ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • মুখঋত: পর্ব ১৩

    ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় (October 17, 2021)
     

    আমরা কেউ হিরো হব না! 

    পাহাড়ে একদিন সন্ধের সময়। কোলাখাম বলে একটি জায়গা। শিলিগুড়ি থেকে প্রায় সাত ঘণ্টার রাস্তা। টুরিস্ট নেই। হোটেলে আমরা ছাড়া আর একটি পরিবার। আমরা পাঁচজন বন্ধু অনেক কষ্টে একসাথে সময় বের করে বেড়াতে গেছি। আমরা অনেক ছোট থেকে বন্ধু। একসাথে বড় হয়েছি। পরস্পরের স্কুল-ছাড়া, প্রেমে বিচ্ছেদ, কাউকে পছন্দ, কলেজে ভর্তি— সব দেখেছি। নিজেদের পরিবার ও ভালবাসার মানুষদের কথা আদান-প্রদান করেছি। তবু এই যে সন্ধের কথা লিখছি, সেটা এক ধাক্কায় আমাদের বড় করে দিল, এক অপরের আরও কাছে আনল, আর ছোটবেলার আওতা থেকে বের করে দিল। 

    আমরা সেদিন অনেকটা ট্রেকিং করে পাহাড়ি একটি নদী দেখতে গেছিলাম। ফিরে এসেও কেউ ক্লান্ত হইনি। যখন হোটেলের বাইরের পাঁচিলে পৌঁছলাম, তখন সন্ধে নামছে, আশপাশের পাহাড়গুলোতে আলো জ্বলছে। এ তো চেনা দৃশ্য। আগের দু’দিন বৃষ্টি হয়েছে বলে মেঘ নেই, শুধু ছোট-ছোট আলো জ্বলছে চারপাশে। সেই হালকা শীতের মধ্যে আমরা পাঁচ বন্ধু কথা বলা শুরু করলাম। হঠাৎ করেই নিজেদের পরিবারের কথা শুরু হল, বড় হওয়ার সময়ের বিভিন্ন ভাল-খারাপ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিলাম— এমন কিছু কথা, যেগুলো একান্তই ব্যক্তিগত ছিল এতদিন। ছোটবেলার যে স্মৃতিগুলো এখনও কষ্ট দেয়, সেই চেপে রাখা নানান কথা বলাবলি করতে থাকলাম। আস্তে-আস্তে পাহাড়ের চারপাশে রাত নেমে এল।

    আমরা কেউ হিরো হব না! ছোট থেকে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপন আমাদের বলেছে, সাধারণের মাঝেই সকলে অসাধারণ। তবে বিজ্ঞাপনের প্রোডাক্ট বিক্রিশেষে আদতে সবাই নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে গেছে। আমরাও মহান হতে পারিনি, হতে পারবও না।

    হাওয়া দিতে শুরু করল। আমরা বাবা-মায়েদের কথা বললাম। প্রত্যেকেই চিনি সবাইকে। কিন্তু এই এত বছরের একসাথে স্কুল, খেলা, কাজের মাঝে সময় কাটানোর পরেও কোনওদিন এইভাবে সম্পর্ক, স্নেহ নিয়ে কথা বলিনি। কথায়-কথায় বেরিয়ে এল পরিবারিক ভাঙনের কথা, নিজের ভাইয়ের কাছে আহত হওয়ার কথা, ভাল-খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে ওঠার কথা। বুঝতে পারলাম, আমরা সত্যি আর এখন নিছক স্কুল-পড়ুয়া বন্ধু নই। আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের যেভাবে মানুষ করে তুলেছেন, সেই সম্পূর্ণ বৃত্তটাই নানান অভিজ্ঞতার ফল। সবকিছু নিয়ে সেদিন আমরা কথা বললাম— পরিচিত কারও ভুলভাবে ছোঁয়া কখন ভাল মনে হয়নি, বা অগ্রজদের একটা ছোট কথা কখন বছরের পর বছর চাপ সৃষ্টি করেছে, কিংবা কোনও একটি ভাল কাজের শেষে কখন বাবা-মায়ের চোখে গর্ব দেখা গেছে। অনেকগুলো চেপে রাখা অনুভূতি বেরিয়ে এল। জানতামই না! এরাই আমার বন্ধু, কাছের মানুষ, অথচ কতটা যুদ্ধ রোজ অতিক্রম করে এত বছর কাটিয়েছে! আগে ভাগ করে নিসনি কেন রে? মনে হল, পাশে থাকলে সাহায্য করতে পারতাম। 

    প্রতিদিনের যুদ্ধ এটা। সেই যুদ্ধ চলছেই। আমাদের সাধারণ যুদ্ধ। 

    কথা বলার শেষে একটা বড় প্রাপ্তি হল। বুঝলাম, আমরা প্রত্যেকেই আসলে সাধারণ। আর পাঁচজনের মতোই স্বাভাবিক একটা জীবন কাটিয়েছি, এবং এভাবেই চলবে। আমরা কেউ হিরো হব না! ছোট থেকে টেলিভিশন, চলচ্চিত্র আর বিজ্ঞাপন আমাদের বলেছে, সাধারণের মাঝেই সকলে অসাধারণ। তবে বিজ্ঞাপনের প্রোডাক্ট বিক্রিশেষে আদতে সবাই নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে ফিরে গেছে। আমরাও মহান হতে পারিনি, হতে পারবও না। বিনোদনের জগৎ এমন একটা পৃথিবী তৈরি করেছে, যেখানে দাঁড়িয়ে মনে হয় আরও সুন্দর, নায়ক-নায়িকাদের মতো রূপকথার জীবন পাবে সবাই। রোজের ধুলোমাখা বড় হওয়ার মধ্যে সেই রূপকথা কোথায়?

    ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ উপন্যাসের শেষে কাঞ্চন একটা বড় যাত্রাপথের অন্তিম লগ্নে বুঝতে পেরেছিল, তার বাবা আসলে আর চারটে সাধারণ মানুষের মতোই, পরিবারের জন্য, অস্তিত্বের জন্য লড়ছে। আমাদের পরিবারগুলো সেই একই লড়াই লড়েছে আমাদের মানুষ করতে গিয়ে। সেই লড়াইয়ের মশাল আবার আমাদের হাতে চলে এল।

    ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ উপন্যাসের শেষে কাঞ্চন একটা বড় যাত্রাপথের অন্তিম লগ্নে বুঝতে পেরেছিল, তার বাবা আসলে আর চারটে সাধারণ মানুষের মতোই, পরিবারের জন্য, অস্তিত্বের জন্য লড়ছে। আমাদের পরিবারগুলো সেই একই লড়াই লড়েছে আমাদের মানুষ করতে গিয়ে। সেই লড়াইয়ের মশাল আবার আমাদের হাতে চলে এল। দেশ, সমাজ, বাস্তব আমাদের আবার সেই বেঁচে থাকার, টিকে থাকার সংগ্রামে শামিল করেছে। সেই লড়াই যতদিনে শেষ হবে, তখন আর হিরো হওয়া হবে না, সিনেমায় দেখা নায়কের মতো গুন্ডাদের মেরে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে সকলের হাততালি নিয়ে ময়দান থেকে বেরোতে পারব না, অথবা বিজ্ঞাপনের নায়িকার মতো সবার চোখের মণি হয়ে উঠব না। 

    আড্ডা শেষ হল ভোরবেলা। চোখের জল, কোলাকুলি, মৃদু হাসি আদান-প্রদান করে আমরা সবাই ঘুমোতে চললাম। আরও কাছাকাছি এলাম সবার। আরও ভাল করে নিজের বন্ধুর জীবনের ছোট্ট মাস্তুল হয়ে উঠলাম। তখন সূর্য উঠছে। মাথায় একটাই ভাবনা চলছে: যারা আগামীর স্বপ্নে ঝাঁ-চকচকে বিনোদনের জগতের বাস্তবকে আঁকড়ে সাঁতার কাটতে চাইছে, সবাইকে গিয়ে বলতে হবে, লড়াইটা এখনও সাধারণ। আমরা হিরো হব না।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook