ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • পোস্টমাস্টার: চলচ্চিত্রের শর্ত


    ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী (November 27, 2021)
     

    সত্যজিৎ রায় সম্বন্ধে আমাদের প্রাথমিক মুগ্ধতার কারণ সহজবোধ্য। এবং তাঁর প্রতি বাংলা সিনেমার দর্শকের আনুগত্য সম্ভবত কোনওদিন যাওয়ার নয়। তাঁর কাজ কালোত্তীর্ণ, তা তাৎক্ষণিকের হাত ছাড়িয়ে অনন্তের দিকে ধাবমান, তাঁর নিজস্ব স্বাক্ষর ও কৌণিকতা সমেত কাল, স্থান ও পাত্রের প্রামাণ্য দলিল ইত্যাদি আমরা জানি। কিন্তু মুগ্ধতা ওতে আসে না। মুগ্ধতার পথ জটিল এবং সরল। আমার মত এই, যাকে আমরা নিতান্তই আটপৌরে, অন্তরঙ্গ বাঙালি জীবন বলে জানি, সিনেমার ভাষায় তার এত গভীর এবং অথেন্টিক দৃশ্য ও শব্দরূপ আমরা আগে দেখিনি। এই আত্ম-আবিষ্কারের অভিঘাত অনুমেয়। কারণ ততদিনে সিনেমার পর্দায় কৌতূহলী বাঙালি হলিউড, ইউরোপ, জাপান ইত্যাদি দেখেছে। একটি আপাদমস্তক বিদেশি মাধ্যম যে বিদেশি জীবনের প্রতিই অনুগত হবে, তাও অনেকটাই মেনে নিয়েছে। দেশীয় কীর্তির যা যা উদাহরণ তার সামনে ততদিনে এসেছে, তাতে নাটকীয়তা, রাগ-দুঃখ-ভক্তি, প্রেম-বিরহ, ভিলেন-নায়ক-নায়িকা, নাচ-গান, হাসি-ঠাট্টা-ভাঁড়ামি, আলাদা-আলাদাভাবে আবিষ্কার করেছে। কিন্তু যেটাকে বলে আমাদের জীবন, মানে যে-জীবনটা আমি যাপন করতেই পারি, সেই জীবনের চেহারাটা যে পর্দায় দেখানো সম্ভব, তার কোনও প্রস্তুতি বাঙালির সম্ভবত ছিল না। এই অপ্রস্তুত বাঙালিকে সেই কারণেই অনন্তকালের জন্য সত্যজিৎ দখল করে নিতে পেরেছিলেন।

    এর পিছনে সত্যজিতের দীর্ঘ প্রস্তুতি ছিল। এবং হলিউড, ইউরোপের ছবি দেখার দীর্ঘ অভ্যাসের গা ঘেঁষে এক ধরনের অনুমানের খেলাও ছিল। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, বিভূতিভূষণের লেখা, বিশেষত তার দৃশ্য-বর্ণনা ও সংলাপ প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থাতেই যে ছবিতে রাখা সম্ভব, তা তিনি নিজে উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর প্রথম দুটি ছবির বিষয় নির্বাচন সেই কারণে আমার মতে কাকতালীয় নয়। যেটা লক্ষণীয়, সেটা হল ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘অপরাজিত’তে পৌঁছতে-পৌঁছতে তিনি তাঁর নির্মাণের ভাষাকে কতটা সংহত ও মেদবর্জিত করে তুলতে পেরেছিলেন। 

    বিভূতিভূষণ নিয়ে সমস্যা কম ছিল। সেখানে মূল চ্যালেঞ্জ ছিল সিনেমার প্রয়োজনে কতখানি রাখব আর কতখানি ফেলব। সমস্যা হল রবীন্দ্রনাথে এসে। 

    এর কারণ একাধিক। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথের গল্পে ঘটনা, প্লট, দৃশ্য-বর্ণনার থেকে চরিত্রদের মনোজগতের কাব্যিক বর্ণনা, জীবনদর্শন ও বিশ্লেষণের প্রাধান্য বেশি। এর রস আলাদা, কিন্তু এই রসের সাথে চলচ্চিত্রের দৃশ্যগ্রাহ্যতার একটা বিরোধ আছে। দুই, বাঙালি ততদিনে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ভয়ানক স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে। তিন, তখনও অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালির মনে সিনেমা বলতে ফোটোগ্রাফড থিয়েটারের একটা চেহারা জ্বলজ্বল করছে। অর্থাৎ লেখক যেটা নিজের ভাষায় নানাভাবে বর্ণনা করেছেন, এবং যে কালক্রমে করেছেন, সেটাকে অক্ষত রেখে চরিত্রের সংলাপ হিসেবে দেখতে চাওয়ার একটা স্বাভাবিক প্রত্যাশা তখনও প্রকট। এই প্রত্যাশা অসঙ্গত নয়। চলচ্চিত্রের ইতিহাসের ভিতরেই এই কনফিউশন নিহিত ছিল। 

    সিনেমা বিংশ শতাব্দীর শিল্প। শুধু এইজন্য নয় যে, তাতে নানান কারিগরি কুশলতার সমন্বয় প্রয়োজন। মূলত এই কারণে যে, সিনেমা হল একটি আদ্যন্ত ‘প্রমিস্কিউয়াস’ মাধ্যম। একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই সিনেমার শুচিবাই কম। তার কোনও কিছুর সঙ্গেই লেনদেনে কোনও বাধা নেই। একেবারে ভরা বাজারের মাঝখানে জন্মানোর ফলে, অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের মতো মেপে পা ফেলার কোনও দায় তার ছিল না। ফলে যাকে বলে ব্যাকরণ, তা তৈরি হতে-হতেই সিনেমা নানান দিকে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ধেয়ে যায়। কারিগরি নানান জটের ধাক্কা ছিল। সাউন্ড আসা, লাইটিং-এর প্রকরণ পালটানো, স্টকের বিবর্তন, স্টুডিও ছেড়ে বাইরে শুট করবার স্বাধীনতা— প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সিনেমাকে একটু থেমে, খানিক পিছিয়ে আবার নতুন বাঁক নিয়ে একটা সংহত চেহারা দেওয়ার একটা চেষ্টা নিরন্তর ছিল। নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে-করতে চল্লিশের মাঝখানে এসে অন্তত হলিউড, গপ্পো বলার একটা লক্ষণীয় ব্যাকরণ বা কিছু ‘নর্ম’ তৈরি করে, যার মূলে ছিল গ্রিক থিয়েটারের থ্রি-অ্যাক্ট স্ট্রাকচার। যেখানে চরিত্র ও ঘটনা আলাদা-আলাদা খাপে না থেকে পরস্পরকে কার্যকারণের নিয়ম মেনে প্রণোদিত করতে থাকে (dramatic-analytic narrative) এবং সংলাপের বদলে দৃশ্য ও শব্দের মাধ্যমে গপ্পোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা স্বীকৃত হয়। সত্যজিৎ মূলত খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে হলিউড থেকে এই শিক্ষাটা নেন। তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিল গল্প বলা। সিন্ট্যাক্সের ক্ষেত্রে সোভিয়েত চলচ্চিত্র এবং বিষয় ও শুটিং-এর প্রকরণে ইতালিয়ান নিও-রিয়ালিস্টদের দ্বারা প্রভাবিত হলেও, তাঁর কাহিনি নির্মাণের মূল শিক্ষা যে হলিউডের, তা তিনি শেষ দিন অবধি বলে এসেছেন (কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আছে)। এই তিনের মিশেলে এবং তার সাথে বাংলা সাহিত্যের অথেন্টিসিটি, এবং একেবারে নিজস্ব অবজারভেশন ও কৌতুক মিলিয়ে তিনি যে শৈলীর নির্মাণ করেন, সেটার কোনও রেফারেন্স আমাদের দেশে ছিল না। 

    প্রত্যেক দেশেই তাদের মতো করে এই ভাষাটির নিজস্বীকরণের একটা প্রক্রিয়া চলেছে। ভারতে তথা বাংলা ছবিতে এই আত্মীকরণ শুরুতে স্বাভাবিক ভাবেই যাত্রা, থিয়েটার এবং সাহিত্যের হাত ধরে হয়েছে। সিনেমার যে একটা নিজস্ব ভাষা আছে, তার ব্যাকরণ যে তার নিজস্ব যুক্তিতে তৈরি হয়, এইটা মেনে নেওয়া অনেকের পক্ষেই খুব মুশকিল ছিল। রেডিওতে যেভাবে নাটক ও গান শোনা যায়, সিনেমাতে সেইভাবেই সাহিত্য/নাটক দেখা যাবে, এইরকম একটা প্রত্যাশা অমূলক ছিল না। 

    সমস্যা একটাই। অন্যান্য দেশে সিনেমার ভাষা নিয়ে যেসব দেওয়াল ভাঙা হয়েছে, সেটা এক-এক শিল্পগোষ্ঠীর হাত ধরে। এমনকী বুনুয়েল ও দালির ‘Un Chien Andalou’ বা পরবর্তীতে বুনুয়েলের ‘L’Age d’Or’-এর মতো মাথা গুলিয়ে দেওয়া নিরীক্ষাও সুররিয়ালিস্টদের বৃহৎ ছাতার তলায় হয়েছিল। ভারতে/বাংলায় এই ঝক্কি খানিকটা সত্যজিৎ একা নিয়েছিলেন। কোনও সংজ্ঞাতেই তাঁকে প্রোভোকেটিভ বলা যায় না। তিনি গল্প ছাড়া কিছু বলতেও চাননি, বা যা বলতে চেয়েছেন তাঁর গল্পের পরিসরের মধ্যেই বলতে চেয়েছেন। কিন্তু ‘চারুলতা’য় পৌঁছে তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে। অতঃপর নানাবিধ কুকথা শোনার পর তাঁকে লিখতে হয়, ‘রুদ্র মশাই সাহিত্য বোঝেন কিনা জানি না, সিনেমা তিনি একেবারেই বোঝেন না। এমনকি বুঝিয়ে দিলেও বোঝেন না।’ 

    তারপরেও ‘প্রসঙ্গ: চারুলতা’ প্রবন্ধে তিনি হাতে ধরে-ধরে বুঝিয়ে দিতে থাকেন ছবিতে কী রাখা যায় ও যায় না এবং কেন যায় না। এই লেখাটি তাঁর ক্রাফট নির্মাণের একটা প্রামাণ্য দলিল। কিঞ্চিৎ রেগে ছিলেন বলেই এই লেখাতে এতটা অকপট ছিলেন হয়তো। ‘প্রসঙ্গ: চারুলতা’র হাত ধরেই এই লেখাতে আমরা সত্যজিতের সিনেমার ভাষা নির্মাণের আর একটা উদাহরণ দেখব। এটি ‘চারুলতা’র তিন বছর আগের কাজ। ‘চারুলতা’য় যা যা করেছেন তার প্রত্যেকটির প্রস্তুতি এই ছবিটির মধ্যে বর্তমান। 

    তার পরেই আসে রতনের প্রসঙ্গ। বিদায়ী পোস্টমাস্টার রতনকে ডাকতে গিয়ে প্রথমে ‘রতন’ এবং তারপরে ‘রত্না’ শব্দটি উল্লেখ করে। এইখানেও সাহিত্যের কাহিনি আর সিনেমার কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠির ফারাকটা খুব পরিষ্কার হয়। সাহিত্যে একবারও মনে হয় না একটি বারো-তেরো বছরের মেয়ের নাম কেন রতন হবে? কিন্তু যেই তাকে ছবিতে দেখি, তার একটা রক্তমাংসের অবয়ব যখনই তৈরি হয়, তখনই বাস্তব জীবনের মতোই প্রশ্ন আসে, মেয়েটির এই নামটি হল কীভাবে? সত্যজিৎ এই নিয়ে কোনও অবান্তর কনফিউশন রাখতে চাননি।

    দেখব, সাহিত্য থেকে অ্যাড্যাপ্ট করতে গিয়ে চলচ্চিত্রের কী কী শর্ত মেনে তিনি গ্রহণ ও বর্জন করছেন, এবং কী পালটে ফেলেছেন।

    রবীন্দ্রনাথের শুরুর দিকের লেখা গল্প— ‘পোস্টমাস্টার’। ১৮৯১ সালে লেখা। কাকতালীয় ভাবে ৩০ বছরের রবীন্দ্রনাথও ছোটগল্পের মতো একটি নবীন বিদেশি ফর্মের আত্মীকরণে হাত দিয়েছেন।

     রবীন্দ্রনাথের গল্পটি পাঁচ পাতার। শুরু হয় এইভাবে—

    ‘প্রথম কাজ আরম্ভ করিয়াই উলাপুর গ্রামে পোস্টমাস্টারকে আসিতে হয়। গ্রামটি অতি সামান্য। নিকটে একটি নীলকুঠি আছে তাই কুঠির সাহেব অনেক জোগাড় করিয়া এই নতুন পোস্টঅফিস স্থাপন করাইয়াছে। 

    আমাদের পোস্টমাস্টার কলিকাতার ছেলে। জলের মাছকে ডাঙায় তুলিলে যে-রকম হয়, এই গণ্্গ্রামের মধ্যে আসিয়া পোস্টমাস্টারেরও সেই দশা উপস্থিত হইয়াছে। একখানি অন্ধকার আটচালার মধ্যে তাঁহার আপিস; অদূরে একটি পানাপুকুর এবং তাহার চারি পাড়ে জঙ্গল। কুঠির গোমস্তা প্রভৃতি যে-সকল কর্মচারী আছে তাহাদের ফুরসত প্্ায় নাই এবং তাহারা ভদ্রলোকের সহিত মিশিবার উপযুক্ত নহে। 

    বিশেষত কলিকাতার ছেলে ভালো করিয়া মিশিতে জানে না। অপরিচিত স্থানে গেলে, হয় উদ্ধত নয় অপ্রতিভ হইয়া থাকে। এই কারণে স্থানীয় লোকের সহিত তাঁহার মেলামেশা হইয়া উঠে না। অথচ হাতে কাজ অধিক নাই। কখনো-কখনো দুটো-একটা কবিতা লিখিতে চেষ্টা করেন। তাহাতে এমন ভাব ব্যক্ত করিয়াছেন যে, সমস্ত দিন তরুপল্লবের কম্পন এবং আকাশের মেঘ দেখিয়া জীবন বড় সুখে কাটিয়া যায়— কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলা কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয় এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে  রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনর্জীবন লাভ করিতে পারে।

    পোস্টমাস্টারের বেতন অতি সামান্য। নিজে রাঁধিয়া খাইতে হয় এবং গ্রামের একটি পিতৃমাতৃহীন অনাথা বালিকা তাঁহার কাজকর্ম করিয়া দেয়, চারিটি-চারিটি খাইতে পায়। মেয়েটির নাম রতন। বয়স বারো-তেরো। বিবাহের বিশেষ সম্ভাবনা দেখা যায় না।’

    এগুলি তথ্য। কাহিনির ভূমিকা— কে, কী ও কেন। বস্তুত রতন ও নামহীন পোস্টমাস্টার ছাড়া রবীন্দ্রনাথের গল্পে আর কোনও চরিত্র নেই। এইটা সাহিত্যের সুবিধা ও জোরও বটে। কয়েক আঁচড়ে একটা পরিবেশের বর্ডার-লাইনগুলো টেনে, বাকিটা পাঠককে দিয়ে কল্পনা করিয়ে নিতে অসুবিধা হয় না। সিনেমা, বিশেষত কাহিনিচিত্রের শর্ত হল, যেহেতু তাকে একটা দৃশ্যগ্রাহ্য কাঠামোর মধ্যে এই চরিত্রগুলি ও তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিকে সাজাতে হবে, তাই শুধুমাত্র ‘wilful suspension of disbelief’-এর উপর ভরসা না করে তাকে প্রেক্ষিত, পরিবেশ, চরিত্র ও ঘটনার কার্যকারণকে ধরতে হবে। 

    সত্যজিৎ ছবি শুরু করেন পোস্টাপিসের একটা সাইনবোর্ড দিয়ে। তার তলায় দাঁড়িয়ে বিদায়রত মাঝবয়সি পোস্টমাস্টার এবং সদ্য চাকরিতে জয়েন করা আমাদের গল্পের পোস্টমাস্টার কথা বলে। কথার শুরুতেই আসে দুজনের পাশে দেওয়ালে সাঁটানো পোস্টারের সূত্রে ম্যালেরিয়ার প্রসঙ্গ। রবীন্দ্রনাথের গল্পে ম্যালেরিয়ার উল্লেখ আসে, যখন পোস্টমাস্টার ম্যালেরিয়া আক্রান্ত হয়। সেটি গল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নাটকীয় ঘটনা। যাকে বলে মাদার সিন। কিন্তু সিনেমার গল্পের নিজস্ব জগতে এই ম্যালেরিয়া সম্বন্ধে আগে ইঙ্গিত না রাখলে দর্শকের বিশ্বাসভঙ্গ হয় এবং গল্পের মোড়-ঘোরানো ঘটনাটিকে উপর থেকে চাপানো (forced and convenient) মনে হয়। তাই ছবির একেবারে শুরুতেই ব্যোমকেশের বড়ি নিয়ে একটা রসিকতার সূত্রে সত্যজিৎ এই প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করে রাখেন।

    তার পরেই আসে রতনের প্রসঙ্গ। বিদায়ী পোস্টমাস্টার রতনকে ডাকতে গিয়ে প্রথমে ‘রতন’ এবং তারপরে ‘রত্না’ শব্দটি উল্লেখ করে। এইখানেও সাহিত্যের কাহিনি আর সিনেমার কাহিনির বিশ্বাসযোগ্যতার মাপকাঠির ফারাকটা খুব পরিষ্কার হয়। সাহিত্যে একবারও মনে হয় না একটি বারো-তেরো বছরের মেয়ের নাম কেন রতন হবে? কিন্তু যেই তাকে ছবিতে দেখি, তার একটা রক্তমাংসের অবয়ব যখনই তৈরি হয়, তখনই বাস্তব জীবনের মতোই প্রশ্ন আসে, মেয়েটির এই নামটি হল কীভাবে? সত্যজিৎ এই নিয়ে কোনও অবান্তর কনফিউশন রাখতে চাননি।

    বিদায়ী পোস্টমাস্টার রতনের সঙ্গে কড়া সুরে কথা বলে। তাকে অনাবশ্যক নতুন পোস্টমাস্টার নিয়ে ভয় দেখায়। বাড়তি খারাপ ব্যবহার না হলেও তাতে মনিব-ভৃত্যের সম্পর্কের মূল সমীকরণের সুরটি স্পষ্ট। আগ বাড়িয়ে এই কনট্রাস্ট আগেই তৈরি করে নেন সত্যজিৎ, কারণ অনতিবিলম্বেই তাঁকে এই নতুন পোস্টমাস্টারের সঙ্গে রতনের এক নতুন সমীকরণে পৌঁছতে হবে। সেই সমীকরণের সূত্র বিদায়ী পোস্টমাস্টারের রতনের প্রতি ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে সূচিত হয়।

    রবীন্দ্রনাথের গল্পের প্রথম পাঁচটি পরিচ্ছেদের পরেই যখন পোস্টমাস্টার রতনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আচ্ছা রতন, তোর মাকে মনে পড়ে?’ তখন একলাফে সম্পর্কের ঠিক মাঝখানটায় গিয়ে এই অন্তরঙ্গতা সৃষ্টিতে কিন্তু কোনও রসহানি হয় না। গ্রামের পরিবেশের মতোই সম্পর্কের এই ছোট্ট যাত্রাটুকু পাঠক নিজের মতো করে কল্পনা করে নিতে পারেন। কিন্তু ছবির পোস্টমাস্টার গ্রামে পৌঁছেই একলাফে রতনকে এই প্রশ্ন করতে পারে না। তাকে অত্যাবশকীয় কতগুলি ধাপ পেরোতেই হয়। ফিল্ম-মেকারের কাজ এই ধাপগুলিকে যতটা সম্ভব সহজ ও অনিবার্য হিসেবে দেখানো। এই জায়গায় পৌঁছানোর জন্য (এবং তার পরবর্তীতে ছবির অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতেও) সত্যজিৎ কী কী করছেন আমরা দেখি।

    ১। আপিসঘরে এবং নিজের শোবার ঘরে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন, এলোমেলো ঘুরে বেড়ানোর পর পোস্টমাস্টার তার সদ্য নিয়ে আসা ট্রাংকটি খোলে। সেখান থেকে জামাকাপড়ের বদলে প্রথমেই বেরোয় ফ্রেমে বাঁধানো তার পরিবারের ছবি। প্রথমেই সে ছবিটি দেওয়ালে একটি উপযুক্ত জায়গায় টাঙিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ খুশিমনে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর তার ট্রাঙ্ক থেকে বেরিয়ে আসে একটি কবিতার খাতা এবং বেশ কয়েকটা বাঁধানো বই। কোনও সংলাপ ছাড়া, ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে রক্তমাংসের একটি মানুষের বিশ্বাসযোগ্য কয়েকটি co-ordinates আমরা, অর্থাৎ দর্শকরা পেয়ে যাই। এগুলো মানুষটিকে চিনতে যেমন সাহায্য করে, তেমন এই প্রত্যেকটি উপাদান পরবর্তীকালে গল্পের কাজে আসবে।

    ২। জিনিসপত্র কিছুটা গোছানোর পর পোস্টমাস্টারের খেয়াল পড়ে যে, ট্রাংকের চাবিটা খাটের উপর পড়ে আছে। সে (এই প্রথমবার) দ্রুত পায়ে এসে চাবিটা দেওয়ালে ঝোলানো পাঞ্জাবির বা শার্টের পকেটে সযত্নে রেখে দেয়। এই অ্যাকশনেও দুটি ঘটনা ঘটে। প্রথমত, সদ্য শহর থেকে আসা একটি মানুষের বিশ্বাসহীনতার একটা পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যায়। আবার পরবর্তীকালে বিশ্বাস তৈরি হওয়ার সংকেত হিসেবে এই চাবির গোছাটি পোস্টমাস্টার যখন নিজে থেকে রতনকে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বার করতে বলে, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, তাদের সম্পর্ক প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে দ্বিতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে। খেয়াল করলেই দেখতে পাব, সত্যজিৎ বারবার একটা সিনেম্যাটিক ইভেন্টকে প্রথমে বর্ণনা এবং তারপরে গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যুগ্ম কাজে ব্যবহার করছেন। 

    ৩। তারপরেই সে বাইরে আসে এবং এসেই দাওয়ায় রাখা চেয়ারটিতে বসতে গিয়ে পায়া ভেঙে মেঝেতে ধপাস করে পড়ে। একেবারেই শহুরে এক তরুণের অজপাড়াগাঁয় এসে যে হাল হয়, তাকে সাহিত্যে মানসিক অবস্থার বিবরণ দিয়ে বর্ণনা করা গেলেও সিনেমায় তার জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা দরকার। কিন্তু সত্যজিৎ এই ঘটনাটিকেও আলগা ছেড়ে রাখেন না। প্রথমে বিবরণ এবং তারপরে সম্পর্কের বয়ানের স্বার্থে কাজে লাগান। পোস্টমাস্টার পড়ে গিয়ে লক্ষ করে, অদূরে রতন তার দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে। সঙ্গে-সঙ্গে তার গলায় প্রভুত্বের ছোঁয়া লাগে (‘হাঁ করে দেখছিস কী? যা গিয়ে ঘরটা ঝাঁট দে’)। সে পরিস্থিতি সামলাতে ক্ষণিকের জন্য মনিব বনে যায়। তারপর স্নান করার ইচ্ছায় ঘরে গিয়ে জামাকাপড় ছাড়তে গিয়ে তার মনে হয়, পাঞ্জাবিতে তার পার্সটিকে অরক্ষিত রাখা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। সন্তর্পণে সেটিকে সে ট্রাংকের মধ্যে চালান করে পুকুরপাড়ে নাইতে যায়। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তার চলাফেরার মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়, সে গ্রামের এই ধরনের রাস্তায় হাঁটতে অভ্যস্ত নয়। এবং কিছুদূর গিয়েই পথের মাঝখানে একটি সাপের খোলস দেখে সে থমকে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, তারপর ফিরে এসে রতনকে জল ধরে দিতে হুকুম করে। স্নানের প্রসঙ্গটি রবীন্দ্রনাথের গল্পে একেবারে শেষদিকের দৃশ্যে আসে। সেখানে বলা হয় যে, বাবু শহরের লোক, তিনি নদীতে নাইতে যান না। পাছে ভোরবেলায় বেরোনোর আগে তার স্নান করার প্রয়োজন হয় এই চিন্তায় রতন মাঝরাতে গিয়ে তার জন্য নদী থেকে জল তুলে আনে। আবারও লক্ষণীয়, সাহিত্যে রতনের আনুগত্য ও কর্তব্যপরায়ণতা বোঝাতে যে-দৃশ্য কাজে লাগে, ছবিতে সেই একই দৃশ্য খুবই দুর্বল হয়। অতএব সত্যজিৎ স্নান করার প্রসঙ্গটি কাজে লাগান গল্পের একেবারে শুরুর দিকে। স্নান করতে গিয়ে সাপের খোলস দেখা এবং ভয় পেয়ে আবার বাসায় ফিরে আসাকে শহুরে অনভ্যস্ততার বিবরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। লক্ষ করার এই যে, এই সময় প্রত্যেকটি দৃশ্যই ক্লাসিক্যাল থ্রি-অ্যাক্ট স্ট্রাকচারে যাকে এক্সপোজিশন বলে, সত্যজিৎ নিয়ম মেনে সেটাই করছেন, অর্থাৎ ছবি বা নাটকের যে-অংশে প্রেক্ষিত এবং চরিত্রের প্রাথমিক লক্ষণগুলো তুলে ধরা হয়, যার হাত ধরে পরবর্তীতে কাহিনি এগিয়ে যাবে। 

    ৪। এরপর গল্পের একেবারে বাইরে গিয়ে সত্যজিৎ সম্পূর্ণ একটি অপ্রত্যাশিত চরিত্র আমদানি করেন। পোস্টমাস্টার স্নানের জলের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে তার সামনে বিশু পাগলা ও তার নাটকীয় কাণ্ডকারখানা দেখে বিহ্বল হয়ে পড়ে। শহুরে অনভ্যস্ততার থিম ধরে দৃশ্যটির শুরু হয় কিন্তু স্নানের জল নিয়ে আসা রতন যে অবলীলায় বিশু পাগলাকে নিরস্ত করে (‘বাবুর গায়ে কত জোর জানিস’— এটাও মজার, কারণ ছবিতে আমরা দেখেছি বাবু সম্বন্ধে শুধু এইটুকু তথ্যই তখনও অবধি রতন জানে) এবং তাড়িয়ে দেয়, তাতে ঘটনার উপরাংশে ঘটে যাওয়া নিতান্তই মজার একটা দৃশ্যের তলা দিয়ে সত্যজিৎ তাদের সম্পর্কের প্রথম গ্রহণযোগ্য ধাপটি দর্শকের অলক্ষ্যে পেরিয়ে যান। এই শর্তগুলি লক্ষ করা খুব জরুরি। খেয়াল করলে দেখতে পাব, একটা বিশ্বাসযোগ্য জগতের ভেতরে বিশ্বাসযোগ্য কিছু চরিত্র তাদের মধ্যে কাহিনির বলয়ের ভিতর এক ধরনের সম্পর্ক স্থাপন ও তার বিস্তার ঘটায়। এবং এই প্রত্যেকটি বিস্তার সংলাপের ওপর নির্ভরশীল নয়। দ্বিতীয়ত, এই বিস্তার চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো নয়। প্রায় অপ্রাসঙ্গিক মনে হওয়া, কিন্তু দেখতে মনোরঞ্জনকর কিছু ঘটনার তলা দিয়ে দর্শকদের অজান্তে ঘটতে থাকে। ছবির ১৩ মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। এইখানে সত্যজিৎ তার ফার্স্ট অ্যাক্ট শেষ করেন। অর্থাৎ এক্সপোজিশন থেকে এবার তিনি দ্বিতীয় অঙ্কের কম্প্লিকেশন-এর দিকে যাত্রা করবেন। যেখানে সম্পর্কের ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে গল্পে একটি বিশ্বাসযোগ্য ক্রাইসিস তৈরি করা আবশ্যক। 

    ৫। ছবির দ্বিতীয় অ্যাক্ট-এর শুরুতেই বোঝা যায়, রতন তার মনিবকে আর ভয় পায় না। পোস্টমাস্টার রাতে টেবিলে বসে চিঠি লেখে, রতন তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে এই নতুন মানুষটিকে দেখতে থাকে। পোস্টমাস্টার প্রথমে তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোর কাপড় এত ময়লা কেন? মা কেচে দেয় না?’ রতন তারপর বলে তার মা নেই।এমনকী বাবাও নেই। অনেক ছোটবেলায় মারা গেছে। তার মনেও নেই। পোস্টমাস্টার বোকার মতো হাসে। তারপর পুরনো মনিবটির কথা জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, রতন তার হাতে মার খেত। পোস্টমাস্টার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সম্পর্কের এই যে স্তরটিতে এখন এলাম, সেটা সাহিত্যে এক লহমায়, ‘হ্যাঁরে তোর মাকে মনে পড়ে না?’ বলে পৌঁছে যাওয়া যায়। ছবিতে এইখানে পৌঁছতে হলে ধাপে-ধাপে আসতেই হত। এমনকী, মা’র প্রসঙ্গে আসতে গেলে আগে ময়লা কাপড়ের ঘুরপথ দিয়ে এলে তবেই সেটা আরোপিত লাগে না। অর্থাৎ যেটাকে বলে বুনন (weaving a narrative); একটা জিনিসের সঙ্গে আর একটা জিনিসকে জুড়ে না দিলে ছবির তৈরি করা জগতের নিজস্ব শর্ত লঙ্ঘিত হয়।

    ৬। গ্রামের প্রথম রাত্তিরে পোস্টমাস্টার শিয়ালের ডাক ও বিশু পাগলার লেফট-রাইট শুনে, ঘাবড়ে গিয়ে বালিশের পাশে দাড়ি কামানোর ক্ষুর রেখে ঘুমোতে যায়। এইখানে এই দৃশ্যটি একটু বাড়াবাড়ি মনে হলেও, এই মানুষটি যে নিতান্ত ভীতু ও দুর্বল, তা ছবিতে পরে কাজে লাগবে। এখন যেটা নিতান্তই কমিক একটি দৃশ্য বলে মনে হয়, সেটাই পরবর্তীতে গল্পের কার্যকারণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। পরের দিন পোস্টমাস্টার খামের ওপর অনভ্যস্ত হাতে স্টাম্প করতে করতে যায় (এটাও সত্যজিৎ পরে কাজে লাগাবেন passage of time বোঝাতে— যাতে ডায়লগে আর বলতে না হয়, ‘বেশ কয়েক মাস কেটে গেল’)। গ্রামের কিছু বৃদ্ধ তার সাথে আলাপ জমাতে এসেছে। তারা হেঁ-হেঁ করে, তাদের মধ্যে একজন জীবনে একবার রানাঘাট অবধি যাত্রা করেছে, তারা এসেছে কলকাতা থেকে আসা এই আজব জীবটিকে দেখতে। গত রাতে শেয়ালের ডাক শুনে ভয় পাওয়া পোস্টমাস্টার তাদের সঙ্গে নিতান্তই শীতল ব্যবহার করে। সে যে কলকাতা থেকে এসেছে এবং এইসব গেঁয়ো মানুষদের থেকে সে যে একেবারেই আলাদা, এটা তার ব্যবহার খুবই স্পষ্ট করে দেয়। সে তাদের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না। কাজে ব্যস্ত এরকম একটা ভান সারাক্ষণ বজায় রাখে। ‘সন্ধেবেলায় একটু ইংরেজি চর্চা করি এবং স্কটের নতুন একটা উপন্যাস ধরেছি’, এই অজুহাতে তাদের গান-বাজনার আসরে যাওয়ার নিমন্ত্রণ এক প্রকার প্রত্যাখ্যান করে। অর্থাৎ সে ভীতু ও দুর্বল কিন্তু প্রয়োজনে সে নিষ্ঠুর ও শীতল হতে পারে, এই দ্বিতীয় লেয়ারটি যুক্ত হল— যেটি গল্পের শেষে তার সিদ্ধান্তকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে। বাড়ি তৈরি করার মতো সত্যজিৎ তাঁর গল্পের যৌক্তিক কাঠামোটিকে ধাপে ধাপে দর্শকের অজান্তে তৈরি করে চলেছেন।

    আর একটা ব্যাপার এখানে লক্ষণীয়। রবীন্দ্রনাথের গল্পে উনিশ শতকের শেষ দশকের গ্রামবাংলার একটা ছবি দেখা যায়। সেই গ্রামে একটা নীলকুঠি আছে, কিন্তু তাদের গোমস্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ভদ্রলোকদের মেশা খুব একটা সম্ভব নয়। এখন, যাদের সঙ্গে মেশা সম্ভব নয়, তাদের ছবিতে দেখতে পাওয়া দুষ্কর। তাদের সঙ্গে মিশতে পারছি না— এইটা ছবিতে বোঝানো আরও দুরূহ কাজ। তাই ‘মিশতে পারছি না’ এটা বোঝানোর জন্য পোস্টমাস্টারের সঙ্গে কিছু চরিত্রের সমাগম ছবিতে অন্তত দরকার। চরিত্রের একাকিত্ব বোঝানোর জন্য তার থেকে বয়সে এবং মানসিকতায় সম্পূর্ণ আলাদা এক গ্রাম্য গোষ্ঠীকে ছবিতে হাজির করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। সত্যজিৎ নির্দিষ্টভাবে না জানালেও, অনুমান করা যায়, স্বাধীনতার কিছু আগে/পরে এই গল্পের সময়কাল। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ হলেও এই কাল নির্বাচন গল্পের শেষ অংশে এসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। 

    ৭। দুপুরের অবসরে পোস্টমাস্টার মায়ের চিঠি নিয়ে বিছানায় এলিয়ে শোয়। মা’র চিঠি শুরু হয় ‘বাবা নন্দ’ বলে। রবীন্দ্রনাথের অনামা পোস্টমাস্টার সত্যজিতের ছবিতে নন্দ নামে পরিচিত হয়। কারণ ছবির প্রয়োজনে তৈরি করা বাস্তবতায় একটা মানুষের দীর্ঘক্ষণ নামহীন থাকা মুশকিল। কিন্তু এখানেও নামকরণের উপলক্ষটিকে সত্যজিৎ অন্য একটা উদ্দেশ্যে পরে কাজে লাগান। যুক্তাক্ষরজ্ঞানহীন রতন, নন্দ নামটি বানান করতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলে। এই যুক্তাক্ষরের প্রসঙ্গটিও অকারণে আসে না। রবীন্দ্রনাথের গল্পে যে-লাইনে পোস্টমাস্টার রতনকে পড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তার দু’লাইনের মধ্যেই রতন যুক্তাক্ষর অতিক্রম করে যায়। ছবির লজিকে তা অসম্ভব। এছাড়াও এইখান থেকে সত্যজিৎ গল্প থেকে সরে আসতে শুরু করেন। তিনি যে-অসমাপ্ততার থিমের দিকে ছবিটিকে নিয়ে যাচ্ছেন সেটি রবীন্দ্রনাথের গল্পের অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে ভিন্ন। তাই সত্যজিৎ-এর ছবিতে রতনের পড়াশোনা শুরু হলেও, যুক্তাক্ষর অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

    ৮। মায়ের চিঠি পড়ার দৃশ্যতে সত্যজিৎ বাস্তবিকই গল্পটিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে সক্ষম হন। নতুনবাবু চিঠি পড়ছে; নতুন পাওয়া আশকারার উপর ভর দিয়ে রতন তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কার চিঠি নতুনবাবু?’ মা’র নাম শুনে সে ছুটে গিয়ে ছবিতে মা’র দিকে নির্দেশ করে, এবং তারপরেই যখন সে জানতে পারে ছবির অন্য চরিত্রটি বাবুর ছোটবোন রানি, তৎক্ষণাৎ তার মুখের অভিব্যক্তি পালটে যায়। বাবু তাকে জানায় যে, তার বোনের অনেক গুণ। সে পড়াশোনা জানে, গান গাইতে পারে। রতনের মতো সে মুখ্যুসুখ্যু নয়। রতন আর থাকতে না পেরে বলে, সেও গান জানে। এবং বাবুর অনুমতিতে (যদিও বাবু আধঘুমন্ত— অর্থাৎ রতন ডেসপারেট) একটা গানের অর্ধেক দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে গেয়েও ফেলে। মাত্র কয়েকদিনের তফাতে প্রথম দৃশ্যের ভীতসন্ত্রস্ত রতন— যে শুধু জানে যে নতুনবাবুর গায়ে অনেক জোর, সে না-দেখা এক কাল্পনিক বোনের সঙ্গে এক কাল্পনিক প্রতিযোগিতায় নামে। গল্প স্পষ্টতই এখন অন্য ধাপে। এবং যে-পরিণতির দিকে আমরা যেতে চাইছি, তার প্রাথমিক শর্ত ইতিমধ্যেই পূরণ হয়ে গেছে। বাবু তার এই গীতি-অর্ঘ্যের পুরস্কার স্বরূপ তাকে পড়াশোনা শেখানোর প্রতিশ্রুতি দেয়। বাবু, যে তার অনুভুতি সম্বন্ধে স্পষ্টতই অজ্ঞান, বলেই ফেলে, গান সে জানে, আর পড়াশোনা শিখে ফেললেই সে বাবুর শহরের বোনের সমকক্ষ হয়ে উঠবে। এইটা সে নিজেও মানসচক্ষে দেখতে পায়। একধাপ এগিয়ে বাবু তাকে কোটের পকেট থেকে তার পার্সটা বের করে দিতে বলে। যে-পার্স নিয়ে প্রথম অ্যাক্টে বাবু সন্ত্রস্ত ছিল, সেই পার্সের হদিশ রতনকে দিতে তার একবারও ভাবতে হয় না। এবং তার সঙ্গে আসে বকশিশের প্রসঙ্গ। ভাল করে লেখাপড়া শিখলে সে আরও বকশিশ পাবে। শুনতে স্বাভাবিক। প্রাসঙ্গিকও। কিন্তু পুরোটাই পরিকল্পিত। কারণ ছবির শেষের নাটকীয়তা পুরোটাই নির্ভর করবে এই বকশিশের ওপর। যা আমার গল্প বলার মূল অস্ত্র, তার ইঙ্গিত দর্শককে আমি সময়মতো, অজান্তে আগে থেকে দিয়ে রাখলাম। যখন মোক্ষম সময়ে পরবর্তীতে তা ব্যবহৃত হবে, তখন দর্শকের অবচেতনে তার স্মৃতি জ্বলজ্বল করবে। অর্থাৎ দৃশ্যটি বিশ্বাসযোগ্য এবং তার অভিঘাত অবচেতনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকবে। 

    দ্বিতীয় অ্যাক্টের প্রাথমিক শর্ত যে কনফ্লিক্ট, অর্থাৎ বিরোধ, যার হাত ধরে গল্প পরিণতির দিকে পৌঁছবে, স্পষ্টতই সেই বিরোধের ফ্রেমওয়ার্ক পরিষ্কার ভাবে তৈরি হয়ে গেছে। দর্শক জানে রতনের এই কাল্পনিক প্রতিযোগিতা অমূলক এবং করুণ, কিন্তু দর্শক তার সঙ্গে-সঙ্গে রতনকে ভালবাসতেও শুরু করেছে। কারণ তার অসহায়তা ও সারল্য ধাপে-ধাপে দেখানো হয়েছে। অতএব এই কনফ্লিক্ট-এর পরিণতি করুণ হলেও দর্শক ছবির সঙ্গে থাকবেন। এবং প্রত্যাশা করবেন যে, রতনের পরিণতি যেন শুধুই খারাপ না হয়। এই প্রত্যাশা এখন থেকে ছবির গতির মূল ভিত্তি। এবং বলাই বাহুল্য এর পুরোটাই যত্ন করে ক্রাফট দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। 

    ৯। তারপর আসে চলতি ভাষায় যাকে আমরা ‘মন্তাজ’ (এগুলিকে আদতে ‘টাইম কম্প্রেশন’ বলাই ভাল) বলি। সময় এগোয়। রতন পড়াশোনা শেখে, কাজ করে, পোস্টমাস্টারের খামে স্ট্যাম্প মারা, দুটি আলাদা-আলাদা দৃশ্যে ক্রমশ গতিমান হতে থাকে। এই ধরনের মন্তাজ কিঞ্চিৎ ক্লান্তিকর হয়, এবং স্ট্যাম্প মারার দুটি দৃশ্যের মধ্যে একটা ব্যবধান দরকার, তাই সত্যজিৎ এই মন্তাজের ভেতরেই একটি ছোট্ট কৌতুকের অবতারণা করেন। সেই কৌতুকের রসদটি মূলগল্প থেকে সংগ্রহ করা হলেও তার ব্যবহার এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মূল গল্পে রবীন্দ্রনাথ বলেন, রাতে রতন বাবুর জন্য চারটে রুটি বানিয়ে দেয়। এইটুকুই। সত্যজিৎ-এর দৃশ্যে নতুনবাবু একটা যেনতেন প্রকারে করা রুটি এক হাতে তুলে প্রশ্নবোধক মুখ নিয়ে রতনের দিকে তাকালে, সে হেসে বলে, আগের বাবুটি ভাত খেত যে! অর্থাৎ ছবির মূল ক্রাইসিস শুরু হওয়ার আগে যে সময়ের বোধটুকু দরকার, সেটাকেও খুব যত্নের সঙ্গে ভেঙে সাজিয়েছেন সত্যজিৎ। যেটা ফাংশনাল, সেটাও যেন অনিবার্য লাগে। সেটাও তাঁর ক্রাফটের অন্যতম দিক।

    এর পরের দৃশ্যে আসে যুক্তাক্ষরের প্রসঙ্গ, যা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। 

    তারপরে শুরু হয় বৃদ্ধদের গান। নতুন পোস্টমাস্টার তাদের গানের আসরে যাবে না বুঝে তারা তার বাড়িতে এসে গান শুনিয়ে যায়। নিতান্তই কেজো দৃশ্য মনে হতে পারে। তাদের গানের কমিক দিকটা ছাড়া প্রথমে আমাদের কিছুই চোখে পড়ে না। কিন্তু অচিরেই বোঝা যায়, নতুন মাস্টারের ম্যালেরিয়া হওয়ার দৃশ্যের অবতারণার ছল এটি। 

    রবীন্দ্রনাথের গল্পে একদিন সকালে অনেকক্ষণ বাবুর ডাকের জন্য অপেক্ষা করে, তারপর থাকতে না পেরে বাবুর ঘরে গিয়ে বাবুর মাথায় হাত রেখে রতন নতুনবাবুর জ্বর আবিষ্কার করে। এই দৃশ্য সাহিত্যে কল্পনা করতে কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু সিনেমায় এই দৃশ্য অচল। দীর্ঘায়িত এবং বোরিং। যে-ঘটনার হাত ধরে ছবির ট্র্যাজেডির সূত্রপাত হবে, তার একটি নাটকীয় ট্রানজিশন হিসেবে সত্যজিৎ এই বৃদ্ধদের গান ব্যবহার করেন। তারপরের দৃশ্যেই রাতে শোবার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে রতন বাবুর ঘর থেকে আওয়াজ পায়। ছুটে গিয়ে সে বাবুকে প্রবল জ্বরে কাতরাতে দ্যাখে। বৃদ্ধদের দলের দুজন আসে। রবীন্দ্রনাথে বদ্যির উল্লেখ আছে, কিন্তু মাঝরাতে বদ্যি পাওয়া মুশকিল, আর বদ্যি এলে ম্যালেরিয়া নিয়ে লঘু রসিকতা করা যায় না, তাই সত্যজিৎ এখানে ওই স্বাধীনতা নেন। দুই বৃদ্ধ প্রথম দৃশ্যে বর্ণিত ব্যোমকেশ বড়ি খাবার পরামর্শ দেয়। আর রতনকে রাতে বাবুর ঘরেই থেকে যেতে বলে।

    রবীন্দ্রনাথ পোস্টমাস্টারের রোগ-বর্ণনায় স্বাভাবিক ভাবেই তার মনের অবস্থার বিবরণ দেন এবং রতনের শিশু থেকে মা হয়ে ওঠার কাহিনি বলেন। 

    ‘এই নিতান্ত নিঃসঙ্গ প্রবাসে ঘনবর্ষায় রোগকাতর শরীরে একটুখানি সেবা পাইতে ইচ্ছা করে। তপ্ত ললাটের উপর শাঁখাপরা কোমল হস্তের স্পর্শ মনে পড়ে। এই ঘোর প্রবাসে রোগযন্ত্রণায় স্নেহময়ী নারীরূপে জননী ও দিদি পাশে বসিয়া আছেন, এই কথা মনে করিতে ইচ্ছা করে। এবং এস্থলে প্রবাসীর মনের অভিলাষ ব্যর্থ হইল না। বালিকা রতন আর বালিকা রহিল না। সেই মুহূর্তেই সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল, বৈদ্য ডাকিয়া আনিল, যথাসময়ে বটিকা খাওয়াইল, সারারাত্রি শিয়রে জাগিয়া রহিল, আপনি পথ্য রাঁধিয়া দিল, এবং শতবার করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি।”

    মনের এই অবস্থা ছবিতে বর্ণনা করলে বিপদ। সত্যজিৎ সেই পথে হাঁটেন না। বাবুকে কাতরাতে দেখে রতন তার নিজের কম্বল নিয়ে এসে বাবুর কম্বলের উপরে চাপিয়ে দেয়। সারারাত তার পাশে বসে থেকে জলপট্টি দেয়, এবং ক্রমে বৃষ্টি, বিদ্যুৎ চমকানো, তার সঙ্গে বিশু পাগলার ‘হারে রে রে’ মিশিয়ে নতুন বাবুর যে ডিলিরিয়াম তৈরি হয়, তাতে রতনকে দেখে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। জিজ্ঞাসা করে, ‘তুই কে?’ আর রতন কাতর গলায় তাকে বলতে থাকে, ‘আমি রতন, বাবু, তোমার কাজ করি।’ 

    রবীন্দ্রনাথের করুণ রসের পথ থেকে বেরিয়ে গিয়ে সত্যজিৎ পোস্টমাস্টারের আতঙ্ক আর রতনের অসহায়তা এই দুয়ের কন্ট্রাডিকশন তৈরি করেন। কারণ এর উপরে নির্ভর করেই তিনি ছবির ফাইনাল রেজলিউশনে পৌঁছাবেন। এই কন্ট্রাডিকশন ছবির দ্বিতীয় অ্যাক্টের কনফ্লিক্টের মূর্ত রূপ। এইখানেই দ্বিতীয় অ্যাক্টের সমাপ্তি।

    ১০। তৃতীয় অ্যাক্টের শুরু হয় ইংরেজিতে ট্রান্সফারের দরখাস্তের ক্লোজ-আপ দিয়ে। ছবির শেষের ঘণ্টা বেজে গেছে। দর্শক অনুমান করতে শুরু করেছে এরপর কী ঘটতে চলেছে। কিন্তু রতন, যার উপরে এই ঘটনার প্রভাব ভয়ানক ভাবে পড়বে, সে কিছু জানে না। কাহিনির চরিত্রদের থেকে দর্শককে আলগা এগিয়ে রেখে দেওয়া, এটাও হলিউডের কাহিনি-প্রকরণের এক মান্য ধারা। এই ট্র্যাজেডিকে সত্যজিৎ গল্প-বলিয়ে হিসেবে এক্সপ্লয়েট করেন। পোস্টমাস্টার বইয়ের মধ্যে রাখা একটা হাতের লেখা কাগজ রতনের দিকে বাড়িয়ে দেয়। একটা নিতান্তই নিম্নমানের ছড়া, যাতে রতনের সেবার প্রশংসা ও তাকে তার বোনের মতন বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গোটা ছবিতে বাবুর থেকে এটাই রতনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। সে লাজুক হাসে। আমরা ভাবি অন্তিম ট্র্যাজেডির আগে এই বাড়তি আঘাতের কি প্রয়োজন ছিল? ছিল নাটকীয়তার নিয়ম মেনেই। তির ছোঁড়ার আগে ধনুকের ছিলা যেমন আরও একটু পেছনে টেনে ধরতে হয়, ছবিতে কাউকে অতর্কিতে মারার আগে সেই আঘাত রেজিস্টার করার জন্য আগে একবার হাত তোলা এবং তারপর দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় মারলে সেই আঘাতের অভিঘাত পর্দায় আরও জোরালো হয়। এটাকে আইজেনস্টাইন ব্যাখ্যা করেছেন ‘ডাবল ব্লো’ হিসেবে। প্রায় গাণিতিক ভাবে, রবীন্দ্রনাথের লেখা গল্প থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গিয়ে এর প্রয়োগ করেন সত্যজিৎ। 

    এরপর পোস্টমাস্টার রতনকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি যদি চলে যাই তোর খারাপ লাগবে না?’ এটা নিতান্তই নির্বোধের মতো প্রশ্ন। কিন্তু এই চরিত্রের নির্বুদ্ধিতার সঙ্গে আমরা আগেই পরিচিত হয়েছি, তার ফলে এটা একেবারেই বেখাপ্পা লাগে না। রতন সেসব বোঝে না। সে ভাবে, বাবুর বোধহয় কাজ করতে খারাপ লাগছে। বাবু হাসে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে সব ভুলে আয়না নিয়ে সে নিজের গালে হাত বোলাতে-বোলাতে তার দুর্দশা কল্পনা করতে থাকে। রতন ভাবে, বাবুর কাজ শেষ হয়নি, তাই সে কিছুতেই কাজ ছেড়ে চলে যেতে পারে না। বাবুর কুইনাইন খেতে ভাল লাগে না। রতন সেটা অবলীলায় চিবিয়ে খেয়ে ফেলে। একটা মিঠে আবহাওয়ায় হালকা চালে হতে থাকা এই দৃশ্যে দুই প্রধান চরিত্র সম্পূর্ণ দুটো আলাদা উদ্দেশ্য নিয়ে একে অপরের সঙ্গে কথা বলে যায়। 

    রবীন্দ্রনাথের গল্পের এই সময়কালটা কিঞ্চিৎ দীর্ঘ। বাবু বদলির আবেদন লিখে তার চিঠির উত্তরের অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে বসে থাকে। রতন বসে থাকে, কখন বাবু তাকে ডাকবে। তারপর একদিন বাবু রতনকে ডেকে বলে, ‘আমি কাল চলে যাচ্ছি।’ এই অপেক্ষা করে বসে থাকা স্বাভাবিক ভাবেই সিনেমার ক্ষেত্রে দেখানো এবং বোঝানো মুশকিল। তাই সিনেমার নিয়ম মেনে সত্যজিৎ গোটা বিষয়টাকে একটি দৃশ্যে ঘনিয়ে আনেন। 

    ১১। রবীন্দ্রনাথের গল্পে শেষ যত ঘনিয়ে আসে, গল্পের আবেগ তত ঘনীভূত হয়। রাতের বেলায় বাবু যখন রতনকে জানায় সে আগামীকাল সকালেই চলে যাবে, রতন থাকতে না পেরে তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘দাদাবাবু আমাকে তোমদের বাড়ি নিয়ে যাবে?’

    ‘পোস্টমাস্টার হাসিয়া কহিলেন, ‘সে কী করে হবে?’ ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব তাহা বালিকাকে বুঝানো আবশ্যক বোধ করলেন না।’

    এই দৃশ্যটি রবীন্দ্রনাথের গল্পের সবচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত। এটা ছবিতে রাখায় কোনও বাধা ছিল না। এবং রাখলে চলচ্চিত্রের শর্তের কোনও ক্ষতিও হত না। তারপরেও সত্যজিৎ এই দৃশ্যটি বর্জন করলেন। এই বর্জনের কারণ সিনেম্যাটিক নয়। তাঁর ছবির গন্তব্য ভিন্ন। তাই সিনেম্যাটিক ও মর্মস্পর্শী হলেও এই মুহূর্তটি তিনি এড়িয়ে গেলেন।

    সত্যজিতের গল্পে পোস্টমাস্টার কখনওই রতনকে তার যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্পষ্ট ভাবে জানায় না। সে কাপুরুষ। সে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চায়। সকালে কাজ করতে-করতে, নতুন আসা পোস্টমাস্টারের সঙ্গে নন্দবাবুর কথোপকথনে রতন বুঝতে পারে, তার নতুনবাবু আজ কাজ ছেড়ে চলে যাবে। সে অবাক বিস্ময়ে দেখে, তার জগৎ তার চোখের সামনে বদলে যাচ্ছে। এবং সেখানে তার কোনও ভূমিকা নেই। বাবুর যে গাঁয়ে থাকা পোষায় না, এই যুক্তিটাও সে এক অপরিচিত সহকর্মীর সাথে শেয়ার করে, কিন্তু রতনকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করে না। 

    যাওয়ার আগে নতুনবাবু অসমাপ্ত যুক্তাক্ষরের দায়িত্ব নতুন পোস্টমাস্টারের হাতে অর্পণ করে। তারপর রতনের বকশিশের টাকাটি তার হাতে দিতে গিয়ে সে শেষ মুহূর্তে থমকে যায়। 

    রবীন্দ্রনাথের গল্পে পোস্টমাস্টার রতনকে ডেকে অজুহাতের মতো করে জানায় যে, সে রতনকে কোনওদিন কিছু দেয়নি। পথখরচা বাদ দিয়ে তার মাস-মাইনের বাকি টাকাটা সে রতনের হাতে তুলে দিতে যায়। রতন তার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদে, ‘বাবু তোমার পায়ে পড়ি, আমায় কিছু দিয়ে যেতে হবে না, আমার জন্য কাউকে ভাবতে হবে না’ এই বলে কাঁদতে-কাঁদতে সেখান থেকে ছুটে পালিয়ে যায়।

    এই দৃশ্যটি সিনেমার নিরিখে দুর্বল। অবশ্যই অতিনাটকীয়। কিন্তু এখন সত্যজিৎ যে বর্জনগুলো করছেন তার কারণ, তাঁর গল্প রবীন্দ্রনাথ থেকে বাঁক নিয়ে অন্য একটা অভিমুখে ইতিমধ্যেই রওনা দিয়েছে। এই বাঁক সময়ের। রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকের শেষ দশকের ১২-১৩ বছরের এক বালিকার গল্প বলেন। যে উচ্চস্বরে কাঁদে, কেঁদে ছুটে পালিয়ে যায়, কিন্তু বাবু চলে যাওয়ার পরেও সারাদিন দাওয়ায় বসে থাকে এই আশায় যে, বাবু তাকে হয়তো-বা নেওয়ার জন্য ফিরে আসবে। বাবুও নৌকায় উঠে একবার ভাবে, ফিরে যাই, মেয়েটাকে নিয়ে আসি। তারপর দর্শনের আশ্রয় নেয়। 

    ‘জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে। ফিরিয়া ফল কি? পৃথিবীতে কে কাহার।’ 

    সত্যজিতের বালিকাটি বাবুর সাথে কোনও কথা বলে না। সে কুয়োতলায় একা কাঁদে। তারপর চোখের জল মুছে হাতে বালতি নিয়ে কাদামাখা পথের প্রান্ত থেকে হেঁটে আসে। বাবু পার্স বার করে একবার অস্ফুটে রতন বলে ডাকতে যায়। রতন কোনও কথা না বলে মাথা নিচু করে তার পাশ দিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। বাবু বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে থাকে। রতন কিছুদূর যায়, তারপর একবার থেমে, ক্ষণিকের জন্য পিছনে ফিরে তাকায়। তারপর হেঁটে চলে যায়। বাবুর ব্যর্থ দর্শনের মূর্ত প্রতীক হয়ে বিশু পাগলা আনমনে মাটির দিকে তাকিয়ে কাদামাখা পথের মধ্যে বসে থাকে।

    এই প্রত্যাখ্যান সত্যজিতের নিজস্ব প্রত্যয়। এবং এটি তাঁর সময়ের ফসলও বটে। এবং ঠিক এইখানে সিনেমার ভাষা এবং আঙ্গিকের বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গল্পটি সত্যজিৎ তাঁর নিজের করে নেন। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook