একটা সময় ছিল, যখন জন্মদিনের সকালে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্ন ছিল, আজ সিমাইয়ের পায়েস খেতে পাব, না চালের পায়েস? কোভিড এসে প্রশ্নটা বদলে গেল: আজকের সারপ্রাইজ পার্টিটা হবে জুম-এ, না গুগল মিট-এ? আর যে সারপ্রাইজ (বা শক) পারফর্ম্যান্স-টা হবে, সেটা ঠিক কী?
২০২০ সালের মার্চের আগে একটা সময় ছিল, যখন জন্মদিন পালন করা হত এক আশ্চর্য ঘটনার মাধ্যমে, যা এখন বিলুপ্ত, তার নাম বার্থডে পার্টি। কিছু প্রিয়জন আমাদের বিশেষ দিনগুলোয় ঠিক শহরের বাইরে বা দেশের বাইরে থাকতেন বটে,কিন্তু একটা বন্ধুর দল থাকতই, যারা কেকের টুকরো পেতে, বা রেস্তরাঁয় গুচ্ছের খাবার খেতে ঠিক হাজির হয়ে যেত, আর তক্ষুনি শুরু হয়ে যেত বার্থডে পার্টি নামের উৎসব। পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে থাকা আত্মীয়-বন্ধুরা হোয়াটসঅ্যাপে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাতেন, সেটাই ছিল বিশেষ দিনটায় তাঁদের একরকম উপস্থিতি।
অতিমারী এসে দুটো জিনিস করল: ১৫ মিনিট দূরত্বে থাকা বন্ধুটাকেও মুহূর্তে ঠেলে দিল ধরাছোঁয়ার বাইরে, আর একই তৎপরতায়, অন্য টাইম-জোনে থাকা বন্ধুরা দুম করে ঢুকে পড়ল আমন্ত্রিতের লিস্টে।
আমি প্রথম ভার্চুয়াল পার্টিতে যোগ দিলাম ২০২০-র মাঝামাঝি। হাউসপার্টি নামে একটা অ্যাপ-এ এই কাণ্ডটা ঘটল, আমরা আটজন বন্ধু এটায় ছিলাম, উস্কোখুস্কো চুলে, আটপৌরে কোঁচকানো পোশাকে, বসে বসে আমরা অন্য বন্ধুদের খুব নিন্দে করলাম। ওই বছরেরই জুন আর অগাস্টের মধ্যে কোনও একটা সময়, সকলেরই মনে হল, ধুর, হাউসপার্টি অ্যাপটা বিচ্ছিরি, জুম অনেক ভাল, কারণ আটজনে কোনও পার্টি জমে না। এছাড়া পার্টি করতে গিয়ে শুধু অলস আড্ডা মারা যথেষ্ট নয়, অনেক ঘণ্টাবাদ্যি চাই, ভেঁপু বাজলেও মন্দ হয় না। আমার চেনাশোনার মধ্যে কারও ‘মাইলফলক জন্মদিন’ (মানে দশের গুণিতকে বয়সে পা দিলে, বিশেষত ৪০ বা ৫০ বছর) হলে, শুধু আড্ডায় তার মন ওঠে না।
ভারতে এই জুম-পার্টির একেবারে বাঁকবদলের ঘটনা হল, ২০২০ সালে কোনও এক ঋদ্ধিমা সাহনির ৪০-তম জন্মদিনে, তাঁর স্বামী ঠিক করলেন, আত্মীয়রা ‘আপ য্যায়সা কোই’ গানটার সঙ্গে নাচবেন, যেটা ১৯৮০-র একটা সুপারহিট গান। এই জুম-পার্টির ভিডিওটা ভাইরাল হল, আর অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে এটার নকল করতে লাগলেন। একটাই মুশকিল, ঋদ্ধিমার সব আত্মীয়ই দিব্যি সুন্দর দেখতে আর তাঁদের চালচলনও বেশ ধোপদুরস্ত। ঋদ্ধিমার ভাই হচ্ছেন রণবীর কাপুর, তাঁর মা নীতু কাপুর (যাঁর বয়স বাড়ে না), আর তাঁর তুতো-বোনেরা হলেন করিনা কাপুর ও করিশ্মা কাপুর। আর করিনার স্বামী হলেন সইফ আলি খান, আর তার সঙ্গে আবার রণবীরের বান্ধবীর নাম আলিয়া ভাট। তাই এঁদের নাচের ভিডিও, কোভিড-কালেও, মানে ওই আকালেও, একেবারে এমটিভি-র মশলা-খচিত। যদি না দেখে থাকেন, তাহলে এখানে লিংক দেওয়া রইল।
এবার যা ঘটল: নিতান্ত নশ্বর মানুষেরাও অনুরোধ পেতে লাগলেন— অবশ্য অনুরোধের বদলে তাকে আদেশ বলাই ভাল— অমুক গানটার (বা গানগুলোর) সঙ্গে নেচে তা রেকর্ড করে পাঠাও, সেসব এডিট করে, অনেকের নাচ দিয়ে একটা ভিডিও তৈরি করা হবে। সাধারণ মানুষ তাঁদের হাঁপানি সামলে, ভুঁড়ি গুটিয়ে, ক্যামেরা অ্যাঙ্গলে মুখটা কতটা কিম্ভূত লাগছে তা উপেক্ষা করে, ভিডিও করতে লাগলেন, যা আদ্ধেক সময়েই পাতে দেওয়ার যোগ্য না, আর যখন খুব ভাল, তখনও তা নেহাৎ মিষ্টি আর বুদ্ধু। চরম লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করি, আমিও এক বন্ধুর ৫০তম জন্মদিন উপলক্ষে নাচলাম ‘ডিস্কো দিওয়ানে’ গানটার সঙ্গে। যার জন্মদিন, সে-বেচারার কোভিড হয়েছিল, দিনটা তার শুয়ে-শুয়েই কাটছিল, ফলে তার দুঃখ ঘোচাতে এটুকু তো করতেই হবে। আমার লজ্জা বাড়ল নেচে যতটা, তার চেয়ে বেশি এইটা বুঝে, আমি এই ক্যামেরায় সামনে নেচে কী প্রবল আনন্দ পাচ্ছি! বোঝাই গেল, বন্দিদশায় থাকলে, হাস্যকর ব্যাপারস্যাপার ক্রমশ দৈব জ্যোতিতে আলোকিত হয়।
একই পথ ধরে এল জুম-অ্যানিভার্সারিও, সেকেন্ড ওয়েভের সময়। জুম কল-এ দেখা গেল, দম্পতি তাদের মুম্বইয়ের ভারসোভা-র বাড়িতে ল্যাপটপের সামনে মালাবদল করছে, আর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বন্ধুরা প্রাণপণ ভার্চুয়াল উলু দিচ্ছে।
ওমিক্রনের দাপটের সময় মেটা-বিবাহের (Meta-wedding) কথা শোনা গেল, যেখানে অতিথিরা তাঁদের ‘ডিজিটাল অবতার’ পাঠালেন, আর দম্পতিরও ‘অবতার’দের বিয়ে হল, যখন কিনা সত্যি-বিয়ের ফেসবুকে লাইভ চলছে, ডারবান-এর একটা চ্যাপেল থেকে।
যখন আমরা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে একটা স্বাভাবিক অবস্থার দিকে চলেছি, অফিস স্কুল কলেজ একটু একটু করে খুলে যাচ্ছে, দেখতে হবে জুম-পার্টি এখনও আমাদের জীবনে বিরাট একটা ভূমিকা পালন করবে কি না। এতে তো সন্দেহ নেই, বন্ধুদের সত্যিকারের উপস্থিতির উষ্ণতা, সত্যিকারের গান বাজার আনন্দ, বড় পার্টিতে গিয়ে ছোট্ট বৃত্ত তৈরি করে খিলখিল হেসে সব্বার কেচ্ছা নিয়ে ফিসফিস করার মধ্যে যে-টান, তাকে এড়ানোর প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু এটা ভাবতে বা বুঝতেও ভাল লাগবে: কেন আমরা নেচে, উলু দিয়ে, বা আবেগ-থরথর কথা বলে বন্ধুদের জন্যে ভিডিও বানিয়েছিলাম। এবং, কেন আমরা ফোন-ক্যামেরার সামনে মালাবদল করেছিলাম, ফুঁ দিয়ে বাহারি মোমবাতি নিভিয়েছিলাম, আর শুভদিনে বন্ধুর মেসেজ পেয়ে ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেলেছিলাম?
অতিমারীর সময়ের একাকিত্ব কি আমাদের একটু বেসামাল করে তুলেছিল? পরপর লকডাউনের ঠেলায়, এই নিষ্ক্রিয়তার আবহে কী করব বুঝতে না পেরে, কোনওমতে শান্ত ও স্বাভাবিক থাকার জন্য ভার্চুয়াল বিশ্বকে জড়িয়ে ধরছিলাম? আমরা এমনিতে যতটা স্বীকার করি, আসলে কি তার চেয়ে অনেকটা বেশি ভালবাসি কণ্ঠস্বর, হাসি, বা কথোপকথনকে?
আর এছাড়া ছিল মৃত্যু। আমরা প্রত্যেকেই জেগে উঠেছি দুঃসংবাদ পেয়ে: কোনও আত্মীয়, বা কোনও পরিচিত, বা কোনও বড় শিল্পী, কোভিডে মারা গেলেন। হয়তো আমাদের ওই নির্বাসনে, আমরা ওই হারানোর বেদনাকে একটু বুঝতে শিখছিলাম, আর সব কিছু পেরিয়ে হেসে ওঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলাম, পরিবার ও বন্ধুদের আঁকড়ে ধরে তাদের উপস্থিতিটাকে বেশ সমারোহে উদযাপন করছিলাম। অতিমারীর আগে, আমরা বলতাম, ইস, কতটা সময় আমরা এই পর্দার দিকে তাকিয়ে কাটিয়ে দিচ্ছি। সত্যি বলতে কী, এই স্ক্রিনের আনন্দগুলোই আমাদের ওই আইসোলেশনের, অনিচ্ছায় আটক থাকার, এমনকী অসুস্থতার দিনগুলোতে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
হতেই পারে, একদিন এই ভার্চুয়াল পার্টির দরকার আর থাকবে না, কিন্তু যদি সেইদিন আসে, যখন আমরা এই অ্যাপগুলোকে ডিলিট করে দেব, আমরা যেন এদের মনে রাখি কৃতজ্ঞতা ও মুগ্ধতার সঙ্গে। যেন মনে রাখি, আমাদের জীবনের একটা আঁধারতম পর্যায়ে এগুলোই ছিল আমাদের আশ্চর্য আশ্রয়।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী