কেউ বুঝল না’ হওয়ার থেকে ‘আমি অত ভালো নই’ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেটা সবাই জানে, তাই সাফল্যের প্রতি অনীহা একটি আত্মঘাতী প্রবণতা। অথচ আমরা যাঁদের শ্রদ্ধা করি, সে বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ বা অমর্ত্য, প্রতিভা বাদ দিলে তাঁরা সবাই প্রবল পরিশ্রমীও। আবার ব্যক্তিগত স্তরে উচ্চাকাঙ্ক্ষী না হওয়ার কিছু ভাল দিক আছে— তাই বাঙালির আড্ডা, খাদ্যপ্রীতি, আতিথেয়তা, জীবনকে উপভোগ করার মানসিকতা, রসবোধ, এইরকম কিছু মূল্যবোধের গুণগ্রাহী না হওয়া মুশকিল।
আসলে বাজার একটা যন্ত্রের মত। আপনি তাতে যে উপাদান দেবেন, সেইমতো ফল পাবেন। বাজারের সাথে মুনাফার আবশ্যক কোন সম্পর্ক নেই। ধনতান্ত্রিক সমাজেও অ-লাভমুখী (non-profit) এবং সামাজিক উদ্যমের (social enterprise) একটা বড় পরিসর আছে। বাংলা বাজারে, কোনও সাহিত্যিক যদি ঠিক করেন, তিনি শুধু লিখে জীবিকা অর্জন করবেন, আর কিছু করবেন না, তা কেন সম্ভব হবে না? যে কয়েকটা উদাহরণ মনে পড়ছে (যেমন, মহাশ্বেতা দেবী, হুমায়ুন আহমেদ) তাঁরা একটা পর্যায়ে বাণিজ্যিক সাফল্যের পরেই এই সিদ্ধান্ত নেন। বিদেশে পেশাদার লেখক হওয়ার উদহারণ অনেক বেশি, কিন্তু সেখানে সামাজিক নিরাপত্তাজাল নিশ্চয়ই একটা সহায়ক ভূমিকা পালন করে (যেমন, জে কে রাউলিং)।
আমার মনে হয়, বাজারের উদ্যমের দিকটার সাথে বাঙালি মানসিকতা আর সংস্কৃতির সঠিক মেলবন্ধন কী করে করা যায়, সেটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে মুনাফামুখী মানসিকতা আর বাজারি সাফল্যের প্রতি আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত অস্বস্তিবোধকে স্বীকার করেই এগোতে হবে।
ছবি এঁকেছেন চিরঞ্জিৎ সামন্ত