ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ভবদীয়: পর্ব ৪


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (December 10, 2021)
     

    পর্ব ৩

    ক্রিসমাসের সপ্তাহ দুয়েক আগে, পরিবারের সদস্যরা ভিজিটার্স পার্লারে দেখতে এসেছিল সিস্টার লুসিয়াকে। ছোট্ট খোপের মতো কাঠের ঘর, নিরাভরণ, শুধু দেওয়ালে একটি সোনালি বাইজেন্টাইন আইকন টাঙানো। মায়ের আদরিণী কন্যা লুসিয়া, মা কিছু খাবার তৈরি করে এনেছিলেন। পরে সিস্টার লুসিয়া সিনিয়র-জুনিয়র-নভিস-পস্টুল্যান্ট সব্বাইকে সেসব সুখাদ্য ভাগ করে দিলেন। শীতকালে প্রতি বছর পিকনিক হয় ওঁদের, কোথায় আর, এই তো গির্জার উঁচু পাঁচিল তোলা ছাদে। এবারও সিস্টাররা বায়না করছেন পিকনিক হওয়া চাই। সকাল চারটেয় উঠে চ্যাপেলে গিয়ে প্রার্থনা, ধ্যান, ছ’টার ‘মাস’, সম্মিলিত প্রার্থনা, ময়দা জলে গুলে পাতলা ‘হোস্ট’ তৈরি, পৌনে বারোটার ভেতর দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ। সিয়েস্তার আর রিক্রিয়েশনের সময়টুকু বাদ দিলে আর যা বাকি থাকে, তা ক্রমাগত প্রার্থনা আর সেই প্রার্থনার জন্য স্বাভাবিক সুস্থতা রাখতে যা যা করণীয়। তাঁরা যে পারপিচুয়াল অ্যাডোরেশনের সন্ন্যাসিনী, বিরতি তো নেই! তবে মানুষের মন তো, একটু আনন্দ তো সে চায়। ওঁরা কেউ চাপাতি বানাতে-বানাতে, কেউ পশম বুনতে-বুনতে পিকনিকের প্ল্যানটা করেই ফেললেন মাদারের সাথে। সিস্টার সুখলতা নিয়মবহির্ভূত ভাবে সিস্টার লুসিয়ার বিছানায় গেছিলেন, সেটা নিয়ে ক’দিন আশ্রমে বেশ অশান্তি হয়েছে। এখন আবার সবার মুখ প্রশান্ত। 

    এই শীতকালে ওয়াজ বাড়ে। গ্রামের লোকের হাতে ধানচালের পয়সা আসে, পয়সা এলেই ঈশ্বরভাবনা চাগিয়ে ওঠে। বাইরে মাঠে আব্দুহুদের সাথে ফুটবল খেলে এসেছে মোজেস, এক হাঁটু ধুলো। মোজেসকে হি-হি শীতে কাঁপতে-কাঁপতে সাবান রগড়ে স্নান করিয়ে দিতে-দিতে রেবতী কান পাতল— ‘বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে আমার নবী এরশাদ করলেন ‘তারাকতু ফীকুম আমরাইনি লান তাদ্বিল্লু মা তামাস্‌সাকতুম বিহিল্লাহ কিতাবাল্লাহি ওয়া সুন্নাতা রাসুলিহী’… অর্থাৎ কি না হে মানুষ! (হাঁক) তুমি কোরআন হাদিস আঁকড়াইয়া রাখিও, তাইলে পথভ্রষ্ট হবা না। অথচ আমার ‘আহলে বয়াত’ ছেড়ে, কিতাবাল্লাহ ছেড়ে বান্দা তুমি কাফেরদের দিকে চলে গেলে (কান্না)… তুমি কি আমার পোতি ইনসাফ কল্লে? (হাঁক) তুমি কি নিজের পোতি ইনসাফ কল্লে? (হাঁক)। এই যে এরা বিদেশি সাহায্যের পাহাড়ের উপর বসিয়া তুমাদের কিতাবুল মুকাদ্দস পড়ায়, ইঞ্জীলশরীফের কথা বলে ভাঁওতা দেয়! হে উম্মতে মুহাম্মদী (হাঁক)! তুমাদের আসমানী কিতাব দিয়েছি আল কুরআন যার যের-যবর পর্যন্ত চেঞ্জ হবে না এই গ্যারান্টি আমি দিয়েছি অথচ তোমরা পাদ্রীদের লেখা কিতাব পড়ে জাহান্নামের রাস্তায় চলে গেলে… জাহান্নামীর সংখ্যা বাড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে এই গির্জা। এই পাদ্রিরা এই মিশনারিরা আমাদের পবিত্র মাটিতে শয়তানের কারখানা চালু রেখেছে। আসমানী কিতাব ইঞ্জীলের নাম করে এরা খ্রিস্টান চার্চগুলি ইসা মসীহ আর মাতা মরিয়মের প্রতিমা দিয়ে সাজায়েছে।’ মোজেসের গায়ে সাবানের ফেনা শুকিয়ে আসছিল, সে তাড়া দেয়। রেবতী তাড়াহুড়োয় দুই মগ জল ঢেলে ধুইয়ে দেয় তাকে। মোজেসের গা গামছায় মুড়িয়ে তাকে ঘরে এনে সবেগে মুছতে থাকে। আর শোনে— ‘বলেন, এই কী সুবিচার আপনাদের? এই কী ইনসাফ আপনাদের? চোখ খুলে দেখেন— এরা তাওহীদ ও শরিয়ত পরিপন্থী। এরা ব্যভিচারী। এরা শেরকী। এরা গোটা দুনিয়াকে জাহান্নামের আগুনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আপনাদেরও চিরস্থায়ী জাহান্নামী বানিয়ে দিচ্ছে অথচ এতটুক ফিকির করছেন না! আপনার ইচ্ছা করে না, এই ইবলিসের কারখানা বন্ধ করে তালা লাগায়ে দিই? এদেরকে ঈমানের আগুনে পুড়ায়ে দিই?’ আবার আগুন! বছর চল্লিশেক আগে গির্জার চত্বরে সদলবলে এসেছিল অতুলবাবুর বড়দা প্রতুলবাবু, লোকে বলত সে নকশাল হয়ে গেছে। প্রতুলবাবু খুব চিৎকার করে জানিয়ে গেছিল, চাষাদের জমি কেড়ে নিয়ে এই গির্জা হয়েছে, এই চাষের জমি ভুখা নাঙ্গা মানুষগুলিকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। নইলে দলেবলে এসে অচিরেই ওরা ওদের ন্যায্য অধিকার কেড়ে নেবে। রাতে গির্জার ভেস্টিবুলে আগুন দিয়েছিল কারা এসে। তখন কাঁটামেহেদির বেড়া মুড়িয়ে দেওয়াল তোলা হল। প্রতুলবাবুকে পরে পুলিশ নিয়ে গেছিল শোনা যায়, পুলিশ-হেফাজতেই ওর মৃত্যু হয়মাদারের কাছে এসে উদ্বেগের মুখে আজ অনেক কথা বলে ফেলছিল রেবতী। এই নিত্য-উপদ্রব তো সে বহুকাল দেখছেই। হলুদ আলোয় মাদারের মুখে কোনও রেখা নেই, যেন হলুদ রেণু গুলে মাখিয়ে রেখে গেছে কেউ তাঁর মুখ। শুধু মৃদু গলায় বললেন, ‘রেবতী, পাতকুয়াটা তুমি বন্ধ করেছিলে তো?’ 

    রেবতী চমকে উঠে জবাব করল— ‘বন্ধ আছে। রুপবান টিন দিয়া চাহিছিনু আগত। পরে সিমেন্ট দিয়া পাকা করি দিছিনু।’

    পরিমল প্রতি বছর খেজুর গাছটায় বেথেলহেমের তারা টাঙায়

    মাদার বিমনা, হাতের আঙুল দুইটিতে শালটায় চিমটি দিয়ে ভাঁজ দিচ্ছেন, যেন পুলি বানাবেন, সাধু ফ্রান্সিস বলে গেছেন, শতবার অন্যমনস্ক হলে শতবার লোকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে— সেটাই সর্বোৎকৃষ্ট প্রার্থনা। অবশেষে ধীরে ধীরে বললেন— ‘ক্রোধ লুসিফারের গুণ, প্রতিশোধ নেবার তাগিদ লুসিফারের গুণ। শত্রুকেও ক্ষমা করে দিতে হবে, তার অপরাধের ভার নিতে হবে। যে-ভার নিয়েছিলেন সেই যিশু, যিনি সশরীরে স্বর্গে গেছেন।’ আশ্রমের মেয়েরা আজকাল ছাঁচে ঢেলে লাল-সবুজ-ক্রিমরঙা মোমবাতি বানাচ্ছে, জরির ফুল বানাচ্ছে, ক্রিসমাস আসছে সামনে। টফি আর কেকের গন্ধ আধা-গেঁয়ো বাতাসে। মসজিদের ওয়াজ চার দিগন্তের দালানে-দালানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— ‘শীতকাল মোমিনের বসন্ত। কেন বলেন? কেননা তা বরকত বয়ে আনে! বড় রাত কি খালি বিবি নিয়া বিছানা গরম করার? নাআআ, বায়হাকি শরীফ মোতাবেক, তা ‘কিয়ামুল লাইল’এর জন্য, রাতে তাহাজ্জুদ নামাজের জন্য। আর ছুটো দিনে রোজা রাখতে সোজা! আলহামদুলিল্লাহ!’ এইসব শোরগোলের ভেতরই মাদার রেবতীর দিকে পরিষ্কার চোখে তাকালেন, কাঁটার মতো দৃষ্টি। একটি রেখার দুই বিপরীত প্রান্তবিন্দুর মতো ওরা তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত একে অপরের দিকে, প্রিয় গির্জা আর আশ্রমকে সকল ঝঞ্ঝ্বা থেকে বাঁচিয়ে রাখবার একটি নিঃশব্দ শপথ নিল যেন দুই অসম মিত্র। ওই এক মুহূর্তই। পরিমল প্রতি বছর খেজুর গাছটায় বেথেলহেমের তারা টাঙায়, ঘুড়ির কাগজের ভিতর আলো জ্বেলে তৈরি করা তারা; মাদার সেইসবের তদারকি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, রেবতীকে হুকুম করলেন, গির্জায় ঢুকবার পথে বাঁদরলাঠি গাছের সারিগুলিতে টুনিবাতি ঝোলানো চাই, যেন স্বর্গে ঢুকবার পথে আলোর গাছ।  

    রেবতীকে বিদায় করে দিয়ে মাদার সুপিরিয়র বাগানে নামলেন, ওঁর মাথায় বিদ্যুৎ খেলছে। তিনি রেবতীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন খ্রিস্টবাণী— ভাল-মন্দ সকলের ওপর ঈশ্বরের সূর্যালোক বর্ষিত হয়, পাপী-পুণ্যবান সকলের ওপর বৃষ্টি বর্ষিত হয়। এই আলো, এই বৃষ্টি কি সিস্টার লুসিলকে ধরে নিয়ে যাওয়া লোকগুলোর জন্যেও ছিল?  সিস্টার লুসিল কি ক্ষমা করতে পেরেছিলেন তাঁর নির্যাতকদের? মঠের নিঃসীম স্তব্ধতায় তিনি নির্বিঘ্নে জন্ম দিয়েছিলেন একটি শিশুর, সেই শিশু বুকে ‘সেন্ট অ্যান্থনি’র একটা সোনালি ধুকধুকি ঝুলিয়ে চলে গেছিল শ্বেতাঙ্গ বাপ-মায়ের কোলে করে। সিস্টার লুসিল বেশিদিন বাঁচেননি, ছোট্ট চ্যাপেলটিতেই পড়ে রইতেন, বিড়বিড় করতেন ছড়া, কারো সাথে কথা বলতেন না! মাদার জিজ্ঞেস করেছিলেন তাঁদের তৎকালীন মাদারকে, ‘সিস্টার লুসিল কি পাগল?’ আর তিনি জবাবে বলেছিলেন ‘কাউকে ‘পাগল’ ডাকতে থাকলে তার অবচেতন মন বাতিঘরের আলোর মতো শব্দটার ওপর আছড়ে পড়ে, এই শব্দ ব্যবহার করতে নেই।’ ওই মোজেসের মতো করেই মাদারের সেদিন মনে হয়েছিল, কেন আমরা গোলাগুলির শব্দ শুরু হবার পরেও মনাস্টারিতে থেকে গেলাম মাদার? কেন আপনি বললেন প্রার্থনার শক্তিতে সব অশুভ দূর হবে? গোটা গ্রাম পালিয়ে গেল, আমরা পঁচিশজন কেন অবিরত প্রার্থনা করতে থেকে গেলাম? সেদিনের মাদার আজকের মাদারকে কী বলতেন তা তিনি জানেন, মনে করিয়ে দিতেন ওঁরা যে পারপেচুয়াল অ্যাডোরেশনের সন্ন্যাসিনী, চব্বিশ ঘণ্টা, সপ্তাহের সাত দিন, বছরের ৩৬৫ দিন ওঁরা আরাধনা করে যাবেন, তাই-ই নিয়ম। ঝড়-ঝঞ্ঝা আসবে, মারী-মড়ক আসবে, মহাযুদ্ধ লাগবে বাইরের পৃথিবীতে, কিন্তু মঠের আরাধনা চলবেই, চলেছেই। কত লক্ষ-লক্ষ মানুষের রোগমুক্তি আর দুর্দশা লাঘবের জন্য প্রার্থনা করেছেন ওঁরা। প্রার্থনাই আরোগ্যের পথ। একদিন সেই ‘কুহর’ পাখির মতো ফড়ফড়িয়ে আত্মা উড়ে গেল সিস্টার লুসিলের। সিস্টার লুসিল মারা যাবার পরে মাদার গান লিখেছিলেন একটা— ‘এ পৃথিবীর মায়া ছেড়ে আজিকে গেল যে জন, ক্ষমা করো তারে সদাপ্রভু সে যে মোদের আপনজন।’

    গ্রামে-গ্রামে প্রভুর পুত্রের জন্মবার্তা রটে গেল ক্রমে, প্রতি ডিসেম্বরের শুরুতেই যেমন যায়, কীর্তন শুরু হয়ে যাবে… ‘শুভদিন এলো রে, ভবে হলো সুপ্রচার/ ঈশনন্দন যিশু ভবে হলেন অবতার’। টিনের বাক্স হাতে-গলায় কীর্তনের দল পাড়ার ঘরে-ঘরে যাবে, কেউ টাকা দেবে, কেউ বসিয়ে দুটো পিঠা খাওয়াবে। পিঠা তৈরির ওস্তাদ খ্রিস্টান মেয়েরা দিন-রাত এ-সময় হাত চালায়, তাদের হাতের ভেজা পিঠার মতোই ভক্তিরসে ফুলে উঠবে সকলের মন, এর কতটা ভক্তি আর কতটা আনন্দ কেউ তার তৌল করবে না। গির্জায় খড়ের কুঁড়েঘর গড়া হবে, তাতে মাটির পুত্তলি যিশু-মেরি-যোসেফ আর ব্যগ্র গরু-ভেড়ার দল, যিশুর জন্মস্থান সেই গোশালঘর যত্ন করে আলো দিয়ে সাজানো হবে। বড়দিনের রাতে মাটির হাঁড়িতে করে বারুদ রেখে উঠানে বাজি পোড়াবে বাজিকররা। আর একটু বাংলা মদ, উৎসবের লালিমা। এই তো দেখে এসেছে রেবতী, দেখে এসেছে সুনীল।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook