লেখকের হাত না কামারের হাত!
আমি তখন বোধহয় ছয় বছরের। এক শীতের সকালবেলায় একা-একা বাগানে বেরিয়েছি। চারদিকে এক ঘন কুয়াশার ঘেরাটোপ। চারদিকে গভীর নির্জনতা। আমি বাগানের শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর হাঁটছি, একটু অন্যমনস্ক। মাদার গাছটার মগডাল থেকে একটা কোকিল হঠাৎ হু-হু করে ডেকে উঠল। কীভাবে সেই ডাক বর্ণনা করি! কোকিল তো কতই ডাকে, কিন্তু সেই শীতের কুয়াশায় আবছায়া সকালে, কাটিহারে, মাদারের গাছে বসে যে-কোকিলটা ডেকেছিল, সে পার্থিব কোনও কোকিলই নয়। সে এসেছিল এক রূপকথার মায়াবী জগৎ থেকে। তার কণ্ঠে ছিল এক গভীর রক্তক্ষরণ। সে যেন তার শেষ ডাক ডেকে নিচ্ছিল। আর সেই গহিন বিষণ্ণ ডাকে আমার আপাদমস্তক বারংবার শিহরিত হয়ে যাচ্ছিল, কাঁপতে-কাঁপতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিলাম আমি। মাথা ফাঁকা, আত্মপরিচয়হীন, চোখে জল। আমার অস্পষ্ট একটা অনুভব হল, আমার গা থেকে, আমার অস্তিত্ব থেকে একটা নির্মোক খসে পড়ে যাচ্ছে, ঠিক যেমন সাপ খোলস ছাড়ে। হাজার বছরে বোধহয় মাত্র একবার কোকিল ওইরকম ডাকে। আমার মনে হল, আমি আর সেই আগের আমি নেই। আমি বদলে গেছি। কে জানে, সেই বিবাগী কোকিলটা আমার শৈশব হরণ করে নিয়ে যেতে এসেছিল কি না! তবে এটা ঠিক যে, আমার ভিতরে সেই শীতভোরের আগন্তুক কোকিল কিছু একটা কারসাজি করে দিয়ে গিয়েছিল। আমি একটু বদলে গেলাম। অনেকক্ষণ ওই বাগানে শীতভোরে আত্মবিস্মৃত হয়ে বসে ছিলাম আমি।
আমার প্রথম বিষাদরোগ দেখা দেয় এই কাটিহারেই, আর ওই ছয় বছর বয়সেই। সাল-তারিখ তো মনে নেই, তবে কোনও একদিন, দিনের বেলা আমি বাড়ির সামনের রাস্তায় একা-একা খেলছিলাম। হঠাৎ কী একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল, আমার চারপাশটাকে চিনতে পারছি না তো! রাস্তাঘাট, গাছপালা, আকাশ কিছুই যেন আমার চেনা কোনও বস্তু নয়। এসব কী? আমি এ কোথায় কোন অচিনপুরে এসেছি! আমি তো এখানকার কেউ নই! আর সেই অ্যালিয়েন অনুভূতি এতই তীব্র যে, আমি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পাগলের মতো ছুটতে লাগলাম মায়ের কাছে। দৌড়ে গিয়ে মা’কে আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে বললাম, ‘মা, আমার মাথার মধ্যে কেমন যেন করছে! আমি যে কিছুই চিনতে পারছি না!’ মা ভয় পেয়ে আমাকে আঁকড়ে ধরে অনেক আদর করে বলল, ‘কী হয়েছে বাবা? কী হয়েছে?’ আমি যথাসাধ্য মা’কে বুঝিয়ে বললাম। কিন্ত এ জিনিস যার হয়নি, তার বুঝবার কথা নয়।
আমার বিষাদরোগের প্রথম আক্রমণ দু’চার মিনিটের বেশি স্থায়ী হয়নি। কিন্তু শুরুটা ওইরকম আকস্মিক ভাবেই হয়েছিল। চারদিক এবং সব বস্তুপুঞ্জ হঠাৎই অচেনা আর অদ্ভুত বলে মনে হওয়া, আমাকে আমূল আতঙ্কিত করে দিয়েছিল। কেমন করে যেন বুঝতে পেরেছিলাম, এই যে শুরু হল, এখানেই শেষ হবে না। হলও না। কিছুদিনের মধ্যেই আবার। এবং অনতিপরে আবার। আর যতবারই হয়, ততবারই আমার দৌড়ে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরা। মা হয়তো এই বিপন্নতার উদ্ধারের পথ জানত না, কিন্তু মা তো এক পরম আশ্রয়! মা’কে কটকটে করে আঁকড়ে ধরলে আমার ওই অবস্থাটা কেটেও যেত। কিন্তু ওই কয়েক মিনিট ছিল বিভীষিকার মতো। আমার তখন দুটো বিপদ। নিশুত রাতে মাঝে মাঝে সেই মেমসাহেবের আগমন, আর ওই অদ্ভুত বিষাদরোগ। কাটিহার আমাকে অনেক কিছুই দিয়েছে, অনেক নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন ভয়, নতুন অনুভূতি। আর সেইজন্যই কাটিহারের অবস্থানকালটি আমি এখনও চলচ্চিত্রের মতো দেখতে পাই। এত স্পষ্ট স্মৃতি আর কোনও জায়গারই নেই আমার।
এরপর এক অদ্ভুত ব্যাপার শুরু হল। ছেলের চিন্তায় মা এত উচাটন হয়ে পড়ল যে, তখন আমাদের বাড়িতে সাধুসন্ত বা জ্যোতিষী এলেই মা আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে হাজির করত। বলত, ‘বাবা, আমার ছেলেটার মাথার মধ্যে কী যেন হয়। ওর একটা উপায় করে দিন।’ জটাজুটধারী এক বিহারী সাধু এসেছিলেন। তিনি সব শুনে নিদান দিলেন, ‘এই ছেলের ওপর শনির দৃষ্টি আছে। প্রতি শনিবার একটা আটার লুচি সর্ষের তেলে ভাজতে হবে, তারপর সেই লুচি এই ছেলে যেন বাঁ-হাতে ধরে একটা কালো কুকুরকে খাওয়ায়।’ ব্যাস, মা লেগে পড়ল। আমাদের বাড়ির ফাইফরমাশ খাটত টুনটুনিয়া নামে একটা ছেলে। মা তাকে প্রতি শনিবার কালো কুকুর ধরে আনত পাঠাত। টুনটুনিয়া একটা নারকোলের দড়ি নিয়ে বেরিয়ে অনিচ্ছুক এবং প্রতিবাদী এক কালো কুকুরকে বেঁধে নিয়ে আসত। কিন্তু সেই কুকুর কিছুতেই লুচি খেতে চাইত না, কেঁউ-কেঁউ করে মুক্তি চাইত আর টানাহ্যাঁচড়া করতে থাকত। সে এক হুলুস্থুলু অবস্থা।
আর আসতেন দাতাবাবা। পূর্ণিয়ার দাতাবাবার বিশেষ খ্যাতি ছিল ফকির দরবেশ হিসেবে। তিনি নাকি অনেক অলৌকিক কাণ্ড ঘটিয়েছেন। তবে বিশাল মোটাসোটা চেহারার দাতাবাবাকে আমাদের খারাপ লাগত না। সর্বদাই হাসিমুখ, দেখলেই ভারি প্রসন্ন গলায় ডাকতেন, ‘আও বাবা।’ কাছে গিয়ে প্রণাম করলেই মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিতেন। মায়ের হেঁসেলে মুরগি ঢুকত না, দাতাবাবা এলে পাঁচু শেখ বাইরে আলাদা উনুন জ্বেলে মুরগি রান্না করত। সঙ্গে পরোটা। বিশাল খাইয়ে পুরুষ ছিলেন দাতাবাবা। অতি সুগন্ধি জর্দা-সহ পান খেতেন অবিরল। গন্ধে চারদিক ম-ম করত। আমার বাবা আবার তাঁর বেশ ভক্ত ছিলেন। কিন্তু আমার সমস্যা যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল।
আর এসেছিলেন আমেরিকাফেরত এক গেরুয়াধারী বাঙালি সন্ন্যাসী। ভারি ফর্সা, সুপুরুষ, মাঝবয়সি এক প্রশান্ত বদনের মানুষ। তিনি আমার কররেখা দেখে মা’কে বললেন, ‘মা, আপনার ছেলে এক স্বভাব-দার্শনিক। একে সর্বদা সবুজের মধ্যে রাখবেন, সবুজ জিনিস বেশি খাওয়াবেন, সবুজ পোশাক পরাবেন। আর যখন বিয়ে দেবেন, তখন দেখবেন এর বউ যেন সুন্দরী হয়। কুৎসিত মেয়ের সঙ্গে যেন এর বিয়ে না হয়। তাহলেই সর্বনাশ!’
কথাগুলো তিনি আমার সামনেই বলেছিলেন, রাখঢাক না করেই। তারপর থেকে মা আমার সব জামা-প্যান্ট রঞ্জক সাবানে ফেলে সবুজ করে ফেলল। আমার খাওয়ার পাতে শাকপাতার বাহুল্য ঘটল। লুডো খেলতে বসেছি, মা ধেয়ে এসে বলল, ‘ওরে রুনু, তুই সবুজ ঘরটা নে।’
কিন্তু এতসব করেও তেমন লাভ কিছু হয়নি। তবে আমাদের বাড়িতে সাধুসজ্জনদের আনাগোনা বরাবর ছিল। জ্যোতিষীও আসত মেলা। আর বাবার সঙ্গীতপ্রীতির জন্য মাঝে মাঝে বাড়িতে ছোটখাটো জলসা বসত। তাতে সেই আমলের একজন মাঝারি মাপের ওস্তাদ আসতেন। রাগপ্রধান আর ঠুংরিই বেশি হত। একবার এলেন সেকালের বিখ্যাত নায়ক-গায়ক রবীন মজুমদার। গান তো গাইলেনই, নৈশাহারও করলেন। রবীন মজুমদারের মহিমা বুঝবার মতো বয়স তখন আমার নয়।
কে যেন একদিন আমাকে নিয়ে গিয়ে মহেশ্বরী স্কুলে ভর্তি করে দিল, ক্লাস টু-তে। মহেশ্বরী তখন মাইনর স্কুল। পাকা দালান যেমন আছে, তেমনি বাঁশের বেড়া দেওয়া টিনের চালের ঘরও আছে। স্কুল ব্যাপারটাই আমার পছন্দসই জিনিস নয়। তাছাড়া আমি অতিশয় দুষ্টবুদ্ধিসম্পন্ন ছেলে। কাজেই স্কুলে ঢুকেই আমি হয়ে গেলাম ব্যাকবেঞ্চার। আর ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু আর বদমাশ ছেলেদের সঙ্গে আমার লহমায় ভাব হয়ে গেল। তাদের মধ্যে একজন ছিল সুবল, যে প্রায়ই ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার জন্য ক্লাসের বেড়া ফাঁক করে পালাত। বাড়িতে আমার আর দিদির প্রাইভেট টিউটর একজন ছিলেন। তাঁর কাছে আমি মন দিয়েই পড়তাম। কিন্ত স্কুলে গেলে পড়া বলতাম না ইচ্ছে করেই, কারণ পড়া পারলে ভাল ছেলে হয়ে যাব যে! ভাল ছেলে হওয়াটা তখন আমার কাছে কাপুরুষজনোচিত কাজ। ফলে প্রচুর বেত খেতে হত, তাছাড়া ছিল বেঞ্চের ওপর দাঁড়ানো বা নীলডাউন হয়ে থাকা। লাগাতার বেত খেয়ে আমার দু’হাত প্রতিদিন রক্তাভ হয়ে থাকত। জ্বালাও করত, কিন্তু গায়ে মাখতাম না। আর এর ফলে আমার হাতের তেলো এত শক্ত হয়ে গেল যে, আজও আমার হাত স্পর্শ করলে লোকে অবাক হয়, এ কি লেখকের হাত না কামারের হাত! তখন আমি মারপিট করতে শিখছি। স্কুলে এবং রাস্তাঘাটে বিস্তর মারপিটে জড়িয়ে পড়তাম আমি। বাড়িতে অবশ্য কেউ টের পেত না। মা আমার জন্য স্কুলে টিফিন পাঠাত। সেটা আমার পক্ষে ছিল বেজায় লজ্জার ব্যাপার। সহপাঠীরা বেশির ভাগই গরিবগুর্বো পরিবারের, টিফিন বলতে তারা হয়তো দু’পয়সার বাদামভাজা বা ঘুপচুপ খেত। ঘুপচুপ আসলে ফুচকার সস্তা সংস্করণ, সেই ফুচকার গর্ভে তেঁতুলজল ছাড়া আর কোনও মালমশলা থাকত না, এক পয়সায় তিনটে পাওয়া যেত। আর আমার বাড়ি থেকে কাজের লোক টিফিনের সময় টোস্ট বা লুচি এবং ঘোল নিয়ে আসত, এবং তা লুকিয়ে খেতে গিয়ে নাজেহাল হতে হত। তাই আমি মায়ের হাতে-পায়ে ধরে এই ব্যবস্থা বন্ধ করি।
তখন কাটিহারে প্রচুর বাঙালির বাস। স্কুলে বেশির ভাগ ছেলেই বাঙালি। দু’চারজন বিহারী ছিল, তারাও আবার বাংলাতেই কথা কইত। স্কুলে আমাদের প্রার্থনাসঙ্গীত ছিল ‘জয়জগদীশহরে’। আর মনে পড়ে স্কুলের ফাংশনে কী একটা দুঃখের নাটক হত, অভিনয় করত উঁচু ক্লাসের ছেলেরা, আর তাতে একটা গান ছিল ‘দুঃখে যাদের জীবন গড়া, তাদের আবার দুঃখ কী রে!’
সেই স্কুলে সবচেয়ে রাগী আর মারকুটে মাস্টারমশাই ছিলেন ছোট নাগবাবু। ভাগ্যক্রমে তিনি আমাদের ক্লাসে পড়াতেন না। তা বলে আমার রেহাই ছিল না। আমাকে পেটানোর জন্য মিশ্রজী ছিলেন, বড় নাগবাবু ছিলেন, আরও অনেকেই ছিলেন।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র