ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নক্ষত্র-যাপনের প্রতিপ্রস্তাব ও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়


    উৎসব মুখার্জি (January 22, 2022)
     

    কী অদ্ভুৎ সমাপতন! সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষের বছরেই, কোনও এক কার্তিক শেষের রবিবাসরীয় হিমেল সকালে এই গ্রহ ছেড়ে, শহর ছেড়ে, সিনেমা ছেড়ে, যাবতীয় নশ্বর অস্তিত্ব ছেড়ে চলে গেছিলেন, আজীবন কলকাতায় থেকেও প্রকৃত অর্থে শেষ আন্তর্জাতিক বাঙালি— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এক উপাখ্যানের মতো জীবন শেষ হল, তবু শেষ হল কি? 

    এই গ্রহে বাঙালি নামক জাতির যতদিন এই বোধ থাকবে যে তার একটা অস্তিত্ব আছে, বাঙালি যেসব উপাদানের মধ্যে তার আত্মপরিচয় খুঁজবে তার মধ্যে অন্যতম বাঙালির দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার প্রবণতা। জাতিগত ভাবে এমন ‘দ্বৈতবাদে’ বিশ্বাসী বোধহয় পৃথিবীতে বেশ বিরল। ঘটি-বাঙাল, ইলিশ-চিংড়ি, মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, হেমন্ত-মান্না, সিপিএম-কংগ্রেস, আনন্দবাজার-যুগান্তর, পেলে-মারাদোনা ছাপিয়ে বাঙালির বিভাজনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান ‘আমরা-ওরা’ হয়ে ওঠে ‘উত্তম-সৌমিত্র’ দ্যোতনা। উত্তমের নাটকীয়, বহির্মুখী, মেলোড্রামা আর সৌমিত্রর সংযমী, অন্তর্মুখী, মধ্যবিত্ত বাস্তবের টানাপড়েনই যেন আত্মবিস্মৃত বাঙালির আত্মপরিচয়ের শকুন্তলার আংটি। ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে, উত্তম পৌঁছে যান বাঙালির হেঁশেলে আর সৌমিত্র আলো করে থাকেন বৈঠকখানা, তবু রয়ে যায় এক অবিচ্ছেদ্য বৈপরীত্য। 

    সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কে ছিলেন? মঞ্চ-পর্দার সফল অভিনেতা? সত্যজিৎ রায়ের মার্সেলো মাস্ত্রোয়ানি? কবি? নাট্যকার? আবৃত্তিকার? পত্রিকা সম্পাদক? বাগ্মী? প্রেমিক? স্বামী? পিতা? বামপন্থী?  সব প্রশ্নের সম্ভাব্য  উত্তরই হবে– হ্যাঁ; এবং তিনি প্রতিটি ক্ষেত্রেই চূড়ান্ত মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। তবে আমরা একটু মনযোগী হলে উপলব্ধি করতে পারি যে প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র পরিচয়ের সীমানা ছাপিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আসলে হয়ে ওঠেন বাঙালির প্রতিরোধের এক গুরুত্বপূর্ণ চিহ্নায়ন। সৌমিত্র যেন এক প্রশ্নমালার সরণি। তাঁর যাবতীয় বাস্তব সত্তা এবং অভিনীত চরিত্ররা বারে বারে প্রশ্ন করে। অপু থেকে উমাপ্রসাদ, অমল থেকে অসীম, ফেলুদা থেকে সন্দীপ, উদয়ন পণ্ডিত থেকে ক্ষিদ্দা, সীতাপতি থেকে দেবদাস, মাস্টারমশাই থেকে সুখেন্দু দত্ত এবং আরো অগণিত চরিত্র বারে বারে প্রশ্ন করে; ইতিহাসকে,  মানুষকে, সমাজকে, ব্যবস্থাকে, মননকে, প্রতিষ্ঠানকে, আত্মাকে। ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে সৌমিত্র হয়ে ওঠেন, তারকার চিরাচরিত স্বর্গারোহনের প্রতিপ্রস্তাব। 

    অপু থেকে উমাপ্রসাদ, অমল থেকে অসীম, ফেলুদা থেকে সন্দীপ, উদয়ন পণ্ডিত থেকে ক্ষিদ্দা, সীতাপতি থেকে দেবদাস, মাস্টারমশাই থেকে সুখেন্দু দত্ত এবং আরো অগণিত চরিত্র বারে বারে প্রশ্ন করে; ইতিহাসকে,  মানুষকে, সমাজকে, ব্যবস্থাকে, মননকে, প্রতিষ্ঠানকে, আত্মাকে

    ‘অপুর সংসার’ থেকে ‘বরুণবাবুর বন্ধু’– প্রায় ছয় দশকের পথচলায় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভাবে তিনি জড়ো করে চলেন অসংখ্য নুড়িপাথর যা ক্রমশ গড়ে তোলে বাঙালির এক অত্যাশ্চর্য সমান্তরাল উপকথা। উত্তমকুমারের থেকে বাঙালির প্রাপ্তি অপরিসীম, তবু যেন রয়ে গেছিল এক অপূর্ণতা— সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সত্যজিৎ সহযোগে সেই না পাওয়ার আক্ষেপ পূরণ করে দিলেন– তাঁর অনায়াস উপস্থিতিতে। বাঙালি তার আইকনের মধ্যে পেল এক সাংস্কৃতিক কৌলীন্য ও আভিজাত্য। মনে রাখা ভাল, উত্তমকুমারের হাত ধরে যদি বাঙালির ‘একটি নক্ষত্র আসে’ তাহলে সৌমিত্র নিশ্চিত ভাবেই সেই নক্ষত্রযাপনের জীবন্ত বিনির্মান।

    যে কোনও উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম প্রাথমিক ভাবে কোনও না কোনও সময়ের দলিল হয়ে ওঠে, অনেক ক্ষেত্রেই তা সময়োত্তীর্ণ হয়, তখন তা পৌঁছে যায় শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্মের দরবারে। তবে অবশ্যই মনে রাখা দরকার শিল্পীর কোনও দায় নেই সমাজকে পাল্টানোর, মানুষকে পাল্টানোর কারণ তিনি সমাজ-সংস্কারক নন তাঁর যদি সত্যিই কোনও দায় থেকে থাকে তা একান্তই তাঁর মাধ্যমের কাছে, কাজের কাছে সত্যনিষ্ঠ থাকার। আর হ্যাঁ, সবার অগোচরে শিল্পী বা তাঁর কর্ম নিঃশব্দে আর একটা কাজ করে যায়– নিজের স্থান-কাল-পাত্রের মাঝে বসেও শিল্পী তাঁর বিরল ক্ষমতায় ভর করে পৌঁছে যেতে পারেন সেই সমসাময়িক স্থান-কালের নিকটগন্ডি ছাড়িয়ে তার নিজস্ব, বৃহৎ পরিধিতে যেখান থেকে তিনি তাঁর অন্বেষণ জারি রাখেন; অর্থাৎ তিনি যেন বর্তমানকেই দেখছেন কিন্তু ভবিষ্যৎ থেকে, সময়-রেখায় অনেকটা এগিয়ে গিয়ে পিছু ফিরে দেখার মত করে, যেন সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাক। তাই আজ যা ঘটছে বা আগামীকাল যা ঘটতে পারে শিল্পী অনেকটা এগিয়ে থেকে তা আগেই দেখে ফেলেছেন আর সেই খোঁজ আর সত্যানুবর্তিতা থেকেই তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে বর্তমানের মানুষকে একেবারে ওপরের স্তরের গভীরে গিয়ে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেন আর বিভিন্ন বিষয়ে অগ্রিম সতর্ক করে দিতে থাকেন। সাবধান করতে থাকেন এক আপাত অজানা আগামীর ব্যাপারে যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ভাবনা ও অনুধাবনের বাইরে। সৌমিত্র তাঁর চরিত্রায়ণের মধ্যে দিয়ে, প্রশ্নের মধ্যে দিয়ে বারবার আমাদের সেই ভাবনার উত্তরণের পথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছেন। যে যতটা গ্রহণ করতে পেরেছে তার লাভ বেশি। 

    সৌমিত্রকে একজন শিল্পী ও মানুষ হিসেবে দর্শক যেমন দেখেছে, তাঁর শিল্পীসত্তা ও জীবনচর্যা যেভাবে জেনেছে, সেখানে এই দুই সাহিত্য শব্দ একত্রে মিশে গিয়েছে। এখানেই সৌমিত্র শিল্পী, আলাদা, একা, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু; জীবনযাপনের ইতিকথায় কুন্সলেরোমান-এর কুশীলব। আমার মনে পড়ছে ‘শাখা-প্রশাখা’র মেজ ছেলে প্রশান্তকে– সকল লোকের মাঝে বসে, আপন মুদ্রাদোষে কী ভাবে তিনি একাই আলাদা হয়ে উঠেছিলেন। 

    সাহিত্যের ক্ষেত্রে দুটি জার্মান শব্দের ব্যবহার আছে। Bildungsroman (বিলডাঙ্গসরোমান) এবং Künstlerroman (কুন্সলেরোমান)। বিলডাঙ্গসরোমান, উপন্যাসের এমন এক আঙ্গিক যেখানে মূল চরিত্রের ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার বিবরণ আখ্যায়িত হয়ে থাকে যেখানে প্রাধান্য পায় মানুষটির চরিত্র, শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব বা মানসিকতার গঠনের কাঠামো। যেমন চার্লস ডিকেন্সের ‘ডেভিড কপারফিল্ড’। কুন্সলেরোমান-ও এক ধরনের বিলডাঙ্গসরোমান, অর্থাৎ একজন মানুষের বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে তার বিবিধ গঠনের বর্ণণা ও ব্যাখ্যা সমৃদ্ধ, তবে এক্ষেত্রে প্রাথমিক ভাবে একটা বিষয় প্রধান হয়ে ওঠে যে জীবনে এগিয়ে চলার পথে, মূল চরিত্র বা প্রোটাগনিষ্ট নিশ্চিতভাবে একজন শিল্পী হয়ে উঠতে চান এবং ওঠেন। যেমন জেমস জয়েসের ‘পোট্রেট অফ দ্যা আর্টিষ্ট অ্যাজ এ ইয়ংম্যান’।  

    ‘বরুণবাবুর বন্ধু’ ছবিতে সৌমিত্র

    ঠিক সেই কাঠামোয় যদি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনচরিতকে বিশ্লেযণ করা যায় তাহলে বোঝা যাবে যে ছোট থেকে পরিণত জীবনের পথে সৌমিত্র কীভাবে একজন সাধারণ প্রোটাগনিষ্ট থেকে একজন শিল্পী-পথে যাত্রা করেন। বিলডাঙ্গসরোমান-এর মূল চরিত্র অনেক সময়েই শিল্পী জীবনের স্বপ্ন দেখলেও পরিশেষে জীবন ও পারিপার্শিকের জাঁতাকলে পড়ে একজন নিতান্ত সাধারণ নাগরিক হিসেবেই থেকে যান কিন্তু কুন্সলেরোমান-এর নায়ক মরিয়া হয়ে পৌঁছতে চান, তার বোধের কাছে, বিকল্প ভাবনার কাছে, প্রশ্ন করার অভ্যাসের কাছে, সুবিধাভোগী ও আরামদায়ক বেঁচে থাকাকে প্রত্যাখ্যান করার কাছে; আসলে শিল্পী সত্ত্বার কাছে। সৌমিত্রকে একজন শিল্পী ও মানুষ হিসেবে দর্শক যেমন দেখেছে, তাঁর শিল্পীসত্তা ও জীবনচর্যা যেভাবে জেনেছে, সেখানে এই দুই সাহিত্য শব্দ একত্রে মিশে গিয়েছে। এখানেই সৌমিত্র শিল্পী, আলাদা, একা, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু; জীবনযাপনের ইতিকথায় কুন্সলেরোমান-এর কুশীলব।  আমার মনে পড়ছে ‘শাখা-প্রশাখা’র মেজ ছেলে প্রশান্তকে– সকল লোকের মাঝে বসে, আপন মুদ্রাদোষে কী ভাবে তিনি একাই আলাদা হয়ে উঠেছিলেন। 

    সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দৈহিক অনুপস্থিতিতে আমাদের তুচ্ছ জীবন-যাপনেরও চোদ্দ মাস কেটে গেল। আকুল ভাবে, অবিরাম চোখের জলে চাইলেও, তাঁকে আজ আর পাব না আমাদের ঘটমান বর্তমানে। তবে কি তিনি অতীত? একেবারেই নয়। প্রকৃত শিল্পী তো বর্তমানে বেঁচে থাকার অছিলায় ভবিষ্যতের কোন সুদূরে পৌঁছে গিয়ে নাবিকের মতো আমাদের দিকনির্দেশ করেন বিনিময়ে কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা ছাড়াই। সেভাবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়-ও কবেই পৌঁছে গেছেন আমাদের সচেতনতা ছাড়িয়ে, আমাদের সাংস্কৃতিক মূলধন ছাপিয়ে, কোনও এক বিস্তীর্ণ পারাবারে আর সেখান থেকেই হাত রেখেছেন আমাদের আত্মায়; হয়তো বা মৃদু হেসে পেছন ফিরে তাকিয়েছেন আমাদের এই অদ্ভুৎ বেঁচে-থাকার দিকে। 

    বাঙালি, জাতি হিসেবে অনেক দিক থেকেই দুর্ভাগা, অনেক বঞ্চনার শিকারও বটে। তবু আমরা আজীবন ঋণী থাকতে পারি বাংলা ভাষা ও তার বর্ণমালার কাছে আর সীমাহীন গর্ব অনুভব করতে পারি কারণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আমার নিজের ভাষায় অভিনয় করেছেন আর তিনি এই শহরের মানুষ। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook