দাবা খেলায় পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাবটি প্রথম ভারতীয় হিসেবে জিতে এ-দেশের ক্রীড়াজগতের একজন কিংবদন্তী হয়ে গিয়েছেন। একইসঙ্গে একজন অত্যন্ত ভদ্রলোক ও তীক্ষ্ণ খেলোয়াড় কী করে হতে হয়, আনন্দ তার জীবন্ত উদাহরণ। ভারতীয় দাবার কেন্দ্রবিন্দু এখনও তিনিই। তাঁর ৫২তম জন্মদিনের আগে ডাকবাংলা.কম আনন্দ-এর বন্ধু, কলকাতার গৌরব এবং গ্র্যান্ডমাস্টার সূর্যশেখর গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা বলেছিল। জানতে চাওয়া হয়েছিল বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের সময় আনন্দ-এর ‘সেকেন্ড’ হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।
পর পর তিনটি বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে (২০০৮, ২০১০, ২০১২) আপনি বিশ্বনাথন আনন্দ-এর ‘সেকেন্ড’দের দলে ছিলেন। সুযোগটা পেয়ে কেমন লেগেছিল?
অসম্ভব আনন্দ হয়েছিল! বিশ্বাসই করতে পারিনি। ২০০৭ সালে, বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের এক বছর আগে, আমি আনন্দ-এর কাছ থেকে একটা ইমেল পেয়েছিলাম। তখনও বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপের কথা কিছু বলেনি, দুজন দাবা খেলোয়াড়ের মধ্যে এমনি কথা-চালাচালিই হয়েছিল। ইমেলগুলো পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে ভাবতাম, ও কী পরিমাণে বিশ্লেষণ করতে পারে। আমার তখন সাইবেরিয়ায় বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার কথা, আমি অনুরোধ করলাম, যদি ওর সঙ্গে কিছুদিন কাজ করতে পারি। আনন্দ সঙ্গে-সঙ্গে চেন্নাই চলে আসতে বলল। মাসখানেক ওর সঙ্গে কাজ করলাম।
তারপর, বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ভ্লাদিমির ক্র্যামনিক-এর সঙ্গে ম্যাচের আগে, হঠাৎই আনন্দ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে বলল, সেকেন্ড-এর দলে যোগ দিতে। আমি তো খুব অবাক, কারণ আমি ঠিক সেকেন্ড হওয়ার মতো খেলোয়াড় নই। বিনয় করছি না। আমার তখন যা ছিল, তা হল টিকে থাকার ক্ষমতা, আর নিজের খেলার কৌশলের ওপর ভরসা। এর বাইরে কোনও জ্ঞানই ছিল না। এক্কেবারে কিচ্ছু না। কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণও ছিল না, সোভিয়েত মডেলে খেলাও শিখিনি তখন। সেই সময় আমি সব খেলাতে একটাই ওপেনিং-এ খেলা শুরু করতাম। আমি যেরকম খেলতে পারি, তার বাইরে অন্য কোনওরকম খেলার ধরন সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা ছিল না। সেই কারণেই আনন্দ আমায় বাছাই করায়, খুব অবাক হয়েছিলাম। যদি আমি এরকম কোনও বড় প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম এবং চাইতাম কেউ সাহায্য করুক, তাহলে নিতাম এমন কাউকে, যার বিভিন্ন ধরনের দাবা খেলার অভিজ্ঞতা আছে। এমন কাউকে সুযোগ দিতাম না, যে কেবল এক ধরনের খেলাই জানে।
ফোনটা পেয়ে একেবারে শিহরিত হয়েছিলাম, আর একবাক্যে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিলাম।
আনন্দের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন?
জ্ঞানচক্ষু খোলার মতো। ওর সঙ্গে কাজ শুরু করার আগে আমি ভাবতাম আমি খুব পরিশ্রমী। তারপর বুঝলাম, সে-ধারণা কত ভুল। আমরা কাজ শুরু করতাম সকালে সাড়ে দশটা-এগারোটার সময়, আর রাত একটার আগে কোনওদিন শেষ করেছি বলে তো মনে পড়ে না। প্রত্যেক দিন এই রুটিন। সাতদিন বা দশদিন অন্তর একদিন বিশ্রাম।
সাধারণ মানুষজন আনন্দের নিষ্ঠা আর শৃঙ্খলা সম্পর্কে ধারণাই করতে পারবে না। আনন্দের প্রতিভা আর খেলার গতি ঈশ্বরদত্ত হলেও, সেটাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু ওর শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা এবং কাজের প্রতি নিবেদন— একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
আনন্দের একজন ‘সেকেন্ড’ হিসেবে কাজ করেছি ২০১২ সালে বরিস গেলফ্যান্ড-এর সঙ্গে ম্যাচ অবধি। ২০১৪-য় ম্যাগনাস কার্লসনের বিরুদ্ধে যে-ম্যাচ খেলেছিল, সেটার প্রস্তুতিপর্বে ওর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু চেন্নাইতে ম্যাচটা যখন হচ্ছিল, তখন আর ছিলাম না। ভালই হয়েছিল। কলকাতায় বসে ম্যাচটা যখন ওকে হারতে দেখছিলাম, এত কষ্ট হচ্ছিল! যদি একদম ম্যাচের জায়গায় হাজির থাকতাম, কত কষ্ট হত, ভাবতেই পারি না।
আপনি অনেকবার বলেছেন, বিশ্বনাথন আনন্দ কেবল ভারতের শ্রেষ্ঠ দাবা-খেলোয়াড়ই নন, তিনি ভারতের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ।
এটা বলার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত, দাবা হচ্ছে একা-খেলোয়াড়ের খেলা, যেটা, অলিম্পিয়াডের তথ্য অনুযায়ী, ১৮০টা দেশ খেলে। ভাবুন, কতগুলো দেশ খেলছে! দ্বিতীয়ত, আনন্দ যখন খেলা শুরু করেছিল, ওর সামনে কোনও রোল-মডেল ছিল না। ভারতে তখন এক বা দুজন ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার ছিলেন, আনন্দ হল প্রথম ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার। দাবার জগতে সব বড়-বড় রেকর্ডের ব্যাপারে ও বোধহয় প্রথম ভারতীয়। তার ওপর আবার ও উঠে এসেছে একেবারে সাধারণ একটা পরিবেশ থেকে, অথচ গোটা দাবার দুনিয়ার সম্রাট হয়েছে। এবং এটাও মনে রাখতে হবে, সেই সময় সোভিয়েতরা দাবার জগতে রাজত্ব করছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন দাবা-খেলোয়াড় তৈরির এক রকম কারখানা খুলে ফেলেছিল বললেই চলে। সেই কারখানা থেকে একের পর এক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বেরিয়ে আসত। ভারতের কথা তো বাদই দিন, এশিয়াতেও এমন কোনও দেশ ছিল না, যা ওদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারে। এবং তখনই আনন্দ-এর আবির্ভাব। যে পর পর সমস্ত রেকর্ড ভেঙে চলেছে। আচ্ছা বলুন তো, কতজন ক্রীড়াবিদ আছেন, পাঁচবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন? এ-ও মনে রাখতে হবে, এই প্রতিযোগিতায় কোনও বয়স, বা ওজন, বা কিচ্ছুই বেঁধে দেওয়া নেই। তার মানে সেখানে পুরো দাবা-বিশ্বটাই রয়েছে। আমি অন্য কোনও খেলার কোনও খেলোয়াড়ের প্রতিভাকে একটুও ছোট না করেই বোঝানোর চেষ্টা করছি, দাবার দুনিয়াটা কী সুবৃহৎ, কী ছড়ানো। এবং আনন্দ এই খেলার সমস্ত ফর্ম্যাটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমি তো অন্তত আর কোনও ভারতীয় খেলোয়াড়কে এমনটা পারতে দেখিনি।
আপনি বরাবর বলেন, আনন্দ শুধু খেলোয়াড়দের নয়, সকলেরই রোল-মডেল হওয়ার যোগ্য। কেন?
ওর বিনয় আর সারল্য দেখে অভিভূত হতে হয়। যখন কেউ একজন খেলোয়াড়ের ‘সেকেন্ড’-এর দলে থাকে, আমরা মুখে বলি সে ওই খেলোয়াড়ের সঙ্গে কাজ করছে, কিন্তু আসলে সে ‘তার হয়ে’ কিছু কাজ করে দিচ্ছে। কিন্তু আমি যতদিন ওর সঙ্গে (বা ওর হয়ে) খেলেছি, একবারের জন্যও আনন্দ আমায় বলেনি, ‘সূর্য, এই জিনিসটা যেন দু’দিনের মধ্যে (বা এক ঘণ্টার মধ্যে) হয়ে যায়।’ কোনও আদেশ ও দেয় না। কখনও না। তাছাড়া ওর মধ্যে এখনও প্রায় ছাত্রের মতো শেখার আগ্রহ। প্রথম-প্রথম, যখন আমায় বুঝিয়ে দিতে বলত, কেন আমি অমুক চালগুলো খেলতে বলছি, তখন আমার ভীষণ লজ্জা করত। আস্তে-আস্তে বুঝতে পেরেছি, একজন যত বড় খেলোয়াড় হয়, সে তত বেশি উপলব্ধি করে, এবং স্বীকারও করে, সে কত কম জানে।
এখন তো উনি খেলছেন কম, বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ধারাবিবরণী দিচ্ছেন। এছাড়া তরুণদের শেখাচ্ছেনও। আপনার মতে, নতুনরা ওঁর কাছ থেকে ঠিক কী পাবেন?
দাবা একটা প্রবল নেশা। আনন্দ যদি সরাসরি দাবা না-ও খেলে, ও দাবার সঙ্গে যুক্ত থাকবেই, সেটাই প্রত্যাশিত। আর, লোকের হয়তো ধারণা যে বিরাট বড় দাবা-খেলোয়াড়রা খুব গুরুগম্ভীর চাল নিয়ে চলেন। তা মোটেই নয়, তরুণরা আনন্দের কাছে সহজেই আসতে পারবে ও পরামর্শ চাইতে পারবে। এবং ওর উপস্থিতি যে ভারতীয় তরুণ খেলোয়াড়দের কাছে কতখানি, তা বলে বোঝানো যাবে না। প্রথমত, এখন নতুন খেলোয়াড়রা যা পাচ্ছে, তা আমাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল। আর. প্রজ্ঞানানন্দ-র কথাটাই ধরুন। ও বিশ্বনাথন আনন্দ চেস অ্যাকাডেমি-তে আছে, সেখানে ৪০জন কোচ, ওর ব্যক্তিগত কোচ হলেন রমেশবাবু। সব জুনিয়র এখন এইরকম সুবিধে পাচ্ছে। এক সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়নে এরকম বন্দোবস্ত ছিল, তখন সেখান থেকে নিয়মিত অসামান্য সব দাবা-খেলোয়াড় বেরিয়েছেন। ভারতের দাবার মানকেও অন্যস্তরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আনন্দের উপস্থিতিই মূল ব্যাপার।
আপনারা তো ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আনন্দ আপনার সম্পর্কে কথা বললে তাঁর স্বরে গর্বও বোঝা যায়। আপনি একটা কোনও ঘটনার কথা বলবেন, যখন আনন্দকে নিয়ে নতুন করে গর্ব হয়েছে?
ও যদি আমাকে নিয়ে একটুও গর্ব বোধ করে, সে তো আমার কাছে একটা অসামান্য প্রাপ্তি। তবে, ওর সঙ্গে এত সময় কাটিয়েছি, একটা নির্দিষ্ট ঘটনার কথা বলা শক্ত। একবার, বিশ্ব ব়্যাপিড ও ব্লিটজ চ্যাম্পিয়নশিপের আগে, আনন্দ আমায় জিজ্ঞেস করল, আমি কি ফ্র্যাঙ্কফার্ট-এ গিয়ে ওকে ট্রেনিং-এ আর অনুশীলনে সাহায্য করতে পারব? গেলাম, তখন এক সপ্তাহ ওখানে ছিলাম শুধু ও আর আমি। চ্যাম্পিয়নশিপের তিনদিন আগে, ওখান থেকে বার্লিনের ট্রেন ধরলাম, সেখানেই খেলাটা হবে। উদ্যোক্তাদের জানাইনি, তাই বার্লিন পৌঁছে ট্যাক্সি ধরলাম। ট্যাক্সিচালক প্রথমটা ইংরেজিতে কথা বলছিলেন, কিছুটা জার্মান মিশিয়ে, কিন্তু যেই তিনি বুঝতে পারলেন আনন্দ ঝরঝর করে জার্মান বলে, তখন আনন্দের সঙ্গে জার্মানে অনেক কিছু নিয়ে প্রচুর কথা বললেন। আমার আর আনন্দের হোটেল ছিল আলাদা, আনন্দকে নামিয়ে আমার সঙ্গে চালক ফের ইংরেজিতে কথা শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলেন আমি ভারতের কোথায় থাকি, এবং উত্তর শুনে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, ভারত সম্পর্কে আমি কিচ্ছু জানি না, শুধু একজন দাবা-খেলোয়াড়ের নাম জানি, ভিশি আনন্দ।’ শুনে আমি তো থ। বললাম, ‘কী বললেন?’ উনি বললেন, ‘আমার ভিশি আনন্দকে ভাল লাগে।’ আমি বললাম, ‘আরে, তাকেই তো আপনি একটু আগে নামালেন!’ উনি তখন উত্তেজিত হয়ে আনন্দের অমুক খেলার তমুক মুভ আর তমুক ভুল নিয়ে আলোচনা জুড়ে দিলেন। আমি ওঁকে খেলার জায়গাতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, কিন্তু সত্যিই একদিনও এসেছিলেন কি না, খোঁজ নিইনি। এই হল বিশ্বনাথন আনন্দের খ্যাতি এবং তার প্রতি লোকের শ্রদ্ধা।