উধম সিংকে নিয়ে নতুন যে সিনেমাটা তৈরি হয়েছে (সুজিত সরকার পরিচালিত ‘সর্দার উধম’), তার আলোচনার মধ্যেই আমাদের ফিরে দেখে নেওয়া হিন্দি সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও অসম্পূর্ণ সিনেমাটাকে: হৃষিকেশ মুখার্জি পরিচালিত ‘ম্যান ফ্রম ইন্ডিয়া’, যার কিছু অংশ শুট হয়েছিল ১৯৭০-এর লন্ডনে অথচ পরবর্তীতে কাজ মুলতুবি রাখা হয়। সিনেমার বিষয়বস্তু ছিলেন উধম সিং— আর নামচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন পরীক্ষিত সাহানি, যিনি সে-সময়ে অজয় সাহানি নামে সিনেমা-জগতে পরিচিত ছিলেন।
‘ম্যান ফ্রম ইন্ডিয়া’ অসম্পূর্ণ থাকার প্রকৃত কারণগুলো আজও অজানাই থেকে গেছে— কেউ বলেন এর জন্য হৃষিদার স্বাস্থ্যের অবনতি দায়ী, কেউ বলেন টাকাপয়সার সমস্যা ছিল আবার কারো-কারো মতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছবিটা সম্পর্কে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন। বহু বছর পরে, প্রযোজকদের একজন, বলরাজ তাহ্ সিনেমাটি সম্পূর্ণ করবেন বলে ঠিক করেন। গুলজার ও সিনেমাটোগ্রাফার জয়বন্ত পাথারের মতো হৃষিদার সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে যাঁরা কাজ করতেন তাঁদের কিছুজনকে নেওয়া হয় এবং তারকা-উপস্থিতি রাখার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করে দুটো পার্শ্বচরিত্রে নেওয়া হয় বিনোদ খান্না আর শাবানা আজমিকে।
এর ফলে জন্ম হয় ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ নামে স্কিৎজোফ্রেনিক একটি সিনেমার, যার নির্মাণ ১৯৭৭ সালে সম্পূর্ণ হলেও বিভিন্ন বাধাবিঘ্নের কারণে তা মুক্তি পায় ১৯৮৭ সালে— এবং বিনোদ খান্নার রুপোলি পর্দায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে আগ্রহ তৈরি হওয়া সত্ত্বেও, এই সিনেমা দ্রুত লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। যথেষ্ট সিরিয়াস এবং সৎ কাজ হলেও গোটা সিনেমা জুড়েই ইতিহাস, দর্শন ও দর্শককে আবেগপ্রবণ করে তোলার উপাদানগুলোর মধ্যে তারতম্য লক্ষ করি আমরা। যেমন, সিনেমার শুরুই হয় অতি উচ্ছ্বসিত সঙ্গীত দিয়ে, যা ১৯১৯-এর ঘটনা ও তার পরবর্তী অভিঘাত নিয়ে বানানো একটা সিনেমাতে খুবই অসঙ্গত ও বেমানান। এই সম্পূর্ণ সংস্করণটিতে (ইউটিউবে পাওয়া যায়) বহু বছর আগে হৃষিদার শুট করা কিছু ফুটেজও কাজে লাগানো হয়েছে, যা দর্শককে আরও বিভ্রান্ত করতে পারে: ১৯৪০ সালে উধম সিং-এর বিচারদৃশ্যে (যেখানে ভি কে কৃষ্ণ মেনন উধম সিংয়ের পক্ষে হিন্দিতে সওয়াল করছে বিস্মিত ইংরেজ জুরির সামনে) পরীক্ষিত সাহানিকে কমবয়সি মনে হয়, কিন্তু ফ্ল্যাশব্যাকের দৃশ্যগুলিতে তাঁকে বয়স্ক ও স্থূল মনে হয়, যেখানে আসলে উধম সিংয়ের বয়স আরও কম হওয়ার কথা।
এত কিছুর পরেও কিন্তু সিনেমাটা হিন্দি সিনেমার ঐতিহ্যে এক দুর্লভ সম্পদ এবং একেবারেই যে তাৎপর্যহীন, এ কথা বলা যায় না। বিশেষত যদি কেউ এই সিনেমা তৈরির পেছনের জটিল গল্পগুলো জানেন— আর যদি আমার মতো আপনাদেরও মনে হয় যে, ১৯৭০ ও ’৮০-র ছোট ছোট সাংসারিক সিনেমাগুলো বানানোর আগে (যেগুলোর সাথে এখন তাঁর নাম আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে) যদি হৃষিকেশ মুখার্জি ‘সত্যকাম’-এর মতো ঐতিহাসিক-উপন্যাসের মতো বিস্তৃত সিনেমা আর একটা বানাতেন! সেই সময়ের এবং তার পরের বহু বছরের সংবাদপত্রের নিবন্ধে চোখ রাখলে জানা যায়, হৃষিদা বেশ কিছু এরকম প্রজেক্টের পরিকল্পনা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত, বাতের ব্যথায় কাবু হয়ে পড়ার পর ‘ছোট’ সিনেমা বানাতে তিনি বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। অধিকাংশ সময় শুটিং তাঁর নিজের বাড়িতেই হত, হয়তো বড় প্রজেক্ট হাতে নিতে তিনি সংশয়ে ভুগতেন! (এই সমস্যার এক প্রকৃত উদাহরণ ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘নৌকরি’, যা ১৯৪০-এর প্রেক্ষাপটে বানানো হলেও সময়ের প্রতিলিপি তুলে ধরতে অসমর্থ হয়।)
‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ সিনেমার অন্যতম চমকগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে গুলজার-এর একটা ছোট ভূমিকায় অভিনয় (সম্পূরণ সিং গুলজার নামে)। উধম সিংয়ের এক সহকারীর ভূমিকায় তিনি অভিনয় করেন, যিনি লন্ডনে মাইকেল ও’ডয়্যারকে চিহ্নিত করে উধম সিংকে দেখিয়ে দেন। মসৃণ কালো পোশাকে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্যায়ের প্রতিবাদে হাইড পার্কের মিছিলে হাঁটছেন গুলজার— অনবদ্য তাঁর উপস্থিতি রুপোলি পর্দায়। যদিও তাঁর ডাবিং সম্ভবত করেছিলেন অভিনেতা করণ রাজদান।