তুমি তা জানো না কিছু
তখনও জীবনানন্দ পড়িনি, কিন্তু হেমন্তকাল এলেই অবধারিত মনখারাপ হত। বড় হয়ে যখন সমস্ত হৈমন্তী মনকেমনের জন্যে জীবনানন্দকে দোষারোপ করেছি, তখন আসলে শূন্যতাকে এড়িয়ে চলতেই চেয়েছি কোথাও। চেয়েছি, কেউ এসে এই ব্যাখ্যাহীন নিঃস্বতার দায় নিক, কেউ এসে আমার হাত থেকে কাঁধে তুলে নিক এই অর্থহীন উদাসীনতার ক্রুশ। তাই জীবনানন্দ দাশ। এই বাংলার হেমন্তের যিশু। নইলে মনখারাপ, সে তো সেই ছোটবেলা থেকেই হত।
আর কী কী হত ছোটবেলায়? কোন কোন খামখেয়ালি গলিঘুঁজির মধ্যে মনখারাপ ওত পেতে লুকিয়ে থাকত আমাদের জন্য? সে টেরই বা পেত কী করে, এবারে এসে গেছে হেমন্তের সন্ধে? তার জন্যে অবশ্য আমরাই দায়ী। আমার ছোটবেলার পুজো মানে বাড়ির হই হই। মায়ের আপন কাকার বাড়িতে পুজোর আয়োজন, সে-পুজো আমাদের বাড়ি থেকে হাঁটাপথে দশ মিনিট। মায়ের কাকার আট ছেলেমেয়ে, তাঁদের সকলের ছেলেমেয়েরা আমার ভাই-বোন-দাদা-দিদি। সব মিলিয়ে সত্যিই বিরাট পরিবার আর বিস্তর আনন্দের অবকাশ। বাড়ির মণ্ডপেই গড়া হত প্রতিমা। খড় বাঁধার সময় থেকে চোখ আঁকা, প্রত্যেক দিন একবার করে ঢুঁ না মারলে আমার অন্তত চলত না। আর পুজোর আগ ঘেঁষে কলকাতার বাইরে থেকে আরও সব মামা-মাসিরা চলে আসতেন বাক্সপ্যাঁটরা হাতে, তাঁদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বছরে ওই একটিবার দেখা, তাই উসুল করে নেওয়া চাইই চাই।
সেই বিশদে আর যাচ্ছি না যে, এমন সৎসঙ্গে আমাদের পাঁচদিনের পুজো কতখানি দীর্ঘায়িত উৎসবের চাদর বিছিয়ে দিয়ে যেত। কিন্তু মুশকিলটা হত সেখানেই। সিঁদুরে মাখামাখি দুর্গা প্রতিমাকে যখন লরির পিছনে তোলা হত আর দেখতাম বাড়ির অনেকের জোড় হাত কপাল থেকে নামিয়ে আনার সময় তাতে ছোঁয়া লাগছে নোনতা চোখের জলের, যখন সে-বছরের মতো শেষবারের জন্য বেজে উঠত জোড়া ঢাক আর কাঁসর, আর বিসর্জনের পথে যাবার সময়ে এক ঝলক পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পেতাম এক ধাক্কায় খালি হয়ে যাওয়া নির্জন নিঃসঙ্গ মণ্ডপটিকে, তখন কেন কে জানে, কান্না পেত খুব, বুকের কাছটায় অব্যক্ত কষ্ট হত। আর আমরা বুঝতাম, হেমন্তকাল টোকা দিচ্ছে। তাই লাগছে। ব্যথা হচ্ছে। ও ঠিক সয়ে যাবে। আস্তে আস্তে।
কিন্তু সইত না শেষমেশ। বদলে বইত। দু’রকম ভাবে বইত। ভার বইত, নামহীন এক ওজনের, এক বায়বীয় ক্রুশের, যা অনেক পরে তুলে দিতে পেরেছিলাম জীবনানন্দের হাতে। আর বইত, বয়ে চলত, এক ফল্গু নদীর মতো, যন্ত্রণার অদেখা ধারার মতো, জাগতিক সব ভাবনার তলা দিয়ে। পাড়ার স্থির, অন্ধকার, ঝিঁঝি-ডাকা পুকুরে ডাকের সাজের নিথর, অসহায় প্রতিমা পড়ার যে-শব্দ, তা আসলে নিস্তব্ধতায় প্রবেশের শেষ দরজা। এইটে বুঝতেই অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছিল আমার, আমাদের। ওই যে দরজা খুলে গেল, আমরা ঢুকে পড়লাম এক অলীক সময়ের মধ্যে, যার ডাকনাম, হেমন্তকাল।
পুজোর বাড়িতে ফিরে এসে আমাদের খুব মনকেমন করত। ‘আসছে বছর আবার হবে’, এই ধ্বনির মধ্যে কোনও সান্ত্বনা আমরা খুঁজে নিতে পারতাম না। কেবল দেখতাম, মণ্ডপ কেমন অপরাধীর মতো একলা দাঁড়িয়ে আছে, তাকে ঘিরে সেই মাতোয়ারা ভিড়, সেই জোরজমকের জাঁক আর নেই কোত্থাও। হাঁটু মুড়ে বসে যখন শান্তিজল নিতাম মাথা পেতে, মনে হত, সব বুঝি ঠান্ডা হয়ে আসছে। সময়, ঋতু, জীবন। সব। আর আকাশ থেকে অজানা, বিশাল পাখির ডানার মতোই নেমে আসছে হিমের আস্তরণ, যাকে দেখা যায় না, কিন্তু যে ভিজিয়ে দিয়ে চলে যায়। হাতের মুঠোর সময়কে যদি ফেলে রাখা যায় টিনের চালে, গাড়ির বনেটে, দোকানে-চাতালে, কয়েক ঘণ্টা পর সে বিন্দু বিন্দু হিমেল ঘামে ভিজে উঠবে। ওই, হেমন্তকালের ঘাম। ঠান্ডা ঘাম। শীতল উত্তাপ। আর আমরা যে যার ট্রাঙ্ক, সুটকেস, আলমারি থেকে নামিয়ে আনব পাতলা চাদরের সৈন্য, বুকপাহারার নাম করে। কত-না দিন ধরে তাদের আগলে রাখা ন্যাপথালিন বলেরা এবার দলছুট বরফ গোল্লার মতো ঠিকানাহীন হয়ে পড়বে, মনখারাপ হত এই ভেবেও। নেহাতই ছেলেমানুষি তা, তবুও, হত।
ফেরার পথগুলো বড় একলা হয়ে যেতে চাইত তখন। সে যেখান থেকেই ফিরি না কেন। স্কুল বা কলেজে থেকে ফিরি, বন্ধুর বাড়ি আড্ডা মেরে ফিরি, কলামন্দিরে সুমনের গানের অনুষ্ঠান শুনে ফিরি, আর পাশের পাড়ার কোচিং ক্লাস সেরেই ফিরি। শিকারি চিতার মতো হেমন্তের শীতলতা আমাদের ওপর নিভৃতে ঝাঁপিয়ে পড়ত, ভাল থাকার টুঁটি টিপে ধরবে বলে। সামনে যে উৎসব নেই আরও, তা কিন্তু নয়। জানি, ক’দিন পরেই দীপাবলির রোশনাইয়ে ঢেকে যাবে চারপাশ, ভাইফোঁটায় আবার জড়ো হওয়া যাবে ক’জন। কিন্তু ওই যে একটিবার বাতাস একটু ঠান্ডা হয়ে লেপটে বসল গায়ে, সে যেন জাপটে নিল মাথার মধ্যে লুকিয়ে থাকা মনকেও। কোথাও হয়তো পুজোর জন্য লাগানো টিউব লাইটের সারি খুলে নেওয়া হচ্ছে, কোথাও রোজকার যাতায়াতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে কোজাগরীর আলপনা, পাড়ার নির্জন কোনও ল্যাম্পপোস্টকে সঙ্গ দিচ্ছে ঝিরঝিরি শ্যামাপোকার ঝাঁক, আর তাক থেকে ফের নেমে আসছে ধুলোময় পড়াশোনার বই, সামনে পরীক্ষা।
সোজা চোখে দেখলে এর মধ্যে মনখারাপের কিছুই নেই, থাকতে পারেও না। কিন্তু সোজা আর আমরা দেখলাম কবেই-বা! ওই নিভে আসা, ফুরিয়ে আসা, নিঃশেষ হয়ে আসার মধ্যে যে-নিরুচ্চার অভিযোগ, যে-নির্জন মেলানকলি ছিল, তা আসলে বায়ুবাহিত রোগ, তা আসলে স্পর্শজনিত অসুখ। যে-অসুখের ওষুধ নেই কোনও।
এসবেরও অনেক বছর পরে, যখন নতমুখ কোনও অলীক মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেছে, যার ওড়নার বাতাস অনুসরণ করে বেপাড়ায় যুদ্ধে যাওয়া যায়, যার সুগন্ধীর রং মিলিয়ে কিনতে চাওয়া যায় বসন্ত, তখনও, হেমন্তের মনখারাপ পিছু ছাড়েনি। বরং ভাসমান কোনও চিরকুটে, বিচ্ছেদ্য কোনও ফোনকলে, অনির্দিষ্ট কোনও কফি-টেবিলে লেপটে থেকেছে, আদরের মতো, নাছোড় ভিখিরির মতো, সীমান্তে মোতায়েন সেনার মতো। আর আমি, সেই কুয়াশাপরিহিত পাড়ার মধ্যে দিয়ে জেগে উঠতে দেখেছি কবিতার জেরুজালেম, যেখানে বিষণ্ণতার দায়ভার কাঁধে চাপিয়ে একলা হেঁটে চলেছেন জীবনানন্দ। আর কানে কানে বলছেন, ‘তুমি তা জানো না কিছু, না জানিলে, / আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে…’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র