নবরাত্রির শব্দ
এ বছর নবরাত্রির প্রথম দিনে আমি তিনশো কিলোমিটারের একটু বেশি রাস্তা নিউ দিল্লি থেকে উত্তরাখন্ড অবধি পাড়ি দিয়েছিলাম। রাস্তায় আসতে-আসতে চোখে পড়েছিল, নবরাত্রির প্রার্থনা ও উৎসবের জন্য মা দুর্গার প্রতিমাগুলি বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর্থিক অসহায়তা যাদের হাত টেনে রেখেছিল, তারা একসাথে ছোট ছোট দলে আনন্দ করতে করতে দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে যাচ্ছিল ছোট ঠেলাগাড়ি করে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে যা ‘রেড়ি’ নামে পরিচিত। অন্যরা বিশাল সব ছাদখোলা ট্রাকে চড়িয়ে মা-কে নিয়ে যাচ্ছিল। আর অসংখ্য ভক্ত, প্রধানত পুরুষ, ট্রাকের প্রতিটি কোণায় জায়গা করে নিয়েছিল। এই ছবি ভারতবর্ষের মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়, কিন্তু আমি লিখতে চাই এই বহু পুরাতন ছোট অথবা বড় মিছিলের পেছনে লুকিয়ে থাকা শাব্দিক অভিজ্ঞতার কথা। প্রতিটি মিছিলেই ছিল বাহনের ওপরে উঁচু করে রাখা মিউজিক সিস্টেম আর স্পিকার, যারা ভয়াবহ হাই ডেসিবেলে গান বাজাচ্ছিল। হাইওয়ের ওপর মিছিল চোখে পড়ার অনেক আগেই পৌঁছে যাচ্ছিল তাদের আওয়াজ। অবধারিত ভাবে কানে আসছিল গাড়ির ঝাঁকুনির শব্দ, শরীর-কাঁপানো রিদম মেশিন আর ইলেকট্রিক ড্রামের আওয়াজ, সেখানে গানের কথা আর সুর থাকলেও সবসময় শোনা যাচ্ছিল না। এমনকী তুলনায় ছোটখাটো মিছিলগুলোতেও গানবাজনার কমতি ছিল না। ট্রাকগুলোতে একের পর এক বিরাট বিরাট মিউজিক সিস্টেম, পড়ে যাওয়ার ভয়ে নাইলনের দড়ি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা, আর স্পিকারগুলোর মাথায় নির্ভয়ে বসে ছিল কপালে লাল ওড়না-বাঁধা অত্যুৎসাহী পুরুষ-ভক্তেরা।
কেন্দ্রীয় পরিবহন মন্ত্রী নীতিন গড়করি সম্প্রতি ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি একটি আইন আনতে চলেছেন যাতে শুধুমাত্র শ্রুতিমধুর ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র, যেমন ‘বাঁশি, তবলা, ভায়োলিন, মাউথ অর্গান, হারমোনিয়াম’ প্রভৃতির শব্দ গাড়ির হর্ন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। নবরাত্রির শব্দপৃথিবী বুঝিয়ে দিচ্ছিল মন্ত্রী যদি সত্যিই এরকম একটি আইন আনতে চান, তাঁর কাজ বেশ কঠিন হতে চলেছে। একদিকে তিনি চাইছেন গতানুগতিক গাড়ির হর্নের বদলে শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার, আর অন্যদিকে হাইওয়ে জুড়ে আমাদের ভক্তরা গোঁ ধরেছিল ঢাক-ঢোলের বদলে বিদেশি ড্রামস আর বৈদ্যুতিক বাদ্যযন্ত্রের কান ফাটানো কলরবের। মন্ত্রী কি বেঁধে দিতে পারবেন পুজো-মিছিলের এই শব্দসীমা? মিছিলগুলো এগিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ আর ট্রাফিক পুলিশে ঘেরা হাইওয়ে ও শহরের রাস্তা ধরে। যখন আমি এইসবের মাঝখান দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলাম, দু’পক্ষের কাউকে দেখেই আমার মনে হচ্ছিল না পথচলতি জনসাধারণের জন্য বিন্দুমাত্র সতর্কতা তারা অনুসরণ করছে। যদিও, সত্যি কথা বলতে গেলে, ট্রাকের মাথায় বসে থাকা ভক্তদের হতাহত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে বা হাইওয়েতে গাড়িগুলোর বিশাল কোনও অ্যাকসিডেন্ট হওয়া নিয়েও তাদের কোনও মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হচ্ছিল না। প্রত্যেকে আনন্দের আতিশয্যে সমস্ত বিপদের সম্ভাবনাকে তুচ্ছ করে এগিয়ে চলেছিল। দুঃখের কথা এই, যেকোনও ধর্মের যেকোনও উৎসব-মিছিলেই এই একই দৃশ্য দেখা যায়।
নবরাত্রি সাধারণত এমন এক উৎসব, যেখানে প্রচুর নতুন গান রেকর্ড হয় এবং প্রচুর উচ্ছ্বাসের সঙ্গেই সেসব প্রকাশ পায়। বাংলার পুজোর গান থেকে গুজরাটের ডান্ডিয়া আর গরবার গান ছাড়াও নবরাত্রি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অসাধারণ সমস্ত আসর বসে। আগেকার দিনে, পাটনা ও বিহারের অন্যান্য শহরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বিখ্যাত সব আসরের গল্প শোনা যেত। সঙ্গীত এবং উৎসবের এই সংযোগ এখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, তবে অন্য অনেক কিছুর মতোই, নবরাত্রি উপলক্ষে প্রকাশ পাওয়া গানের ধরন ও চরিত্র অবশ্যই পাল্টেছে। ঐতিহ্যবাহী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জনমানসে পুরনো হয়ে আসছে দ্রুত, আর তার জায়গা পূরণ করে ফেলছে ঝিনচ্যাক গান, সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়ে গিয়ে যা অতিদ্রুত দেখে ফেলছে বিপুল সাফল্যের মুখ। লালপাড় শাড়ি পরিহিতা মেয়েদের ধুনুচি নাচ এবং ঢাকিদের গতানুগতিক উপস্থিতি এখনকার জনমানসে দেবীশক্তির প্রবল শৌর্য ও শক্তিকে ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে।
পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিলাপ এ নয়, বরং সমসাময়িক সঙ্গীত ও জনপ্রিয় স্লোগানের রেওয়াজরীতির পরিপ্রেক্ষিতে বয়ান করা তথ্যমাত্র। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র স্লোগানের তাৎপর্য আর থাকছে কি? কেউ কেউ বলতে পারেন যে, পুজো উপলক্ষে যে-গানগুলি রিলিজ করছে সেগুলো তো ভারতেই তৈরি, এবং ঠিকই, এ সমস্ত গানের স্রষ্টারা প্রায় প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সঙ্গীতকার, যাদের কাজ হয়তো পুরাতনপন্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। এটা মেনে নিতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু সেক্ষেত্রে বাকি সমস্ত ক্ষেত্রে ‘বি ইন্ডিয়ান’, ‘মেক ইন্ডিয়ান’-এর অ্যান্থেম কেন? যোগব্যায়াম ও আয়ুর্বেদের জন্য যদি নতুন মন্ত্রণালয় গঠন করা যেতে পারে তাহলে ঐতিহ্যবাহী /প্রথাসম্মত শিল্পের জন্য কেন নয়? প্রাচীনকে নিয়ে এই গর্বিত মনোভাব সঙ্গীতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় কেন?
পরিবর্তন ও নতুন সঙ্গীতধারাকে স্বাগতম জানানোর সাথে সাথে মনে রাখা দরকার, আমাদের গান, প্রার্থনা সঙ্গীত, ঢাক, খোল-করতাল ও ঢোলের ঐতিহ্যময় ইতিহাস দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে আসছে রেপার্টরির ধারা, মরশুমি ও উৎসবের চিরাচরিত গানগুলো হারিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির গহ্বরে, আমরা এগিয়ে চলেছি বীভৎস আওয়াজনির্ভর বৈচিত্রহীন এক সঙ্গীত-ঐতিহ্যের দিকে। মনে রাখা উচিত, উগ্র জাতীয়তাবাদী উৎসাহ ও উচ্ছ্বাস আমাদের পাথেয় বা প্রেরণা কোনওটাই হতে পারে না। আমাদের সেই বোধে পৌঁছনো উচিত, যেখানে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সসম্মানে আমরা রচনা করতে পারি এক সুসংহত সেতু।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র