ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অন্ধকার যেমন কালো হয়


    নীলোৎপল মজুমদার (January 28, 2022)
     

    কুলগাছ। ব্যাকুল মাসির উঠোন। লাল-হলুদ, হাজার-হাজার। ভাতের পর ঝিমুচ্ছে পাড়া। এখনও বাচ্চারা স্কুল থেকে ফেরেনি। ছুটির পর কুলতলা ফাঁকা হয়ে যাবে। আজ একটু দুপুর-দুপুর বেরিয়েছে। বিকেল হলে কালচে-র ঠান্ডা লাগতে পারে। মরা ঘাসের ওপর টাপুরটুপুর কুল। কালচে বুঝতে পারছে না, কী করবে। সোজা হয়ে দাঁড়ায়। বাপ রে! অবিনাশের দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ায়। দু’বার গাছের চারিদিকে ঘুরে লাফিয়ে চলে যায় যে-দিকটা লালচে হয়ে আছে। ঘুরে অন্যদিকে তাকায়। কোনদিকে যাবে বুঝতে পারছে না। ছোট-ছোট শ্বাস নেয়। অস্থির। কয়েক পা এগোয়। ছোট-বড়, গোল-গোল, এদিক-ওদিক, পিছলে আসছে রং, আবছা সবুজ, অর্ধেক গেরুয়া। গলা দিয়ে হালকা চাপা আওয়াজ। ওর মাথার ওপর একটা সন্দেহের বড় ভাঁজ। অবিনাশের দিকে তাকায়। ঠিক বলেছে কালচে। এত কুল! আগে কখনও অবিনাশ দেখেনি। হলদে, লাল আর গেরুয়ায় ভরে গেছে মাসির উঠোন। উঠোনের এক কোনায় ব্যাকুল মাসির আস্ত একটা ঘর। নিরিবিলি। স্বাধীনতা দিবসে আগে কুলতলায় বিনয়-বাদলদের নিয়ে নাটক হত। স্বদেশি হত। যুক্তফ্রন্টের সময় জটিল ডালপালায় লুকোনো থাকত লোহার পাইপগান। এখন কালচের খেলার মাঠ। শনি আর রবি। ওর কাছাকাছি কেউ আসে না। প্রবল চেহারার কালচের চোখের ওপর দুটো কমলা রঙের সূর্যাস্তের টিপ। লেজের শেষে গোলা-পায়রার বুকের কাছের একটা মেঘলা পালক। ওর শরীর অন্ধকার, নৌকাডুবির রাত। জাপটে আছে কালো লোম। গলা থেকে বুক অবধি কমলার প্রলেপ। পায়ের পাতায় সেই কমলা আরও গাঢ়। পুরপ্রধানের পদ হারানো আত্মনিবিড় পুরনো হেডস্যারের মতো আনমনে, আস্তে-আস্তে হাঁটে কালচে। পাড়ার একমাত্র অকুতোভয়। সবাই অবাক হয়ে যায় ওকে দেখে। ভয়, সামনে আসে না। ওর দারুণ সম্মান। ওকে আদর করার জন্য জয়েন্টের কোচিং ক্লাস থেকে মাঝে মাঝে কয়েকটা মেয়ে আসে। ঘাম, সেন্টের গন্ধে কালচে টের পায় ওরা এসে গেছে। বারান্দায় ছুটে যায়। কালচের সুখশান্তির খবর জিজ্ঞেস করে, দূর থেকে ‘ভাল থাকিস’ বলে চলে যায়। উপেক্ষিত কালচে জোরে ডাকত। সেই অভিমানের ডাকে ছিল এক দুর্ভাবনার ঘন ভাঙা মেঘ— পেতলের মস্ত হাঁড়িতে গরম হচ্ছে ভাঙা টুকরো-টুকরো নিম্নচাপের বাজ।

    পাড়ার লোকের জন্য ব্যাকুল মাসির এক অনবদ্য উপহার এই কুলগাছ। পুরো আকাশটাকেই যেন ঢেকে রেখেছে অগুন্তি শাখা-প্রশাখার নিখিল সংসার। বিস্তৃত ডালপালার বুননে এক সবুজ মৌচাক। চারিদিকে নেমে এসেছে শ্যামলীদির মতো খোলা বেণির আলুথালু চুলের জঞ্জাল। আরেকটু হলেই জানু ছোঁবে মাটি। প্রত্যেকটা পাতার পাশে গোটা-গোটা কুল, কিছু-কিছু এখনও সবুজ। উঠোনে শুধু কুলগাছ, আর পোহানোর জন্য পাতা আছে রোদ। দেড় কাঠা মাটি। বাকি সব ভাইয়ে-ভাইয়ে ভাগ হওয়া বন্ধ সেগুন দরজার বাড়ি। তুমুল বৃষ্টিতে কলোনিতে কারো পায়ে কাদা লাগে না। আট বছর আগে কালচে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছিল, কালশিটে ইটের দেওয়াল আধভাঙা চাঁদ হয়ে আছে। এখন চারতলা গম্বুজ। অলিগলি, রিকশা, স্কুটার। অমানুষের এই কুলতলায় কালচের সাথে দেখা হয় লাল পিঁপড়ে, মথ, ফেরারি ইঁদুর, বেচারা শালিকের। ব্যাকুল মাসি বলে বেড়ায়, তার গাছ নিন্দেমন্দর রাগে প্রত্যেকটা পাতার ভেতর ফুটিয়েছে ফল। রটে গিয়েছিল, ব্যাকুলের উঠোন থেকেই নাকি নিমোনিয়া ছড়াচ্ছে। এই কুলে পাপ আছে। কিছুদিন হল, বিয়ের নেমন্তন্নও পায় না ব্যাকুল। কালচে অবাক হয়ে একটু দাঁড়ায়। চোখের মণি ঘুরঘুর করছে। কোন কুল-টা ধরবে! এক চক্কর লাফিয়ে চলে যায় অন্যদিকে। গন্ধ শুঁকতে থাকে। পা দিয়ে ঠেলে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বোঝার চেষ্টা করে, পাকা না টোপা। অবিনাশ ধমক দেয়। ‘অত জোরে নাক টানিস না, ধুলো ঢুকে যাবে!’ অবিনাশের চিন্তা হচ্ছে, কালচে বোধহয় একটু বেশিই অবাক হয়ে গেছে। কালচের গায়ে আলোছায়ার কলমকারি। আয়না-ভাঙা টুকরো রোদ মাথায়, গায়ে, লেজে দৌড়োদৌড়ি করছে, পাতার ফাঁকফোকর থেকে। এই গন্ধে নতুন মাদক, কালচের চার পা পাগল হয়ে যায়।

    অবিনাশের মনে হল, কালচেকে আজ খুব আনন্দে রাখা যাক। আজ সেরকম একটা দিন, ওকে অভিভূত করা যাবে। অবিনাশ কুলগাছের গুঁড়িটা চেপে ধরে। একটু-একটু করে ঝাঁকাতে থাকে। গাছ যেন এটাই চাইছিল। দুলে-দুলে ডালপালায় একটা হালকা ঝড়ের ঝাঁকুনি ছড়িয়ে দেয়। টুপটাপ করে পড়তে থাকে অজস্র কুল। কালচের মাথায়, গায়ে। মাটিতে পড়ে কুলগুলো গড়িয়ে যায়। হালকা এক গোপন শিলাবৃষ্টির আওয়াজে উঠোনের রং বদলে যায়। বাঁ-দিক, ডানদিক লাফাতে থাকে কালচে। ওর লেজে উপনির্বাচনে জেতার উল্লাস। দুপদুপ করে পড়ছে নানা রঙের কুল। হাঁপাচ্ছে কালচে। থামে। কুলতলায় কখনও হিসি করে না। আজ ওর উৎসবের দিন। অবিনাশের দিকে অনুমতির চোখে তাকায়। ‘বেশ। করো।’ ডান পা উপরে তুলে হিসি করতে থাকে। ক্ষমাপ্রার্থী, ওর মুখে প্রশ্রয়ের আহ্লাদ।

    থমথমে মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ব্যাকুল মাসি। হাতে একজোড়া মারি বিস্কুট। ‘তালজ্ঞান সব হারিয়ে ফেলেছ?’ অবিনাশ অস্বস্তির ভান করে বলে: এরকম তো ও করে না কখনও! অসন্তুষ্ট ব্যাকুল তাকিয়ে থাকে কালচের দিকে। কালচে মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে আরেকটু পা ভেঙে নেয়। হিসি করেই যাচ্ছে। ওর রোমকূপ থেকে ছড়িয়ে পড়ছে এক স্নিগ্ধ আমোদ। ব্যাকুল মাসির বিরক্তির চোখ ওর দিকে। তার ভালমানুষের সুনাম এখনও অক্ষত। উঠে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে সরে যায় কালচে। মাসি ডাকে। ‘কী রে নে, নিয়ে যা।’ বিস্কুট দেখায়। কালচে কিছুতেই গেল না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইল। আড়চোখে দেখে নিল অবিনাশকে। মারি দুটো কৌটোয় ভরে মাসি ঘরে ঢুকে গেল। এত উত্তেজনার চাপ, কালচে বসে পড়ল মাটিতে। আঠার মতো মুখে ঝুলছে লালা। জিভ বেরিয়ে এসেছে। নিঃশ্বাস আরও ছোট আর ঘন। মেন গেটের কাছে স্কুলের বাচ্চাদের ভিড়, উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে। ‘এবার নে, বাড়ি চল।’

    রাতের বেলায় অটো গ্যারেজ করে রোজ মাতাল হয়ে ফিরে আসে বেণু। পুরো নাম চোলাই বেণু। আর দশ মিনিটের মধ্যে শোনা যাবে ওর বৌয়ের আর্তচিৎকার। কখনও মাছে নুন কম, কোনওদিন গুহ্য-পোড়া ঝাল, বা ভাত চালের মতো শক্ত। হাড়ভাঙা খাটুনির পর এতটা অন্যায় বেণু কখনও নিতে পারত না। ‘খাব না শালা।’ ছত্রভঙ্গ দু’একটা থালা ঝনঝন করে কখনও রাস্তায়, কখনও স্টেনলেস স্টিল, ফোড়নের জিরা, শুকনো লঙ্কা ওর পায়রা-ঘরে গিয়ে ছিটকে পড়ত। তারপর পিটুনি। পূর্ণিমার কান্নার আওয়াজে কালচে দাঁড়িয়ে থাকত বারান্দায়। চঞ্চল হয়ে এদিক-ওদিক করত। তারপর চুপ করে কী একটা ভাবত মেঝেয় বসে। একজন সমাজসেবিকা বলেছে, আপনি চুল কেটে একদম ছোট করে ফেলুন। এরপর পূর্ণিমার গোঙানির ঝাঁঝ অনেক কমেছে।

    রাতের বেলায় অটো গ্যারেজ করে রোজ মাতাল হয়ে ফিরে আসে বেণু। পুরো নাম চোলাই বেণু। আর দশ মিনিটের মধ্যে শোনা যাবে ওর বৌয়ের আর্তচিৎকার। কখনও মাছে নুন কম, কোনওদিন গুহ্য-পোড়া ঝাল, বা ভাত চালের মতো শক্ত। হাড়ভাঙা খাটুনির পর এতটা অন্যায় বেণু কখনও নিতে পারত না। ‘খাব না শালা।’ ছত্রভঙ্গ দু’একটা থালা ঝনঝন করে কখনও রাস্তায়, কখনও স্টেনলেস স্টিল, ফোড়নের জিরা, শুকনো লঙ্কা ওর পায়রা-ঘরে গিয়ে ছিটকে পড়ত। তারপর পিটুনি। পূর্ণিমার কান্নার আওয়াজে কালচে দাঁড়িয়ে থাকত বারান্দায়। চঞ্চল হয়ে এদিক-ওদিক করত। তারপর চুপ করে কী একটা ভাবত মেঝেয় বসে। একজন সমাজসেবিকা বলেছে, আপনি চুল কেটে একদম ছোট করে ফেলুন। এরপর পূর্ণিমার গোঙানির ঝাঁঝ অনেক কমেছে। কিন্তু বেণু থাবড়া মারত ভালই। চোলাই বেণু বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে বাতাসে ভেলিগুড় আর পাকা কাঁঠালের সাথে ডিজেলের গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ত। অনেকে টের না পেলেও, কালচের কপালে সন্দেহের বাঁকা ভাঁজ। চোখদুটো স্থির, কিছু একটা ঘটছে যেন! চট করে মেঝে থেকে উঠে যেত। তিনলাফে বারান্দায়। বেণুকে দেখেই বজ্রবিদ্যুতের মতো গর্জন করে উঠত। সবাই জানে, কালচে ততই বর্ষায়। অনেকবার টলতে-টলতে বেণু চেষ্টা করেছে কালচের সঙ্গে ভাব-ভালবাসা করতে। কিন্তু ওকে কাছে দেখলেই কালচের চোখে একটা অবিশ্বাস, একটা বিক্ষোভ ফেটে পড়ত। বেণুর একটা কষ্ট ছিল। কালীমোহন এমন কেন করে? শালা আমি কী এমন করেছি? চোলাইয়ে ডুবন্ত বেণু রাতে ফেরার পথে ‘কালীমোহন, কালীমোহন’ বলে কালচেকে ডাকত। ঈশানী দরজা বন্ধ করে রাখত। অকারণে কালচে উত্তেজিত হয়ে যাবে, হাত-পায়ে চোট পাবে।

    অনেকদিন হয়ে গেল কালচে ঘরে আছে। বেরোনো হয় না। ভোট আসছে। বড় রাস্তা পিচের হচ্ছে। এম.এল.এ.-র ছেলেবেলেরা বেঞ্চি পেতে চা-অমলেট খায়। গলির মধ্যে দিয়ে স্কুটার, বাইক, সবজি-ভ্যান। ভয় করে, এই ভিড়ে কালচে যদি কিছু করে বসে! ট্রাকের বিজনেস করে তপন শিকদার। শীতল বোস হয়েছে সবে পুলিশ অফিসার। সবাই গলিতে কিছু-না-কিছু কাজে বেরোয়। অমরনাথের জ্যাঠা, সুখেন্দু মাস্টার। এক সময় ইতিহাস পড়াতে-পড়াতে গরিব হয়ে যায় । ১০১ বছর। এখন তার কোনও ছাত্র নেই। জলন্ধরে এক মেয়ে ছাড়া কোনও সন্তান নেই। দুলে-দুলে হাঁটে, কেঁপে-কেঁপে দাঁড়ায়। পা ঘষে-ঘষে চলে। একটু হেঁটেই লাঠির ওপর ভর দিয়ে থেমে যায়। অক্সিজেন টানে নাকে তর্জনী চেপে। অসীম সে-হাঁটা। কালচেকে দেখলেই দাঁড়িয়ে পড়ত। আঙুল দিয়ে কী একটা বলত। কালচে খুব ধীরে মাথা দুলিয়ে মাস্টারমশায়ের সাথে কথা বলত। কালচের চোখে মহিষের বিনয়। তাকিয়ে থাকত, যতক্ষণ না দ্বিপদ সুখেন্দু মাস্টার গলির মুখ থেকে বাঁক নিত। সুখেন্দু মাস্টারের সাথে দেখা হলে সেদিন কালচে অনেকক্ষণ একা থাকত। ভাবনার মৌমাছি হুল ফোটায় ওর মাথায়। মায়া!

    মেঘলা আকাশ। ঈশানী বলল, ‘যাও না, আজ একটু ঘুরে এসো কোথাও।’ অবিনাশের অনেক দিনের শখ, কালচেকে নিয়ে দূরে কোথাও যাবে। অনেকগুলো গল্প নিয়ে বাড়ি ফিরুক কালচে। ভাবতে ভালবাসে ছেলেটা। রেললাইন পেরিয়ে নদীর এপার বড় নিরিবিলি। অবিনাশের হাতে পেতলের শেকল, বাকিটা কালচের গলায়। টো-টো করে নদীঘাট। শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া। ওপারে মন্দির, ইটের কারখানা। কালচের একটা ভয়, নদীর কাছে যেতে চাইছে না। সামনে একটা জলা জায়গা, ঘাসফুল হয়ে আছে। কোথাও একবার কালচে ব্যাঙ দেখেছিল আগে, অবিনাশের মনে নেই। হঠাৎ একটা ব্যাঙ লাফিয়ে ওঠে। কালচে পিছিয়ে যায়। ব্যাঙটা আবার লাফিয়ে এগিয়ে যায়। কালচের মুখের চেহারা বদলে যায়। এই বস্তুটা ওর বোঝা দরকার। শেকল টানতে থাকে কালচে। ব্যাঙ আরেকটা লাফ দেয়। সোনা না কুনো, অবিনাশ বুঝতে পারে না। কালচে দৌড়ে চলে যায় ব্যাঙটার কাছে। মনোযোগ দিয়ে দেখে। মুখ দিয়ে ব্যাঙটাকে প্রায় ছুঁতে যায়। সব চুপ। শুধু কালচের গাঢ় নিঃশ্বাসের শব্দ। নদীর আলতো ঢেঊ লাগে পাড়ের কাদায়। কাছে যায়, ব্যাঙ চুপ হয়ে থাকে। কালচে এক পা পিছিয়ে দূরে চলে আসে। ব্যাঙ লাফাতে-লাফাতে ঘাসজলার ভেতর মিলিয়ে যায়। শরীর চুরমার করে শেকল নিয়ে ছিটকে যায় কালচে। এক পা তুলে সামনে রাখে, আরেক পা সাবধানে, একটু এগোয়। আস্তে করে জলার ধার দিয়ে হাঁটে। সব বিষয়ে নাক গলানো কালচে অধিকার বানিয়ে ফেলেছে। কিছুতে ওকে নড়ানো যাচ্ছে না। ওর ধারণা ব্যাঙটা আবার একটা লাফ দেবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

    শাশ্বতী নদী। চুন-সুরকির ঘাট। একটা ডিঙি বাঁধা। অবিনাশের মনটা খারাপ হয়ে যায়। খুব ইচ্ছে, কালচে একদিন যাবে নৌকো ভাড়া করে, নদীর ও-পার। সবার সাথে নৌকোয় ওঠা যাবে না। আজ একটা খালি নৌকো আছে। চল, ও-পারে যাব। চেষ্টা করে অবিনাশ। কিন্তু কালচেকে কিছুতেই নড়ানো যাচ্ছে না। ঢেউ ভাঙতে-ভাঙতে চিকচিকে জলের আলোয় কালচে এক অপূর্ব জনপথে যাবে। কালচেকে অবিনাশ দেখাবে হোলসেল গাঁদাফুলের বাজার, দূরপাল্লার বাস কন্ডাক্টর, তাল-তেল, কালো কড়াইয়ের টিফিনঘর, লুচি-মাসির গনগনে উনুনের চারিদিকে খিদে-পাওয়া মাঝি, বুড়ো পুরোহিত, তরিতরকারির ভ্যান, আর সবার সম্মান পাওয়া নবান্নের বড় অফিসার। মানুষের কোলাহল, সৌহার্দ্য, বুদ্ধি আর বিবাদের এই কাব্যিক বিস্ময় কালচে এখনও জানে না বোধহয়। কত কিছু জানে না কালচে! দেখা হল না কুমারটুলি, মেলা, সিনেমা, পুরসভা আর বিশ্ববিদ্যালয়। ওর শক্তি আর রূপের বিস্ময় সবাইকে দূরে রেখে দেয় অচেনা আশঙ্কায়। শুধু এক হলদে বেড়াল, মুখপুড়ি, বারান্দার কাছে এসে বসে থাকত কালচের কাছে।    

    চোলাই বেণু এসে গেছে। ‘কালীমোহন, কে ছেপেছে তোর কপালে এই সুয্যিমামু? সূর্য দুটো দে, আমি নেব।’ কালচের কানে-মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় বেণু। গ্রিলের বারান্দা দিয়ে আরেকটু আদর খাবে বলে কালচে মাথা বার করে রাখে। আজ কালচে সহ্য করে যাচ্ছে বেণুকে! কী ব্যাপার! ঈশানীর একটু অবাক লাগে। এ তো অচেনা বেণু! চোলাই বেণুর সংস্কার হয়ে গেল। আজ আর মদ নয়। বেণুকে স্বাভাবিক লাগছে। কালচে অসম্ভব বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। বেণুর সঙ্গে এতদিনের দুর্ব্যবহারের অনুতাপ থেকে কালচে যেন নিস্তার পেল।

    কালচের সকালের প্রিয়জন মুখপুড়ি। একটা নিরন্ন বেড়াল। মুখপুড়িকে নিয়ে একটা লোককথা আছে। গরম দুধ চুরি করে খেতে গিয়ে নাকি মুখ পুড়িয়েছে! নাকে একটা কালো দাগ। কালচেকে খুব ভয় পায়। গুটিয়ে থাকা মুখপুড়ি ভয় লুকিয়ে রাখত। আজ দু’বছর হয়ে গেল, ওকে দেখে কালচে একটা ঘেউ পর্যন্ত করেনি। কালচে যেন ওর একমাত্র ভরসার পাত্র। সকাল-সকাল রোদ বাড়লে বারান্দার সিঁড়ির কাছে এসে বসে থাকে। তবে, কালচের নাগালের বাইরে। কালচে যে নানারকম ভাবে ওকে দেখে, মুখপুড়ি বুঝতে পারে। জানে, এখানে বসে থাকলে ওকে আর কেউ বকাঝকা করবে না। এই আস্থার সুন্দর আঁচ কালচে উপভোগ করে। দু’দিন হল, মুখপুড়ির দেখা নেই। সকাল হলেই কালচে মুখ বাড়িয়ে দেখে রাস্তায়। সব ক’টা জানলার ওপর উঠে কী যেন খুঁজতে থাকে। পাঁচিলের ওপর তো কেউ নেই! 

    বিয়ে-বার্ষিকীর তারিখ এবার অবিনাশ ভুলে গেছিল। দু’দিন মুখ দেখাদেখি বন্ধ। বিব্রত, অবিনাশ টবসুদ্ধু একটা গন্ধরাজ কিনে আনে। ভোরবেলা ঈশানী গাছটা বারান্দায় নামিয়ে জল দেয়। পাতার গায়ে ধুলোবালি একটা পাতলা ন্যাকড়া দিয়ে মুছে দেয়। শুকনো পাতাগুলো সাবধানে ডাল থেকে তুলে দেয়। আস্তে-আস্তে গাছটা তাজা হয়ে উঠছে। কালচে রোজ সকাল-সকাল উঠে পড়ে এই পরিচর্যায় নেতৃত্ব দিতে। দুজনের জল আর আলোয় গন্ধরাজে একটা কুঁড়ি আসছে মনে হয়। আজ সকালে ঈশানীর ঘুম ভাঙে না। ঈশানীর মাথায় মুখ দিয়ে টোকা মারতে থাকে কালচে। দরজা-জানলা খুলে সবে তৈরি হচ্ছে ঈশানী। কালচে রান্নাঘরের পাশে রাখা নীল মগের পাশে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে থাকে। মগের ভেতর আছে ছোট্ট একটা জল স্প্রে করার বোতল। কালচের আর অপেক্ষা করার সময় নেই। ঘক করে ডেকে ওঠে। ‘চুপ, মাতব্বরি করিস না।’ ভাড়াটের চিলেকোঠাযর নীচে সূর্য আটকে আছে। ঈশানীর হাতে স্প্রে। এখন গরমকাল। নাতিশীর্ণ গন্ধরাজের পাতায়-পাতায় শিশিরের মতো জল জমতে শুরু করেছে। কালচে দেখে যাচ্ছে, একটা পাতা সবুজ থেকে আরও সবুজ হয়ে যাচ্ছে, ভিজতে-ভিজতে। ঈশানী আরেকটা টব থেকে নরম মাটি নিয়ে গুঁড়ো-গুঁড়ো ছড়িয়ে দেয় গন্ধরাজের গোড়ায়। কালচের চোখে অপূর্ণ মায়া। ঈশানীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এত বৃষ্টি মায়ের হাতে! ভোরের মহিমার মতো এক সুসংবাদ কালচের কালোতে, কমলায়। ‘সত্যি রে! কুঁড়িটা বড় হচ্ছে। কাউকে বলবি না, আগে ফুটুক।’ আকাশ-কাঁপানো এক ডাক দিয়ে কালচে আমন্ত্রণ জানায় আজ ছুটির সকালকে।

    কালচে মেঝেতে। ইন্ডিয়া বোধহয় পারবে না। অবিনাশ কপালে হাত দিয়ে বসে পড়ে। সচিন আউট! ঈশানী আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে নেয়। কালচের মুখে অশান্তির অনুযোগ। কপালে দড়ির মতো ভাঁজ। উঠে দাঁড়ায়। ঈশানী চকিতে ওকে কোলে টেনে নিয়ে বলে: তুই ঠিক, সচিন আউট হয়নি। ভুল লেগ বিফোর। চ্যানেল ঘুরিয়ে দেয় অবিনাশ। টিভিতে বাংলার হিংসা নিয়ে বিতর্ক। সারা ঘরে যেন তুঙ্গ-সংকীর্তন; একটা ভিড়, স্টেশন রোড, যেন বাতিল হয়েছে লোকাল। বোধিবাক্সে অসম্ভব তর্ক দূষণ। কালচে উঠে যায়। বেসিনের কাছে গিয়ে দুটো পা সামনে নিয়ে থুতনি দিয়ে বসে। মাথা এলিয়ে একটা কান ঢেকে রাখে। 

    অবিনাশ জামাকাপড় পাল্টায়। প্রচুর হয়েছে ভাই, আজ অলিপাব যাব। ‘তোমার ডেবিট কার্ডটা দেবে?’ ঈশানী এই ভয়টাই করছিল। স্কুলমাস্টার অবিনাশের ওয়ালেটে নক্ষত্রমণ্ডলের যতগুলো ছায়াপথ, সব ঈশানীর নখের আয়নায়। ‘কিছুই প্রায় নেই।’ অবিনাশ আজ একটু ঝুঁকি নিতে চায়। ‘তাও দাও, কাছে রাখি।’ দিনের আলো যখন পার্ক স্ট্রিটের দেওয়ালে শেষবারের মতো অমৃতলোকের ঠিকানা চাইছে, ভাল লাগে ঠান্ডা বিয়ার। শৌনক স্যার আসবেন। অধ্যাপকরা বাংলার শ্রেষ্ঠ বড়লোক। সারাক্ষণ মনকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু শাস্ত্র-বিরোধিতার সাথে ঝুরিভাজা আর ভেজানো ছোলা ছাড়া বাকি সব হারাম। কৌশিক আই.টি.-তে আছে, ছাইপাশ গেলাতে ভালবাসে। ওর প্রতি এমন একটা স্নেহ স্যারের যে, ওকে ভোগবাদী বলে উনি মানেন না। ‘কৌশিক তুমিই অর্ডারটা দাও।’ প্লেট খালি হলেই কৌশিক ডাকে: রেশমি কাবাব। এখন উন্নয়ন, আর ঝুরিভাজা নয়। 

    বাড়ি ফিরছে অবিনাশ। আড্ডাটা জমেনি। আজ এসেছিল কবি তুষার। তাছাড়া শৌনক স্যার পোস্ট-ট্রুথ নিয়ে দারুণ একটা হোমওয়ার্ক করে এসেছিলেন। অবিনাশের আবার শুধুই শুনতে ভাল লাগে না। কিন্তু খুব একটা বলতেও পারল না। সেরকম স্কোর তোলা গেল না আজ। কোথাও একটা একা-একা লাগছে। মাথায় বিজবিজ করে সেই গোবিন্দভোগ আর বোটকা দুধপোড়া গন্ধ, আর দরজায় নখের চিড়বিড় আওয়াজ। জোরে-জোরে অসংলগ্ন নিঃশ্বাস। পায়ের ধুলো যেন সব মুখে ঢুকে যাবে। ভয় হত অবিনাশের, এই বুঝি কালো সব ধুলো গিলে নিল। গলির মুখে ঢুকতেই অবিনাশের শ্বাস-গন্ধে কালচের মাথাটা তালগোল পাকিয়ে যাবে। ঝাঁপিয়ে পড়বে। উল্টে ফেলে দেবে। বারান্দায় আঁধার হয়ে ওত পেতে বসে আছে অবর্ণনীয় এক মন, যে বাংলা জানে না। সেই লোভ আর সামলাতে পারছে না অবিনাশ। বাড়ির সামনে এসে চিৎকার করে ওঠে: সোনার ছেলে কালীমোহন! ঘরের ভেতর থেকে বেজে উঠল পাঞ্চজন্য-নাদ। 

    রাতের বেলায় কালচে ঈশানীর পেছন-পেছন। টর্চ নিয়ে গন্ধরাজের মধ্যে আলো ফেলছে। খুঁটিয়ে দেখছে ডালপালা। ‘কালো, খবর খুব ভাল, এই দ্যাখ।’ মুখ উঁচিয়ে কালচে গন্ধরাজের খুব কাছে। উসখুস করে ওঠে। ‘কুঁড়ি এবার সত্যি ফুটছে!’ ওর লেজ নড়ে ওঠে বৈশাখের তালপাখার মতো। মিষ্টি কয়েকটা হাততালি দেয় ঈশানী। ‘দেখলি তো, আদর কীরকম উপহার দেয়!’ রাবার বলের মতো কালচে লাফাতে থাকে। ঈশানীর কাপড়ে মুখ ঘষতে থাকে। যেন গন্ধরাজের প্রজনন ওরই হাতের কাজ। ঈশানী বুঝতে পারে কালচের সব কিছু অধিগ্রহণের রোগ আছে। 

    রোদ ওঠেনি। আকাশ ডাবের শাঁসের মতো ঘন। সকালে অবিনাশ অসাধারণ গোলমেলে আওয়াজে বিছানা থেকে উঠে আসে। ঈশানী চুপচাপ, কাঁদো-কাঁদো মুখ। অসম্ভব অস্থির কালচের বাসি মুখে ভেঙে পড়েছে রাগ। বারান্দায় লাফালাফি করছে। লেজের ধাক্কায় লোহার গ্রিলে গমগম করছে আওয়াজ। পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে কালচে। তীব্র চিৎকারে ওর শরীর থেকে বেরিয়ে আসছে বিবিধ ধিক্কার। ভাঙা ঘুমের ম্যাক্সি পরে মণিমালা উল্টো দিকের ঝুলবারান্দায়। ‘কী গো, এরকম করছে কেন? চোট পেয়েছে?’ ঈশানী শান্ত স্বরে বলে: মণি, আমার গন্ধরাজ ফুলটা কে চুরি করে নিয়ে গেছে! অবিনাশ এই প্রথম একটু জল টবের মধ্যে ঢালে। আবার বোধহয় একটা কুঁড়ি আসবে শিগগির। অবিনাশ বুঝতে পারে, এক অদ্ভুত অপেক্ষায় ছিল গন্ধরাজ। ভোরের প্রতিদিন তাকে নিয়ে চর্চায় ছিল দুটো প্রাণের অগাধ বিস্ময়। কী অসম্ভব এক মুহূর্ত বুনট বাঁধছিল ফুল হয়ে ফুটে ওঠার। ঈশানী সামান্যের মধ্যে অসামান্য ঢেউ আর রঙের আলাপ দিয়ে কালচের জন্য নিয়ে আসে যাপনের মানে, আর ছোট-ছোট গল্প। অবিনাশের বড় খারাপ লাগছে আজ। ‘এমন কিছু হয়নি, আমিও ছোটবেলায় খুব ফুল চুরি করতাম। দু-একদিনের মধ্যে কুঁড়ি আসবে।’ কালচের দৃষ্টি স্থির। এই ভবিষ্যদ্বাণীতে ওর উৎসাহ নেই।

    হিসি করতে শুরু করেছে কালচে। ঈশানী আঁতকে উঠল: কী ব্যাপার, হিসি এত হলুদ! কাল খুব কম জল খেয়েছে। কয়েকদিন কালচে শুধু বসে বা শুয়ে থাকে। ঘরের আড্ডায় আর আসে না। খুব একটা কৌতূহল নেই। অনেকদিন বাদে আজ মুখপুড়ি এসেছিল, কালচে যায়নি। অবিনাশ চিন্তিত: কী ব্যাপার বলো তো! ঈশানী বলল: তুমি মাথা ঘামিও না, আমি দেখছি। খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক করছে। কাল জামশেদপুর যাবে অবিনাশ। ছেলের হোস্টেলে। ছুটি পড়ছে। একবার চেষ্টা করে কালচের ভাবুক পৃথিবীকে ঝাঁকিয়ে দিতে। কালচের বল নিয়ে পাশের ঘরে ড্রিবল করতে থাকে, শট নেয়। চেয়ারে-সোফায় লেগে বল শব্দ করে এদিক-ওদিক গড়ায়। অন্যদিন হলে এক লাফে চারপায়ে ছোঁ মেরে বলটা কামড়ে সোফায় উঠে বসবে। তারপর ঈশানীর সাথে খেলবে এতোল-বেতোল। অবিনাশ কানের লতিতে আঙুল দিয়ে লিখতে থাকে: শান্তশীল, আনন্দমোহন। ‘ব্যাকুলের উঠোনে যাবি? ফড়িঙের সাথে গোল্লাছুট?’ পাখার হাওয়ায় একগুচ্ছ কালো লোম জট পাকিয়ে খাটের তলা থেকে উড়ে আসে। কালচের চোখে মন নেই আজ। 

    আজকাল আর কেউ আসে না। কুল এখনও তেমন কুল হয়নি, কষকাঁচা। এখানে কালচে আসত। ব্যাকুল দরজা খুলে রাখে। বিকেলের কালীমোহন কি বাইরে বেড়াতে গেছে? নিমোনিয়া হয়নি তো? ব্যাকুলের উঠোনে আজকাল তাড়াতাড়ি বিকেল ফুরিয়ে যায়। আসন্ন একাকিত্বের চাপে ব্যাকুল দরজায় খিল তুলে দেয়। সবে হাওড়ায় নেমেছে অবিনাশ। সঙ্গে সেমেস্টার শেষ করে ছেলে সুপর্ণ, সুপু। ফোন আসে ঈশানীর। স্টেশন-চিৎকার হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। অবিনাশ চকিতে একটা গ্রহে পৌঁছে যায়, যেখানে বাতাস নেই। ‘বাবা, কী হয়েছে?’ অবিনাশ শুনতে পায় না। হাতের ইঙ্গিতে বলে ‘চলো, তাড়া আছে।’ বুকের ভেতর কী হচ্ছে অবিনাশ জানে না। মাথায় একটাই দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সৎকারের কী হবে! ও তো কিছুই জানে না! 

    বাড়ির গেটে হতভম্ব ছোট একটা ভিড়। কালচের লম্বা লেজের কাছে মগ্ন পোড়ামুখি। অবিনাশকে আসতে দেখে ছোট পায়ে ঘরের পেছনে মিলিয়ে যায়। সুপর্ণ সটান দাঁড়িয়ে থাকে। মা-কে জাপটে ধরে। ঈশানী চুপচাপ। প্রতিবেশীদের একটা জটলায় ফিসফিস শোনা যায়। বস্তার মধ্যে ঢুকিয়ে যদি হাইওয়ের ডাম্পারে ফেলে আসা যায়। রাতে কেউ টের পাবে না। দিল্লি রোড। সবচেয়ে ভাল। তা না হলে বারাসত। একটা ঢিপি আছে, মর্গের পেছনে। সুপু আর ঈশানীর মিশ্র গোঙানি অবিনাশকে ভেঙে ফেলে। কালোর অন্ত্যেষ্টি হবে! সম্ভব? কোথায়? ব্যাকুলের উঠোনে? সুন্দরবাবু বলে দিয়েছে, আমাদের পাড়ায় কিন্তু এসব চলবে না। অবিনাশের ইচ্ছে ছিল ওর সমাধির পাশে রোপণ করবে সাদা গন্ধরাজ। তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে থামল অটো। বেণু! কালচে তখন সম্পূর্ণ ঢাকা আছে প্রিয় কার্পেটে, ওর শীতের বিছানা। এক আঙুল বেরিয়ে আছে লেজ। ঘোলাটে গোলা-পায়রার পালকের রং, লেজের অন্তিমে। দৌড়ে গিয়ে লাফিয়ে পড়ল বেণু। বুকের পাঁজর উল্টে চিৎকার করে ওঠে: কালীমোহন! ইতিমধ্যে চাঁদের তলপেট ঘেঁষে চলে গেছে কোহিমার মেঘ। ঈশানী বেণুর সাথে কথা বলে যায়। বেণু ফোন করতে লাগল কোথায়-কোথায়। জায়গা আছে, একটু খরচা আছে। রানাঘাট, বেলগাছিয়া, ডায়মন্ড হারবার। অবিনাশ পাগল হয়ে যাবে। ওর চাই পাঁচ হাত মাটি। ভূমিহীন কালো কি পাবে এই অধিগ্রহণের স্বাদ?

    আজকাল আর কেউ আসে না। কুল এখনও তেমন কুল হয়নি, কষকাঁচা। এখানে কালচে আসত। ব্যাকুল দরজা খুলে রাখে। বিকেলের কালীমোহন কি বাইরে বেড়াতে গেছে? নিমোনিয়া হয়নি তো? ব্যাকুলের উঠোনে আজকাল তাড়াতাড়ি বিকেল ফুরিয়ে যায়। আসন্ন একাকিত্বের চাপে ব্যাকুল দরজায় খিল তুলে দেয়। সবে হাওড়ায় নেমেছে অবিনাশ। সঙ্গে সেমেস্টার শেষ করে ছেলে সুপর্ণ, সুপু। ফোন আসে ঈশানীর। স্টেশন-চিৎকার হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়। অবিনাশ চকিতে একটা গ্রহে পৌঁছে যায়, যেখানে বাতাস নেই। ‘বাবা, কী হয়েছে?’ অবিনাশ শুনতে পায় না। হাতের ইঙ্গিতে বলে ‘চলো, তাড়া আছে।’

    চোলাই বেণু। ঈশানীর মনে হল, বেণু ঈশ্বরের সহপাঠী, এক টেবিলে বসে ধূমকেতু বানায়। অবাক দেবদূত। বেণু খুঁজে বার করে ফেলেছে। শাশ্বতী নদীর ওপার, গণপিটুনির মাঠ। কালচেকে ওখানেই সমাহিত করা যাবে। অবিনাশ জানে না, কপালে কী আছে! কালো, তুই কোথায়? অটোর পেছনে কার্পেট মুড়ি দিয়ে কালো। পাশে বিহ্বল সুপু। নৈশ পাহারায় চাঁদ। অধুনা ডুবে আছে মেঘে। বেণুর গাড়ি চলছে শাশ্বতীর ঘাটে। কালচে কখনও নদীর কাছে যেতে চায়নি। উবুডুবু রূপালি নদী, খুব ছিল ভয়। বেণু একটা নৌকো ভাড়া করে। ঘাটে মাটির প্রতিমা, ছিল ইলেকট্রিক লাইট। বাসন্তী আলোয় নৌকো এসে থামে। মুখ ঢাকা কালচের, এখন নৌকোয়। সাথে কাঠের হরিণ, পীতাভ শেকল, আর প্রিয় ড্রপ-খাওয়া বল। চার প্যাকেট নুন কিনে এনেছে বেণু। ভোলেনি মাটি খোঁড়ার শাবল। নদীতে জোয়ার, টলোমলো জলের বাড়ি লাগছে বৈঠায়। ওপারে মহাশ্মশান। তারপর গণপিটুনির মাঠ, মাছের আড়ত আর দুষ্কৃতীর পুণ্য লোকালয়। অবিনাশ পার হতে চায় না এই নদী। একটা দেশলাই ছুড়ে দেয় ছেলেকে। ‘একটু আগুন জ্বালিও।’ নৌকোয় বেণু আর সুপর্ণ, কালচের পাশে। ওপারে আলো-অন্ধকার। নৌকো যেতে শুরু করেছে, দুলে-দুলে। শাশ্বতীর গায়ে ওপারের পঞ্চায়েতের লালচে ডুম, ছেঁড়া কাপড়ের মতো ভাসছে শাশ্বতীর ওপর। কার্পেট একটু সরে গেল। কালচের দুটো পা, কমলা প্রলেপ। শক্ত বাঁশের মতো। যেন হাত বাড়িয়ে আছে। জলের ছপাৎ-ছপাৎ; জোয়ারের ঢেউ। নদীপথে প্রথম ভ্রমণ। নৌকো ওঠে, নামে। এক নৌকো গল্প নিয়ে চলে যাচ্ছে একটা প্রাণ। আস্তে চলে যায় অন্ধকারে। কালচের দুটো পা এক সময় মিলিয়ে যায় শাশ্বতীর গাঙে। গাঙে বুকভর্তি অন্ধকার, হাল ধরে নাবিকের হৃষ্টপুষ্ট হাত। অবিনাশ কি ঠিক করল ছেলেকে ওপারে পাঠিয়ে? বেণু কি পারবে? মেসেজ করে ঈশানীকে। ‘কালচে ভালভাবে নৌকোয় উঠেছে।’

    ধন্যবাদ শাশ্বতী। ভাগ্যিস প্রাণভরে কেঁদেছিলে। এক নৃশংস কাপালিক জনৈক ব্রাহ্মণের একমাত্র মেয়েকে মায়ের উৎসর্গের জন্য গ্রামের মেলা থেকে অপহরণ করে। নিস্পৃহ বালিকার মুখে মায়ের আদল। কাপালিকের মায়া হয়। একদিন তাকে গ্রামের প্রবীণ কাঁঠালগাছের ছায়ায় রেখে আসে। সঙ্গে গুড়-মুড়ি, জল। দুর্ভাগা শাশ্বতী। গণদেবতার রায় তাকে আবার ফিরিয়ে দিল কাপালিকের গহন জঙ্গলে। তারপর শাশ্বতী শুধু কাঁদত ওর মায়ের স্নানের জন্য। শেফালিগাছের জন্য। বাবার পুঁথির ওপর রাখা পাখির মুখের মতো ধূসর নীলাভ পাথরের জন্য। অবিরল কান্না থেকে শাশ্বতী একদিন নদী হয়ে গেল। অবিনাশ শেষবারের মতো জলমগ্ন শাশ্বতীর কাছে আবদার করে অন্তত পাঁচ হাত মাটি। আর কালচের শেষ কাজে তার অব্যর্থ অবদান।

    ঈশানী এখনও সোফায়। অবিনাশ শুয়ে আছে খাটে। বন্ধ জানালার কাচে ঘোলাটে আলো। পাশের বাড়ি চোরের ভয়ে অন করা আছে বাল্‌ব। সুপুর ফোন এসেছে। ‘এখানে হবে না। মাঝিরা অনেক টাকা চাইছে। আমরা নিষ্কৃতির পুকুরে যাচ্ছি। একটা নিমগাছ আছে। চাপ নিও না।’ আর কথা বলা যাচ্ছে না। মনে হয় সুপুর ফোনের চার্জ শেষ। বেণুরও তা-ই। এবার চাপে অবিনাশের শরীর শুকিয়ে আসছে। কিছু আর জানতে চায় না অবিনাশ। এলইডি-র আলোয় চিতার মতো ছায়া জানালায়। দেওয়াল ধরে হাঁটে। একবার আঁচড়ায় জানালায়। আকাশে মৃদু মেঘের গর্জন। মুখপুড়ি জানালার কাছে চলে আসে, পাঁচিলে বসে। ওর ছায়া আরও কালো আর বড় হয়ে ওঠে। ঝুলে আছে লেজ। অবিনাশ নির্ভয়। অনেকক্ষণ বাদে পেতলের শিকল থেকে ঘুঙুরের এলোমেলো গান। কিছুক্ষণ। মুখপুড়ি একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে মিয়াঁও করে ওঠে। একবার ওঠে, ওর ছায়াছবি ঘুরে তাকায় ঘরের ভেতরে। লেজটা টানটান উঠে আসে। গোঁফের পাতলা ছায়া জানালার কাছে আরও বড় হয়ে ওঠে। লেজটা তুলে পাঁচিলে রাখে। জানলা ঢেকে যায় খোঁজের ছায়ায়। 

    অবিনাশ দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির রাস্তায়। শেষ রাতের ট্রাক মাটি কাঁপিয়ে ছুটছে। নিংড়ে নেওয়া মধু ভাসাচ্ছে চায়ের দোকান। অবিশ্বাস্য আলোর সকাল। এই বোধহয় অটো এসে থামবে। অবিনাশ আর পারছে না। জিলিপি ভাজুক ছাই মিষ্টান্নের সুবল সরকার। সুপু কোথায়! ‘যাবেন?’ কাকের ডাকের মতো কত অটো আসে, যায়। বেণুর অটো আর আসে না। হাওড়ার দিকে যেতে শুরু করেছে সরকারের বাস। লাইটপোস্ট থেকে কেকের দোকান, অবিনাশ ওঠানামা করে। ক’টা বাজে? বেণুর গাড়ি এসে থামে। দুজনে অটো থেকে নামে। ‘একদম ঠিকঠাক।’ ‘সব ঠিকমতো হয়ে গেছে? চলো, গরম জলে স্নান করে তাড়াতাড়ি কিছু খেয়ে নাও। ঘুমোবে।’

    দু’মাস হয়ে গেল। এখানে কালচে থাকে না। নেই সেই মন্দ সুবাস। ভালবাসা ছাড়া কোনও প্রতিরোধ নেই। মুখপুড়ি চলে গেছে ভাতের হোটেলে। বাজে না পাঞ্চজন্য শাঁখ। ঈশানী দুটো মোমবাতি জ্বালায় অন্ধ বারান্দায়। অবিনাশ অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে কম্পমান আলোর শিখায়। দেখে যায় কাঁপন, স্পন্দন। মোমের শিখায়, পোড়া দুধ আর গোবিন্দভোগের গন্ধ লেগে আছে। বাকি সব কালো। অন্ধকার যেমন কালো হয়।

    আজ সম্পূর্ণ ফুটে আছে সাদা গন্ধরাজ।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook