কিন্তু তা হোক, তবু তো সংসার থেমে থাকে না। মানুষের সুখ–দুঃখের পরোয়া করে তো সংসারে চলে না। আমি গিয়ে পৌঁছবার একদিন পরেই গুরুকে আরো ভালো করে চিনে নিলাম। দেখলাম আগুনের মধ্যে বসেও কেমন করে সে হাসিমুখে সমস্ত সহ্য করতে পারে। আমাকে বলল— কালকে আমরা লোনাভালায় যাব বিমলবাবু, আপনি তৈরি থাকবেন— সেখানে গিয়ে একমাসের মধ্যে আমরা সিনারিও লেখা শেষ করে ফেলব—
তারপর আমাকে আবার বললে— সঙ্গে যদি কিছু নেবার থাকে তো আগে–ভাগে বলে দিন, জোগাড় করে রাখবো—
বলে গুরু বেরিয়ে গেল।
সেদিন দুপুরে আমি আর গীতা খেতে বসেছি। বললাম— আপনিও চলুন না গীতাদি, বেড়িয়ে আসবেন আমাদের সঙ্গে—
গীতা বললে— আমাকে নিয়ে যাবে না ও—
— কেন?
গীতা বললে— আপনি আমাদের সংসারের সব ব্যাপারটা জানেন না। আমাদের দুজনের মধ্যে এখন কথাবার্তা বন্ধ।
— সে কি? কথা বন্ধ কেন?
গীতা বললে— সে অনেক ইতিহাস। সে সব বলতে অনেক সময় লাগবে। ওই যে সেবারে আপনাকে বলেছিলাম, আপনার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ আমাদের দুজনের জীবনেরই গল্প? আমাদের দুজনের কিছুতেই মেলে না। বিয়ের প্রথম ছ–বছর বেশ সুখে কেটেছিল, কিন্তু তারপর থেকেই গোলমাল শুরু, যেদিন থেকে স্টুডিওতে ওয়াহিদা রেহমান এলো—
আমি তখন সিনেমা–জগতে নতুন, কাউকেই চিনি না। চুপচাপ শুনে গেলুম কথাগুলো। গীতা বলতে লাগল— আপনি হয়তো জানেন আমাদের তিনজনকে নিয়ে সিনেমা পত্রিকাগুলোয় অনেক কুৎসা বেরোয়—
বললাম— কই, আমি তো জানি না—
সকাল থেকে লাঞ্চ–খাওয়ার সময় পর্যন্ত আমি আবার উপন্যাস লিখেছি। একটু পরেই আবার স্টুডিওতে যেতে হবে। আর বেশি শুনবার সময় ছিল না। গাড়ি আসতেই সোজা স্টুডিওতে চলে গেলাম। বাড়িতে গীতার মুখে যা কিছু শুনে গেলাম, স্টুডিওতে গিয়ে গুরুর মুখের দিকে চেয়ে তার কিছু আভাসই পেলাম না। সেই হাসিমুখ, সেই গল্প নিয়ে আলোচনা। সেই গুরুস্বামীর সঙ্গে বসে গল্প। লোনাভালায় যেতে হবে। তারই তোড়জোড়। রতন এসে ক্ষেপে–ক্ষেপে চা দিয়ে যেতে লাগল। আমি কিন্তু পালি হিলের বাড়িতে গীতার মুখের কথাগুলো ভাবছিলাম। গুরুর মুখের দিকে চেয়ে কে কল্পনা করবে যে, এই গুরু দত্ত একদিন কলকাতায় শুটিং বন্ধ করে সারাটা দিন হুইস্কি খেয়ে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের কামরায় রাত কাটিয়েছে।
কিন্তু সেদিন যখন মাদ্রাজের কুইন্স হোটেলের কামরায় বসে গুরু দত্ত অ্যালবার্ট সিন্হার সঙ্গে তাস খেলছিল, আমি সেই আগেকার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবছিলাম। গুরুর জীবনের এতগুলো বছরের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে যতই তাকে দেখছিলাম, ততই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম।
রাত বারোটার সময় খেলা যখন শেষ, তখন গুরু দুহাজার টাকা হেরে গেছে তাসের খেলায়। আমি বললাম— চলুন, আর নয়, এবার উঠুন—
গুরু উঠে নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল, আর আমি আমার নিজের ঘরে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম কেন এ–মানুষটা এমন করে নিজের জীবনটা নষ্ট করে ফেলছে? কিসের অভিমানে? অভিমান না হয়ে যদি রাগ হয় তো কার ওপর রাগ? ওয়াহিদা রেহমান তো নিজের থেকেই গুরুর জীবন থেকে একদিন নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। সে আর ভুল করেও দেখা করে না গুরুর সঙ্গে। এখন তো আর কোনও বাধা নেই। গীতা আর গুরু দুজনের মধ্যে তাহলে কেন অশান্তি, কেন এই তাসের জুয়া, কেন এই অনিদ্রা? আমি বেশ বুঝতে পারলাম পাশের ঘরে গুরু আমার মতোই জেগে–জেগে আকাশ–পাতাল ভাবছে, কিন্তু কিসের তার ভাবনা। কি তার সমস্যা? কি তার অসুখ?
হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ল— বিমলদা, বিমলদা—
আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিতেই দেখি গুরু দাঁড়িয়ে আছে। বললাম— কি হল?
গুরু বললে— আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন নাকি?
বললাম— কেন, ঘুম আসছে না আপনার?
গুরু অসহায় শিশুর মতো বললে— না—
বললাম— তাহলে, বলুন কি করব?
গুরু বললে— ভেবেছিলাম আমার কাছে ঘুমের পিল্ আছে, কিন্তু এখন খেতে গিয়ে দেখি নেই— কি করব আমিও বুঝতে পারলাম না—
বললাম— কিন্তু সারাদিন স্টুডিওতে পরিশ্রম করেছেন, তার ওপর বিকেলে মানুষের সঙ্গে অতক্ষণ গল্প করেছেন, তারপর তাস খেলে দুহাজার টাকা হেরেছেন, মদও খেয়েছেন খুব, তবু ঘুম আসছে না কেন?
গুরু বললে— কি জানি! কিন্তু আমার এরকম হয়—
বললাম— অথচ ডাক্তার তো আপনাকে খুব সাবধানে থাকতে বলেছেন, তবু কেন অত সিগারেট, অত মদ খান। যদি এখন আবার শরীর খারাপ হয়? আবার পেটে ব্যথা হয়?
গুরু হাসতে হাসতে বললে— কি আর হবে, মরে যাব—
বললাম— মরে গেলে তো ল্যাঠা চুকেই যায়, কিন্তু তার আগের যন্ত্রণাটা? সে যন্ত্রণায় তো আপনি আগেও ভুগেছেন।
গুরু বললে— আমি মারা গেলে তো কারোর কিছু যাবে–আসবে না, আমার মরে যেতেই বা কিসের আপত্তি, যন্ত্রণা পেলেই বা কার ক্ষতি?
গুরুর কথাগুলো সুস্থ–স্বাভাবিক লোকের মতো নয়। বোধহয় নেশাগ্রস্ত বলেই ওই কথাগুলো তখন বললে। বললাম— আচ্ছা, আপনি দাঁড়ান, আমি দোকান থেকে স্লিপিং পিল্ কিনে নিয়ে আসছি—
গুরু বললে— আমি কি পিল্ খাই জানেন তো? সোনেরিল, এক প্যাকেট নিয়ে আসবেন। এক প্যাকেটে আটত্রিশটা বড়ি থাকে।
সেই রাত্রে আবার বেরোলাম গাড়ি নিয়ে। নতুন দেশ, নতুন জায়গা, কোথায় ডাক্তারি দোকান, তাও জানি না, তবু অনেক খুঁজে দোকান বার করলাম। কিন্তু এক প্যাকেট নয়, চারটে বড়ই কিনলাম। পিল্ চারটে গুরুকে এনে দিলাম, গুরু তখনও চুপ করে অপেক্ষা করছিল আমার ঘরে। পিল চারটে দিয়ে বললাম— চারটেই আজকে রাত্রে খাবেন না, আজ দুটো আর কাল দুটো খাবেন, আস্তে–আস্তে নেশাটা কমিয়ে আনুন—
গুরু যে হাসি হাসল সেটা বিদ্রূপের হাসি। বললে— নেশার কথা বলছেন। পৃথিবী সুদ্ধ লোক আমাদের চারদিকে নেশা করিয়ে দেবার জন্যে ওৎ পেতে বসে আছে, আমরা কি করব? কোটি–কোটি টাকা কারবারে খাটছে আমাদের শিকার করবার জন্যে, আমরা কেমন করে আত্মরক্ষা করব বলুন! ভোরবেলা খবরের কাগজ পড়া, সেও তো এক নেশা— বলে নিজের মুখে পুরে দিল দুটো বড়ি। পুরে নিজের ঘরে চলে গেল।
পরের দিন সকালে গুরুর ঘরে গেলাম দেখতে কেমন আছে সে। দেখলাম তখনও ওঠেনি
বিছানা থেকে। তারপর যখন উঠল বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। স্টুডিও থেকে গাড়ি নিয়ে লোকে এসে গেছে, দুবারই ফিরে যেতে হয়েছে।
তারপর যখন তৈরি হয়ে নিয়ে স্টুডিওতে যাবার আয়োজন করছে, তখন বললাম— চলুন এখান থেকে আমরা অন্য কোথাও চলে যাই—
গুরু আমার দিকে চেয়ে বললে— অন্য কোথাও মানে?
—অন্য এমন এক জায়গায় যেখান থেকে আপনি স্টুডিওতে রোজ যাতায়াত করতে পারবেন অথচ অন্যরা কেউ আপনাকে বিরক্ত করতে পারবে না—
গুরু বললে— এক কাজ করুন, আজকে স্টুডিও থেকে সকাল–সকাল ফিরে আমরা দুজনে সমুদ্রের ধারে চলে যাব, সেখানে গিয়ে আমরা গল্প নিয়ে আলোচনা করব—
আমি বললাম— হ্যাঁ তাই ভালো, আমি এখানে কাজও করতে এসেছি, আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করলে আমারও মন খারাপ হয়ে যাবে। ভাবুন তো, এখানে আমাকে আনার জন্যে আপনার কত টাকা খরচ হয়েছে—
গুরু বললে— তাই–ই ঠিক রইল—
বলে স্টুডিওতে চলে গেল।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত