কুয়াশা
এখন নয়। একটা বিশেষ দিনে নতুন কড়া আইন বসবে কয়েক ঘণ্টার জন্য। প্ল্যান করেই করা হচ্ছে। ওই সময় কিনে ফেলতে হবে জলের দরে। তারপর ফের বাড়লে বেচে দেওয়া যাবে। কিনতে বিশেষ টাকা লাগবে না। স্রেফ কাগজের খেলা। লভ্যাংশের একটা বড় অংশ সরকার খাবে, কিছুটা ক্যাশে ফেরত আসবে। এটাই প্রফিট। অনেকটা শেয়ারের মতো ব্যাপার। এখানে কোম্পানির স্বত্ব নয়, পাহাড়। কত বিঘে হবে জিজ্ঞেস করায় লোকটা হেসে বলেছিল, ‘হাইটের দাম নেই বুঝি? ফার্নিশড ফ্ল্যাট বোঝেন, টন-টন ধাতু, মণিমুক্তো ঠাসা একটা পাহাড়ের ভ্যালু বুঝতে পারছেন না?’ চিটিংবাজ অনেক দেখেছি। ইনি কিন্তু আলাদা। একটু খুলে বলি।
ফাঁকা ট্রামে ফিরছিলাম। বোর হলে সবাই যা করে, আমিও তাই করছিলাম। একে-ওকে আজেবাজে মেসেজ পাঠাচ্ছিলাম। প্রত্যেকটার পরেই তুরুং-তুরুং শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম পিছনে। দেখি একটা লোক, সেও ফোন নিয়ে কীসব করছে। ফিকফিক করে হাসছে। অদ্ভুত ব্যাপার, আমি মেসেজ ছাড়লে ওর ফোনেই সেটা চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার করলাম। পিছনে ফের তুরুং। ভুলের কোনও চান্স নেই। আমি তো আর জিজ্ঞেস করতে পারছি না, ‘ওগুলো আপনার কাছে যাচ্ছে কেন? দেখি একবার…’ ভয় করছিল। একেবারে সামনে চলে গেলাম। খাঁচার মধ্যে ড্রাইভার দাঁড়িয়ে আছে। ফাঁকা লাইন, কোনও সিগন্যাল নেই। তাও ট্রাম নড়ছে না। ওকে কিছু বলা গেল না। নেমে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। দরজার পাশে বসে কন্ডাক্টর খুচরো গুনছে। কিন্তু সেই লোকও যে নামছে! আমি নামলাম না। সেও নামল না।
আবার দেখা হয়ে গেল একদিন। একেবারে সামনাসামনি। এগিয়ে এসে লোকটা বলল, ‘সেদিন সময় পেলাম না। আপনার ফোনের সেটিংস বদলাননি তো আবার? প্রবলেমটা কিন্তু মনের। আচ্ছা পরে দেখিয়ে দেব নাহয়, আজ সময় নেই।’ বলে চলে গেল। এরপর থেকে রাস্তায় বেরোলেই একটা আতঙ্ক হত। মাস্ক খুলতাম না। খুব দরকার না থাকলে ভিড়ের জায়গায় যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। ফাঁকা জায়গায় ঘুরঘুর করতাম। জাদুঘরের মমিটা দেখছিলাম একদিন। হঠাৎ সেই লোক এসে হাজির। বলল, ‘আছে, প্রাণ আছে বইকি। আপাতত পজ দেওয়া হয়েছে। ভুলে যাবেন না, ইজিপ্সিয়ানরা ডেঞ্জারাস। অকারণে আখাম্বা পিরামিডগুলো বানায়নি। এখন সব বেরুচ্ছে একটু-একটু করে।’ বলে প্রায় অন্ধকার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। না, এর সঙ্গে কথা বলার দরকার আছে। আমার কোনও ক্ষতি তো করেনি। ও আমাকে প্ল্যান করে চেজ করছে ভাবার কারণ নেই। কী আর পাবে আমার কাছে? দৌড়ে বাইরের বারান্দায় বেরোলাম। নেই। বেঞ্চে বসলাম। শান্ত হলাম। মন বলছিল ফের দেখা হবে। কারণ সেটাই হয়ে আসছে। একটা অবসেশন তৈরি হয়ে গেল, রাস্তায় লক্ষ-লক্ষ লোকের মধ্যে ওকে খোঁজা। ক্রিসমাসের রাতে ওকে দেখতে পেলাম সেন্ট পলসের পাশের অন্ধকার রাস্তাটায়। দৌড়ে গিয়ে বললাম, ‘এই তো, কোথায় ছিলেন এতদিন?’ লোকটা বলল, ‘জানুয়ারির ফার্স্ট উইকে যাচ্ছি। যাবেন?’ হ্যাঁ বলে দিলাম। পাহাড়ের ব্যাপারটা তখনই শুনলাম। তারপর এই রাতের ট্রেন।
ছোটনাগপুরের ওপর দিয়ে অনেকবার গেছি। প্রতিবার ট্রেন পেরিয়ে গেছে রাতে। কুয়াশার জন্য ট্রেন দেরিতে ছাড়ল। বারবার হর্ন, গড়িয়ে-গড়িয়ে চলা দেখে বুঝলাম লেট হবে। হোক। তাড়া নেই। কোথায় নামব সেটা ও-ই জানে। শুধু বলেছিল বনপলাশিতে কোনও স্টপেজ নেই। চেন টেনে নামতে হয়। টিকিট ও কেটেছে। খাবার আমি এনেছি। বেশ ঠান্ডা। লোকটা বলল, ‘ওখানে কিছু নেই। আমার সঙ্গে বিস্কুট আছে। একদিনের ব্যাপার, চালিয়ে নেব।’ ওর ঝোলা ব্যাগের মধ্যে আর একটা প্যাকেট ছিল, দেখছিল। ভোর হতেই ও জানলা দিয়ে বারবার বাইরেটা নজর করছিল। আলো ফুটছে। পাশের ভিজে রেললাইন, কিছু মাটি-পাথর, তন্দ্রা-জড়ানো গাছ পেরিয়ে একটা পাহাড় চোখে পড়তেই ও তৎপর হয়ে উঠল। পাহাড়টার মাথা আছে। শরীরের তলাটা নেই। খুব কুয়াশা। চেন টানার দরকার হল না। আমরা লাফিয়ে নেমে পড়লাম। নীচু প্ল্যাটফর্ম, শেড নেই। কোথাও স্টেশনের নাম লেখা নেই। কেউ নেই। মনে হয়, স্টেশন হবে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু পরে তা নাকচ হয়ে যায়। ট্রেন মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল আমাদের ফেলে রেখে। চলে যাবার পর দেখলাম আর একটা লাইন আলাদা হয়ে চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। ‘আপনি কাউকে কিছু বলেননি তো?’ জিজ্ঞেস করায় আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। হাঁটতে-হাঁটতে শুনলাম এই জায়গাটার ওপর লোকের নজর বহুদিন ধরে। আমাদের পাহাড়টার ওপর। জায়গা বলি কী করে। যেখানে মানুষ থাকে না, কারণ যাই হোক, সেখানে ধান্দার কীই-বা থাকতে পারে। আশেপাশে জনপদের কোনও চিহ্ন দেখছি না। পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে না। কুয়াশা ছড়িয়ে আছে অনেক জায়গা জুড়ে। একটু-একটু করে আলো বাড়ছে। লোকটা এর আগে এখানে এসেছে নিশ্চয়ই। বেশ প্রত্যয় নিয়ে হাঁটছিল। ‘গরমের সময় এলেও আপনি এটা পাবেন’, কুয়াশার কথা বলল বোধহয়। একটা ফিলোজফিকাল হাসি হেসে আরও বলল, ‘যা দেখা যায় না, তা নিয়েই সবার ইন্টারেস্ট। কিন্তু কিছু তো একটা আছেই, কী?’ এর কোনও উত্তর হয় না। সত্যি বলতে কী আমি কিছুই জানি না। এমনি এসেছি। কেনার কোনও বাধ্যবাধকতা নেই, ও আগেই বলেছিল। আমার কাছেও কিছু টাকা আছে। কেনার ব্যাপারে আমাকে কো-ইনভেস্টর হিসেবে ও চাইছে কি না তাও পরিষ্কার নয়। ছাগলের ডাক শুনলাম। ‘মা বাচ্চাকে খুঁজছে, ঠিক পেয়ে যাবে।’ জমিটা একটু উঁচু, হাম্পের মতো, আমরা উঠছি আস্তে-আস্তে। এর ওপরে উঠলে পাহাড়টা আবার দেখা যাবে। আশেপাশের গাছগুলো এখন আগের চেয়ে পরিষ্কার। তলায় ম্লান সবুজ ঝোপঝাড়ে বেগুনি-সাদা কুচো ফুল। বুনো গন্ধ। জঙ্গুলে জায়গা দিয়ে যাচ্ছি। দূর থেকে বুঝতে পারিনি। ছিল নিশ্চয়ই। আর কতক্ষণ লাগবে জিজ্ঞেস করায় লোকটা পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘কোথায়?’ তারপর একটু বুঝে বলল, ‘আমরা ওপরে চড়ব না। তলাতেই তো। সব মাল ভেতরে। ওপরে কিছু নেই। তলাটা একদম ফাঁকা।’ মজার আভাস পেলাম। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে লোকটা বলল, ‘গ্রাম আছে, দূরে। তবে লোক চলে। আপনার মতো কথায়-কথায় অটো-মেট্রো কোথায় পাবে এরা?’ আজব কথা। ও যেন হেঁটেই দুনিয়া চষে ফেলে!
লোকটা দাঁড়িয়ে পড়েছে, কী যেন শুনছে কান খাড়া করে। ‘শুয়ে পড়ুন, হ্যাঁ, একদম মাটিতে, এই যে, কান ঠেকান, শুনতে পাবেন।’ আমি সম্পূর্ণ ভাবে ওর ইচ্ছেতে চলছি। যা বলবে তাই করতে হবে। উপুড় হয়ে ধুলোতে কান ঠেকালাম। প্রথমে কিছু বুঝলাম না। একটু পরে মনে হল ধাতু পেটানোর শব্দ হচ্ছে। ‘পাচ্ছেন?’ শব্দটা কমে গেল। মাথায় ধুলোভর্তি, উঠে পড়েছি। অন্য একটা আওয়াজ কানে এল। হালকা ছন্দ আছে তার। শুকনো পাতার ওপর চললে যে খড়মড় আওয়াজ হয়, সেই রকম। ‘মেয়েগুলো যাচ্ছে। কাঠকুটো নিয়ে।’ ধড়াম-ধড়াম আওয়াজের প্রসঙ্গ তুলতে বলল, ‘পাহাড়ের ভেতরে লুকিয়ে পাথর কাটে ওরা।’ পাহাড়টার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম, অনেকক্ষণ ধরে দেখতে পাচ্ছিলাম না। একগুঁয়ের মতো বললাম, ‘ভেতরে মানে?’ এবারে বিরক্তি-ভরা উত্তর এল, ‘জিরেন জানেন? জিরেন? খেজুর গাছ কেটে রস বের করার সময় গাছকে কয়েকদিনের জন্য বিশ্রাম দেওয়া হয়। গাছকে চুষবেন চুষুন। একটু মায়াদয়া থাকবে না? ওই গাছ দেখে ভেতরে কী আছে, বোঝা যায়?’ কথা বাড়ালাম না। একটু এগিয়ে একটা পাথরের বাঁকের পর আবার পাহাড় দেখা গেল। এখন অনেক কাছে। মাথাটা ছোট দেখাচ্ছে। রোদ উঠেছে। নীচের কুয়াশা একটুও কমেনি। এরপর ওখানে, কুয়াশায় ঢুকে পড়তে হবে। এই পাহাড়টাকেই কিনতে হবে। এর মালিক ইচ্ছেমতো কুরে-কুরে তার শরীর থেকে যা খুশি নিয়ে নিতে পারে। এইখানেই সরকার হস্তক্ষেপ করেছে। নেবে নাও। কিন্তু ফেরতও দিতে হবে। পাহাড় কি গাছ নাকি? একটা কাটলে দুটো লাগাবে? বা জল ঢালবে? পাহাড় গরু বা লেবার নয় যে তাকে ভাঙিয়ে নিলে দানাপানি, মাইনে, পেনশন দিতে হবে! এই অবস্থায় চটপট ফিট করে রাখা লোককে দিয়ে কিনিয়ে কিছু পয়সা খেয়ে ফের নিয়মে রিল্যাক্সেশন দিলে সবারই লাভ। এই অবধি মোটামুটি বুঝলাম। কিন্তু পাহাড় কার কাছ থেকে কেনা হবে? জনপ্রাণী নেই কোথাও। আমরা এই মুহূর্তে ঠিক কি দেখতে এসেছি? কাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে? আমার আর ভাবতে ইচ্ছে করছিল না। একটু চা পেলে ভাল হত। আমার মনের কথা বুঝে নিয়ে লোকটা বলল, ‘আছে। এখন পাবেন না। লোক নেই। তাই লোক নেই।’
রাগ হচ্ছিল। এখন কিছু করার নেই। ঘোলাটে লোক। ধোঁয়াটে পাহাড়। সবটাই ভুলভাল। উদ্ভট অ্যাডভেঞ্চারের লোভে চলে এসেছি। ভেবেছিলাম আমোদ হবে কিছু একটা। এখন ফিরতে পারলে বাঁচি। দমকা হাওয়া শুরু হল। ট্রেন লাইনটা কোন দিকে যেন? ট্রেন তো থামে না, তাহলে? লোকটার নাম এখনও জানি না। আজ অবধি জিজ্ঞেস করা হয়নি। ও চলছে ডালে-ডালে। অতএব আমিও পাতায়-পাতায়। অকারণ গোঁয়ার্তুমি করে ফেলেছি। অপেক্ষা করতে হবে। একটু পরে ভাঙা ছাউনি মতো দেখা গেল। সামনে ভাঙা ভাঁড়, ছাই। মাটির উনুন, পোড়া কাঠ। মাটিতে একটা কালো সসপ্যান। আচমকা হাওয়া ঢুকে যাওয়ায় সেটা কিছু দূর ঘষটে গিয়ে উল্টে সোজা হয়ে গেল। পর পর আরও দুটো আবিষ্কার হল। একটা টিউবওয়েল। পাম্প করতেই ঝকঝকে পরিষ্কার জল, গরম। খেলাম আঁজলা করে। পাখি ডাকছে। মাথার ওপর একজোড়া ঘুঘু। উৎসুক চোখে দেখছে আমাকে। দু’হাত দিয়ে হাওয়ায় গুলতি ছোঁড়ার মতো ভঙ্গি করলাম। নড়ল না। এই প্রথম একটা চেনা প্রাণী দেখলাম। পকেট থেকে ফোন বের করলাম। অফ হয়ে গেছে, ব্যাটারি খতম। যাক গে, এখানে টাওয়ার পেতাম না। লোকটা একটু দূরে কীসব দেখে ফিরে এল হাসি-হাসি মুখে। হাতে একটা পাথর। ‘ভাঙতে পারবেন এটা? না। এই দেখুন’ বলে মাটিতে ছুঁড়ে মারল। টুকরো নয়, একদম বালির মতো গুঁড়ো হয়ে গেল। হলুদ গুঁড়ো। ছুঁয়ে দেখলাম। পাউডারের মতো মিহি। সালফার এরকম হয়? ‘বিশ্বাস করছিলেন না। না করারই কথা। এবার বুঝেছেন কেন এসেছি?’ অবাক হলেও, আমার বোঝার আর ইচ্ছে হচ্ছিল না। সেটা বললাম না। ‘তলায় ঢুকবেন তো একবার?’ কার তলায়? পাহাড়ের? সেখানে তো এখনও ঘন কুয়াশা। বা চাপা ধোঁয়ার বলয়। মালটা ওর ওপরেই ভাসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে নাকি দালাল আসবে। ওই সময়ে আমি যেন ওদের কথাবার্তায় না ঢুকি, জানানো হল। এটা অপমানকর। দোকানের বেঞ্চে গিয়ে বসলাম। আর নড়ব না। লোকটা পায়চারি করছিল। মাঝে মাঝে দূরে তাকাচ্ছিল। এক সময় মনে হল কিছু একটা দেখতে পেয়েছে। পিছনের জঙ্গলের মধ্যে থেকে একটা শব্দ পেলাম। গাড়ির দরজা বন্ধ করার। তার মানে রাস্তা আছে। কাউকে দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ পরে মনে হল সামনে দিয়ে পানপরাগ, জর্দার একটা গন্ধ চলে গেল। লোকটা এদিকেই আসছিল, থেমে মুখ ঘুরিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে গেল। ঘুঘু দুটো খুবই অসভ্যতা করছে। দেখতে লাগলাম। মাথা বেশ গরম হচ্ছে। আমার যাওয়া দরকার। যাব আমি। ঢুকব কুয়াশায়। উঠে দাঁড়ালাম। পাথুরে জায়গা। পায়ের ছাপ পড়েনি কারুর। একটু এগোতে আবার পানমশলার গন্ধ পেলাম। ঠিকই যাচ্ছি। পৌঁছলাম কুয়াশার সীমানায়। প্লেনের জানলায় অনেক সময় মেঘের তীর দেখা যায়। স্লো-মোশনে ঢুকে পড়লাম সেখানে। গন্ধটা আমাকে রাস্তা দেখাচ্ছে। যদি সেটা আর না পাই, তাহলে ফেরার রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে। মনে হতে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ফিরে যাব? লোকের গলার শব্দ পাওয়া গেল। ওরা কাছেপিঠেই আছে। আমার লোকটার গলাও কানে এল। হিন্দি জাতীয় ভাষায় কথাবার্তা হচ্ছে। গাঁও, ভাঁও, দাঁও এগুলো শুনতে পেলাম। উত্তেজনাভরা টুকরো কথা। বাক্বিতণ্ডা চলছে। আর একটা কথা কানে এল, ‘তোড় দে।’
একটা ফিকে ছাইরঙা হাওয়ার পুকুরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। তলায় ঝাঁঝি থাকলে, পায়ে ঠেকলে যেমন আবছা দেখা যায়, এখানে তেমন পাথর। তুললাম একটা। ছুঁড়লাম না। আওয়াজ হবে। কাছে যাওয়া যাবে না। শব্দের সোর্স হারিয়ে ফেললে মুশকিল। ওরা দূরে সরে গেছে। হাওয়া নেই। থম মারা ঠান্ডা। একটা তিনশো ষাট ডিগ্রি ব্ল্যাঙ্ক গ্রে-বোর্ডে মরিয়া হয়ে সাউন্ড খুঁজতে লাগলাম। কোন দিক থেকে এসেছি সেটা গুলিয়ে গেছে। চেঁচাব? টলমল করে চলছি। চলে কী লাভ, থামলে কী সুবিধে? জমিটা ঢালু, আমাকে টানছে নীচের দিকে। পাথর কম, কাঁকর বেশি। স্লিপ করছে। সেখান থেকে আর একটা টানা ভারী শব্দ উঠে আসছে। খনির মধ্যে চলা ঠেলাগাড়ির চাকার মতো না? এদিকে মাথার ওপরে, যেখানে আকাশ থাকার কথা, সেটা অন্ধকার হয়ে আসছে। আর নয়। যে-কোনও এক দিকে যেতে হবে। যেদিকেই যাই, এই ভয়ঙ্কর কুয়াশা থেকে বেরোতে পারব। ঢাল বেয়ে উঠতে লাগলাম সাবধানে। মোটামুটি সমতল জমিতে সবে পৌঁছেছি, হুড়মুড় করে কিছু একটা পড়ল পিছনে। ফিরে দেখি ওদিকটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
দৌড়তে-দৌড়তে ঝপাং করে বেরিয়ে এলাম কুয়াশা থেকে। ঠিকই এসেছি। ওই তো সেই চায়ের দোকান। ঠান্ডা মাথায় চললে ঠিক রেললাইন ধরে নেব। লোকটার কোনও পাত্তা নেই। মরুক গে। আমার বাপের জামাই নয় সে। কুড়িয়ে নেওয়া পাথরটা এতক্ষণ হাতে ধরা ছিল। সপাটে আছড়ে ফেললাম মাটিতে। ভাঙল না। ফের তুলে নিলাম। দেখা হলে ওর মাথায় ভাঙব এটা। ক’টা বাজে জানি না। দেরি না করে হাঁটতে শুরু করলাম। খেয়াল করলাম, যা আসার সময় করিনি, মোটামুটি পথের রেখা আছে। যেখানে মাটিতে শুয়ে পড়েছিলাম সেটাও পেরোলাম। একটা পানমশলার ছেঁড়া প্যাকেট নজরে এল। একটু দূরে সেই ছাগলটা। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। দু’পাশে উঁচু, সেই জায়গাটা পেরোনোর সময় একটা আওয়াজ শুনলাম পিছনে। এগিয়ে আসছে। ধুলো উড়ছে। সাইরেন না? ভয়ঙ্কর মানুষভর্তি মস্ত সাদা গাড়ির মাথায় একটা লাল চোখ বনবন করে ঘুরতে থাকে। আতঙ্ক ছড়াতে থাকে। থামলেই বিপদ। হয় পাকড়ে নিয়ে যাবে। নয়তো মেরে ফেলবে। কেউ পালাতে পারবে না। এরা খোঁজ নিয়ে আসে। জানে টার্গেট কোথায় লুকিয়ে রয়েছে। আমি একপাশের পাড়ের ওপর উঠে পড়লাম, আড়াল থেকে দেখতে লাগলাম। আলোর ফ্ল্যাশ, ধুলোর ঝড় এগিয়ে এল। বিকট আওয়াজটাকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল অন্যদিকে। বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পর মাথা তুললাম। কেউ কোথাও নেই আর।
মরীচিকা নয়। আস্ত রেললাইনটা বেরিয়ে পড়ল। মরচে ধরা। ট্রেন চলাচল করলে এমন হবার কথা নয়। কোন লাইন এটা? একে ধরে চললে কি মেন লাইনে পৌঁছতে পারব? তারপর কি প্ল্যাটফর্মটা পাওয়া যাবে? নাকি সেটাও কুয়াশায় হারিয়ে যাবে? ডান না বাঁ, কোন দিকে এগোব? দূরে একটা আওয়াজ শুনলাম। একটু পরে আবার। লোকটার গলা। চিৎকার করছে। এখন কাউকে বিশ্বাস-অবিশ্বাস কিছুই করার দরকার নেই। আমি মুখ ঘুরিয়ে দেখতে রাজি নই। তাহলে সেই পাহাড়টা আবার চোখে পড়বে। নাও পড়তে পারে। যেভাবেই হোক বনপলাশি পৌঁছতে হবে। লোকটা অন্য দিকে যেতে পারে। যাক। ওর সঙ্গে আমি আর নেই। এদিকে এলে অন্য ব্যবস্থা নেব। হাঁটতে-হাঁটতে রেললাইনের ধার থেকে ব্যালাস্ট কুড়োতে লাগলাম। এখন আমার কাছে সবকিছু স্পষ্ট। বুঝে গেছি আমার গন্তব্য বলে কিছু নেই। কোনওদিন ছিল না।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র