আঁকার মাস্টারের কাছে ছাত্রী এসেছিল তার প্র্যাক্টিকাল খাতায় ছবি এঁকে দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে। আর সেই খাতাতেই বড় বড় করে মাস্টার লিখে দিলেন, ‘দিদিমণি ছাগল’! ব্যাস! সে এক হইহই কাণ্ড! তারপর ছাত্রী যখন একসময়ে ধরেই নিয়েছে, গার্জেন কল অবধারিত— তখনই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ওই শব্দবন্ধ থেকে তৈরি হয়ে উঠল জীবনবিজ্ঞানের নিখুঁত ছবি। পরে এও জানা গেছিল, সর্বোচ্চ নম্বর জুটেছে ওই ছাত্রীরই কপালে।
অবাক লাগলেও একথা আজ না মেনে উপায় নেই, যে কোনও শব্দকে তারই অনুষঙ্গে ছবিতে বদলে ফেলতে চিত্রশিল্পী শুভেন্দু সরকারের সময় লাগে গড়ে পাঁচ মিনিট থেকে সাত মিনিট। আর এ এমনই এক পদ্ধতি, যা শুভেন্দুরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ছবি আঁকার এই পদ্ধতির নাম তিনি রেখেছেন ‘ওয়ার্ডটুন’, অর্থাৎ ‘ওয়ার্ড’ এবং ‘কার্টুন’-এর মিশেল।
কীভাবে এল এই ওয়ার্ডটুনের আইডিয়া? শুভেন্দু জানান, ‘হাতের লেখা ভাল ছিল বলে, স্কুলে বন্ধুদের প্রেমপত্র লিখে দিতে হত। এদিকে স্যারদের কাছে ধরা পড়লে তো চাপ, তাই নামগুলো যাতে বোঝা না যায়, সেগুলো আঁকা দিয়ে ঢেকে দিতাম। যার বোঝার শুধু সেই বুঝবে! বন্ধুরা উৎসাহ দিত খুব। এরপর বাজি রেখেও চ্যালেঞ্জ লড়েছি। যে যা শব্দ লিখবে, তা থেকেই ছবি আঁকতে হবে… আজ অবধি কখনও হারিনি। তবে পুরোটাই মজার ছলে, তখনও সিরিয়াসলি কিছু ভাবিনি সে-অর্থে। একবার তো মনে আছে, ট্রেনে যেতে যেতে বন্ধুরা বলল, তুই এটা ম্যাজিকের মতন করতে থাক, আমরা মাথাপিছু পাঁচ টাকা করে নেব। ১৯৯৮ সালে ১৩৮০ টাকা উঠেছিল, ভাবা যায়!’
শুরুটা এভাবেই। এরপর আর্ট কলেজে পড়াকালীন শুভেন্দুর সামনে খুলে যায় একটা অন্য দিগন্ত। একদিকে পল ক্লি, মার্ক শাগাল, ক্লদ মনে, এডগার দেগারা তাকে তোলপাড় করতে থাকে— পাশাপাশি এই সময়ই তাঁর আলাপ হয় পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়, প্রকাশ কর্মকার, বিজন চৌধুরী, অনীতা রায়চৌধুরীর মতো শিল্পীদের সঙ্গে। ছবি এবং সেই সঙ্গে ছবির ভাষা নিয়ে চলতে থাকে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও, কোথাও যেন থিতু হতে পারছিলেন না তিনি। তাগিদটা ঠিক কোথায় ছিল? তাঁর কথায়, ‘আমার তখন খালি মনে হত, আর্ট শুধুমাত্র কিছু নির্দিষ্ট মানুষের মধ্যে আটকে থাকতে পারে না। সব স্তরের মানুষেরই এতে অংশগ্রহণ করার অধিকার আছে। ছবি শুধু দেওয়ালে ঝুলে থাকবে, এটা দেখতে দেখতেও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। আর এই ভাবনা থেকেই আমি এমন একটা ফর্ম খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম, যার মধ্যে দিয়ে মানুষের সঙ্গে সরাসরি কমিউনিকেট করা যায়।’
২.
২০১০ সাল। ফিরে আসে শব্দ থেকে ছবি তৈরির সেই ভাবনাই। এক কবিবন্ধুর সৌজন্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘Religious’ শব্দটাকে নিয়ে ওয়ার্ডটুনের প্রথম ভিডিও আপলোড করার পরে পরেই, সাড়া পড়ে যায় চতুর্দিকে। শুভেন্দু বলছিলেন, ‘আস্তে আস্তে আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে আমার। একদিন কফি হাউসে এসে লাইভ ওয়ার্ডটুন করি। তারপর বইমেলায়। সেবার বিরাট লোক জড়ো হয়েছিল। সবাইকে বলছিলাম, এক্ষুনি যা মনে আসে লিখুন। আসলে সব সময়েই আমার এটা জানার আগ্রহ থাকত, একজন মানুষ কী ভাবছে। আমি ওই ভাবনার ভেতরে ঢুকতে চাইতাম আর্টের মধ্যে দিয়ে। চেষ্টা করতাম, লোকজনও যেন রিলেট করতে পারে। যেমন একবার একজন লিখল, ‘মদন এখন জেলে’, আমি সেখান থেকে জেলের ভেতরের মদন মিত্রকেই আঁকলাম, কিন্তু সঙ্গে একটা মদের বোতলও এঁকে দিলাম, যেটা ওঁর পকেট থেকে উঁকি দিচ্ছে।’
শুধুমাত্র ছবি নয়। ওয়ার্ডটুনের ভেতর দিয়ে শুভেন্দুর লক্ষ্যই থাকে সমাজের নানান অসঙ্গতির দিকে আঙুল তোলা। কেননা তিনি বিশ্বাসই করেন, আর্ট ছাড়া তাঁর আর প্রতিবাদের কোনও ভাষা নেই। অস্ত্র একমাত্র ব্যঙ্গচিত্র নির্মাণ। দুটো উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে: ‘সুশীল সমাজ’ শব্দটা থেকে যখন ছবি তৈরি হয়েছিল, তখন সেখানে দেখা যায় একজন মহিলা হেঁটে যাচ্ছেন, আর তাঁর লুটোনো আঁচল ধরে রয়েছেন একাধিক শিল্পী-সাহিত্যিক। আর একবার, ‘লোকসভা’ শব্দটা বদলে গেছিল অনেক বাঁদরের ছবিতে।
৩.
এত এত শব্দ, তার এত রকম আকৃতি, কখনও অসুবিধেয় পড়তে হয়নি? এই কথায় শুভেন্দু হাসেন, ‘বললে হয়তো বিশ্বাস করবি না, আমার কাছে কোনও শব্দই আর শব্দ থাকে না তখন। যখনই কেউ কোনও শব্দ লিখে দেয়, আমার কাছে ছবিটা ভেসে ওঠে। তা সে যত খারাপ হাতের লেখাই হোক! আর সেখানে আমার কী বক্তব্য থাকবে সেটাও মুহূর্তে পরিষ্কার হয়ে যায়। শুধু তো বাংলা নয়, আমি ভারতের বিভিন্ন ভাষা থেকেই ওয়ার্ডটুন করেছি। সেক্ষেত্রে মানেটা শুধু বলে দিতে হয়, এই যা!’
পেশা হিসেবে এই মাধ্যমকে বেছে নেওয়ায় এখন বিভিন্ন সংস্থা তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়ে ওয়ার্ডটুন ভিডিও বানাচ্ছে। কেউ-বা বানাচ্ছেন প্রিয়জনের নাম দিয়েও। তবে, এসব ভিডিওর চাহিদা ক্রমাগত বেড়ে চললেও শুভেন্দুর পছন্দ, সেই মানুষের মধ্যে গিয়ে ওয়ার্ডটুন বানানোই, ‘আসলে এসব ভিডিও থেকে প্রচুর পয়সা আসে হয়তো, কিন্তু কোথাও যেন সেই সংযোগটা থাকে না। আমি মানুষের মুখচোখের ওই উত্তাপের মধ্যে থেকেই বেঁচে থাকার প্রেরণা পাই। আমার নিয়মই থাকে, যখন শো করি, একটা ক্যামেরা আমার দিকে থাকে, দুটো থাকে অডিয়েন্সের দিকে।’
৪.
কিন্তু বছর দশেকের মধ্যেই যে ওয়ার্ডটুনের এত জনপ্রিয়তা, কোনও ভিডিও বেরোলেই হাজার হাজার লোক দেখে ফেলছে অল্প সময়ে, তার পরিণতি ঠিক কী? শুভেন্দু নিজেও জানেন না, ‘আসলে এটা তো কাউকে শেখানো যায় না, যার হল তার হল। আমি ওই কারণেই এটাকে ছবি আঁকা বলি না। বলি ম্যাজিক। কেউ কেউ এখন অবশ্য চেষ্টা করছে অল্প অল্প, তবে তা খুবই অ-পরিকল্পিত ভাবে।’
পরম্পরা অনিশ্চিত হলেও কাশীপুরনিবাসী এই শিল্পীর স্বপ্ন এখন একটাই— বিদেশের বিভিন্ন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পৃথিবীর সমস্ত ভাষায় ওয়ার্ডটুন করা। গৃহহীন ইহুদিদের দেখে মার্ক শাগাল যেমন ভেবেছিলেন, ‘যদি আমি এঁদেরকে আমার ছবির ভেতরে আশ্রয় দিতে পারতাম!’ শুভেন্দুর ভাবনাও খানিক সেরকমই। তবে এখানে তাঁর লক্ষ্য মানুষের মন। হাজার হাজার মনের নাগাল পাওয়ার জন্য, এখন তাঁর দিন গোনা শুরু হয়েছে।
ছবি সৌজন্যে: শুভেন্দু সরকার