কলকাতায় ফিরে এলাম। আসার আগে গুরু আমায় সব খবরের কাগজগুলো দিয়ে দিলে। বললে— এগুলো আপনি চেয়েছিলেন—
মনে পড়ল, সত্যিই আমি খবরের কাগজগুলো একবার চেয়েছিলাম গুরুর কাছে। কলকাতায় যখন বাংলা ‘সাহেব বিবি গোলাম’ প্রথম মুক্তি পেয়েছিল, তখন সমস্ত কাগজেই প্রায় অপ্রীতিকর সমালোচনা প্রকাশিত হয়েছিল। আমার এই উপন্যাসটার কপালে অনেক অকারণ দুর্ভোগ গেছে সেকালে, মানে আজ থেকে তেরো বছর আগে। বইটি যত বিক্রি হচ্ছিল, ততই গাত্রদাহ হচ্ছিল পত্র-পত্রিকা মহলের। তারই নগ্ন প্রকাশ দেখেছিলাম বাজারে সেটা ছবি হয়ে বেরোবার পর। শুধু এই একটা বই-ই নয়। এইটেই বলতে গেলে আমার স্থায়ী ললাটলিপি। জনসাধারণ এবং সুধী সমাজ তাঁদের অকুন্ঠ ও অকৃপণ সমাদর জানালেও পত্র-পত্রিকা মহলকে আমি খুশি করতে পারিনি। সেটা আমার খানিকটা ব্যক্তিগত স্বভাবের জন্যেই হয়তো দায়ী। আমি স্বভাব-লাজুক মানুষ। সব জায়গায় গিয়ে সকলের সঙ্গে মিলে-মিশে অকারণ হাসি-খুশি আলাপ করতে পারি না। যেটা পারি সেটা হল একান্ত-নিরিবিলিতে বসে ঘাড় গুঁজে বই পড়া বা লেখা।
যা হোক, কাগজগুলো কলকাতায় নিয়ে আসার উদ্দেশ্য ছিল সেটা প্রয়োজন হলে এখানকার পত্রিকা মহলকে দেখানো। তারা জানুক যে যে-গল্পকে তারা তাচ্ছিল্য দিয়ে অপবাদ, নিন্দে দিয়ে কলঙ্কিত করেছিল, বাংলা দেশের বাইরে সেই গল্পকেই অবাঙালিরা কত সম্মান দিয়েছে। বাংলা-সাহিত্যের ওপর কত তাদের শ্রদ্ধা। বাংলা দেশের একজন অবজ্ঞাত লেখককে তারা কত গুণগান করে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।
কিন্তু যে স্বভাবের কথা আগে বলেছি, সেই স্বভাবটা ছিল গুরুরও সহজাত। অর্থাৎ গুরুকেও দেখেছি লাজুক স্বভাবের মানুষ। স্টুডিওতে যে-ঘরটা ছিল তার নিজস্ব, তার বাইরে প্রায় লাল আলো জ্বলতো। সাধারণত কেউ হুট্ করে তার ঘরে ঢুকে পড়তে পারত না বিনা অনুমতিতে। তাই গুরুস্বামীকে বসিয়ে রেখেছিল তার ঘরের আগের ঘরে। গুরুস্বামী অনুমতি দিলে তবে কেউ গুরুর ঘরে ঢোকবার পাসপোর্ট পেত।
আসলে সেটা ছিল তার আবরণ। অকারণে হেসে, অকারণে কেঁদে মানুষের সহানুভূতি বা প্রীতি বা জনপ্রিয়তা আদায় করবার যে সহজ পথ একটা আছে, সেটা গুরুর পথ ছিল না। সে বিশ্বাস করত গুণকে। আমার যদি গুণ থাকে, আমার যদি প্রতিভা থাকে তো আমাকে তুমি ভালোবাসো। তার বেশি কিছু চাই না।
তারপর আরো একটা বিশেষ গুণ দেখেছি তার। শুধু ছবি করলেই হয় না, বা সাহিত্য করলেই হয় না। সাহিত্য করার সঙ্গে-সঙ্গে যেমন কিছু রাজনীতি করার দরকার, এবং রাজনীতি না করলে যেমন সাহিত্যিক হিসেবেও স্বীকৃতি বা সরকারি পুরস্কার পাওয়া যায় না, ছবির মানেও তাই। ছবির জন্য আরো বেশি রাজনীতি দরকার, কারণ ছবি আরো ব্যয়সাপেক্ষ শিল্প। এবং আরো ব্যাপক। বিশেষ করে আজকের যুগে। এবং একটু রাজনীতি করতে না পারলে আপনার ভালো ছবি করেও অপ্রিতিষ্ঠিত থেকে যেতে হবে। অর্থাৎ ভারতীয় সরকারি পুরস্কার তো পাওয়া যাবেই না, বিদেশে যাবার সুযোগ-সুবিধে থেকেই বঞ্চিত থাকতে হবে। অর্থাৎ কিছু খোশামোদ কিছু তদবির-তদারক না করলে আপনার প্রতিষ্ঠার আশা সুদূরপরাহত হবে।
গুরু এই ব্যাপারে ছিল ঠিক আমারই মতো। লোকজনের ভিড়ে সে হাঁপিয়ে উঠত। সেই কারণেই বাইরের লোক তাকে অপবাদ দিত, তাকে অহঙ্কারী বলত। পত্র-পত্রিকায় তার সম্বন্ধে যে-সব কুৎসা-কটূক্তি ছাপা হয়ত, তাও সেই কারণেই।
মনে আছে ১৯৬৩ সালে কলকাতায় বি-এফ-জে-এ তাকে শ্রেষ্ঠ ‘অভিনেতা’র সম্মান দিয়ে একবার একটা পুরস্কার দিয়েছিল। সেই উপলক্ষ্যে সে কলকাতায় এসেছিল। মনে আছে খুব খুশি দেখেছিলাম তাকে। পরের বারে যখন বোম্বাইতে গেলাম তখন গুরু হঠাৎ বললে— বিমলবাবু, আপনি দেখেছেন ‘অমৃতবাজার পত্রিকায়’ আমার ছবি প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছে?
বললাম— কই, দেখিনি তো?
গুরু আলমারি থেকে কাগজটা বার করে এনে দেখালে। সত্যিই তাই।
গুরু বললে— আমার ছবি প্রথম পাতায় কেন ছাপালে বলুন তো?
এ-সব ব্যাপারে গুরু ছিল শিশুর মতো। কেউ তাকে ভালোবাসলে সে গোলে যেত। কিন্তু তার এই শিশু স্বভাবটার কথা কজনই বা জানত। দুঃখ তো তার ছিল সেই জন্যেই। যারা তার কাছাকাছি আসবার সুযোগ পেত, তারা হয় খোশামোদ করতে আসত, কিংবা স্বার্থসিদ্ধি করতে আসত। আর নয় তো তার খ্যাতি-অর্থের সান্নিধ্য পেতে আসত। কেউ তাকে ভালবাসতে কাছে আসতে চায়নি।
সারা আকাশ এই কথাগুলোই ভাবতে-ভাবতে উড়ছিলাম। কিন্তু যত কলকাতার দিকে আসতে শুরু করলাম ততই সিনেমার চেয়ে সাহিত্যের দিকে মনটা ঝুঁকতে লাগল। আবার লেখা, আবার লেখা, আবার সেই কলম পেষা। একদিকে আরাম, আর একদিকে যন্ত্রণা। এই দুই-এর সংগ্রামেই সারা জীবন ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গিয়েছি।
************************************************************************
কলকাতায় এসে আবার গুরুর কথা ভুলে গেছি। নিজের কাজের মধ্যে ডুবে গিয়েছি আবার। তখন আর ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এর কিছুই মাথার মধ্যে নেই। ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বইটা তখন পাঠকদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু করে দিয়েছে। একদিন পাঠকদের কাছ থেকে অনেক স্তুতি, অনেক গঞ্জনা পেয়েছি। এবার অন্যরকম আকর্ষণ অনুভব করতে লাগল পাথক-পাঠিকারা। যাঁরা ঘোষণা করছিলেন যে আমি শুধু অতীত কালের ঘটনা নিয়ে লিখতে পারি, বর্তমানকাল নিয়ে লিখতে পারি না, তাঁরা একটু হতচকিত হয়ে গেলেন। এতদিনে আমার সম্বন্ধে তাঁদের সমস্ত ধারণা বদলে গেল। এবার তাঁরা আমাকে কোন্ দিক থেকে আক্রমণ করবেন, আমার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ আনবেন, তা তাঁরা বুঝতে পারলেন না। হতবাক হবারই কথা। কারণ ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ আর ‘সাহেব বিবি গোলামে’ অনেক তফাত। টেক্নিকের কথা ছেড়ে দিলেও, বক্তব্যের বিস্তার দেখে তাঁরা বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন মনে-মনে। তখন সবাই এ ওর কাছে গিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন— এটা কি হল?
— কোনটা?
তারা বললে— ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ পড়েছেন?
ওঁরা বললেন— ভালো-মন্দ বুঝি না, তবে বইটা বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম উপন্যাস, সে-বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই—
কথাটা যে অনস্বীকার্য, তা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতে লাগলেন। পাতার সংখ্যা গুণে দেখলেন সবাই। দামও বেশি। অন্তত বই-এর বাজারের বিক্রির ইতিহাসে এ একেবারে অভিনব ঘটনা। কেন বই কিনছে সবাই? বইটা যদি খারাপই হয় তো লোকে অত টাকা খরচ করে বই কেনে কেন? লাইব্রেরির পাঠক মহলে রীতিমতো শোরগোল পড়ে গেছে তখন। কেন তাঁরা পড়ছেন? কেন তাঁরা বই কিনছেন?
রীতিমতো রিপোর্ট নিয়ে জানা গেল বইটা পাঠক-পাঠিকাদের নাকি ভালো লেগেছে। তাহলে কি বইটা ভালো হয়েছে? যাঁরা বাংলা-সাহিত্যে ধ্বজাধারী, তাঁরা ফতোয়া দিলেন— ওতে ভয় পেও না তোমরা। বই বেশি বিক্রি হওয়াটাই সুসাহিত্যের লক্ষ্ণ নয়। ‘সাহেব বিবি গোলাম’ও প্রচুর বিক্রি হয়েছে। তাতে ক্ষত বৃদ্ধি হয়নি। দেখতে হবে আমরা ভালো বলেছি কি না—
হিন্দি ছবির ব্যাপারে কোনো উচ্চবাচ্য এই বাংলা দেশে হল না। তাঁরা শুধু লক্ষ্য করতে লাগলেন হিন্দি ছবির বিচারকরা ছবি সম্বন্ধে কী বলেন। যেটা এঁদের এক্তিয়ারের বাইরে।
কিন্তু গুরু দত্ত ছিল আমারই মতন। আগেকার অনেক ছবি করে গুরুর অনেক আর্থিক লাভ হয়েছে। এবার অন্য ধরণের ছবি। এবার আর কেউ বলবে না যে গুরু টাকা উপায়ের জন্য ছবি করেছে। ছবির একটা বক্তব্য আছে। পত্র-পত্রিকাওয়ালারা ছবিটার প্রশংসা করেছে। হিন্দি ছবির জগতে গুরু একটা নতুনত্ব এনেছে। একে একটা কিছু সম্মান দিলে সমস্ত হিন্দি ছবিকেই সম্মান দেওয়া হবে।
তাই ছবিটা বেরোবার পরেই হিন্দি ছবির দর্শকরা একটা নতুন ধরণের রস পেলেন, যা আগেকার কোনও ছবিতেই তাঁরা পাননি। তখন চারদিক থেকে সম্মান-প্রশংসা উজাড় করে আসতে লাগল গুরুর কাছে। ‘ফিল্ম-ফেয়ার’ পত্রিকা ছবিটাকে ১৯৬২ সালের শ্রেষ্ঠ ছবি বলে ঘোষণা করলে। পত্র-পত্রিকার ভোটেও সেই একই ফলাফল ঘোষিত হল। বাংলা দেশেও সে-খবরের ঢেউ কিছু কিছু এসে পৌঁছোল। সিনেমা সংক্রান্ত খবরে এর কিছু-কিছু প্রকাশ হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত হঠাৎ একদিন ঘোষণা বেরোল যে ভারতবর্ষের ছবি হিসেবে ওটাকে ‘বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে’ পাঠাবে।
আমি বরাবর কলকাতায়। কারণ সে সম্বন্ধে আমার কিছু করণীয় নেই। গুরুর ভাই আত্মা কলকাতায় এল। তার মুখে শুনলাম গুরু সমস্ত দিন ছবির এডিটিং নিয়ে ব্যস্ত। তার ধ্যান-জ্ঞান সমস্তই ছবিটাকে ঘিরে। ছবি বিদেশে পাঠাবার আগে অনেক কিছু করণীয় থাকে। যেমন সাবটাইটেল। তাই নিয়েই গুরু সব কিছু ভুলে গেছে। বললাম— গুরু কেমন আছে?
আত্মা বললে— সেই রকমই—
— আজকাল ঘুম হচ্ছে?
আত্মা বললে— কি করে জানব? গুরু তো আমাদের কিছু বলে না—
সত্যিই গুরুর মনের ভেতর কিসের যন্ত্রণা তা কাউকেই বলবে না। বলবে না বলেই সমস্ত যন্ত্রণাটা বুকে পুষে রাখে। আর সেই কারণেই যত অশান্তি!
এদিকে আমি ১৯৬২ সালের নভেম্বর থেকে আর একটা উপন্যাস ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেছি। ‘একক দশক শতক’। সাপ্তাহিক ‘ঘরোয়া’ প্ত্রিকাতেই। এ আমার উপন্যাস ত্রয়ীর শেষ পর্ব। যে উপন্যাস শুরু হয়েছিল ‘সাহেব বিবি গোলাম’ দিয়ে, তারই পরিসমাপ্তি। খন্ডে-খন্ডে দুশো বছরের সামাজিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত। সে উপন্যাস যখন ১৯৬৩-র মাঝামাঝি পর্যন্ত লিখছি তখন হঠাৎ একদিন সকালবেলা ট্রাঙ্ককল এল।
ওদিক থেকে গুরু জিজ্ঞেস করলে— কেমন আছেন?
বললাম— আপনি কেমন আছেন?
— ভালো। আপনি একবার এখানে আসতে পারবেন?
— কেন?
— খুব ব্যস্ত আছেন নাকি? একবার দরকার ছিল আপনার সঙ্গে। এক সঙ্গে মাদ্রাজে যাব। একমাস-দেড়মাস থাকব সেখানে। আসতে পারবেন?
— গল্পের ব্যাপার?
— এলে সব বলব। কবে আসতে পারবেন?
আমি কি জবাব দেব বুঝতে পারলাম না। বেশি সময়ও নেই। এদিকে ‘একক দশক শতক’ শেষ হতে আর মাসখানেক দেরি। উপন্যাসের শেষ দিকটা নিয়েই উদ্বেগ বেশি থাকে। শেষে এসেই যত অশান্তি।
তাড়াতাড়ি বললাম— আচ্ছা যাব—
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত