আত্মাকে তখনও আমি দেখিনি। তখন সে লন্ডনে বার্মা-শেল অফিসে ডকুমেন্টারি ছবির পরিচালক। কিন্তু গুরুর কাছে তার সম্বন্ধে অনেক কথা তখন শুনে ফেলেছিলাম। তাই ১৯৬৩ সালের জুলাই মাসে যখন গেলাম তখন গীতা ছাড়া গুরুর আত্মীয় স্বজন সকলের সঙ্গেই আবার দেখা হল। মাত্র তো চার-পাঁচটা দিন। চার-পাঁচটা দিনের মধ্যে যেন চার-পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল।
গুরুস্বামীকে বললাম— মাদ্রাজে গুরুর কি ছবি হচ্ছে? গল্পটা ভালো?
গুরুস্বামী সমস্ত গল্পটা আমাকে শোনাল। ছবিটার প্রথমে নাম ছিল ‘শান্তি’। পরে ছবিটা বাজারে বেরিয়েছে ‘সুহাগন’ নাম দিয়ে। মাদ্রাজ বাংলা দেশের মতো গল্পের দেশ। মাদ্রাজী প্রোডিউসারদের সঙ্গে পরে অনেক আলাপ পরিচয় হয়েছে। তাদের কথা থেকে বুঝেছি তারা গল্প শুনতে, গল্প পড়তে ভালোবাসে। গল্পের বই তামিল-তেলেগু ভাষায় বিক্রি হোক আর না-হোক, গল্পের মাসিক-সাপ্তাহিক-পত্রিকা ওদের ভাষায় খুব বিক্রি। অন্তত হিন্দি-গুজরাটি-বাংলার চেয়ে বিশগুণ!
যেদিন বোম্বাই ছাড়বার কথা তার আগের দিন রাত্রেও আমরা দুজন যথারীতি গল্প নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। বললাম— একটা কিছু ঠিক করুন, কি করবেন?
গুরু বললে— একটা বই পেলে আজকাল ছবি করতে সুবিধে হয়—
বললাম— হিন্দি বই-এর খবর তো আমি বিশেষ রাখি না। আপনি বরং কিছু কিছু ভালো বাংলা গল্পের বই কিনিয়ে আনুন, আমি আপনাকে একটা লিস্ট করে দেব—
সত্যিই আমি একটা বাংলা গল্পের বইয়ের তালিকা করে দিয়েছিলাম। আর সেই তালিকার সব বই গুরু কলকাতা থেকে কিনিয়ে আনার ব্যবস্থা করেছিল। সে বইগুলো এখনও গুরু দত্ত স্টুডিওতে গুরুর নিজের আলমারিতে থাক থাক সাজানো আছে। প্রায় দুশো বই। বাংলা দেশের প্রত্যেক লেখকের বই তাতে আছে। কারো নাম বাদ দিইনি সে-তালিকা থেকে। আমি বলেছিলাম— আপনি এই বইগুলো আপনার সময়মতো পড়বেন, তারপর আমরা দুজনে আলোচনা করব এ নিয়ে—
হায়, সে আর হল না! গুরু বইগুলো কিনেছিল ঠিকই, কিন্তু পড়া আর তার হয়নি। তার আগেই সে চলে গেল। যা হোক, পরের দিন ভোরবেলা এয়ারপোর্টে গেলাম দুজনে। ঠিক সময়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু প্লেন বোধহয় সামান্য দেরি ছিল ছাড়তে। সিনেমার যারা স্টার তাদের পক্ষে স্টেশনে বা এয়ারপোর্টে বেড়ানো অস্বস্তিকর। লোকে ভিড় করে, আঙুল দিয়ে দেখায়।
গুরু বললে— চলুন, ওপরে যাই—
ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারলাম। বললাম— আপনাকে সবাই দেখছে—
সে-কথার উত্তর না দিয়ে গুরু সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল। গোটা কয়েক পুলিশ কনস্টেবল সামনে এসে গুরুকে সসম্মানে সেলাম করলে। ইঙ্গিতটা সুস্পষ্ট। গুরু ব্যাগ থেকে কয়েকটা দশটাকার নোট বার করে তাদের বখশিস দিয়ে নিষ্কৃতি পেলে।
এই-ই প্রথম দেখলাম গুরুকে নিজের হাতে মানিব্যাগ থেকে টাকা বার করতে। রতন নেই। সাধারণত ও-কাজটা রতনেরই। রতনই গুরুর ছিল সর্বস্ব। অর্থাৎ তার কাছেই গুরুর সিগারেট দেশলাই থেকে শুরু করে সব কিছু থাকত। একটা মোটা ব্যাগ সব সময় সে বয়ে বেড়াতো। তার মধ্যে আবার থাকত গুরুর কিছু-কিছু বই। গুরুর যদি হঠাৎ কোনো বই পড়তে ইচ্ছে হয়, তখন যেন সে বার করে দিতে পারে।
আমি অনেকবার ভেবেছি মানুষের জীবনের সার্থকতা কিসে! অর্থে? খ্যাতিতে? স্বাস্থ্যে? শান্তিতে? অথচ তাও তো নয়। তা যদি হত তো কোথায় গেল সেই সব মানুষ, যারা সব কিছু পাওয়া সত্ত্বেও আজ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছে। নাকি চিরকাল প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকার মধ্যেও কোনও সার্থকতা নেই?
গুরু বলত— পৃথিবীতে কিছুই চিরস্থায়ী নয়—
বলতাম— কিন্তু শেক্সপীয়ারের নাটক, অজন্তার গুহা-চিত্র, সবই তো এতদিন টিঁকে আছে—
গুরু বলত— আরো কিছুদিন যাক, তখন দেখবেন—
বলতাম— সে দেখবার জন্যে আমি তো বেঁচে থাকব না—
গুরু বলত— আপনি-আমি হয়তো থাকব না, কিন্তু অন্য মানুষেরা থাকবে, তখন তারা শেক্সপীয়ারের নামও শুনবে না, অজন্তার গুহা-চিত্র আর কিছুদিনের মধ্যেই নিঃশেষ হয়ে যাবে, হয়তো একটা ভূমিকম্পের তোয়াক্কা—
গুরু এসব কথা বলত বড় অবলীলায়। কিন্তু শুনে আমার কষ্ট হত। এই পৃথিবীর মহৎ কীর্তিকলাপ কিছুই থাকবে না, সবই বিলুপ্ত হয়ে যাবে, এটা ভাবলেই আমার বরাবর কষ্ট হয়।
কিন্তু গুরুর সঙ্গে আসলে ওইখানেই ছিল আমার তফাত। গুরু ভালো-মন্দ সব কিছুর নশ্বরতায় বিশ্বাসী। তার মতে সব কিছু ভঙ্গুর। পাপ, পুণ্য, স্নেহ-ভালোবাসা, কীর্তি, মহত্ত্ব, সব কিছুর ওপরেই ছিল তার অপরিসীম অনাস্থা। তাই গুরু যেন ছিল আমারই উল্টোপিঠ। ওই বৈপরীত্যটুকু ছিল বলেই এত লোক থাকতে গুরুর সঙ্গে আমার অতখানি অন্তরঙ্গতা হয়েছিল।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত