কেরল-এর এক অজ পাড়াগাঁ পায়ানুর। খিটকেল বুড়ো ভাস্করন সেখানে থাকে ছেলেকে নিয়ে। বুড়োর যন্ত্রপাতির প্রতি বেশি বিশ্বাস নেই। বাড়িতে টিভি নেই, রেডিও নেই, ফ্রিজ, মিক্সি— কিচ্ছুটি নেই। পারলে বুড়ো ইলেট্রিসিটি বন্ধ করে দেয়। বুড়োর ছেলে বাবার এই বাতিক নিয়ে পড়ে বিশাল ঝামেলায়। ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হয়েও, বেঙ্গালুরুতে মোটা মাইনের চাকরি পেলেও, ভাস্করন তাকে গ্রামের বাইরে যেতে দেয় না। ছেলে এক রাতদিনের মাসিকে হাতেপায়ে ধরে কাজের জন্য রাজি করালেও, সে-ও দু’দিন পর কাজ ছেড়ে চলে যায়। যে-বাড়িতে টিভি নেই, সে-বাড়িতে কাজ করবে না। মহা ফাঁপরে পড়ে ছেলে। বাবা তার বাতিক ছাড়বে না। ছেলের সব শখে জল ঢেলে বাবা বিন্দাস বসে নিজে হাতে নারকোল কুরিয়ে শিলে বেটে দোসার চাটনি বানায়।
চূড়ান্ত ফ্রাসট্রেটেড ছেলে বাবার হাত থেকে পালাতে রাশিয়ার এক রোবটিক সংস্থায় চাকরি নিয়ে চলে যায়। স্বাধীন জীবন, জাপানি বান্ধবী— সব পেলেও ছেলের বাবাকে নিয়ে চিন্তা যায় না। শেষে উপায় বাতলে দেয় বান্ধবীই। সে বলে, জাপানে তার অ্যালঝাইমার্স-রুগি বাবাকে দেখভাল করত একজন রোবট। সেরকম এক রোবট কেন ছেলেও তার বাবার জন্য অর্ডার করছে না? যে-বাবা জীবনে কোনও দিন রেডিও পর্যন্ত চালায়নি, তার সঙ্গী হতে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে কেরল-এর সুদূর গ্রামে হাজির হয় এক রোবট। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-এর সাহায্যে বিপত্নীক খিটকেল ভাস্করনের নাড়িনক্ষত্র সব বুঝিয়ে ফেলে তার ছেলে। নামহীন এক অ্যান্ড্রয়েড রোবট হয়ে ওঠে ভাস্করনের ছোট্ট ছেলে কুঞ্জাপ্পান।
করোনার প্রথম ঢেউয়ে বাড়িতে বসে এই মালায়লি সিনেমা ‘অ্যানড্রয়েড কুঞ্জাপ্পান’ দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, আহা! আমার জীবন কেন এমন হয় না। ওয়ার্ক ফ্রম হোম, বাচ্চার হোমওয়ার্ক, আর ওয়ার্ক অফ হোমে তখন আমি চিঁড়েচ্যাপ্টা। সিনেমাটা দেখে মনে হয়নি অনেক দূরের সময়ের কোনও কল্পকাহিনি। ছোটবেলায় সত্যজিৎ রায়ের ছোটগল্প ‘অনুকূল’ পড়ে মনে হয়েছিল, টাইমমেশিন যখন আবিষ্কার হবে রোবট হয়তো তখন আমাদের জীবনে আসবে, তার আগে মনে ছিল সাদাকালো টিভিতে দেখা ‘জনি সোকো অ্যান্ড হিজ ফ্লাইং রোবট’ নামের একটি জাপানি টিভি-শো। কোভিডের আগে সিঙ্গাপুরে বন্ধুর বাড়িতে প্রথম পরিচয় হয়েছিল একটি চাকতির সাইজের গুড়গুড়ে রোবটের সঙ্গে। ফিলিপিনো কাজের মাসির থেকে সে অনেক বেশি এফিশিয়েন্ট। তাই সে আসার একমাসের মধ্যে চাকরি খোয়ালো ফিলিপিনো কাজের মাসি। ভেবেছিলাম এইসব বড় মেকি ব্যাপার। আমাদের পোড়া দেশে এইসব আজিব দাস্তাঁ হ্যায়।
কিন্তু কোভিড সব বদলে দিল। ঘরে ঘরে মনে হয় শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আর অদ্রীশ বর্ধনের চরিত্ররা ঘুরছে। সকালে ঘুম ভাঙাচ্ছে অ্যালেক্সা। চান করে ল্যাপটপে অনলাইনে ছেলে স্কুলে পড়ছে, আমি yoga app-এ সূর্য-নমস্কার করে গাইডেড মেডিটেশনে করছি অনুলোম-বিলোম— সময়মতো। কাঁচা বাজার, দুধ, মাছ, সবজি— অ্যাপ টিপলেই বাড়ির দরজায়। বন্ধুর জন্মদিনে মহারাষ্ট্র থেকে অর্ডার করে সোনপথে পাঠাচ্ছি লোকাল কাবাব আর বিরিয়ানি। ইনস্টাগ্রামে ভুজের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সুলেমান ক্ষত্রি পাঠিয়ে দিলেন পুজোর কালা-কটন শাড়ি। শুনছি থিমওয়েডিং-এ ড্রোন যেমন নতুন বউয়ের মাথায় পুষ্পবৃষ্টি করে, খুব শিগগিরি তারা হোমডেলিভারিতে খাবারও সাপ্লাই করবে। ব্যাস, জীবনটা গুপি-বাঘার মতো হয়ে গেল। হাততালি দিলেই ঝুপঝুপ করে মন্ডা-মিঠাই পাতে পড়বে। এহেন হাইটেক জীবনে লক্ষ্মীকান্তপুর বা কলাবাগান বস্তির মালতী বা কাকলি বেমানান। তাছাড়া, দু’বছর আগে যেটা বড়লোকের শখ ভেবেছিলাম, অ্যামাজনে ঢুঁ মেরে দেখলাম ব্যাপারটা অনেক সস্তা। বাসনমাজা, ঘরমোছা আর কাপড়কাচা নিয়ে মলিনার মাইনে পাঁচ হাজার। মানে বছরে ষাট হাজার, আর পুজোয় আরও পাঁচ হাজার বোনাস। অন্যদিকে রোবো-ক্লিনার, ডিশওয়াশার আর ওয়াশিং মেশিন মিলিয়ে খরচ এককালীন প্রায় ৬২,০০০ টাকা। মলিনার মাইনে বছরে পাঁচশো টাকা বাড়লেও, ওদের বাড়বে না। ওদের বোনাস নেই, রান্নাপুজোর ছুটি নেই, বারপুজোয় ছুটি নেই, ট্রেনফেল নেই, বর পেটালে জ্বরে পড়ে থাকা নেই। এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরে কোভিড ছড়ানোর ভয় নেই, আলাদা লিফটে আসা-যাওয়া নিয়ে গজগজ নেই, কাজশেষে সিকিওরিটি গার্ডের কাছে খতিয়ে ব্যাগ-তল্লাশি নেই। এই কাজের মাসিদের ক্লামজি কালচারের থেকে মেশিনের সঙ্গে দোস্তি অনেক ভাল।
সবথেকে বড় কথা: সিকিওরিটি। ছেলের স্কুলে মাইগ্রেশন পড়াচ্ছে। বলছে কী করে বেআইনি পথে ভারতে ঢুকছে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীরা। আর কত বিপদ, অভাব, অভিযোগ তাদের জীবনে। মনে পড়ে গেল মারিয়মের কথা। মুম্বইয়ে আমার প্রথম কাজের মেয়ে। বাঙালি শুনে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলাম। কামড়ে-খামচে হিন্দি বলার বদলে বাড়িতে দু’দণ্ড বাংলা বলে শান্তি পাব। দু’দিন পরেই বুঝলাম, বাংলাটা ঠিক আমাদের মতো না। চেপে ধরতেই বোঝা গেল, কাঁটাতার পেরিয়ে চোরাপথে সে এসেছে এদেশে। আসল বাড়ি বাংলাদেশ। হাওড়া থেকে সোজা গুজরাটে গিয়ে মারিয়ম ভোটার আইডি বানাতে পারলেও, আধার কার্ড করাতে পারেনি। মুম্বইয়ে বস্তিতে-বস্তিতে তখন চলছে চিরুনি-তল্লাশি। বাড়ি ভাড়া পাচ্ছে না— তারকাটা ঘুড়ির মতো এর বাড়ি-তার বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে মারিয়ম ক্লান্ত হয়ে গেল। একটা চিনামাটির বাটিতে ঝাল শুঁটকি মাছ নিয়ে এসে বলল, ‘আমি চললাম। মাছটা খেও, বাটিটা রেখে দিও। অনেক শখ করে কিনেছিলাম।’ বিনা ভিসায় কাঁটাতার পার হয়েছিল এজেন্ট দিয়ে। এবার আগে কলকাতায় যাবে এজেন্ট ধরতে। আমি জানি না, মারিয়ম কোথায় আছে। আদৌ আছে কি না। তবে পরেরবার আর বাঙালি মেয়ের খোঁজ করিনি, মারাঠি মুলগি-ই ভাল আমচি মুম্বইয়ে।
সদ্য অফিস খুলেছে— বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনেশন ড্রাইভ করে। অনেকদিন ট্রেন বন্ধ ছিল— আসতে পারেনি সুমনা। এতদিন ছুটি— ফিরে এসে দু’দিনের মাথায় আবার ছুটি চাই তার। ওবিসি কার্ড রিনিউ করাতে হবে। ‘ওবিসি কী?’ ছেলের প্রশ্ন। ‘Other Backward Class’। ‘সব সার্ভেন্টরাই কি backward class? আর class মানে কী?’ কী বলব ভেবে পাই না। উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে ছেলে মত্ত playstation-এর দাম জানতে। পৈতেতে apathy থাকলেও পৈতেয় পাওয়া টাকায় সদ্ব্রাহ্মণ সদ্কাজে ব্যবহারের স্বপ্নে ডুবে গেছে। তাই রোবট কাজের লোকই ভাল। তার বর্ডার, কাস্ট, ধর্ম কিছুই নেই— কর্মই ধর্ম। আর তাতেই আমাদের মুক্তি।
কিন্তু আমরা কারা? এই ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’ কারা নাচব বাড়ির ছাদে? কারা ডালগোনা আপলোড করব? কারা তুলব রোবট-সেলফি? আমরা, মানে মেয়েরা। কারণ রান্না করা, বাসন মাজা, কাপড় কাচা আর এই সাপ্লাই-চেন ম্যানেজমেন্ট আমাদের দায়িত্ব। এটা পালন করে, সময় থাকলে, বাচ্চার পড়া-ম্যানেজমেন্ট। আর তারপরে একটু-আধটু শখের চাকরি চলতেই পারে। ম্যাকের লিপস্টিক বা ম্যাকবুক কেনার জন্য। এই লেখাটা লিখতে বসার আগে নেট-তল্লাশি করতে গিয়ে দেখলাম হোম-রোবো’র বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়ে প্রায় সব লেখাই ছেলেদের, আর তার কার্যকারিতা বা উপকারিতা নিয়ে রিভিউ করেছে শখের ব্লগার, মূলত যারা হোম-মেকার। আরও অবাক লাগল, বাড়িঘরের কাজ করা রোবটের নাম ব্রাভা, রুম্বা— আর অ্যালেক্সা বা সিরিকে তো আমরা চিনিই। আশা করছি রোবটের জেন্ডার নিয়ে কোনও অস্বস্তিতে আমাদের পড়তে হবে না। আর কাজের মাসির হাত থেকে যে মুক্তি রোবট আমাদের এনে দেবে, আমরা সেটার জোরে কাজের জায়গায় অদৃশ্য কাচের দেওয়াল ভাঙতে পারব, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-অর্থনীতি-রাজনীতি-চিকিৎসাবিজ্ঞানে আরও বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করে জিডিপি-র অংশীদার হতে পারব।
রোবট আমাদের মুক্তি দিক। মুক্ত করুক। শুধু অনুকূলের মতো শক যেন না দেয়। এই ব্যাপারটাই একমাত্র ফুলপ্রুফ এখনও নয়। মানে রোবট বিগড়োলে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটতেই পারে। তবে এইসব মৃত্যুচিন্তা অলীক। তার আগে বাড়িতে বসে অনলাইনে ময়দা আর তাল-তাল মাংস কিনতে কিনতে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া করতে করতে, আমরা স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি আর সুগারেই শেষ হয়ে যাব।
এই লেখা শেষ করতেই শুনলাম— গতকাল আমার রান্নার মেয়ে গীতার ছেলের চাকরি গেছে। মিষ্টির দোকানে ছানা-মাখার কাজ করত সে ছোটবেলা থেকে। কোভিডের ভয়ে মালিক জাপান থেকে ছানা-মাখার রোবট আনিয়েছে। গীতার ছেলে ক’মাস মনমরা হয়ে বাড়িতে বসেছিল। শ্বশুর তাকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছে। বউ পুকুর থেকে মাছ কিনে মাটির উনুনে কীভাবে রাঁধছে, তার ভিডিও আপলোড করেছিল ইউটিউবে। ১০ হাজার ভিউ হয়েছে। গীতার ছেলের মন খুশি। ঠিক করেছে ইউটিউব ভিডিওই করবে। রোজগারও হবে। নামও হবে।
আমার ছেলেও বলেছে, স্কুলের গণ্ডি পেরোবে না— সেও ইউটিউবার হবে। তার মোটে ৩৩টা সাবস্ক্রাইবার। আমার জীবন থেকে গীতা, সুমনা, মারিয়মকে বাদ দিয়ে রুম্বাকে আনলেও, পরের দৌড়ে আমার ছেলে না গীতার ছেলে— কে এগিয়ে থাকবে, কে জানে!
ছবি এঁকেছেন উপল সেনগুপ্ত