ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নৈতিক চেতনা


    দেবদত্ত পট্টনায়েক (Devdutt Pattanaik) (December 17, 2021)
     

    আজ থেকে হাজার বছর বা তারও কিছু আগে রচিত শ্রীমদ্ভগবতগীতায় (১.১৩.৪৭) আমরা এই শ্লোকটি পাই:

    ‘অহস্তানি সহস্তানামপদানি চতুষ্পদাম্‌ ।
    ফল্গুনি তত্র মহতাং জীবো জীবস্য জীবনম্‌ ।।’

    — যারা হস্তহীন তাদের শিকার করে যাদের হাত আছে। যারা পদহীন তাদের শিকার করে যাদের পা আছে। দুর্বলকে শিকার করে সবল, জীবন জীবনকেই ভক্ষণ করে।

    এই শ্লোকে জঙ্গলের আইনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে জোর যার মুলুক তার। প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে একে সম্বোধন করা হয় মাৎস্যন্যায় নামে, যার অর্থ মাছেদের আইন। এ-পথ সভ্যতা-সংস্কৃতির পথ নয়, কারণ মানুষের সামর্থ্য আছে প্রকৃতির এই মাৎস্যন্যায়কে খারিজ করে দেওয়ার।

    সভ্যতায় বা সংস্কৃতিতে সবল দুর্বলকে শিকার করে না, রক্ষা করে। এর নামই ধর্ম। সবল যখন দুর্বলকে গ্রাস করে, মানুষ যখন পশুর মতো ব্যবহার করতে শুরু করে, তখনই বিরাজ করে অধর্ম। এই হচ্ছে হিন্দু নীতিবোধ। এই ভাবনার প্রথম দর্শন পাওয়া যায় ৩০০০ বছরের পুরনো শতপথ ব্রাহ্মণে (১১.১.৬.২৪), যেখানে দেবতারা ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন উত্তর দিকে, যা স্থিতির প্রতীক কারণ ওইদিকে রয়েছে ধ্রুবতারা, এবং জলে, যা উৎপাদনশীলতা এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতার প্রতীক। ‘যখন জলের আগমন হয়, তখন ধর্ম এবং সুফলতা আসে। যখন জলের আগমন হয় না, তখন অভাব আসে, সবল দুর্বলকে গ্রাস করে, অধর্ম বিরাজ করে।’

    ২৫০০ বছর পুরনো বৃহদারণ্যক উপনিষদ (১.৪.১১-১৪) আমাদের শিক্ষা দেয়, ‘দুর্বল ব্যক্তি ধর্মের সাহায্যে সবল ব্যক্তির কাছে যান, যেভাবে সাধারণ মানুষ রাজার কাছে যায়।’ এভাবেই রাজার ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্মের প্রতিষ্ঠানে এবং এমন একটি পরিবেশের প্রতিষ্ঠানে যেখানে সবল দুর্বলকে শোষণ করবে না। নিয়মকানুন, রীতিনীতি, এ সবই আসলে ধর্মের চিন্তার মূর্ত রূপ মাত্র। নিয়ম বা প্রথা যদি সমাজের থেকে জঙ্গলের স্বভাবকে দূরে রাখতে পারে, তবেই সে-নিয়মকে ধর্মানুবর্তী বলা যায়। রামায়ণে প্রতাপশালী রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে তাঁর ইচ্ছের বিরূদ্ধে তাঁকে লঙ্কায় ধরে রাখেন, তখনই তিনি অধর্মে পতিত হন। মহাভারতে প্রতাপশালী দুর্যোধন যখন তাঁর পাঁচ অনাথ ভাই পঞ্চপাণ্ডবের সাথে সূচ্যগ্র মেদিনী ভাগ করে নিতে নারাজ হন, তখনই তিনি পতিত হন অধর্মে।

    পৃথিবীটা যে একমাত্রিক বা বৈচিত্র্যহীন নয়, হিন্দুধর্ম তাও স্বীকার করে। সবকিছুই সব সময়ে পাল্টাচ্ছে (অনিত্য)। অতএব নিয়ম বা প্রথাকেও অনড়, অপরিবর্তনশীল হলে চলবে না। পুরাণের মতে বিষ্ণু যেমন যুগে-যুগে ভিন্ন-ভিন্ন অবতারের রূপ ধারণ করেন, ধর্মশাস্ত্রও বিধান দেয় যে দেশ-কাল-পাত্র অনুযায়ী সমস্ত নিয়ম এবং প্রথাকেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে হবে।

    এ-জিনিস সফল ভাবে করতে হলে নিজের চেতনাকে বৃদ্ধি পেতে হবে, প্রসার পেতে হবে, এবং জঙ্গলের আইনকে অতিক্রম করতে হবে। অর্থাৎ পশু যেমন অন্য পশুকে কেবল খাদ্য, খাদক, প্রতিদ্বন্দ্বী বা দোসর হিসেবেই দেখতে সক্ষম, মানুষকে সেই সংকীর্ণ প্রবণতা অতিক্রম করে অপরের প্রতি সহমর্মী হওয়া শিখতে হবে। এর ফলে সহানুভূতি বা মায়ার মতো আবেগ, দয়া বা দাক্ষিণ্যের মতো ক্রিয়া সম্ভব হয়ে ওঠে। বৃহত্তর চেতনা মানুষকে নিরাপত্তাহীনতায় না ভুগে স্বজীব অর্থাৎ নিজের পাশাপাশি পরজীব অর্থাৎ অন্যের খিদে-আশঙ্কা-সংশয় অনুধাবন করার শক্তি দেয়।

    পৃথিবীটা যে একমাত্রিক বা বৈচিত্র্যহীন নয়, হিন্দুধর্ম তাও স্বীকার করে। সবকিছুই সব সময়ে পাল্টাচ্ছে (অনিত্য)। অতএব নিয়ম বা প্রথাকেও অনড়, অপরিবর্তনশীল হলে চলবে না। পুরাণের মতে বিষ্ণু যেমন যুগে-যুগে ভিন্ন-ভিন্ন অবতারের রূপ ধারণ করেন, ধর্মশাস্ত্রও বিধান দেয় যে দেশ-কাল-পাত্র অনুযায়ী সমস্ত নিয়ম এবং প্রথাকেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে হবে।

    এই বৃহত্তর চেতনা থাকলে ধর্মের প্রতি সত্যনিষ্ঠ থেকেও নিয়ম বা প্রথাকে প্রসঙ্গ অনুসারে পালটে নেওয়া যায়। এই উপায়েই ত্রেতা যুগে, যখন নিয়ম মানা হত, বিষ্ণু এই চেতনাকে রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র রামের মধ্যে দিয়ে এক ভাবে ব্যবহার করেন। আবার দ্বাপর যুগে, যখন নিয়ম ভাঙা হত বা নিয়মের সুযোগ নেওয়া হত, তখন তিনি রাখাল পরিবারের কনিষ্ঠ পুত্রের মধ্যে দিয়ে অন্যভাবে ব্যবহার করেন। ৩৫০০ বছরের পুরনো ঋগ্‌বেদ যে-সমাজকে পর্যবেক্ষণ করছে, সেই সমাজকে সে কল্পনা করে চার শ্রেণির মানুষ (চতুর্বর্ণ) দিয়ে গঠিত একটি জীবিত প্রাণী হিসেবে। ২০০০ বছরের পুরনো মনুস্মৃতি অবশ্য এই কল্পনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার ক’রে সামাজিক বৈষম্যবাদ এবং জাতিবিদ্বেষের সাফাই গেয়ে থাকে। ব্রাহ্মণ (পুরোহিত শ্রেণি) ক্ষত্রিয়ের (জমির মালিক) চেয়ে শ্রেষ্ঠ, তাঁরা আবার বৈশ্যদের (সাধারণ মানুষ) চেয়ে উত্তম, এবং তাঁরা নিজেরা শূদ্রদের (পরিচারক শ্রেণি) চেয়ে শ্রেষ্ঠ, সে এই ধারণার প্রচার করে। দলিতদের শোষণ এবং তাঁদের উপর অত্যাচারকে এই তত্ত্বের দ্বারা প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে থাকে। ভগবদ্‌গীতায় (৫.১৮) যে বৃহত্তর প্রসারিত সচেতনতার বা চেতনার কথা রয়েছে, এ-ব্যবহার কিন্তু সেই নীতির বিরূদ্ধাচরণ করে।

    ‘বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি ।
    শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ’

    — যিনি বিদ্বান এবং বিনয়ে পরিপূর্ণ, তাঁর কাছে ব্রাহ্মণ, গরু, হাতি, কুকুর, এবং যে কুকুর খায়, সবাই সমান।

    এখানে বিভিন্ন শ্রেণি বা জাতির মানুষ এবং পশুর বিষয়ে সচেতনতার কথা পাওয়া যায়, পাওয়া যায় শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক, এবং শ্রেণিগত পার্থক্য অতিক্রম করে সেই এক আত্মাকে চেনার কথা, যে আত্মা আমাদের সবাইকেই জীবিত রেখেছে। ঋগ্‌বেদে একেই এক এবং অনন্য সামাজিক প্রাণী হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে। এই আত্মজ্ঞান বা আত্মোপলব্ধি থাকলে মানুষের মনে শান্তি এবং নিরাপত্তা আসে, তখন ‘উত্তম’-এর সামনে নতমস্তক থাকার বা ‘অধম’কে হেয় করার প্রবণতা থাকে না। তখন বোঝা যায়, অন্যদের অপমান করে বা মানুষের মর্যাদা না দিয়ে নিজের ব্যাপারে আত্মপ্রসাদ অনুভব করার প্রয়োজন শুধু তাদেরই আছে যারা নিজেদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। উত্তর-অধমের দ্বৈত পরিপ্রেক্ষিত আসলে ভ্রম, এ-ভ্রমের জন্ম ভগ্ন চেতনা থেকে। এই ভগ্ন চেতনারই আর এক চিহ্ন হল বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে একমাত্রিকতা কায়েম করার ইচ্ছা। অতএব নীতিবোধ মানে নিজের চেতনাকে প্রসারিত করা, তার বৃদ্ধি। মানুষের চেতনা যত প্রসারিত হয়, তাকে তত বেশি নৈতিক বা নীতিবান বলা যায়।

    এ-ধারণা মূর্ত হয়েছে মিথিলার জনকের মতো রাজর্ষির, বা একাধারে রাজা এবং ঋষির মূর্তিতে। তিনি এই প্রসারিত চেতনার অধিকারী, অতএব রীতি এবং প্রথার নৈতিক নিয়মাবলি সৃষ্টি করতে তিনি সক্ষম।

    আমরা যে-সময়ে বাস করি, সে-সময়ে চেতনা এবং নীতিবোধের মধ্যে একটা ফাটল দেখা যাচ্ছে। চেতনা হয়ে উঠেছে গুরুদের ব্যাপার, আর নীতিবোধ এসে পৌঁছেছে পুলিশ এবং অ্যাকটিভিস্টদের এক্তিয়ারে। এ হয়তো চেতনার বৃদ্ধি এবং প্রসারকে সামাজিক স্তর থেকে ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে আসারই ফল। কেবল চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসলেই চেতনা বৃদ্ধি পায় না বা প্রসারিত হয় না, এর জন্য প্রকৃতি এবং সংস্কৃতি, মানুষ এবং পশু, সবার রীতিনীতির দর্শনচর্চা করতে হয়। অপরকে দেখতে-চিনতে না পারলে চেতনা বৃদ্ধি পায় না, আত্মসর্বস্ব হয়ে ওঠে, অন্যের ঘাড় ভেঙ্গে আত্মপ্রসাদের ভার বাড়ায়, পরের জমি দখল করে (দুর্যোধনের মতো), পরের সম্মতি লঙ্ঘন করে ফেলে (রাবণের মতো)।

    প্রসারিত চেতনার দুনিয়ায় প্রত্যেকটি ক্রিয়ার কর্ম এবং কর্মফলের গভীর যোগসূত্রের ব্যাপারে সচেতনতা আসে। উদ্ধত শূর্পনখার নাক লক্ষ্মণ কেটে নেবার পর থেকে রাম এবং সীতা সারা জীবনে আর কোনওদিন সুখ পান না। একের পর এক অনর্থ উপস্থিত হয়। কৃষ্ণ ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন বটে, কিন্তু কৌরবদের মা গান্ধারীর অভিশাপ তাঁকে পারিপার্শ্বিক আঘাত (collateral damage) হিসেবে মেনে নিতেই হয়। এ-কারণেই ধর্ম, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে নীতিবোধ এবং চেতনা, অতি সূক্ষ্ম বিষয়। এ কেবল বিচক্ষণ বিচারকের চোখে কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ, তার নিক্তি মাপার বিষয় নয়।

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook