ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ঢাকা ডায়েরি: পর্ব ৬


    খান রুহুল রুবেল (August 6, 2021)
     

    সাম্যবাদী বৃষ্টি, বাহন রিকশা

    ঈদের ঠিক পরদিন। আমি দাঁড়িয়ে আছি মোহাম্মদপুরে ‘আগোরা’ নামক সুপারশপের সামনে। অনেক মৃত্যুর কথা বলেছি ক’দিন। এখনও মৃত্যু চারপাশে। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল বৃষ্টি, আজ আমি ভরা বর্ষার কথা বলব। বেতারে খবর দিয়েছে, সমুদ্রের মন খারাপ। বিপদ-সংকেতের মাত্রা তিন। ফলে সমস্ত দেশে আদিগন্ত বর্ষা নেমে আসবে। আশ্চর্যের বিষয়, গত দু’দিন বর্ষার অত্যাচারে বারান্দা পর্যন্ত ডোবা হয়ে রয়েছে, আজ ঢাকায় ঝকঝকে রোদ, যদিও উপকূল বিপদসংকুল রইবে আরও চারদিন।

     রিকশা বাহনটা আশ্চর্য। হাতের সংকেত দিয়ে থামানো যায়, বাহনে উঠে বলা যায় কোথায় যাব। কিন্তু আমার নিজেরও জানা নেই আমি কোথায় যাব। ফলে একটা রিকশায় উঠে আমি প্রথমে ধানমণ্ডি যাই, এরপর ওই রিকশাকে অনুরোধ করি নিউমার্কেট যেতে। আমি জানি নিউমার্কেট বন্ধ, কিন্তু বন্ধ দরজায় দাঁড়াবার যে আকর্ষণ, সেটা উপেক্ষা করার ক্ষমতা আমার কই?

    ঢাকায় এখনও লোক ফিরতে শুরু করেনি। ঈদের জন্য কয়েকদিন অনুমতি ছিল লোক চলাচলের। এরপর ফের লকডাউন। লোকজনের দ্বিধা এখনও কাটেনি, তাঁরা কি ঢাকা ফিরবে না ফিরবে না?

    নিউমার্কেট এমন বিরাট, এমন হতদরিদ্র দেখাটা কম আশ্চর্যের নয়। প্রতিবার এমন দেখার জন্যই আমি ঈদের পরদিন নিউমার্কেট আসি। অনেকটা চৌধুরীদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে তাঁদের ভাঙা প্রাসাদ দেখার আনন্দ হয়। কিন্তু বিপুল সওদার এই বাজার তো বন্ধ, আমার রিকশা এখন কোথায় যাবে? এক দরজা বন্ধ দেখলে অন্য বন্ধ দরজায় যেতে ইচ্ছে হয়। অনেকদিন বাংলাবাজার যাই না। ঈদের পরদিন কিছু ঝকমকে বইয়ের দোকান ছাড়া পুরনো বইয়ের বাজার সব বন্ধ। ফলে, আমি রিকশা বদল করি। বাংলাবাজার বহুদূর, বন্ধ বাংলাবাজারে যেতে হলে ভিন্ন রিকশা নিতে হবে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা থেকে বাংলাবাজারের বন্ধ দরজার উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠে পড়ি। পুরনো ঢাকার অলিগলিগুলো চিরকাল মোহনীয়। এত সরু রাস্তা, যেন বাতাস পর্যন্ত যেতে পারবে না। অথচ চারশো বছর ধরে এখান দিয়ে মানুষ পার হয়ে যাচ্ছে, বাতাসের চেয়ে সরু মানুষেরা। নতুন ঢাকা যত দ্রুত কোরবানির বর্জ্য অপসারণ করেছে, পুরনো ঢাকায় সেটা সম্ভব হয় না। ফলে সিটি কর্পোরশনের দক্ষিণ এলাকায় এখনও কোরবানির চিহ্ন রয়ে গেছে। পুরনো ঢাকায় অনেকেই কোরবানির প্রথম দিন কোরবানি করেন না, নিরিবিলি দেখে দ্বিতীয় দিন বেছে নেন। তার নজির মিলল নাজিরা বাজার পার হতেই। নাজিরা বাজার মানেই হাজির বিরিয়ানির দোকান। ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া এই বিরিয়ানির দোকান আজও মুগ্ধ করে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণ কর্পোরেশনের নগরবাসীকে। এই বিরিয়ানির জাদু কী আমি জানি না। কিন্তু এই বিরিয়ানি ছাড়া ঢাকার অন্য বিরিয়ানি আমি বিশেষ খেতে পারি না। সহজ সর্ষে তেলের রসনা, কোনও মশলার বাহার নেই, তেলের প্রাবল্যবিহীন। কোনও কোনও ঢাকাবাসীর জীবনে এই বিরিয়ানি টানা পঞ্চাশের বছরের বিকেলের খাবার। বিক্রি বেড়ে চলে, দোকানের জৌলুস বাড়ে না। টেবিল-বেঞ্চি বাড়ে না। অথচ এই নামে নকল দোকান আছে ঢাকায় অন্তত কয়েকশো।

    পুরনো ঢাকায় একটা গলি পার হতে আধাঘণ্টা লেগে যায়। অথচ ফাঁকা শহরে আজ আধাঘণ্টায় আমি বাংলাবাজার পৌঁছে যাই। যেমন জানা ছিল, বাংলাবাজার বন্ধ। সদরঘাট লঞ্চ স্টেশন থেকে নেমে আসা মানুষের ভিড় ছাড়া আর কোনও কোলাহল নেই। বিশ বছর ধরে বাংলাবাজারে আমার যাতায়াত। তবু কি জানতাম এর এত কাছে বুড়িগঙ্গা নদী? গঙ্গা কোনওদিন বুড়ি হয় না, অথচ কত সহজে বুড়িগঙ্গা হয়ে যায়! আমি রুটিরুজির জন্য যে চাকরি করি, সেটা পরিবেশ সম্পর্কিত। ফলে, বাংলাবাজার আসার একটা গোপন উদ্দেশ্য আছে, বুড়িগঙ্গা দেখে ফেরা। সরকার, বুড়িগঙ্গার চারপাশ থেকে চামড়াশিল্পের কারখানা সরিয়ে নিয়েছে (ট্যানারি কারখানা)। বুড়িগঙ্গার নিকষ কালো জল এখন অনেকটাই স্বচ্ছ। তার জলে সবুজ রঙের কয়েকটা স্টিমার। স্টিমারে সবুজ রং? ঠিক সবুজ নয়, আধা নীল, সবজেটে। যেন মালাকাইটের ঝাঁপি ভেসে আছে বুড়িগঙ্গার জলে।

    নাজিরা বাজার মানেই হাজির বিরিয়ানির দোকান। ১৯৩৯ সালে শুরু হওয়া এই বিরিয়ানির দোকান আজও মুগ্ধ করে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণ কর্পোরেশনের নগরবাসীকে। এই বিরিয়ানির জাদু কী আমি জানি না। কিন্তু এই বিরিয়ানি ছাড়া ঢাকার অন্য বিরিয়ানি আমি বিশেষ খেতে পারি না। কোনও কোনও ঢাকাবাসীর জীবনে এই বিরিয়ানি টানা পঞ্চাশের বছরের বিকেলের খাবার।

    বুড়িগঙ্গার তীর ঘেষে লালকুঠি, যার আদি নাম নর্থব্রুক হল। নামেই কুঠি, আদতে এক ভাঙা দালান। ১৮৭৪ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল জর্জ ব্যারিং নর্থব্রুক ঢাকা সফরে এলে তার সম্মানে এই কুঠি নির্মাণ করা হয়। সাহেব-সুবোদের খাতিরে নির্মাণ করা হলেও, জানা যায়, ভাওয়াল রাজা এ-হল নির্মাণে অর্থ ব্যয় করেছিলেন বিস্তর। তখন শহরের রাজকর্মচারী, পয়সাওয়ালা লোকজনদের সভাসমিতির জন্য এ-ভবন ব্যবহার করা হত। ১৮৮২ সালে কুঠিটি টাউন হল থেকে পাঠাগারে রূপান্তরিত হয়। পাঠাগার হিসেবে বেশ রমরমা ছিল, রীতিমতো বিলেত থেকে বই আনানো হত এই পাঠাগারে। পাঠাগারের সঙ্গে ক্লাব ছিল, নাট্যশালা ছিল, সংলগ্ন রাস্তার নামও কুঠির নামে নর্থব্রুক হল রোড হিসেবে পরিচিত করা হয়। ১৯২৬ সালে ঢাকা পৌরসভা এ-হলে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা প্রদান করে। এখন সেসব সুদূর স্মৃতি। গত পাঁচ বছর ধরে এ-হলের জরাজীর্ণ ভবন আর কোনও কাজেই ব্যবহার করা হয় না। বুড়িগঙ্গার ঘোলা জল ছলছল করে লালকুঠির পাষাণ সিঁড়িতে আছড়ে পড়ে। লালকুঠি কোনও কথা বলে না। বেহুলার মতো সে চেয়ে থাকে, ভেলা ভাসাবার কাল সমাগত। নর্থব্রুক রোড থেকে আমি শহরের দিকে আগাই। আমাকে যেতে হবে বহুদূর, যতদূর গেলে নদীর স্মৃতি ভুলে যাওয়া যায়। মহামারীতে আবদ্ধ ফাঁকা শহরে রাত্রে আর গাড়িঘোড়া মিলবে না।

    ২.
    ২২ জুলাই-২৩ জুলাই, পর পর দু’দিনে কোভিডে মারা গেলেন কবি নুরুল হক, গণসঙ্গীতশিল্পী ফকির আলমগীর। আজম খান, ফিরোজ সাঁই, ফকির আলমগীর— স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, এরাই তো ছিলেন আমাদের রকস্টার। যদিও তাঁরা রক নয়, গাইতেন পপ মিউজিক। মধ্য সত্তরে ও আশির দশকে বাংলাদেশে ব্যান্ড সঙ্গীতের যে উজ্জ্বল উদ্ধার, তাঁরই পূর্বসূরি ছিলেন এরা। মিনমিনে, ন্যাকা, বড় বেশি চারুবাক লিরিকের বদলে তাঁদের গান ছিল তূর্যনিনাদের মতো, ঢাকার মুখের ভাষা, চলতি গালি (আদতে বুলি), রিকশাচালকের প্রেম, শ্রমিকের ঘাম, মহাজনের সর্বগ্রাসী খিদে, রেললাইনের ভাঙা বস্তি, গ্রাম থেকে শহরমুখী মানুষ, এসব কথাকে সিটি বাজানোর মতো করে তাঁরা ছুড়ি দিয়েছিলেন ভদ্রলোকের কানে। ভদ্রলোকেরা নাক সিঁটকিয়েছেন শুরুতে, কিন্তু এই গায়কেরা কান নয়, জিততে এসেছিলেন হৃদয়। বাংলাদেশ তাঁদের হৃদয় দিয়েছিল।

    ‘সেবার বানে সোনাফলা মাঠ হইলো ছারখার
    দেশ-গেরামে শেষে নামে আকাল, হাহাকার
    আমরা মরি কী আসে যায় মহাজনের পাওনা টাকায়
    বেবাক ফসল তুইলা দিলাম আমরা তাগোর খামারে

    জলার পাছে কলা গাছের ছায়া সারি সারি
    তার তলাদি চইলা আইলাম আমি অনাহারী
    হাজার ঠ্যাটায় গরিব ঠকায়, তাকায় রাঙা চোখে
    মিডা কথা কয় না তো কেউ আমরা ছোডলোকে’ 

    এই তো সেই গান, যা উচ্চারণমাত্র লক্ষ স্রোতা হর্ষ আর বেদনা নিয়ে কোরাসে মিলেছেন। ফকির আলমগীরের কথা মনে হলে স্বাধীনতার ‘জাগরণের গান’ থেকে সেই অদ্ভুত ভারী, তেজি, ধীর, বিষণ্ণ গলা মনে পড়বে— ‘আমি দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা… কারুর দানে পাওয়া… নয়’।

    বুড়িগঙ্গার ঘোলা জল ছলছল করে লালকুঠির পাষাণ সিঁড়িতে আছড়ে পড়ে। লালকুঠি কোনও কথা বলে না। বেহুলার মতো সে চেয়ে থাকে, ভেলা ভাসাবার কাল সমাগত। নর্থব্রুক রোড থেকে আমি শহরের দিকে আগাই। আমাকে যেতে হবে বহুদূর, যতদূর গেলে নদীর স্মৃতি ভুলে যাওয়া যায়।

    কবি নুরুল হক ছিলেন এক সন্ত কবিতাসাধক। ছিলেন সরকারি কলেজের অধ্যাপক। অবসর নিয়ে তারপর কবিতাচর্চা শুরু করেন। যে-বয়সে লোকে কবিতা থেকে ছুটি নেয়, সে বয়সে তাঁর কবিতাযাত্রা শুরু। তাঁর ভাষা তাঁর সাহচর্যের মতো সরল; উপমায়, বাক্যে, অলংকারে আঘাতের ফুলঝুরি সে ছোটায় না, বরং বন্ধুর উষ্ণ হৃদয়ের মতো হাত রাখে কাঁধে। তাঁকে নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছিল গত দু’বছর। কিন্তু বয়স আর মহামারী কবিকে আড়ালে নিয়ে শুধু তাঁর কবিতাকে দেখার সুযোগ করে দিল। ‘একটি গাছের পদপ্রান্তে’, ‘সব আঘাত ছড়িয়ে পড়ছে রক্তদানায়’ আমরা হয়তো ফিরে ফিরে পড়ব। কোথাও যেতে যেতে ফিসফিস করে উচ্চারণ করব—

    ‘জীবন এক অপূর্ব দৃশ্য,
    যা দেখে মানুষ
    বাড়ি ফেরার কথা
    ভুলে যায়।’
    (পাদটীকা/একটি গাছের পদপ্রান্তে)

    ৩.
    বেতার ভবনের গোপন একান্ত পুকুরে বৃষ্টির বুলেট দেখে মনে হল, কুকুর হননের এইসব দিনেও কুকুর-বেড়াল বৃষ্টি কিছুতেই থামানো যাবে না। লাল বেতার থেকে দূরে সাদা আবহাওয়া ভবন পর্যন্ত একাধারে ভিজে চলেছে।

    বৃষ্টিই একান্ত সাম্যবাদী— যেসব ভবনেরা বৃষ্টির সন্দেশ প্রচার করে আর যারা কোনওদিন বৃষ্টির কথা বলে না, সকলকেই সে নিজের বারুদে নিহত করে ফেলে। কেননা, আরেকটি ভবনের একাদশ তলা থেকে আমি নিচে তাকিয়ে দেখি পাশাপাশি ভিজে চলেছে একটি সবুজ ও একটি কমলা সিংহ…

    আসলে সিংহ বলে মনে হলেও ওরা লেবু ও কমলালেবুর স্তুপ, বিক্রয়ের অপেক্ষায় রয়ে গেছে। একাদশ তলা থেকে তাদের সিংহ বলে ভ্রম হয়। নাকি সিংহকেই আসলে কমলালেবু বলে ভুল হয়ে যাচ্ছে? পাবলো নেরুদা একবার প্রশ্ন করেছিলেন, বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা একটা একা একা ট্রেনের চেয়ে বিষাদময় আর কিছু পৃথিবীতে আছে কি না! বৃষ্টিতে ভিজতে থাকা একটি কমলা সিংহকে দেখে আমার মনে হল, একাকী ট্রেনের চেয়ে একটা বা অনেকগুলো ভেজা সিংহ আরও দুঃখবিধুর, আরও বেশি কমলা।

    বহুবার, বহুবার আমি তোমাদের বলেছিলাম, এমন মেঘের দিনে তোমরা অহেতুক সিংহ পুষো না। অনেক কমলা নিয়েও, পৃথিবীতে কোনওদিন সিংহ গোপন থাকেনি।

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook