যে লোকটা দিন-রাত ছবির জগতে বাস করে, দিন-রাত অর্থ আর খ্যাতির বিড়ম্বনায় অস্থির, তাকে একটু শান্তি পেতে দেখে ভালো লাগে। তার একটু হাসির দাম অনেক। তার মুখে আমি হাসি ফোটাতে পারি, এ কথা ভাবতেও আমার আনন্দ হল। সেদিন বুঝলাম কেন সু্যোগ পেলেই গুরু আমাকে ডাকে।
ইংরেজি ভাষায় একটা কথা আছে— Introvert. সংসারে যারা মানুষ হিসেবে অন্তর্মুখী, তাদেরই বলা হয় ‘ইন্ট্রোভার্ট’। গুরু সেই তাই। আসলে আমি নিজেও সেই তাদের দলে। আমাদের মুখ দেখে আমাদের মনের সন্ধান পাওয়া যায় না। বাইরের মানুষ তাই হামেশাই আমাদের ভুল বোঝে। কেউ আমাদের ভাবে অহঙ্কারী, কেউ ভাবে গম্ভীর, কেউ ভাবে অন্যমনস্ক। আবাএ কেউ-বা ভাবে আমরা খুব ভাবুক।
বাইরের লোক যা কিছু ভাবুক, আমাদের মধ্যে আসল মানুষটার সন্ধান কেউ পায় না। পায় না বলে এত ভুল বোঝাবুঝি, এত অশান্তি। সেই জন্যেই আমি বোম্বাই যাবার পরেই গুরু আমার মধ্যে তার নিজেকে দেখে আনন্দও পেয়েছিল। হয়তো বুঝেছিলাম গুরুর মনের আসল চাবি-কাঠিটা কোথায়!
গুরু বললে— হাতে আপনার এখন আর কিছু কাজ নেই তো!
বললাম— আর দুসপ্তাহের মধ্যেই আমার ‘একক-দশক-শতক’ ধারাবাহিক শেষ করে ফেলবো— তারপর আমি একেবারে ফ্রি—
গুরু বললে— তাহলে কালই আমরা স্টার্ট করছি— কাল ভোরবেলা—
বাড়িতে গুরুর স্ত্রী গীতা নেই। গুরুর মা শ্রীমতী বাসন্তী দেবী নতুন মেয়ে নীনার ভার নিয়েছেন। শ্রীমতী বাসন্তী দেবী শুধু গুরুর মা বলে নয়, তাঁর নিজস্ব অনেক গুণের জন্যে উল্লেখযোগ্য চরিত্র। ছেলে আর মা। একদিন এই মা-ই ছিল গুরুর কাছে সর্বস্ব। গুরু যখন ছোট, এই মা-র কাছেই গুরু পেয়েছে সব চেয়ে বড় উৎসাহ। মা জীবনে কখনও কোনও কাজে বাধা দেয়নি। মা চেয়েছে স্বামীর কাছ থেকে যে-আশা তার মেটেনি, গুরু তাই মেটাবে।
হঠাৎ হয়তো গুরু একদিন মাকে বলেছে— মা, আমি বিয়ে করব—
মা বলেছে— তা করো—
কাকে বিয়ে করবে, সে-মেয়ে কি রকম, কেন বিয়ে করবে, সে প্রশ্ন করেনি মা। গুরুর যদি কোনও বই পড়ে ভালো লেগেছে তো সে-বই মাকে এনে দিয়েছে। ছেলে যেখানে যা কিছু করেছে, যা কিছু দেখেছে, সব মাকে এসে বলেছে। জীবনে গুরু কখনও সন্ধের আগে বাড়ি ফিরে আসেনি। যারা জীবনের নেশায় মশগুল, তারা এত সহজে ঘরের দেয়ালে বন্দী হতে চায় না। যখন কলকাতায় বাবা চাকরি করেছে , তখন এই কলকাতাকে দেখে দেখে একেবারে নতুন করে আস্বাদ করতে চেয়েছে। ছোট ভাই আত্মা। সেও মা-র আদরের। সে কিন্তু লক্ষ্মী ছেলের মতো স্কুল থেকেই বাড়ি এসেছে।
কিন্তু গুরু যখন বাড়ি এসেছে, তখন অনেক রাত। সেই অনেক রাত পর্যন্ত মা জেগে থেকেছে খাবার কোলে করে। তারপর যখন গুরু ফিরেছে, সেই ওত রাত্রে খাবার গরম করে দিয়েছে গুরুর সামনে।
তারপর আস্তে-আস্তে গুরু যত বড় হয়েছে, ততই যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে মায়ের কাছ থেকে। মা ছেলের দেখা হয়েছে ক্কচিৎ-কদাচিৎ। সেই বাসন্তী দেবীকে দেখলাম আবার গুরুর বাড়িতে।
বললাম— অনেক দিন পরে আবার আপনাকে দেখে ভালো লাগল—
বাসন্তী দেবী বললেন— গীতা লন্ডনে গেল, গুরুও মাদ্রাজে চলে যাচ্ছে, তাই নীনাকে দেখবার জন্যে এ-বাড়িতে এখন আমার ডাক পড়েছে—
বললাম— আপনি বরাবর এখানে থাকুন না আপনার ছেলের কাছে—
বাসন্তী দেবী বললেন— এখানে থাকতে আমার ভালো লাগে না—
— কেন?
বাসন্তী দেবী বললেন— গুরু আমার সঙ্গে সবসময় কথা বলে না—
বললাম— ওই দেখে গুরুকে বিচার করবেন না। গুরু নিজের অনেক সমস্যায় বিব্রত হয়ে থাকে। দেখলেন না সুন্দর বাড়িটা কেমন ভেঙে দিলে—
— তা-তো দেখলাম। কিন্তু কথা বলতে দোষ কি?
বললাম— কিন্তু আমার কাছে আপনার অনেক কথা বলেছে গুরু। আপনাকে গুরু মনে-মনে বড্ড ভালোবাসে, আপনাকে খুব ভক্তি করে।
— তা জানি, কিন্তু তাতে কি আমার মন ভরে? সেই আগের ছোটবেলাকার মতো আমাকে আর ওর মনের কথাগুলো বলে না কেন?
বললাম— ওর মনের মধ্যে এখন শুধু যন্ত্রণা। জানেন না, রাত্রে গুরু ঘুমোয় না, ঘুমোতে পারে না। ঘুমের জন্যেই তো পিল খায়, হুইস্কি খায়—
বাসন্তী দেবী বললেন— আজকাল ওই হয়েছে এক জিনিস। যন্ত্রণা কি আমাদের যুগে কম পেয়েছি? ও কি জানে না যে আমি কত কষ্ট করে ওদের মানুষ করেছি। কত কষ্ট করে আমি বুড়ো বয়সে পাশ করেছি, পাশ করে চাকরি করেছি, তবে সংসার চলেছে। অথচ আমি তো সেদিন কারো সঙ্গে কথা বন্ধ করিনি—
বললাম— কিন্তু আমি তো দেখেছি গুরুকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে—
বাসন্তী দেবী বললেন— এক-এক সময়ে তাই বলে। অনেক হাসে, অনেক কথা বলে আমার সঙ্গে, আবার কিছুদিন কোনো কথা বলে না। একেবারে চুপ করে থাকে। আমার মনে হয় আমি বোধহয় গুরুর কাছে পুরনো হয়ে গেলুম। তখন আর এ-বাড়িতে থাকতে ভালো লাগে না, মাতুঙ্গার বাড়িতে চলে যাই—
বললাম— ওটাই ওর স্বভাব। শুধু ওর স্বভাব নয়, ও-স্বভাবটা আমারও আছে, তাই আমাদের সবাই ভুল বোঝে। আপনি ভুল বুঝবেন না যেন—
চলে আসছিলাম। হঠাৎ বাসন্তী দেবী বললেন— আচ্ছা, ওই যে আপনি বললেন গুরু আমার কথা আপনাকে বলেছে, সত্যিই কি তাই? গুরু সত্যিই আমার কথা বলে?
আমি যে গুরুর সঙ্গে ওর মাকে নিয়ে কত আলোচনা করেছি, সে-কথা বললাম। শুধু মা কেন? প্রথম যেদিন বোম্বাই গিয়েছি সেদিনই গুরু তার মার সম্বন্ধে আমাকে বলেছে। মা-ও যে গল্প লেখেন, এটা বলতে গুরুর মুখে গর্বের চিহ্ন ফুটে উঠেছে।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত