হুমকিটা এল বিশপ বার্নার্ড ডি কস্তার মোবাইলে। এসএমএস আকারে। পরদিন স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তা এলেন কয়েকজন পুলিশ-সহ। সকালের প্রাতরাশ করলেন ওঁরা, পাউরুটি-কলা-ডিম-ভাজি আর চা-কফি। আশ্বস্ত করলেন আশ্রমের মাদারকেও, দু’তিনজন পুলিশ অবশ্যই স্থায়ীভাবে গির্জার প্রহরায় মোতায়েন করা থাকবে। তবে খ্রিস্টজাগের অনুষ্ঠান রাতে না হওয়াটাই তাঁদের জন্য মঙ্গল, সেটা জানালেন পুলিশের বড় অফিসার রকিবুল আলম। গির্জায় জমায়েত হল ‘জাগরণী’ আর ‘ফাতেমা রানি’ ধর্মপল্লীর সজ্জনদের, ‘কলকাকলি’ মাইনর স্কুল আর ‘ধানজোড়’ প্রায়োরি স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। সাব্যস্ত হল বড়দিনের আগের রাত্রির তাবত আনুষ্ঠানিকতা পালিত হবে সেদিনের বিকেলে, দস্তুরমাফিক রাত্রিবেলা নয়। আর মোমবাতি হাতে আলোর মিছিল হবে না। মাদার সুপিরিয়রের চোখে না কি কাঁটা-কম্পাস আছে, বলে সিস্টাররা, ইস্কুলের শিক্ষিকারাও বলে, একবার তাকিয়েই পরিমাপ করে নিতে পারেন… ওজন করে নিতে পারেন মানুষের, ভিতরটা অব্দি খুঁচিয়ে দেখে ফেলেন। মাদার যখন সিস্টারদের অভয় দিলেন, স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিক সহায়তার কথা বললেন, স্বেচ্ছাসেবকদের পাহারার কথা বললেন, আশ্রমের মেয়েরা বিশ্বাস করল যে, তারা নিরাপদ। তারা ক্ষুণ্ণমনে বিকেলবেলা খ্রিস্টজাগের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন। রেবতী চলল গাছগুলো থেকে টুনিবাতির ঝালর নামাতে। রাতে কেউ না এলে কে আর দেখবে এই আলোকসজ্জা! এ-রাতের খ্রিস্টজাগের ঘণ্টা বাজাত তার বাপ, কতকাল আগে। ক্যারল গাইত তারা ভক্তিভরে। সিস্টারদের ক্ষার কাচবার জন্যে কলাগাছের ছাল পোড়াত সুনীল সরেন; বগি থালার আকারের পাঁপড় ভাজা হত বড়বাজারের মুখে, সিস্টাররা চায়ের সাথে খাবেন বলে মাঝে মাঝে খবরের কাগজে মুড়িয়ে পাঁপড় আনত সুনীল। সেই তো বাপের সাথে ঘুরে-ঘুরে গির্জা আর আশ্রমের এই জীবনকে কেন্দ্র করেই রেবতীর জীবন আপূর্যমান। ঘোলা চোখে অন্যমনে সে বসে থাকে বাঁধাকপি ক্ষেতের পাশে। আগে শুধু লোকে ফলমূল চুরি করতেই ঢুকত… কেমন বদলে যাচ্ছে এই দেওয়ালের বাইরের জগৎ, এত দ্রুত যে, দেওয়ালের ভিতরটাকেও বদলাতে হচ্ছে। কার ভেলকি? কার কারসাজি? মোজেস একটা পেলাস্টিকের মুখোশ পরে রোদে দেওয়া মশলা পাহারা দিচ্ছিল, হাতে গুলতি-ছররা, বাপের মুখভাব সুবিধের নয় বলে সেও উচ্চবাচ্য করে না কোনও। বাতাসে কান পাতলে আবারও শোনা যায় নিরিবিলিতে কেবল ভোমরার গুঞ্জন। ইতিউতি দু’চারটে ক্লান্ত কাকের ডাক।
বড়দিন ধুমধাম করে কেটে গেল, গির্জা আর আশ্রম ঘুড়ির কাগজের রঙিন শিকলি দিয়ে সাজানো হল, সুধীজনকে আপ্যায়ন করা হল গুড়ের পুলি আর পিঠা দিয়ে, জরি মুড়ে দেওয়া হল ক্রিসমাস ট্রি-কে মানে ঝাউগাছকে, শিশুরা পেল উপহার। এর একমাস পর পিকনিকও ছোট্ট করে হয়ে গেল আশ্রমের ছাদে, লোকচক্ষুর অন্তরালে সে এক আশ্চর্য পৃথিবীতে। বিশেষ যত্ন করে সুখলতারা খাবার তৈরি করলেন, বাগানের লেবু দিয়ে লেবুর কেক। সিস্টার সিসিলিয়া করলেন মালাবারের পরোটা। এমনিতে দারিদ্রের প্রতিজ্ঞাও সন্ন্যাসিনীদের একটি প্রতিজ্ঞা, ফলে সারা বছর অসচ্ছল মানুষের মতো করে খেতে হয় ওঁদের। অনেকদিন পর প্রফুল্ল দেখাচ্ছিল সবাইকে। মাদার গল্প করছিলেন বিলেতি সিস্টার এমিলির, যিনি পাঁউরুটি ফলের রসে ভিজিয়ে সামার পুডিং বানাতেন। চুরি করে একবার সেটা খেয়ে ফেলেছিলেন সিস্টার দীপশিখা। বড়রা খাবারদাবারের পরে চা-কফি খেলেন, ছোটরা কোকো। সামান্য নাচ-গান হল নিজেদের মতো করে, দর্শক বলতে নিজেরাই। মোজেসের সাথে গির্জার ছাদ থেকে ঘুড়ি ওড়ালেন নভিসরা। অতুলবাবুর হোমিওপ্যাথির কল্যাণে মোজেসের ভোরবেলার কান্নাকাটি কমেছে। স্বাস্থ্যও ভাল হয়েছে আগের চেয়ে। মাথার ওপর তকতকে নীল আকাশে বিকেলের মেঘের গোলাপি-গোলাপি পালক। প্রসন্ন চোখে তাকিয়ে দেখলেন মাদার, ঈশ্বরের অনুগৃহীত ভক্তদের মনেও আজ প্রশান্তি।
শর্মিলারা গির্জায় এল পরের রবিবার, গায়ে ঝলঝলে নাইলনের শাড়ি, পেট উঁচু হয়ে উঠছে। মাস-এর পরেও গির্জাচত্বরে অনেকক্ষণ রইল ওরা, এই যে পশ্চিমে শিশুদের এত হিতকথা শোনানো হয় না, পুবে হয়, এইসব আলাপ। ‘সুশীল বালক’ বানাবার মতো করে হিতোপদেশ নয়, আরেক রকম করে দেওয়া উচিত… যেখানে শিশু নির্মলতা, শুভ ইত্যাজি জানবে, কাম্য হিসেবে শিখবে, ত্যাগের মহিমা যে সত্যিই আছে তা চাক্ষুষ দেখবে। এইসব বলতে-বলতে শর্মিলা আলগোছে জেরেমির বউয়ের হাতের সোনার চুড়িটা নেড়েচেড়ে দ্যাখে। পিটপিট করে তাকিয়ে মোজেস শোনে, মোজেসের বাপও শোনে। তারা কেউ তেমন কিছু বোঝে বলে মনে হয় না।
মোজেসকে সুলেমানবাহিনীর লোকরা ধরে নিয়ে গেল তার পরের সপ্তাহে, ওই চ্যাংড়া বন্ধু আব্দুহুর সাথে মাঠে খেলবার সময়ই। গির্জা আর আশ্রমকে দুষ্পাচ্য বিষের বালির মতো করে গিলছিল আশ্রমের চারদিকের চালাঘর-ছাপড়া মসজিদ-কলতলা-গ্লাস ফ্যাক্টরি-হোমিও হল-আখের ট্রাক-পানাপুকুর, উগড়েও দিচ্ছিল বারবার। প্রতিটা ওয়াজে তারা তো শিখছিল— তাদের গ্রামগুলিতে মেয়েদের সাবান-শ্যাম্পু-লোশন-তেল-কাপড় কাচার গুঁড়ো সাবান দেয় খ্রিস্টান পাদ্রিরা, বাচ্চাদের খেলনা পুতুল-জন্মদিনের কেক-বাদলায় রেনকোট আর শীতের কম্বল দেয় পাদ্রিরা, প্রত্যেকটি ধর্মান্তরিত শিশুর একটি করে বিদেশি শিশুর সাথে দোস্তালি, এরা পত্রমিতালি করে, এরাই শিশুদের ভবিষ্যত প্রেমাষ্পদ… একদিকে এত কিছু, আরেকদিকে কেবল জশনে সঙ্গতিহীনের সমবায়ে প্রস্তুত ভিক্ষান্নের খিচুড়ি— সাথে জবাইয়ের একপিস গোস্ত। অত কিছু কি আর মোজেস বোঝে, সে কি বোঝে অত অপরিমিত বিদ্বেষের আকার? শীতশেষের সন্ধ্যাবেলা সে আর ফিরল না, যেসব শীতের সন্ধ্যায় মোজেসের দাদা সুনীল সরেন মোজেসের বাপ রেবতীকে কিচ্ছা শোনাত— এমনই সাঁঝের কালে না কি সোনা রায়ের নাম শুনলে মুখ থেকে গাইগরু ফেলে দিয়ে বাঘ পালাত!
সুনীল সরেন বুড়ো বয়েসেও মাঠে দুর্বা বুনতে-বুনতে মিহি গলায় গাইত, ‘যেমন তোমার মা ফতিমা তেমন আমার দুর্গা শ্যামা’… আর কাঁচা বয়েসের রেবতীও বাপের সাথে গলা মেলাত। কবে কখন রাতের বাতাসে প্রেমজুরি বাজিয়ে নেচে-নেচে গাওয়া মারফতি গানের আওয়াজ কমে এসেছে কেউ টেরও পায়নি, রাতজাগা পিটার কিংবা পরিমল কেউই না। ওয়াজের মৌসুম ফুরায়, দালানে-দালানে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে-ফিরে আসে হুজুরের গর্জন— ‘এরা নিজেগো কয় ঈসায়ি মুসলমান! হায়! না খুদা হি মিলা, না বিছালে সনম! এইদিকেও না, ওইদিকেও না। কাউয়াও না, কবুতরও না।’ এই কয়দিনে মোজেসের বাপ কোথায় না গেছে! গির্জায় যিশুর সামনে দাঁড়িয়ে বসন্তের দাগধরা রেবতী চোখের জল ফেলেছে এমন যেন জলভরা স্পঞ্জ থেকে কেউ চিপড়ে জল বের করছে, হে প্রভু আমার প্রার্থনা গ্রাহ্য কর। ঢেলা পীরের দরগায় গিয়ে ঢিল ছুঁড়ে শিন্নি মেনে এসেছে। নেত্রমণির দিঘিতে জিন থাকে, টেনে নিয়ে যায় ছোট ছেলেপুলে, প্রয়োজন ফুরালে ফিরিয়ে দেয়, সেখানে গিয়ে কত বসে থেকেছে। বুড়ো আসলামের পরামর্শে খুররম শাহের মাজারে মোমবাতি জ্বেলেছে। মাদার জানতে পারলে কী করবেন তার মনেও আসেনি। আর গেছে থানায় ধর্না দিতে।
একদিন রাতে মোজেসের জামাকাপড় বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে রেবতী। হঠাৎ তার চটকা ভেঙে গেল কীসের শব্দে। বসন্তের মাতলামি লেগেছে, গাছগুলির পাতা পতপত করছে রাতের ঈষৎ উদ্দাম বাতাসে। রূপবান টিনে বাতাসের ঝনঝন শব্দ। কুয়ার দিক থেকে আসছে। পায়ে-পায়ে রেবতী বাইরে এসে দ্যাখে, বাঁধাই কুয়ার মুখে সেই চুল বাঁধার ভঙ্গিতেই অ্যাগ্নেস বসে আছে। চাকায় ফেলে গড়া মাটির কুপির মতো দপদপ করে জ্বলত অ্যাগ্নেসের চোখ, জ্বলছে না। মুখে-চোখে বড্ড ছেনালি ছিল তার, কই! অ্যাগ্নেসকে দেখাচ্ছে ফাতেমা রানির মতো নির্মলহৃদয়া। তাকে দেখে কী যেন হয়ে গেল রেবতীর, ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল সে, কুকুরের কান্না। অ্যাগ্নেস মায়ায় ভরা মুখ নিয়ে তার কান্না দেখতে লাগল। এক সময় নিজের অশ্রু-লালা-সর্দি মুছতে-মুছতে রেবতী জিজ্ঞেস করল, ‘তোক মুই মারি ফেলাইছিনু দেখি তোর আর রাগ নাই?’
ছাতার কালো-কালো শিকের মতো আঙুল খেলিয়ে অ্যাগ্নেস মাদার সুপিরিয়রের গলায় বলল— ‘না, আমার রাগ নাই। ক্ষমা আর মাজ্জনাই শক্তির পরম পোকাশ।’
রেবতী ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘মোর আইজ চ্যাংড়াও নাই!’
অ্যাগ্নেস কেমন করে যেন হাসল। সান্ত্বনার মতো করে। বলল— ‘ফের হবে!’ বলেই ঢেউটিনের ঢাকনাটা খুলে কুয়ার ভিতর লাফ দিল। মুক্তিদাতা খ্রিস্ট। পুণ্য পরমেশ্বর। তোমার দেহ আর রক্ত দ্বারা পাপ ও অমঙ্গল হতে আমাকে রক্ষা করো। তোমা হতে আমাকে বিচ্ছিন্ন কোরো না।
একটি সর্বজনবোধ্য কোনও বীভৎস কৌতুকের মতো করে রেবতী তার ছেলে ফিরে পেল পরদিন। গির্জার ফটকে কে ফেলে গেছিল তাকে। আদুল গায়ে বড়-বড় নীলে পড়া ক্ষত, মুসলমানি করে দেওয়া নুনু। অতুলবাবু ছুটে এলেন, নাড়ি ধরে দেখলেন মোজেস জীবিত আছে, রক্তে-পুঁজে-ধুলোয়-কাদায় আচ্ছন্ন সেই ছোট্ট শরীর বুকে নিয়ে রেবতী সরেন বুকফাটা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল, বাইবেলে তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল পুনরুত্থান আর পুনরাগমন, অত ভালবাসার যিশু কি মানুষকে ছেড়ে যেতে পারে! ঈশ্বরের পুত্র, সংসারের ত্রাতা, সংসারের এত পাপ মানুষ সাঁতার দেবে কী করে তাঁকে ছাড়া! তাঁকে যে ফিরতেই হবে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র