ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ড্রাইভারের ভার লাঘব


    শ্রীজাত (October 9, 2021)
     

    গাড়ি চালানোর চেয়ে সংসার চালানো যে বেশি কঠিন, সে আর কে না জানে! আর সংসারের চাইতে জীবন চালানো। কিন্তু এ প্রবাদ পৃথিবীর অন্যান্য অনেক শহরে সত্যি হলেও, কলকাতায় কোনওমতেই নয়। এখানে যদি-বা টেনেটুনে সংসার চালানো যায়, যদি-বা লড়েপিটে জীবনও চালানো যায়, গাড়ি চালানো যায় না। আর যাঁরা সে-কাজ পারেন, মানে, কলকাতার রাস্তায় দিব্যি গাড়ি চালাতে পারেন, তাঁদের আমি অসম্ভব সম্ভ্রমের চোখে দেখি। কেননা, এই একটি কাজ কক্ষনও আমার দ্বারা হবে না। কাজ তো অনেক দূর, কলকাতার পথে গাড়ি চালানোর ভাবনাটুকুই আমার ঘাম ছুটিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তাই আমি জীবনে কপি লেখা থেকে অভিনয়, সব কাজে ঝাঁপ দিলেও, এই একটি কাজে নিজেকে কখনও ভরসা করিনি। এখন, নিজেকে ভরসা না করলে অন্যকে করতেই হয়। দীর্ঘ কৈশোর ও যৌবন আমার কেটে গেছে অটো এবং বাসের চালকদের ভরসা করে। সে অবশ্য খুবই ঝুঁকির কাজ, সেই ভরসা করে থাকা। কেননা কলকাতার বাসচালক ও অটোচালকদের মর্জি-মেজাজ বোঝা প্রায় হেগেল-এর তত্ত্ব বোঝার মতোই দুষ্কর। তা সত্ত্বেও, তাঁদেরই হাতে দু’বেলা প্রাণ সঁপে দিতে হয়েছে অনেকদিন পর্যন্ত। যতদিন না সাহস করে নিজেদের একখানা ছোট্ট বাহন কিনে উঠতে পেরেছি। যেই না কেনা, মনে হল, এইবার তো একজনকে দরকার, যিনি এই চারপেয়ে বস্তুটিকে চরাতে বেরোবেন আমাদের পিঠে চাপিয়ে। 

    পাড়াতেই পাওয়া গেল একজন চালককে। কমবয়সি, হাত মোটামুটি ভালই। একদিক থেকে সুবিধেই, ফিরতে আমাদের রাতবিরেত হয় প্রায়শই, এ-ছেলে পাড়ার বাসিন্দা, অসুবিধে হবে না। দিন পনেরো অসুবিধে হলও না। তারপর একদিন বাড়ি থেকে বেশ দূরে কোথায় একটা গেছি, রাতও হয়েছে অনেক। চালক ছেলেটি কোথায় গাড়ি দাঁড় করিয়েছে জানি না, কিন্তু কিছুতেই ফোন ধরছে না। একবার, দু’বার, সতেরোবার। অগত্যা খুঁজতে বেরোলাম। খুঁজে যখন পেলাম তাকে, সে আর আমাকে চিনতে পারছে না। তার প্রথম প্রশ্ন, ‘আপনি কে, যে আমাকে গাড়ি চালাতে বলছেন?’ অবশ্য এই বাক্য ডিকোড করতে আমার সেকেন্ড তিরিশ লেগেছিল, কেননা একটি অক্ষরের সঙ্গে আরেকটি অক্ষর এমনভাবে জড়ানো, যেভাবে দলবদলের আগে রাজনীতিকরা একে অপরকে জড়িয়ে থাকেন। হাতে অনেকখানি সময় পেয়ে গলা অবধি নেশা করে বসে আছে। বুঝলাম, এ যদি আমাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে ফেরে, তাহলে এই গাড়িই সৎকার সমিতির গাড়িতে পরিণত হবে। তাকে বোঝানোর অনেক চেষ্টা করলাম যে আমি সেই ব্যক্তি, যে অনেক কষ্ট করে গাড়িখানা কিনেছে, আর এই মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে চায়। কিন্তু তাতে লাভ হল না। সে উল্টে আমাকে এমন গালিগালাজ করল, যা আমি পরে ফেসবুকে অনেক পেয়েছি, কিন্তু সে-সময়ে বিরলই ছিল। অগত্যা গাড়ি বন্ধ করে তাকে একটি ট্যাক্সিতে তুলে দিয়ে, নিজে আরেকটি ধরে বাড়ি ফিরতে হল। এবং বুঝলাম, আমার চালকভাগ্য সুবিধের নয়।

    কলকাতার পথে গাড়ি চালানোর ভাবনাটুকুই আমার ঘাম ছুটিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। তাই আমি জীবনে কপি লেখা থেকে অভিনয়, সব কাজে ঝাঁপ দিলেও, এই একটি কাজে নিজেকে কখনও ভরসা করিনি। এখন, নিজেকে ভরসা না করলে অন্যকে করতেই হয়। দীর্ঘ কৈশোর ও যৌবন আমার কেটে গেছে অটো এবং বাসের চালকদের ভরসা করে।

    কথাটা ভুল বুঝিনি। কেন, সেটা বলছি। এর মাসখানেক পর খুঁজেপেতে একজনকে যখন আনা হল চালক হিসেবে, সে আমাকে খুব শ্রদ্ধা করতে শুরু করল। এমনিতে নিজে খুব মেপে চলা লোক, মদ ছোঁয় না, সিগারেটের নেশা নেই, কখনও এক-দু’কাপ চা, এই হলেই চলে যায়। আমি ভাবলাম, একদিক থেকে ভালই হল, মাঝরাতে আর বেকায়দায় পড়তে হবে না। কিন্তু বেকায়দা শুরু হল ভরদুপুরেই। হয়তো কোনও কাজে ডালহৌসি যাব, তাকে বললাম একটা রাস্তা ধরতে, সে হাতের পাতা তুলে আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘আপনি একদম চুপ করে বসুন, আমি ঠিক নিয়ে যাব।’ বেশ কথা, চুপ করে বসলাম। এবং সে যেখানে নিয়ে গেল, সেখান থেকে ডালহৌসি বহুদূর। যখন জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কী হল? সে ভুবন-ভোলানো হাসি দিয়ে বলল, ‘আজ একটু ভুল হয়ে গেছে আর কী!’

    আমি এমনিতে ঠান্ডা মেজাজের মানুষ, অন্যের ভুলে নিজের ক্ষতি হলেও দোষারোপ করে উঠতে পারি না। তাই ব্যাপারটা মোটামুটি রোজের ঘটনা হয়ে দাঁড়াল। হয়তো বলছি ডানদিকে যেতে, সে আবার বুদ্ধের ভঙ্গিতে গিয়ে বলছে, ‘একদম চুপ থাকুন, ঠিক নিয়ে যাব।’ বাঁদিকে ঢুকে অবধারিত ওয়ান-ওয়ে, এবং পুলিশের কেস। এইটা টানা একমাস চলার পর সে একদিন, চিবোতে গিয়ে গাড়ির চাবিটা দু’আধখানা করে ভেঙে ফেলল। ডুপ্লিকেট চাবি আগেই খোয়া গেছে। আমি নিরুপায় হয়ে জানতে চাইলাম, ‘হঠাৎ চাবি চিবোতে গেলে কেন?’ সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘কী করব, অপেক্ষা করার সময়ে মুখে কিছু একটা না দিলে চলে না।’ আমি বুঝলাম, আমার চালকভাগ্য সোনার আখরে লেখা। অপেক্ষা করার সময়ে মুখে মদ ঢালা আর চাবি দেওয়া, দুটোই যে সমান বিপজ্জনক, সেটা আর কে কাকে বোঝাবে! সে এরপর নিজেই ছেড়ে দিল কাজ, দেশগাঁয়ে গিয়ে আর ফিরল না। আমার গাড়ির চাবি করাতে দিন সাতেক লেগে গেল।

    এরপর আর চালক রাখিনি নিজেদের জন্যে। ড্রাইভার হায়ারিং সেন্টার থেকে যখন যেমন দরকার, আনিয়ে নিয়েছি। তাঁদের নিয়ে গল্প জুড়লেও রাত কাবার হয়ে যাবে। তবে সমস্যাটা হল ২০২০-র গোড়ায়। আমি আর দূর্বা প্রচণ্ড সাহস করে আগের চেয়ে বহরে একটু বড় আরেকখানা গাড়ি কিনে বসলাম। তখন সামনে হাতে যা কাজ আছে, তাতে সব মিলিয়ে অসুবিধে হবার কথা নয়। রাখলাম একজন চালককে কাজে। তিনি দিব্য চালান। কিন্তু আমাদের কারওরই রোজকার আপিস নয়। দূর্বা যদি বা নিয়ম করে কাজে যায়, আমার তো অনিয়মের জীবন। টানা তিনদিন বেরোলাম, তারপর হয়তো আটদিন ঘরে থেকেই লিখলাম। সে বেচারা ভদ্রলোক আসেন আর গ্যারাজে বসে থাকেন। একদিন সাফ-সাফ বললেন, ‘স্যার, আপনার ডিউটি আর করতে পারব না সামনের মাস থেকে। বসে বসে হাতে জং ধরে যাচ্ছে, তাছাড়া খুব বোরিং হচ্ছি।’ যুক্তি অকাট্য। আমি নিজেই এত ‘বোরিং’ হই, তাঁর আর দোষ কী! অগত্যা ছুটি দিলাম তাঁকে।

    হয়তো বলছি ডানদিকে যেতে, সে আবার বুদ্ধের ভঙ্গিতে গিয়ে বলছে, ‘একদম চুপ থাকুন, ঠিক নিয়ে যাব।’ বাঁদিকে ঢুকে অবধারিত ওয়ান-ওয়ে, এবং পুলিশের কেস। এইটা টানা একমাস চলার পর সে একদিন, চিবোতে গিয়ে গাড়ির চাবিটা দু’আধখানা করে ভেঙে ফেলল।

    এর ঠিক এক মাসের মধ্যেই যে পৃথিবীর এতদিনকার ইতিহাস আমূল বদলাতে চলেছে, সে তো আর জানা ছিল না! গৃহবন্দি হলাম আমরা, গাড়ি মুখ লুকোল গ্যারাজে। কেবল টাকা, সে দিব্যি ব্যাঙ্ক থেকে গটমটিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল ই-এম-আই সেজে। টাকার করোনা হয় না। বুঝলাম, চালক-পর্বের ইতি এখানেই। সামনের এক বছরের সমস্ত কাজ ঝাড়বাতির মতো নিভে গেল ঝুপ করে। নিজেদের চালানোই যেখানে এত কঠিন, গাড়ি চালানোর জন্যে আর রাখব কাকে? আর কী করেই বা? ভাগ্যিস আমাদের চালকমশাই নিজেই ছেড়ে গেছিলেন, নইলে এই দুর্দিনে আমাদেরই তাঁকে বিদায় জানাতে হত।

    এই দু’বছরে পৃথিবী কত কিছুকে বিদায় জানাল। কত ধরন, কত অভ্যেস, কত ধারণা, কত চাহিদাকে যেতে দিলাম আমরা। তেমনই যেতে দিলাম চালককেও। সকলেই নয়, কেউ কেউ। যেমন আমরা। এখন আমাদের গাড়ি নতুন নতুন হাতে সেজে ওঠে এক-একদিন, ইচ্ছে না থাকলেও। তার জন্য নির্জন বন্ধু খোঁজার দিন আর নেই আমাদের।

    তবে এই দিনকালও নাকি আর থাকছে না। শিগগির বাজারে আসছে স্বয়ংচালিত গাড়ি। স্বয়ংক্রিয় তো আগেই ছিল, এবার চালিতও। মানে, চালকের আসনে আর কাউকে প্রয়োজনই হচ্ছে না। গাড়ি আপনাআপনি চালু হবে, এগোবে-পিছোবে, মোড় ঘুরবে, আমার-আপনার যেখানে যাবার ঠিক নিয়ে যাবে। ওয়ান ওয়ে ভুল করবে না, অতি-আত্মবিশ্বাসে ভুগবে না, নিজের চাবি নিজেই চিবোবে না, এইসব আর কি! আমরা দিব্যি চড়ে বসে হুকুম করব, আর গাড়ি নিজেই তা তামিল করবে। এমন দিন আসছে। রাস্তাঘাটের সিগন্যাল সব সেই ভাবেই জুড়ে দেওয়া হবে গাড়ির সংযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে, যাতে দুর্ঘটনা না হয়। এমনিতেও, গাড়ি তো দুর্ঘটনা ঘটায় না, ঘটায় মানুষ।

    কিন্তু এই যে এক ধরনের পেশা আজ বিলুপ্তির মুখে চলে এল, এই দুর্ঘটনা কে ঠেকাবে আর! একজন চালক তো কেবলমাত্র গাড়ি চালান না, তিনি পরিবারের একজন হয়ে ওঠেন দেখতে দেখতে। অনেক সময়ে মুখোশ পরা বন্ধুদের চাইতে গাড়ির চালককে বেশি ভরসা করি আমরা। ডাক্তার আর উকিলের কাছে তবু যদি বা কিছু লুকনো যায়, নিজের চালকের কাছে কিছুই যায় না। আমাদের অজান্তেই তিনি হয়ে ওঠেন চলমান, নীরব কনফেশন-বক্স। যাঁর কাছে আমাদের সমস্ত গোপন চিরকুট জমা পড়তে থাকে। সেই অলীক ভরসার জায়গা এবার মুছে যাবে। সামনের সিট থেকে মুছে যাবেন একজন মানুষ, একটা গোটা প্রজাতি। এই না হলে সভ্যতা!

    ছবি এঁকেছেন উপল সেনগুপ্ত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook