গুরুর জীবনে যেটা মিথ্যে সেইটেই সত্যি হয়ে গেল সেইদিন থেকে। কি কুক্ষণে গুরু দত্ত ‘গৌরী’ ছবি করতে এখানে এসেছিল, কে জানে! কিন্তু কেউ জানে না, কেন সেইদিন থেকে গুরু দত্ত আমূল বদলে গেল। সেই যেদিন কলকাতার দল-বলকে বোম্বাই পাঠিয়ে গুরু রাত কাটাল গ্রেট-ইস্টার্নে।
আসলে সে ঘরটা ভাড়া নেওয়া হয়েছিল রামু সারিয়ার নামে। লোকে জানল সারিয়াই সে রাতটা হোটেলে কাটিয়েছিল।
কিন্তু আসল ঘটনা অন্য-রকম। সেইদিন থেকেই ওয়াহিদা রেহমান বদলে গেল, গুরু দত্তও বদলে গেল। তখন থেকেই শুরু হল গুরুর জীবনের অশান্তির আক্রমণ। ওয়াহিদা রেহমানের মতো শান্ত-ভদ্র অভিনেত্রীটি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল। সেদিন সে প্রথম বুঝতে পারল যে সে শুধু অভিনেত্রী নয়, সেও একজন নারী।
আর গুরু দত্ত? গুরু দত্তকে তখন কে আর সামলাবে? অসীম অভিমানী ছেলে গুরু। সারাজীবন সে শুধু নিজের কথাই মন দিয়ে শুনে এসেছে। বাবার কথা শোনেনি, মায়ের কথা শোনেনি, বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়স্বজনের হিতোপদেশে কান দেয়নি। সুতরাং আর কোন্ বারণ সে শুনতে যাবে?
বোম্বাইতে ফিরে গিয়েই সে ঝাঁপিয়ে পড়ল আর এক আলোড়নের মধ্যে। কাগজে-কাগজে তাকে নিয়ে কানাঘুষো চলতে লাগল। তার নামে কলঙ্ক, তার নামে কুৎসা। তার নামে কেলেঙ্কারি।
হোক কেলেঙ্কারি, হোক বদনাম। তাতে কিছু এসে যায় না তার। তখন তার খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। প্রযোজনার খ্যাতি, পরিচালনার খ্যাতি, অভিনয়ের খ্যাতি। তার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে ডান, ধ্যান, উদারতা, শিল্প-প্রতিভার খ্যাতি।
লোকে বলতে লাগল— এ এক নতুন প্রতিভার পরিচালনা।
বোম্বাই ছাড়িয়ে সারা ভারতবর্ষে তখন তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে তখন। ‘পিয়াসা’ বলে তার ছবিটা তখন সারা ভারতবর্ষে নতুন উদ্দীপনা এনে দিয়েছে। অর্থ আসছে লাখ-লাখ।
একদিকে প্রচুর অর্থ, প্রচুর খ্যাতি, আর সঙ্গে-সঙ্গে আর একদিকে রাত্রে ঘুম নেই, মনে শান্তির অভাব, প্রচুর নেশা আর অসংখ্য উমেদার। আর কাউকে দরকার নেই আমার, গৃহ-ই যখন রইল না আমার, তখন আর কি নিয়ে বাঁচব। বদনাম যদি হলই তো আর ভালো করেই হোক। ঠিক ‘পিয়াসা’র নায়কের মতোই গুরু আকন্ঠ মদ নিয়ে যাত্রা শুরু করল। শুধু মদ আর বই। কত যে বই তার বুঝি আর হিসেব নেই। গুরু যখন বিছানায় গিয়ে শোয়, তখন রতন একগাদা বই আর একটা টেবল্-ল্যাম্প নিয়ে গিয়ে রাখে তার পাশে। মদের নেশার মতো বই-এরও বুঝি একটা নেশা আছে। সারা জীবনে মদ তাকে শান্তি দিক আর না-দিক, বই তাকে চিরকাল শান্তি দিয়েছে। শুধু হিন্দি বই নয়, সব ভাষার বই। সঙ্গে-সঙ্গে বাংলা বইও আছে। সেই বই নিয়েই তার রাত কেটেছে তখন থেকে, যতদিন সে বেঁচে ছিল।
তখন একদিন ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বাংলা বইটা হাতে এল। বইটার নাম আগেই শুনেছিল সে। কিন্তু পড়া হয়নি। বইটা পড়তেই গুরুর মনে হল গল্পটা নিয়ে ছবি করলে হয়। গুরু শুনল যে গল্পটা নিয়ে বাংলা ছবি হয়ে গেছে। সঙ্গে-সঙ্গে খবর পাঠাল কলকাতায়। কলকাতায় সূর্য লাডিয়া তার ডিস্ট্রিবিঊটার।
অনেক খুঁজে-খুঁজে সূর্য লাডিয়া একদিন সকাল্বেলা আমার বাড়িতে এসে হাজির। আমি জিজ্ঞাসা করলাম— আপনি কে?
সূর্য লাডিয়া নিজের নাম-ধাম পরিচয় দিয়ে বললে— গুরু দত্ত আমাকে পাঠিয়েছে, সে আপনার ‘সাহেব বিবি গোলাম’টা হিন্দিতে করতে চায়— হিন্দি রাইট কি আপনি কাউকে বিক্রি করেছেন?
আমি বললাম— না—
এ ঘটনাটা আগেও বোধহয় একবার উল্লেখ করেছি। দাম-দস্তুর হল। কিন্তু গোল বাঁধল স্বত্ব নিয়ে। বললাম— চিরস্বত্ব বিক্রি করতে পারব না। তবে যদি দশ বছরের মতো কিনতে চান তো আমি রাজি আছি—
সূর্য লাডিয়া বললে— ঠিক আছে, সেই কথা জানিয়ে ট্রাঙ্ককল করছি—
কিন্তু সেই সময়ে একদিন স্টুডিওর অফিসে একখানা খামের চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠির ওপরে গুরু দত্তর নাম-ঠিকানা লেখা। গুরু দত্তর সব চিঠিই ম্যানেজার গুরুস্বামী খুলে পড়ত।
কিন্তু খুলে পড়েই গুরুস্বামী অবাক হয়ে গেল। চিঠির নিচেয় সই রয়েছে ওয়াহিদা রেহমানের। ওয়াহিদা লিখেছে— আপনার সঙ্গে আমার একটা বিশেষ গোপনীয় কথা আছে। কাল রাত্রে নটার সময়ে যদি আপনি ‘ইরোজ’ সিনেমার সামনে আসেন তো আমার সঙ্গে দেখা হবে। আমি আপনার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করব। বিশেষ দরকার। ইতি—
গুরু দত্তের ঘরে গিয়ে গুরুস্বামী চিঠিটা দিয়ে বললে— এই চিঠিটা ভুল করে খুলে ফেলেছি—
গুরু দত্ত হাসল। তার তো কোনও কিছুই গোপনীয় নেই। তার নামে চিঠি এলে গুরুস্বামীরই তা খোলবার নিয়ম আছে। চিঠিটা নিয়ে বললে— না-না, কিচ্ছু অপরাধ হয়নি তোমার—
বলে সমস্ত চিঠিখানা পড়ল। ততক্ষণে গুরুস্বামী ঘর ছেড়ে চলে গেছে। রতনকে ডাকলে গুরু দত্ত। রতন চা করে নিয়ে গেল। সিগ্রেটের নতুন প্যাকেট দিলে। তখনও দেখলে তার সাহেব চুপ করে বসে আছে অন্যমনস্কভাবে। শুধু রতন নয়, তখন যে ঘরে এসেছে সেই-ই দেখেছে গুরু দত্ত যেন অন্যমনস্ক হয়ে কথা বলছে। হঠাৎ কি হল গুরুর!
সেদিন যথারীতি দুপুরবেলা লাঞ্চ খেতে বসল গুরু। দুপুরবেলা গুরুর বাড়ি থেকে লাঞ্চ আসে, আর আসে গুরুস্বামীর বাড়ি থেকে। আর যদি কেউ হঠাৎ এসে পড়ল, তো সে-ও এসে লাঞ্চে যোগ দেয়।
কিন্তু ঘটনাচক্রে কেউই এল না। দুজনে চুপচাপ লাঞ্চ খেয়ে নিয়ে উঠে পড়ল। সবে মাত্র কলকাতা থেকে বাংলা ছবির শুটিং বন্ধ করে দলবল নিয়ে সবাই চলে এসেছে। কোনও কাজ নেই স্টুডিওতে। হঠাৎ ট্রাঙ্ককল এল কলকাতা থেকে। গুরুস্বামী টেলিফোনের রিসিভারটা ধরলে।
–কে? কাকে চাই? গুরু দত্? তাড়াতাড়ি গুরু দত্তের ঘরে গিয়ে গুরুস্বামী বললে—গুরুজী, কলকাতা থেকে ট্রাঙ্ককল এসেছে—
বললে— বোধহয় সূর্য লাডিয়া— কি বলব তাকে?
গুরু দত্ত বললে— বোধহয় ‘সাহেব বিবি গোলাম’ গল্প সম্বন্ধে কথা বলতে চায়। বলে দাও আমি স্টুডিওতে নেই—
— কিন্তু গল্প সম্বন্ধে কি বলব?
গুরু দত্ত বললে— কিছুই বলতে হবে না। বল আমি এখনও ভাবছি—
গুরুস্বামী আর কিছু কথা না বলে ঘরের বাইরে চলে গেল। কিন্তু তার পরেই এল সাদিক সাহেব। সাদিক সাহেব বহুদিনের পুরনো ফিল্ম ডাইরেক্টর। গুরু দত্তের কাছে অনেকদিন আগে এসে একটা ছবি করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন গুরু দত্ত কথা দিয়েছিল সাদিক সাহেবকে দিয়ে একটা ছবি করাবে। কিন্তু সে-প্রায় দশ বছর আগেকার কথা। তখন একটা গল্পও কিনিয়েছিল গুরু দত্তকে দিয়ে। তবে সে-ছবি তখন হয়নি। সাদিক সাহেব বললে— কিছু ঠিক করলে গুরুজী?
গুরু দত্ত বললে— ভাবছি ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিটা করব—
— সেটা কি গল্প?
গুরু দত্ত বললে— একজন বাঙালি লেখকের গল্প—
সাদিক সাহেব বললে— আমি যে গল্পটা পাঠিয়েছিলাম সেটা কি হল?
গুরু দত্ত বললে— গল্পটা কি বলুন তো? আমার কিছু মনে নেই!
সাদিক সাহেব বললে— নাম ‘চৌধবী-কা-চাঁদ’—
গুরু বললে— ঠিক আছে, আমি সেটা আর একবার পড়ে আপনাকে খবর দেব, পড়ে দেখি কেমন লাগে— সাদিক সাহেব সেদিন চলে গেল। তখনই গুরু দত্ত গল্পটা খুঁজে বার করতে হুকুম করলে। হাতে এল ‘চৌধবী-কা-চাঁদের’ পাণ্ডুলিপি। একটা ছবি করে থেমে থাকলে তো চলবে না। পরপর ছবি করে যেতে হবে। কেবল সংগ্রাম। সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে শেষ পরিণতিতে পৌঁছতে হবে। যদদিন জীবন না শেষ হয়, ততোদিন তো এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতেই হবে। স্টুডিও, স্টুডিওর স্টাফ, সংসার, সমস্ত কিছুই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। বাইরের লোক শুধু জানে তার টাকার কথা, তার সাক্সেসের কথা। তার কলঙ্কের কথা দিয়েই তো সিনেমা পত্রিকার পাতাগুলো ভরাট হয়ে যায়। কিন্তু তারা তার ঘুম-না-আসার কথা জানে না, তার সংগ্রামের কাহিনী জানে না। সে-সব যন্ত্রণার কোনও শরিক থাকে না বলেই তার কোনও রেকর্ড থাকে না মৃত্যুর পর।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত