ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • দখল


    সুভাষ কর্মকার (October 22, 2021)
     

    দিনে-দিনে কাজের চাপ বেড়েই চলেছে। বাড়িতে একদম সময় দেওয়া হচ্ছে না। ছুটির দিনেও কাজ এসে পড়ল। বৌকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার তারিখ ছিল কিন্তু অন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে  বেরিয়ে পড়লাম। কোনওভাবে কাজটা মিস করা যাবে না। রেজিস্ট্রি অফিসে বারোটার মধ্যে পৌঁছাতে  হবে। জমি-সংক্রান্ত কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে। দুই পার্টি সইসাবুদ করলে জায়গাটার দখল পাব। বহুদিনের ইচ্ছে ছিল, গ্রামের জায়গাটা কেনার! গাড়িতে স্টার্ট দিতে গিয়ে দেখি, ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ড কাজ করছে না। মেকানিককে ফোন করতে বলল, ‘এই কাজে অনেক সময় লাগবে।’ এদিকে হাতে একদম সময় নেই। সরকারি অফিসে পৌঁছাতে দেরি হলে বিপদ! অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি না পেয়ে অগত্যা লোকাল বাসে উঠে পড়লাম। বেশিক্ষণ তো লাগবে না! বহুদিন দৌড়ঝাঁপ না করে শরীরটা বেশ ভারী হয়ে গেছে। বাসে প্রচণ্ড ভিড়, কুলকুল করে ঘামছি। সিটের পাশে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে  কাতর নয়নে তাকিয়ে আছি। বসে থাকা মানুষজন কী অদ্ভুত ক্ষমতায় এত ভিড়, অসহ্য গরম, তীব্র  আওয়াজের মধ্যেও হা করে ঘুমাচ্ছে! রাস্তায় কাজ হচ্ছে সম্প্রসারণের। ড্রাইভার মাঝে মাঝে বিচ্ছিরি রকমের ব্রেক দিচ্ছে। ঘুমন্ত মাথাগুলো সামনের সিটে ধাক্কা মারতে গিয়েও প্রতিবার নিজের সিটে ফিরে ফিরে আসছে। এদিকে আমার মাথার উপরে কোনও হাতল নেই। লাগেজ রাখার রডগুলো ধরে হেলে পড়ার জোগাড়। ভিড়ের মধ্যে একজন মহিলার সাথে পেছনদিকে সেঁটে রয়েছে। ভীষণ রকম অস্বস্তি! কলেজ-লাইফে গ্রামের বাড়ির থেকে শহরে যাবার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এইরকম বাসে গাদাগাদি করে  যাতায়াত করার অভ্যাস ছিল। পরে চাকরি পেয়ে গাড়ি চাপা শুরু করে সব ধামাচাপা পড়েছে। এক-একবার মনে হচ্ছে, বাস থেকে নেমে পড়ি। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, এই ধ্যারধেরে গোবিন্দপুরে, মাঝরাস্তায় কোনও শাট্‌ল ট্যাক্সি পাওয়া যাবে  না। দমবন্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। বহুদিন প্রেসার টেস্ট  করানো হয়নি। কে জানে, হার্টফেল না হয়ে যায়!

    ‘এই আমডাঙ্গা, আমডাঙ্গা… আসুন, আসুন, নেমে পড়ুন।’

    হঠাৎ মাঝের  সিটের জংলি ফুল সিট ছেড়ে নেমে পড়ল। জোর বাঁচা বেঁচে গেলাম! মাঝখানের সিটে সরে গিয়ে বাঁ-হাত দিয়ে সিটে মৃদু থাবড়া দিয়ে ইশারা করতে, বয়স্ক মানুষটি চোখদুটো কুঁচকে, হাসিমুখে, ডানহাতের ইশারায় অবলীলায় সিটটা ছেড়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যে অন্য লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

    পাশের সিটের ত্রিমূর্তির মধ্যে জানলার উল্টোদিকের প্যাসেঞ্জার, কন্ডাক্টরের বাসের দরজা বাজানোর  আওয়াজে হঠাৎকরে জেগে উঠে, লুঙ্গি সামলাবে না লাগেজ নামাবে, জগঝম্প করতে করতে অল্প দ্রুত অবস্থায় বাস থেকে তড়াক করে নেমে গেল। ভিড়ের মধ্যে বহুপ্রতীক্ষিত বসার জায়গা পেয়ে হার্টফেলবাবু, মানে আমার এখন একটু শান্তি। বসলাম ঠিকই, কিন্তু জুত হল না। আমার আয়তনের তুলনায় সিটে জায়গা খুবই কম, তার মধ্যে মাঝের ঘুমোযাত্রী মাঝে মাঝেই লাউগাছের মতো আমার   গায়ে লটকে-লটকে পড়ছে। ঘুমন্ত মাথার লম্বা সিঁদুর আমার বুকপকেট রাঙিয়ে দিয়েছে। ঘেমো গায়ের  থেকে জংলি ফুলের গন্ধ আসছে। কতবার সাবধান করা যায়? তবে গন্ধটার মধ্যে একটা পুরনো আবেশ আছে। বহুদিন আগে এইরকম ভাবে আমার বুকে মুখ গুঁজে একজন স্বপ্ন দেখেছিল। এদিকে বৌয়ের ফোন ঢুকল, ‘গ্রামের মন্দিরে সময় পেলে একটু পুজো দিয়ে এসো।’ মন বলছে, ‘কত মন্দিরেই তো পুজো দিলাম কিন্তু পিতৃত্ব এখনও অধরা।’ অনেক বন্ধুবান্ধবে আই.ভি. করার পরামর্শ দিয়েছে। জানালার ধারের ছেলেটার ঘুম ভেঙে গেছে। হলদে দাঁতে ডিমসিদ্ধ কামড়ে মুখে মিলিয়ে যাচ্ছে। এদের ভিড় বাসের মধ্যেই  থাকা-খাওয়া-শোওয়া। ছোটলোকে বাসে চড়ে। সিগন্যালে মনের সাময়িক ছটফটানিকে গাম্ভীর্যের আড়ালে ঢাকতে, চোখে রোদচশমা পরে নিলাম। দার্শনিক চার চোখ জানলার  বাইরে বেরিয়ে দেখতে পেল, চেনা জায়গাগুলো কীরকম যেন পাল্টে যাচ্ছে। শহরের সম্প্রসারণের গ্রাস থেকে বেরিয়ে সবুজ রঙের চাদরে চারপাশটা একটু একটু করে মুড়ে যাচ্ছে। উন্নয়নের এখনও সম্ভাবনা! জমিটা পজিশন পেলে এক বছরের মধ্যেই কারখানা বানাব, তার ছ’মাসের মধ্যে প্রোডাকশন শুরু হবে। এদিকে ঘরে নতুন অতিথি কবে যে আসবে? হঠাৎ লক্ষ করলাম, সিটের পাশে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। বুকের দিকে দু’বোতাম ছেঁড়া জামা দিয়ে হাড়পাঁজরা উঁকি দিচ্ছে। বয়সের ভারে শরীরটা বেশ সামনের  দিকে ঝুঁকে গেছে। চেনা-চেনা লাগছে। একটা সময় লোকটা আমার গ্রামের বাড়ির জঙ্গল পরিষ্কার করত। লোকটার চোখদুটো যেন আমাকে দেখেও বারবার না দেখার ভান করে ঘুরে যাচ্ছে এদিক-সেদিক। একদিন একমাত্র জোয়ান ছেলেটা প্রেমঘটিত কারণে জমির বিষতেল খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। মাঝখানে পেরিয়ে গেছে প্রায় বছর কুড়ি—

    ‘বহুদিন পর, ভাল তো?’

    ঘুমন্ত মাথাগুলো সামনের সিটে ধাক্কা মারতে গিয়েও প্রতিবার নিজের সিটে ফিরে ফিরে আসছে। এদিকে আমার মাথার উপরে কোনও হাতল নেই। লাগেজ রাখার রডগুলো ধরে হেলে পড়ার জোগাড়। ভিড়ের মধ্যে একজন মহিলার সাথে পেছনদিকে সেঁটে রয়েছে। ভীষণ রকম অস্বস্তি!

    কথাটি বলে চুপ করে গেলাম। ভাল-ভাল মন-ভাল-করা কথা আর মাথায় আসল না। ওই লোকের  বর্তমান অবস্থা জিজ্ঞেস করলে আবার যদি টাকা চায়! মানুষটি মাথা ঘুরিয়ে ভিড়ের মধ্যে অতিকষ্টে  দাঁড়িয়ে আছে। একজন বয়স্ক মানুষ বাসে এভাবে ঝুলে-ঝুলে যাবে আর আমি সিটে বসে থাকব? কিন্তু  অন্য কোনও উপায় মাথায় আসল না। বহুদিন পর বাঁদর ঝুলে অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। হঠাৎ মাঝের  সিটের জংলি ফুল সিট ছেড়ে নেমে পড়ল। জোর বাঁচা বেঁচে গেলাম! মাঝখানের সিটে সরে গিয়ে বাঁ-হাত দিয়ে সিটে মৃদু থাবড়া দিয়ে ইশারা করতে, বয়স্ক মানুষটি চোখদুটো কুঁচকে, হাসিমুখে, ডানহাতের ইশারায় অবলীলায় সিটটা ছেড়ে দিল। মুহুর্তের মধ্যে অন্য লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাড়িতে জঙ্গল সাফ করার পরে স্নান করে এদের খাবার জায়গা হত বাড়ির বাইরে উঠোনে। অবশ্যই কলাপাতায়! এখনও কি এইসব মনে রেখেছে? জল খেতে দেওয়া হত মাটির ভাঁড়ে। ওরা চলে যেতেই  জুতো পরে ওদের ফেলে দেওয়া ভাঁড়ের উপরে পা দিয়ে মটকাতে বেশ মজা লাগত। একবার মটকাতে  গিয়ে পায়ে খোঁচ ঢুকেছিল, তার দাগ এখনও বয়ে চলেছি। আচ্ছা, চক্ষুলজ্জার খাতিরে ওই লোকটার  টিকিট তো আমি কেটে দিতেই পারি! উনি চলে যাবার পর মা বাড়ির চারপাশটা একটু গঙ্গার জল ছিটিয়ে দিত। উনি সব কিছু জানতেন কিন্তু মুখে ফুটে কিছু বলতে পারতেন না। চক্ষুলজ্জা আছে না! ছেলেটা মারা যাওয়ার পরে, ওঁর বৌয়ের এক পাশ পড়ে গিয়েছিল। বৌয়ের চিকিৎসার জন্যে বাবার কাছে কিছু টাকা ধার চাইতে এসেছিলেন। বাবা এক পয়সাও ঠেকায়নি, উল্টে ওঁদের বিপদের সময়ে জলের দরে ওঁদের জমি কিনে নিয়েছিল। লোকটা এখনও দাঁড়িয়ে আছেন।

    ‘দাদা, আমার পার্সটা পাচ্ছি না, এই তো এখনই ছিল।’

    লোকটির ছেলের আত্মহত্যার আগের দিন ওর বান্ধবীর সাথে ঝামেলা হয়েছিল।

    ‘পার্সের মধ্যে আধার কার্ড, প্যান কার্ড সব ছিল।’

    মেয়েটির পেটে বাচ্চা ছিল।

    ‘টিকিট কাটার সময় বললাম না, সাবধান! বাসে  ঠগ আছে।’

    ছেলেটি জানতে পেরেছিল, মেয়েটির সাথে আমার গোপন সম্পর্কের কথা।

    ‘টাকা কি ফিরে পাবেন? দরকারি নথিপত্রের জন্যে পুলিশে মিসিং ডাইরি করুন।’ 

    পুলিশি ভয়ে গর্ভপাত করানো হয়েছিল।

    হঠাৎ মানুষের চিৎকারে ঘুম ভেঙে, তাড়াতাড়ি নিজের প্যান্টের পকেট হাতড়াতে লাগলাম। তখনই মোবাইলে বৌয়ের ফোন  আসল, ’তাড়াহুড়োতে তুমি পার্স ফেলে চলে গেছ। ডাক্তার দেখাতে বেরোলাম। দেখি, আবার কী টেস্ট করাতে বলে…’ কথা শুনতে-শুনতে হঠাৎ লক্ষ করলাম,পাশে বয়স্ক  লোকটি হাওয়া। তাহলে কি মানুষ চিনতে ভুল হল! তাড়াতাড়ি সিট থেকে উঠে সিঁড়ি দিয়ে দু’পা নেমে দরজার থেকে পেছনে মাথাটা বাড়িয়ে দেখতে পেলাম, লোকটি পেছনের ভিড় বাসের মধ্যে উঠছে। এটা  কি জমে থাকা ঘৃণা না বৃদ্ধ ভাতা! হঠাৎ করে নিজের সিটের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেটিও দখল হয়েছে।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook