শুরুতেই আমার একাদশী পিসের কথা মনে পড়ছে। টেনিদার একাদশী পিসে। তাঁর পৈতৃক নাম কী ছিল তা সবাই ভুলে গেছিল। কিপটেমির জন্য আত্মীয়মহলে নাম হয়ে গিয়েছিল ‘একাদশী’। ওকালতি করে উনি বিস্তর অর্থ উপার্জন করেছিলেন, কিন্তু টাকাপয়সা খরচ ওঁর একদম না-পসন্দ। বাড়িতে কাজের লোক টিকত না, কেউ যদি আসতও, দু’দিন মোটা চালের ভাত আর ডাঁটাচচ্চড়ি খেয়ে দৌড় লাগাত। গোয়ালভরা গরু, কিন্তু দুধ সব বিক্রি করে দিতেন। মাংস খেতেন না নিজের জায়গায়, কারণ তাতে জীবহিংসা হয়। দুটো শিঙিমাছ আনলে মাসখানেক চলত। দাড়ি কামানোর ব্লেড দিয়ে শিঙিমাছের লেজ থেকে আধ ইঞ্চির কুড়ি ভাগের এক ভাগ কেটে নিতেন রোজ। জিয়নো মাছ টেরও পেত না, পরের দিন আবার গজিয়ে যেত। যেদিন মাছ দুটো মরে যেত সেদিন বাড়িতে মহাভোজ। তারপরে একমাস মাছ আসত না। এত মাছ আগে হজম হোক— এই ছিল তাঁর যুক্তি।
এই অত্যাচার বছরের পর বছর সহ্য করে পিসিমা একদিন বিদ্রোহ করলেন। পিসেমশাই তাঁর রোজকার পথ্য খেয়ে নিয়ম মতো কোর্টে চলে গেলে, পিসিমা আনাতে লাগলেন ইলিশ, গলদা চিংড়ি, পাকা পোনা, বিবিধ ভাল ভাল মাছ। তারপর পিসিমা কীভাবে ধরা পড়লেন, পিসেমশাই বা কোন শোকের ধাক্কায় রাঁচি রওনা দিলেন, তার জন্য আপনাদের পড়তে হবে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের অণনুকরণীয় ভাষায় ‘একদশীর রাঁচি যাত্রা’। আমি যা বলতে চাইছি তা হল, টেনিদার পিসির মতো করে না হলেও, বাড়ির কর্তা অফিসে চলে যাওয়ার পর সংসারের অনেক গোপন জানলা খুলে যেত। আর যে-বাড়ির কর্তারা সকালে উঠে অফিস যেতেন না, তাদের বাড়িকে ঘোর অস্বস্তির চোখে দেখা হত। যেমন আমাদের পাড়ায় তানিয়ার বাড়ি। তানিয়ার বাবা শো-অর্গানাইজ করতেন। সারা সকাল ঘুমিয়ে, বিকেলে উঠে পরচুলা পরে চিৎপুর রওনা দিতেন। পাড়ায় কথিত ছিল, প্রত্যেক বছর বিজয়া দশমীর দিন রানিকুঠি পুকুরের পাশে লুকিয়ে থাকতেন, রাতের দিকে ভাসান হওয়া কার্তিকের চুল খুলে পরে নিতেন। আমরা সচরাচর তানিয়ার বাড়িতে খেলতে যাওয়া থেকে বিরত থাকতাম শুধুমাত্র কাকুর উপস্থিতির জন্য।
এখন এই ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ চালু হয়ে, বাবারা সারাদিন অফিস না গিয়ে বাড়িতেই বসে কাজ করছেন, এতে যে সন্তানদের কী দমবন্ধ অবস্থা হচ্ছে, তা ভাবতে বসলে অবধি হাঁপ ধরে যায়। ওয়ার্ক ফ্রম হোম সম্পর্কে বহু আলোচনা, হইহই, রসিকতা কানে আসে। কেউ বলে, বিছানায় বসে বারমুডা পরে আর যা-ই হোক অফিসের কাজ সিরিয়াসলি করা যায় না। অফিসের কিউবিকল, ধোপদুরস্ত জামাকাপড়ের মধ্যেই একটা গুরুগম্ভীর ওজন আছে, তা এড়িয়ে কখনও কাজ হয়? কেউ বলে, বলিস কী, এই যে ট্র্যাফিক জ্যামে সেদ্ধ হতে হল না, ভিড়ে পেষাই হতে হল না, কোনও ফর্মালিটির ধার ধারতে হল না, নিজের বাড়িতে তোফা আরামে আলুভাজা খেতে খেতে মিটিং সারা হয়ে গেল, এতেই তো বরং প্রোডাক্টিভিটি হু-হু করে বাড়বে। অন্যরা তখন বলে, রান্নাঘরের ছ্যাঁকছোঁক, বাচ্চার কান্না, আর পোষা কুকুরের ঘেউঘেউ শুনে মনোযোগ দিয়ে ফাইল ঠেলবি কী করে? কিন্তু আমাকে সবচেয়ে ভাবায় এই নতুন ব্যাপারের যে-দিকটা, তা হল, অফিসের কাজ ছাইভস্ম যা খুশি হোকগে, বাবা ও সন্তানের সম্পর্ক তো এতে বদলে যাবে। বাবা অফিসে বেরিয়ে না গেলে, সন্তান উড়বে কখন? নিজের জীবনটা বাঁচবে কখন? ’পরম্পরা, প্রতিষ্ঠা, অনুশাসন’— এই পৃথিবীর যাবতীয় বাবা যেন ‘মহব্বতেঁ’র অমিতাভ বচ্চন হয়েই জন্মেছেন। সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে গেলে গলায় বাড়তি বেস চলে আসে। নিজে হয়তো ব্যক্তিজীবনে লাদেন, কিন্তু সন্তানকে বিশ্বশান্তির পায়রা হয়ে দালানে ফড়ফড় করে উড়তে বলবেন। এই সবকিছু থেকে সন্তানের মুক্তির নামটা হল অফিস। সে জানে, বকুনি-টকুনি যা হবে, অফিস যাওয়ার আগের সময়টা সেসব সহ্য করে মুখ বুজিয়ে কাটিয়ে দাও, তারপরেই তো স্বাধীনতা। আবার ঝামেলা শুরু হবে লোকটা বাড়ি ফেরার পর, সন্ধেবেলায়।
মায়ের সঙ্গে যুক্তি চলে, তর্ক চলে, কিন্তু বাবা যেটা বলেন তার পর যেন কলম ভেঙে দেন। তার ওপর যেন কিছু যেন বলা যায় না। আত্মা টাইপ— অবিনশ্বর এবং ভয়ের। অতএব ত্রৈরাশিকের অঙ্ক ততক্ষণই, যতক্ষণ বাবা চৌকাঠ না পেরোচ্ছেন। বাবা অফিস বেরনো মানেই, কে সি নাগ থেকে আমি ডিরেক্ট তেন্ডুলকর। মা মৃদুমন্দ প্রতিবাদ করেই হাল ছাড়তেন, কারণ আমরা ছিলাম পার্টনার্স ইন ক্রাইম। আসলে, মা-ও তো বাবা অফিস চলে যাওয়ার পর জগজ্জননী। গোটা ভারত আসছে তখন আমাদের দুয়ারে। মণিপুরের স্ট্রাইপ চাদর (তলায় ঝুমকো উলের বল), অসমের মেখলা, সিকিমের জপযন্ত্র, দার্জিলিং-এর কমলালেবু, গুজরাটের কাচ বসানো সালোয়ারের পিস— কী নেই সেখানে! মাঝেমাঝে বাবা ভ্রুকুটি করে বলত বটে, ‘এটা কবে কিনলে’? সবকিছু মা নৈহাটির দূর-সম্পর্কের বোনের নামে চালিয়ে দিত।
ওরে কোভিড, আর সব কেড়ে নে, আমাদের লুকোনোর জায়গাগুলো কেড়ে নিস না। বাবা যদি অফিসে যাওয়া ছেড়ে ডালগোনা বানায়, সন্তানের আর কী কাজ থাকতে পারে চাল গোনা ছাড়া! ভাবুন, বয়ঃসন্ধির একটি মেয়ে একটি ছেলেকে বলছে, ‘আমাদের যা করার পাঁচটার মধ্যে করতে হবে, তারপর বাবা-মা insta reel করবে।’ একে তো স্কুল নেই, তাই পেটব্যথা, গা বমি-বমি ডাইনোসর হয়ে গেছে। তার উপর যাদের টাই পরে ঘোরার কথা, তারা বেরোচ্ছেই না বাড়ি থেকে। চরম অশ্লীলতা। বাবাকে অনেকক্ষণ অবধি সহ্য করা যায়, শুধুমাত্র এই প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে যে, তাদের অনেকক্ষণ সহ্য করতে হবে না। নিজে বাবা হয়েই কথাটা বলছি। সারাক্ষণ বক্সার পরে বাবা চারপাশে জগিং করছে আর ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছে— এ এক অর্থে শৈশবের ডেথ সার্টিফিকেট।
তাও তো আমি এমন একটা বাবা পেয়েছিলাম, যার তুলনায় আমিও সেকেলে। ২০০৫-’০৬ হবে, মায়ের সঙ্গে ছোট ছোট কথায় ঝামেলা হচ্ছে। আমি ভাবছি দাদা বিদেশে বলে মায়ের মেজাজ খারাপ। বাবা একদিন ডাকল। বলল, ‘এত ঝামেলা হচ্ছে কেন?’ আমি বললাম, ‘দাভাই-কে মিস করছে বলে।’ বাবা বলল, ‘শি ইজ গোয়িং থ্রু হার মেনোপজ… ডিল ডেলিকেটলি।’ বাবাটা আমার অফিস করতে করতেই মরে গেল। ছুটি পেল না।
ছবি এঁকেছেন উপল সেনগুপ্ত