সুনীলদা হেসে বললেন, ভুল নেই
আমি পড়তাম লোরেটো কলেজে। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়েছি, থাকি তথাকথিত সাহেব পাড়ায়। তাই সবার ধারণা, আমার বাংলা বই নিয়ে বা সাহিত্য সম্পর্কে তেমন জানা নেই! অন্তত প্রথম জীবনে সেটাই শুনতে হত আমাকে। সবাই ভুলেই গিয়েছিল আমি গোখলে ইস্কুলে পড়েছি, যেখানে অষ্টম শ্রেণিতে ব়্যাপিড রিডার ছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘সীতার বনবাস’, উপনিষদের গল্প, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পণ্ডিতমশাই’, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপায়ের ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’, ‘রজনী’। নবম শ্রেণির মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, শরৎবাবু, বঙ্কিমবাবুকে গুলে খেয়েছি। এমনকী এক বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে মহাভারতের বিশেষ বিশেষ সরস অংশও মুখস্থ। তবে এগুলো ক্লাসিক, তাই আমাদের পড়তে দেওয়া হত। কিন্তু আধুনিক সাহিত্যিক— যেমন সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর, এঁদের সম্পর্কে তেমন জানতাম না। হ্যাঁ, ব্যোমকেশ পড়েছি স্কুলেই। একটা দুটো ফেলুদাও। কলেজে এসব ধুয়েই বাংলা পাসে ডিস্টিনকশন।
তবে সত্যিকার আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় এম.এ পড়তে এসে। সুনীল গাঙ্গুলি ছিলেন আমার প্রথম প্রেম। ওঁর নীরার জন্য কবিতা, ওঁর গদ্য, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস আমাকে অসম্ভব টানতে থাকে। তাই যখন প্রথম বইমেলায় ওঁর সঙ্গে দেখা হয়, আমি আলাপী ও পাকা মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও, কেমন যেন হতবাক হয়ে পড়ি। তখন আমি নাটক করি। আর খোলামেলা জীবন যাপন করি। একটু লাগামছাড়াই বলা যায়।
সুনীলদাদের একটি আসর বসত এখনকার শেক্সপিয়র সরণিতে। সেখানে থাকতেন আমলা, কবি, ডাক্তার ও সাহিত্যিক। সুনীলদা, শক্তিদা, এমনকী সমরেশদাও। আমি বেশ অনেকবার ওই আড্ডায় গেছি। তখন আমার একুশ… সেখানে চলত আবৃত্তি, সমালোচনা, সাহিত্য, সিনেমা নিয়ে রাম বা হুইস্কির পাত্তরে ঝড়। দেশ-বিদেশের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা। সেই সঙ্গে সুনীলদার যৌবনের গল্প, সমরেশদার অভিজ্ঞতা, শক্তিদার প্রাণখোলা উদাত্ত হাসি। পরিস্থিতি কোনওভাবে গম্ভীর হয়ে উঠলেই সুনীলদা গান ধরে নিতেন। এই আসরেই কথা হত নাটক করার। কারণ তখন আমার পরিচয়: আমি জার্মান পরিচালকের নির্দেশনায়, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের অনুবাদে, ‘আন্তিগোনে’ নাটকে অভিনয় করেছিলাম। সেই নাটকের প্রযোজনা বেশ আলোড়ন তুলেছিল। সমালোচনা ও প্রশংসাও হয়েছিল। মাঝেমধ্যেই আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করা হত ওই নাটক নিয়ে। ওই আসরেই একজন হঠাৎ একদিন বলে উঠলেন, ‘তুমি অলোকের বাংলা বুঝে বলতে, না শুধু মুখস্থ করে আওড়াতে?’ কথাটি ব্যঙ্গাত্মক। কারণ আমি ইংরেজি নিয়ে পড়ছি, জিন্স আর ক্রপ টপ বা জাম্পসুট পরি, সাহেবপাড়ায় থাকি। সুনীলদা সেদিন কিন্তু আমার সমর্থনে কথা বলেন। ‘পোশাক বা বেশভূষা দেখে যাচাই না করে, ওর সঙ্গে কথা বলেই বোঝার চেষ্টা করো, ও কী বোঝে আর না-বোঝে।’
এরপর আমি চাকরি পেয়ে গেলাম ‘আজকাল’ পত্রিকায়। তাই আর তেমন সময় হত না ওই আসরে যাওয়ার। আর যিনি ছিলেন আমার সেই আসরের এন্ট্রি পাস, তাঁর সঙ্গেও বাঁধন কেটে যায়। তাই এরপর সুনীলদার সঙ্গে দেখা, আবার যখন নতুন চাকরিতে জয়েন করি ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ কাগজে। সেখানে ঢোকার পর, আমি যেহেতু বাংলা কাগজ থেকে এসেছি, তাই প্রথম দিকে অনুবাদের কাজ দেওয়া হত। আজকাল ডেস্কে টেলিপ্রিন্টার থেকে খবর অনুবাদ করতাম। ইংরেজি থেকে বাংলা। আর এখানে এসে, দুটো বাংলায় লেখা কলাম ইংরেজি করতে দেওয়া হল। তার মধ্যে একটি ছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ফার্স্ট পার্সন’। এই লেখা সপ্তাহে একদিন বেরোত, সুনীলদা লিখতেন নানা বিষয়ে ওঁর ভাবনা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে। প্রথম যে-লেখাটি আমি অনুবাদ করি, সেটি ছিল কলকাতায় যে নতুন মূর্তিগুলো বসানো হয়, সেগুলি নিয়ে। যেমন শ্রীঅরবিন্দর মূর্তি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সামনে, বা রেড রোডে মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি, বা ইডেন গার্ডেন্সের কাছে গোষ্ঠ পালের মূর্তি। উনি এই মূর্তিগুলির শৈল্পিক মূল্যায়ন করেন এবং কিছু ক্ষেত্রে তা বেশ কঠোর মনে হয় আমার। যাই হোক, অনুবাদ করার পর আমার বস আমাকে বলেন, উপরে ‘দেশ’ পত্রিকার দপ্তরে গিয়ে সুনীলদাকে অনুবাদটা দেখিয়ে আনতে। আমি যাই। একটু বাধো-বাধো ঠেকছিল। প্রায় এক বছর পর দেখা হচ্ছে, যিনি আমাকে ওই আসরে পরিচয় করিয়েছিলেন তিনি ছিলেন সুনীলদার বন্ধু। তাঁর সঙ্গে যেহেতু সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে, তাই…
গেলাম ওঁর ডেস্কে, লেখাটা দিলাম। অনেকে ছিলেন ওঁর দপ্তরে। আমাকে তেমন ভাবে চিনলেনও না। পেশাদারি ভঙ্গিতে বললেন, ‘নাও, পড়ো কী লিখেছ।’ অত অজানা মানুষের সামনে পড়তে লজ্জা করছিল। সুনীলদা বুঝতে পেরেছিলেন, বললেন, ‘সাংবাদিকদের ভূষণ লজ্জা নয়, সাহস।’ এক সময় পড়া শেষ হল। সবাই চুপ। আমি অপেক্ষা করছি ওঁর মতামতের জন্য। হঠাৎ ওঁর গুণমুগ্ধদের একজন বলে উঠলেন, ‘ইংরেজিতে আপনি কিন্তু সুনীলদার বাংলার রসটা ধরতে পারেননি। বড্ড সাদামাটা শোনাচ্ছে।’ আমি কী করব ভাবছি। বললাম, ‘কোথায় পরিবর্তন করব বলুন।’ নতুন চাকরি, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ, সব কিছু নিয়ে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। আবার নৈঃশব্দ্য, প্রায় ৩০ সেকেন্ড । সুনীলদাও চুপ। হঠাৎ হেসে বললেন, ‘কোনও ভুল নেই, বাংলার রস কখনও ইংরেজিতে ধরা যায় পাগলি? তুমি যে চেষ্টা করোনি, তাতেই আমি তুষ্ট। খুব ভাল হয়েছে। আমি আকবরকে বলে দিচ্ছি, এরপর থেকে তুমিই আমার লেখা অনুবাদ করবে।’ নতুন চাকরিতে আমার প্রথম দায়িত্ব সুনীলদার দৌলতে।
আর উনি কখনওই সেই আড্ডা বা আমার পুরনো সম্পর্ক নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। এমনকী যখন উনি একা থাকতেন, তখনও না। অবশ্য সুনীল গাঙ্গুলিকে একা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার ছিল। উনি দপ্তরে আসামাত্র চারদিকে ভিড় হয়ে যেত। সকালের দিকে উঠতি লেখক, কবি, আর বিকেলে মহিলা গুণগ্রাহী। তার মধ্যেই উনি লিখতেন, পড়তেন, বোঝাতেন, জনসংযোগ করতেন।
ওঁর মনোযোগ-ক্ষমতা ছিল অসাধারণ! উনি লিখছেন, আর সামনে একদল কবি ফ্যান বসে। কেউ কেউ আবার ওঁর চেহারা, লেখা, কবিতার প্রশংসা করে চলেছেন। আর সুনীলদা লিখে চলেছেন। ওঁর জুলপির রহস্য উদ্ঘাটন করছেন। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম একবার, ‘আপনার অসুবিধে হয় না?’ ‘ওরা আমার লেখা পড়ে বলেই তো আমি লিখি, ওরাই লেখার অনুপ্রেরণা আমার।’ তখন কথাটা পুরোপুরি বুঝিনি, আজ বুঝি।
একবার এক পার্টিতে রিপোর্টিং করতে যাই। অনেক কবি-সাহিত্যিক ছিলেন। সুনীলদাও ছিলেন। চারদিকে তাঁর মহিলা গুণগ্রাহী। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, আপনি যা লেখেন সেগুলো কি জীবন থেকে? ‘অবশ্যই। তবে নিজের জীবন না, আমার চরিত্রের জীবন থেকে।’ আরেকটি প্রশ্ন প্রায়ই ওঁকে করতেন অনেকে। নীরা কে? আপনার প্রেমিকা ছিলেন? না কি আপনার স্ত্রী? আমার সামনে উনি একবার উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আপনি। কিংবা উনি, কিংবা উনি। যে যখন সামনে আছে সে, বা যে পড়ছে— তার চোখে যে আছে সে। কল্পনার কোনও স্থায়ী অবয়ব হয় না!’