কী ঋত্বিকদা, এবার পুজোয় কোথায় যাচ্ছ?’
‘এখনও ঠিক করিনি… ভাবছি, পুরুলিয়াতে মহুলবন নামে একটা জায়গা আছে, খুব সুন্দর; পেট ফ্রেন্ডলি, জ্যাক-টাকেও নিয়ে যাওয়া যাবে।’
‘ছোঃ! পুরুলিয়া! রাজাদা চাঁদে যাচ্ছে!’
‘চাঁদে? তার মানে? বেড়াতে? কী ভাবে?’
‘হুঁ হুঁ বস! ভার্জিন গ্যালাক্টিক। বুক করে ফেলেছে। দেখলে হবে, খরচা আছে!’
‘যাঃ শালা! ব্যাপারটা কোথায় চলে যাচ্ছে রে!’
গ্যাগারিন-আর্মস্ট্রং-এর যুগের কথা বাদ দিন, আজ থেকে বছর তিরিশেক আগেও এসব কথাবার্তা পাবলিক পিওর ঘনাদা বলেই ধরে নিত, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পোস্ট-প্যান্ডেমিক সময়ে যখন পুজোর বাজারটা স্মার্টফোনে অ্যামাজন থেকেই সেরে নিতে হচ্ছে, টুক করে একটু জেফ্ বেজোস-এর স্পেস-টুর সংক্রান্ত খবরেও চোখ বুলিয়ে নেওয়া যায়।
সত্যিই তো, ব্যাপারটা ঠিক যাচ্ছে কোথায়?
১১ জুলাই, ২০২১— ব্রিটিশ কোটিপতি রিচার্ড ব্র্যানসন তাঁর স্পেস টুরিজম কোম্পানি ভার্জিন গ্যালাক্টিক-এর ‘ইউনিটি ২২’-নামের রকেটে চেপে নিউ মেক্সিকোর মোহাভে মরুভূমি থেকে একেবারে সোজা মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। তিন মিনিটেরও বেশি সময় ভারহীন অবস্থায়, মাইক্রো গ্র্যাভিটি-তে কাটিয়ে সুস্থ-সবল অবস্থায় ব্র্যানসন পৃথিবীতে ফেরত আসেন। যদিও তাঁর এই যাত্রা ঠিক মহাশূন্যে নয়; প্রযুক্তির ভাষায়— পৃথিবীর সাব-অরবাইটাল স্পেসে (উপকক্ষ পথে), যেখানে রকেটের গতি পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছে যাওয়ার থেকে বেশ খানিকটা কম। ‘ইউনিটি ২২’-এর এটাই ছিল প্রথম মানুষ নিয়ে সফল স্পেস-সফর— ১৭ বছর আগে শুরু করা ব্র্যানসন-এর স্পেস-ফ্লাইট কর্মযজ্ঞের একটা দুর্দান্ত মাইলফলক।
জেফ বেজোস পিছিয়ে পড়তে পারেন না। ২০ জুলাই, ২০২১— ‘অ্যাপোলো ১১’ চাঁদে নামার ৫২তম বার্ষিকীতে— অ্যামাজন.কম প্রতিষ্ঠাতা বেজোস তাঁর স্পেস-টুরিজম কোম্পানি ‘ব্লু অরিজিন’-এর ‘শেপার্ড’ রকেটে মহাশূন্যে পাড়ি দেন। যাত্রীসমেত এই রকেটের এটাই ছিল ‘লঞ্চ’ সফর; বেজোস-এর সঙ্গে তাঁর ভাই মার্ক ছাড়াও ছিলেন ৮২ বছর বয়স্কা বিমানচালিকা ওয়ালি ফাঙ্ক এবং ১৮ বছর বয়সি ডাচ ছাত্র অলিভার ডেমেন। পুরো যাত্রাটাই ব্লু অরিজিনের ওয়েবসাইটে লাইভ-স্ট্রিম করা হয়।
ডিসেম্বর ২০২১-এ জাপানি কোটিপতি ইয়াসাকু মেজায়া-র ‘স্পেস অ্যাডভেঞ্চারস্’ কোম্পানির একটি রাশিয়ান রকেটে চড়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন’ ঘুরে আসার কথা। ২০২৩-এ মেজায়ার চাঁদে যাওয়ার কথা, ‘স্পেসএক্স’ নামের কোম্পানির নতুন রকেটে।
শুধু বেজোস, ইলন মাস্ক বা ব্র্যানসনের মতো মাল্টি-বিলিওনেয়ারের নয়, বেজোস-এর ‘ব্লু অরিজিন’ এবং ব্র্যানসন-এর ‘ভার্জিন গ্যালাক্টিক’ ছাড়াও, গত দুই দশকে, ১৫টির বেশি স্পেস-টুরিজম ‘এজেন্সি’ গজিয়ে উঠেছে, যারা সাধারণ (!!) মানুষের জন্য মহাশূন্য-সফরের ব্যবস্থা করে থাকে। আপাতত এই সফরের সিট নিলামে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার-চুম্বী দরে বিক্রি হচ্ছে, তবে অচিরেই বুকিং-এর বন্দোবস্ত হয়ে যেতে পারে।
মহাশূন্য একটু বেশিই দামি মনে হচ্ছে? বেশ তো, নাহয় স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার অবধিই ঘুরে আসুন। একটা ফুটবল মাঠের সাইজের বেলুনের টানে আপনি স্পেস নেপচুন ক্যাপসুলে চেপে ঊর্ধ্বতর বায়ুমণ্ডলে পৌঁছে যেতে পারবেন, মাত্র ১২৫,০০০ ডলার খরচে। বাজেটটা আরও একটু কমলে সুবিধা হয়? ‘জিরো-জি’ কোম্পানির প্যারাবোলিক ফ্লাইটে চেপে বসুন— একটা মডিফাই করা বোয়িং বিমানে ভারহীন মহাশূন্যের অভিজ্ঞতাও পেয়ে যাবেন, অসাধারণ ছবি তুলে আসতে পারবেন। ‘জি ফোর্স ওয়ান’ নামের এই বিমানের সিটের দাম মাত্র ৫,০০০ ডলার— কয়েক লাখ ডলারের চেয়ে কম, এবং চট করে ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
যেহেতু এ-জীবনে অন্তত ওই অঙ্কের আয় অসম্ভব, আমার দ্বারা কখনওই স্পেস ট্র্যাভেলটা হবে না, সে আমি জানি— যদি না আমি ওমেজ.কম-এর কোনও একটা কম্পিটিশনে ‘ভার্জিন গ্যালাক্টিক’-এর মহাশূন্য টিকিট জিতে ফেলি, আর তাঁদের ‘নাগরিক মহাকাশযাত্রী’ প্রোগ্রামের সূত্রে বিনামূল্যে স্পেসটা একটু ঘুরে আসি! কিন্তু এই সব লটারিতে প্রাইজ জেতার ব্যাপারে আমার ভাগ্যটা চিরকালই জঘন্য…
আমাদের কথা ছাড়ুন। আর কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যাবে আমি-আপনি চিনি, এমন বেশ কিছু লোকজন মহাকাশযাত্রার টিকিট কেটে, ঘুরে-ফিরে, কয়েক লাখ ছবি তুলে তাদের সোশ্যাল মিডিয়ার ফিড তারায় তারাময় করে তুলেছে। ঠিক পুজোর বেড়ানো না হলেও, স্পেস-টুরিজম যে হই হই করে আবাহনমুখী, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ আর বাকি নেই। খুব শিগগিরি, কোটিপতি ব্যবসায়ীরা ছাড়াও, নামী কোম্পানির অধিকর্তা, নামজাদা খেলোয়াড় এবং হলিউড অভিনেতারা ১৫ মিনিটের মহাকাশযাত্রার জন্য কয়েক লাখ ডলার খরচ করে ফেলতে একটুও পিছপা হবেন না।
‘নাগরিক মহাকাশযাত্রী’র মতো উপাধি থেকে এটা পরিষ্কার যে, ভ্রমণের সংজ্ঞা বদলাতে চলেছে। বছরের পর বছর দস্তুরমতো কঠিন হাতে-কলমে শিক্ষা নিয়ে জীবনে হয়তো এক বা দু’বার মহাকাশে যাত্রা করতে পারেন একজন পেশাদার মহাকাশযাত্রী, বা ‘অ্যাস্ট্রোনট’। বাণিজ্যভিত্তিক স্পেস-টুরিজম এই ধারণাটাই সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলবে। সোজা কথায়, ট্যাঁকের জোর থাকলে— আপনি কালকেই চাঁদে হাত বাড়ানোর জন্য যে কোনও মহাকাশ ভ্রমণসংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। বাকিটা তারা বুঝে নেবে। হ্যাঁ, কিছু নির্ণায়ক রয়েছে: যেমন ধরুন, বেজোস-এর ব্লু অরিজিন উচ্চতা এবং শারীরিক ভার নিয়ে একটা সীমা টেনে রেখেছে (৫’০” এবং ৫০ কেজি থেকে ৬’৪” এবং ১০০ কেজি)। সম্ভাব্য যাত্রীদের ৯০ সেকেন্ডে সাত রাউন্ড সিঁড়ি ভাঙার শারীরিক ক্ষমতা থাকা দরকার।
মহাকাশযাত্রার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় প্রোফেসর শঙ্কুর গল্প ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’-তে। আমাদের বয়সি অনেকেরই হয়তো তাই, হয়তো বা টিনটিনের চাঁদে যাওয়ার অ্যাডভেঞ্চার কমিক্স-যুগল পড়ে। গিরিডিবাসী জিনিয়াস বৈজ্ঞানিক প্রোফেসর শঙ্কুর নিজের হাতে তৈরি রকেটে মঙ্গলগ্রহে পাড়ি দেওয়ার অভিযানের অনবদ্য, অসাধারণ কাহিনি ‘ব্যোমযাত্রীর ডায়রি’ সত্যজিৎ রায়ের লেখা শঙ্কুর প্রথম গল্প। সেই রকেটের উপাদান? ‘…ব্যাং-এর ছাতা, সাপের খোলস আর কচ্ছপের ডিমের খোলা…।’ যাকে বলে ‘অর্গানিক’-এর শেষ কথা, এবং ঢের সস্তাও।
এই রকেট নিয়ে বাণিজ্যিক কোনও ইচ্ছা— অর্থাৎ যাত্রীসমেত মহাকাশযাত্রা— শঙ্কুর ছিল বলে জানা যায় না। গল্পে পড়া যায়, তাঁর হোম-মেড রোবট বিধুশেখর এবং বেড়াল নিউটন অবশ্যই শঙ্কুর মঙ্গলযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিল।
শঙ্কুর নিজের কথায়, তাঁর ‘…বাইরের কোনও জগতের প্রতি (আমার যেন) একটা টান আছে, এই টানটা লিখে বোঝানো শক্ত। মাধ্যাকর্ষণের ঠিক উলটো কোনও শক্তি যদি কল্পনা করা যায়, তা হলে এটার একটা আন্দাজ পাওয়া যাবে।’ শুধু তাই নয়, ‘একটা বিশেষ দিন থেকে’ শঙ্কু এই টান ‘অনুভব’ করে আসছেন, এবং সেই দিনের কথা তাঁর ‘আজও বেশ মনে আছে।’ এর পর ফ্ল্যাশব্যাকে ১২ বছর আগের এক আশ্বিনের রাতের কথা লেখেন শঙ্কু, যখন এক ঝলকে একটা বিরাট উল্কা তাঁর বাগানের পশ্চিম দিকের গোলঞ্চ গাছটার উপর পড়ে। প্রথমে স্বপ্ন ঠাহর হলেও, শঙ্কুর এই মহাকাশের প্রতি টানের অনুভূতি শুরু হয় সেই দিন থেকেই। উল্কাপাতের দিনক্ষণটা একটু লক্ষ করুন— শরৎকাল, আশ্বিন মাস, দুর্গাপুজোর ধুম। আবাহন আর কাকে বলে!
মহাকাশ এবং নক্ষত্রমণ্ডল— এবং সেই সঙ্গে মুগ্ধ করে দেওয়া কিছু অ্যাডভেঞ্চারের গল্প— মাঝেমধ্যেই শঙ্কু-কাহিনিতে দেখা যায়, যেমন ‘মহাকাশের দূত’ এবং ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও ইউ এফ ও’, যদিও শেষের গল্পটায় ভিনগ্রহী মহাকাশযানের বিষয়টাই প্রাধান্য পেয়েছে।
আরও একটু বড় হয়ে টিনটিনগুলো হাতে পেয়েছি, এবং এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছি মানুষের মহাকাশ-জয়ের গল্প! ভেবে দেখুন, হার্জ ‘ডেস্টিনেশন মুন’ লিখেছিলেন ও এঁকেছিলেন ১৯৫০ সালে, এবং তার দু’বছর পরেই কল্পনা করেছিলেন, ড্রাফট করেছিলেন এবং প্রকাশ করেছিলেন ‘এক্সপ্লোরার্স অন দ্য মুন’, যেখানে মহাকাশই ছিল গল্পের অভাবনীয়, অসম্ভব সুন্দর প্রেক্ষাপট। নীল আর্মস্ট্রং-এর ১৭ বছর আগেই হার্জ তাঁর তরুণ সাংবাদিক-নায়ক এবং তাঁর ছোট্ট কুকুর স্নোয়ি-কে সফল চন্দ্রযাত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছিলেন। কী কল্পনাশক্তি! সত্যজিৎ রায়ের প্রথম শঙ্কু-কাহিনি লেখা হয় ১৯৬১ সালে; সত্যজিৎ আজীবন টিনটিন-ভক্ত ছিলেন; তাঁর ছবিতে টিনটিনের কমিক্স ঘুরে-ফিরে এসেছে (‘সোনার কেল্লা’য় ‘টিনটিন ইন টিবেট’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ‘দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড’)।
আইজ্যাক অ্যাসিমভ ‘দ্য লিভিং স্পেস’ নামের ছোটগল্প লেখেন ১৯৫৬ সালে। সারাজীবন মহাকাশযাত্রার কট্টর অধিবক্তা, স্যার আর্থার সি. ক্লার্ক ‘২০০১: এ স্পেস ওডিসি’র চিত্রনাট্য লেখেন ষাটের দশকের মাঝামাঝি—অ্যাপোলো ল্যান্ডিং-এর আগেই।
আজ যখন এই কালজয়ী লেখক-শিল্পী-পরিচালকদের কল্পনাকাহিনি একেবারে (বেজায় ধনী) মানুষের হাতের মুঠোয়, কী ভাবতেন হার্জ, সত্যজিৎ, ক্লার্ক বা অ্যাসিমভ? আশা করা যায়, যা ছিল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের মহা-পদক্ষেপ, বাণিজ্যবুদ্ধির এক ধাক্কায়, ‘টুরিজম’ শব্দটা জুড়ে দেওয়াতে, আর যাই হোক, যেন দৈনন্দিন আর গতানুগতিক না হয়ে বসে! অ্যাডভেঞ্চারটা মিইয়ে গেলে বড্ড খারাপ হবে!