ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • লিপি বনাম শ্রুতি


    অনুপম রায় (October 9, 2021)
     

    কেলেঙ্কারি কাণ্ড! ছোট থেকে শুনে এসেছি, লোকের কথায় একদম কান দেবে না, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। এটাই বেঁচে থাকার বেসিক নিয়ম। এখন দেখি উলটো, কেউ আর পড়তে চায় না, কানে শুনেই সব হয়ে যাবে বলছে। এ কী সময় এল রে বাবা! 

    ইতিহাসের কথাতেই যদি আসি, হিন্দুদের ‘বেদ’ই হোক বা বৌদ্ধদের ‘ত্রিপিটক’, এ সবই কিন্তু শ্রুতি দিয়ে শুরু। বেদ বা ত্রিপিটক-এর জন্ম-সময় খ্রিস্টপূর্ব বেশ কিছু শতক আগে ধরা হয়। কিন্তু এরা লিপির আকার পেয়েছে অনেক পরে। বুদ্ধদেব যখন গাছের তলায় বসে মাঘধী প্রাকৃত ভাষায় নিজের বাণী দিচ্ছেন, তখন তো আর প্যামফ্লেট বিলি করা হচ্ছে না, বইও পাওয়া যাচ্ছে না পাশের কোনও স্টলে। যা হচ্ছে সব শ্রুতিনির্ভর। অডিও। উনি বলছেন, মানুষ শুনছেন। শুধু সেই গাছতলাতেই নয়, চারিদিকে তাই চলছে। ঋষি বলছেন, বাকিরা শুনছেন। গুরু বলছেন, শিষ্যরা শুনছেন। আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতও সেভাবেই শুরু। গুরু গাইছেন, শিষ্যরা শুনে শুনে গাইছেন। স্বরলিপি এসেছে বহু পরে। ভাতখান্ডের স্বরলিপি তো এই হালের উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর ব্যাপার। এখন লেখা আছে বলে আমরা তর্ক করতে পারি, এখানে শুদ্ধ নিষাদ হবে, ওখানে কোমল নিষাদ। ২০০ বিসি-তে নিশ্চয় তর্কের সেই উপায় ছিল না। গুরু হয়তো শেখাচ্ছেন এক রকম, কিন্তু পুরোটাই শ্রুতিনির্ভর হওয়ার কারণে তাতে বদল আসছে। দেখা যাবে বহু রাগ-রাগিণী এই এত বছরের স্রোতে অনেকটাই পাল্টে গেছে। লালনের গান এখন লালন শুনে নিজেই হয়তো চিনতে পারবেন না। এখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রসঙ্গ অবশ্যই আসবে। রবি ঠাকুরের গানের স্বরলিপি আছে কিন্তু উনি নিজে তো সেগুলো তৈরি করেননি, করেছেন অন্য মানুষ। এবার, এই প্রশ্ন আমার দুষ্ট মস্তিষ্কে সব সময় আসে যে, যিনি দায়িত্বে ছিলেন তিনি কি সব শুনে শুনে ঠিক করেছেন না কিছু হিউম্যান এরর-ও রয়েছে? ধরা যাক, তাঁর রচিত ১৯১৭-তে কোনও গানে অন্তরায় এক জায়গায় রে-মা-পা-নি রয়েছে এবং আভোগে সেই জায়গাতেই আছে রে-মা-পা-ণি। এবার সেই গান ২০১৭ সালের শিল্পী মঞ্চে গাইতে গাইতে থেমে গেলেন, বললেন রবি ঠাকুর বুঝতে গেলে ওঁর এই সূক্ষ্ম জিনিসগুলো বুঝতে হবে। এই যে উনি পরেরবার কোমল নি ব্যবহার করলেন, এটাই ম্যাজিক। উনি বলেই পারলেন। কী দারুণ বললেন! করতালিতে মুখরিত হল প্রেক্ষাগৃহ। এদিকে আমার মাথায় শয়তানি বুদ্ধি, এটা কি সত্যি ওঁর আইডিয়া? হতেই পারে। আবার নাও তো হতে পারে! হয়তো যিনি লিখছেন, তাঁর শোনার ভুল। হয়তো শুনেছেন ঠিক, লেখার সময় ন আর ণ গুলিয়ে গেছে। কিংবা হয়তো লিখেছেন ঠিক কিন্তু যিনি সেখান থেকে নিয়ে ছেপেছেন, তিনি হাতের লেখা বুঝতে পারেননি, ন কে ণ লিখে ফেলেছেন। 

    ঠিক তেমনই, বেদ যখন লিপির আকার পাচ্ছে, সে তো অনেক পরের ব্যাপার। তখন যাঁরা লিখছেন, তাঁরা কি আদৌ তাঁদের পাঁচশো বছর আগে শ্রুতিতে কী চলত হুবহু সেটা লিখছেন? আমরা তো দশ বছরের জিনিসই মনে রাখতে পারি না ঠিক করে। তখন কে রাজা, তিনি কী চাইছেন সেটাও নিশ্চয়ই ঢুকে পড়ছে তাতে। তখন সমাজের কী অবস্থা, সেটার ছাপও থেকে যাছে। সুতরাং এই শ্রুতি থেকে লিপিতে যে কী এসেছে, কতটা জল আর কতটা দুধ— এই নিয়ে ঐতিহাসিকরাও নিশ্চয় ঘেঁটে থাকেন।

    আমি চাই একটু নিরিবিলি, শান্ত দুপুর, হাল্কা করে পাখাটা ছাড়া। আমি আর আমার চোখের সামনে আমার বই। লেখক লিখে গেছেন। এবার ওই অক্ষরগুলো ক্রমে আমার দৃষ্টির মাধ্যমে আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে। তৈরি হচ্ছে কত কিছু। কত ছবি, কত কল্পনা! যেই সেটা অডিও-বুক হয়ে গেল, কোথায় একটা সমস্যা তৈরি হল, পুরো ব্যাপারটার নিরপেক্ষতা কোথাও কম্প্রোমাইজ্‌ড হল।

    এখন দেখছি এত কষ্ট করে সবকিছু লিপিবদ্ধ করার পর মানুষের আবার শ্রুতির দিকে যাওয়ার একটা সাধ জেগেছে। তবে সুবিধে একটাই, এ হল ‘রেকর্ডেড’ শ্রুতি। আপনি এসে বললেন যে, বিভূতিভূষণ লিখেছেন অপুর একটা পোষা পায়রা ছিল। চার-পাঁচজন বিশ্বাস করলেও যে ঠিক করে শুনেছে সে বলবে, না এরকম তো উনি লিখে যাননি। আপনি তর্ক করলে হেরে যাবেন কারণ রেকর্ড আছে। ওই অডিও-বুক শ্রুতি হলেও তার একটা রেকর্ড আছে। আপনি সেটাকে হাজারবার প্লে করলেও অপুর পায়রা আসবে না। বেদ, রামায়ণ, মহাভারতের এই সুযোগটাই নেই। কারণ সেখানে আসল রেকর্ডটাই মিসিং! 

    লিপি নিয়ে মহা জ্বালা। টেক্সট পড়া যে মহাকঠিন কাজ! দীর্ঘদিন নারীদের এসবের থেকে দূরে রাখা হয়েছে। এই করে ৫০% অফ হিউম্যান পপুলেশন লিপির থেকে দূরে থেকেছে। শাস্ত্র নাম দিয়ে এমন এক জিনিস লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যার নাম শুনলেই পাবলিক পালিয়ে যায়। কিছু পড়তে গেলে যে মনঃসংযোগের প্রয়োজন তা মানুষ বোঝে। বেশির ভাগ মানুষেরই সেটা নেই, তাই তারা কেউই পড়তে পছন্দ করেন না। এতে কোনও সংশয় নেই, সংখ্যা দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে। পৃথিবীতে পাঠক আর ক’জন? ‘গেম অফ থ্রোন্স’ ক’জন পড়েছেন আর ক’জন দেখেছেন? বিশাল ফারাক। আমাকে ছেলেবেলায় বই পড়াতে হিমশিম খেত মা-বাবা। বাংলা তো পড়তেই চাইতাম না। মনে পড়ে ক্লাস ফোর, পরদিন বাংলা পরীক্ষা। বিকেল বেলা। আমি ছাদে ছুটে বেড়াচ্ছি আর মা মাদুরে বসে আমার বাংলা টেক্সট-বই থেকে পড়ে পড়ে শোনাচ্ছে। আমি কিছুতেই ওই অক্ষরগুলোর দিকে তাকাতে চাই না। তাকালেই কিলবিল করে আমার মাথা খারাপ করে দেয় ওরা। মা, তুমি পড়তে থাকো, আমি শুনছি তো। যা মনে থাকবে, তাই লিখে আসব খাতায়। তফাত হল একটু বয়স বাড়ার পর, না দেখলে কিছু বিশ্বাস করি না। মাথাতেও ঢোকে না। এটা পুরোপুরি অভ্যাস বলেই আমার মনে হয়। 

    আমার অডিও-বুক শোনার একদম অভ্যাস নেই। কিন্তু আমি দেখেছি আমার কিছু বন্ধুদের, যারা কিন্তু শুরু করে দিয়েছে এই অভ্যাস। গাড়ি চালাতে চালাতে দেখি গল্প শুনছে। আমার খুব অস্বস্তি লাগে। আমি চাই একটু নিরিবিলি, শান্ত দুপুর, হাল্কা করে পাখাটা ছাড়া। আমি আর আমার চোখের সামনে আমার বই। লেখক লিখে গেছেন। এবার ওই অক্ষরগুলো ক্রমে আমার দৃষ্টির মাধ্যমে আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করছে। তৈরি হচ্ছে কত কিছু। কত ছবি, কত কল্পনা! যেই সেটা অডিও-বুক হয়ে গেল, কোথায় একটা সমস্যা তৈরি হল, পুরো ব্যাপারটার নিরপেক্ষতা কোথাও কম্প্রোমাইজ্‌ড হল। চলে এলেন একজন ন্যারেটর। যিনি পড়ছেন। তিনি যতটা স্বাভাবিক ভাবেই পড়ুন না কেন, কিছু তো একটা যোগ হচ্ছে মূল লিপির সঙ্গে। সেখানে আমার এবং আমার লেখকের মধ্যে এই তৃতীয় ব্যক্তিটি হয়ে উঠছেন অতিরিক্ত। আমি চাই না ওঁকে। গানের জন্য যেমন এখন দরকার মিউজিক ভিডিও, বইয়ের জন্যও কি দরকার অডিও? কী রে ভাই! প্র্যাক্টিকাল ভাবে দেখলে মানুষের হাতে সময় কমতে কমতে যে জায়গায় গেছে, এখন মানুষ যদি অপেক্ষা করে থাকে কবে সময় পাবে, তবে সে বই হাতে নিয়ে বসবে, এ আর হওয়ার নয়। তাহলে তার আর বই পড়াই হবে না। বই হল নলেজ আর নলেজ ইস পাওয়ার। এদিকে পরিস্থিতির যা অবস্থা, সমাজ চায় না মানুষ পাওয়ারফুল হোক। তাই হয়তো এসে পড়েছে অডিও-বুক।

    মানুষ চিরকাল শ্রুতি ভীষণ পছন্দ করে। বুদ্ধদেব যেখানে যেখানে গেছেন, দলে দলে লোক গিয়ে শুনেছে তাঁর বাণী। বিচক্ষণ কেউ কথা বললে মানুষ তা শুনবেই। মানুষ শুনতে ভালবাসে। তখন এত টেকনোলজি থাকলে বুদ্ধদেবের পডকাস্ট সুপার হিট হত। হু-হু করে তাঁর সাবস্ক্রাইবার বাড়ত।

    এক সময় মানুষ ভেবেছে রেডিওর দিন শেষ, ভিডিও এসে গেছে। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল এসে গেছে পডকাস্ট এবং তা ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এবার আবার ফিরে যাই বুদ্ধদেব-এর সময়ে। মানুষ চিরকাল শ্রুতি ভীষণ পছন্দ করে। বুদ্ধদেব যেখানে যেখানে গেছেন, দলে দলে লোক গিয়ে শুনেছে তাঁর বাণী। বিচক্ষণ কেউ কথা বললে মানুষ তা শুনবেই। মানুষ শুনতে ভালবাসে। তখন এত টেকনোলজি থাকলে বুদ্ধদেবের পডকাস্ট সুপার হিট হত। হু-হু করে তাঁর সাবস্ক্রাইবার বাড়ত। রেকর্ডেও থাকত যে উনি কী ঠিক বলে গেছিলেন। 

    আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এটা আমার নিজস্ব একটা মেন্টাল ব্লক। আসল ব্যাপারটা হল সমৃদ্ধ হওয়া। ইনফর্মেশন চোখ দিয়ে প্রবেশ করছে না কান দিয়ে প্রবেশ সেটা বড় ব্যাপার নয়, মাথায় কী রেজিস্টার করছে সেটা আসল। এখানে প্রশ্ন এসে যাবে, কবিতার কী হবে? মনে হয় কবিতা পড়া আর কবিতা শোনা দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক্সপিরিয়েন্স। আমার কবিতার শরীরটা দেখতে ইচ্ছে করে। কেমন ভাবে কবি লিখেছেন? এক লাইনে ক’টি শব্দ? এই অনুভূতি যাঁরা চাইবেন, তাঁদের কবিতা পড়া ছাড়া গতি নেই। তবে যেই শ্রুতিতে চলে যাবে বিষয়টি, অন্য স্কোপ আরও বেড়ে গেল। সঙ্গীত ঢুকে পড়তে পারে কবিতার সঙ্গে। সাউন্ড ডিজাইন ঢুকে পড়তে পারে। তবে যে-লেখা পড়তে গেলে চোখ আটকে যায়, এক লাইন দু’তিনবার পড়তে হয় কখনও মানেটা ভাল করে বুঝতে কিংবা আরও বেশি রস আস্বাদন করতে, এরকম টেক্সটের অডিও করা কিন্তু চাপের ব্যাপার।  

    তাই মনে হয় শ্রুতি, লিপি দুই-ই থাকবে। যদি মনে হয়ে থাকে যে একটা অন্যটাকে মুছে দেবে, সেটা বোধহয় সম্ভব নয়।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook