ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু, না কি বিনা-বিচারে হত্যা, এদেশের কোটি কোটি মানুষের কাছে কেবল একজন নিজের বিশ্বাসে নিষ্ঠ, অদম্য সাহসী, ধর্মপ্রাণ মানুষের মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য হওয়া নয়, এটা এই গণতন্ত্র বলে ঘোষিত দেশের বিচার-ব্যবস্থারও মৃত্যুচিহ্ন। তাই এই দেশের নাগরিক হিসাবে আমরা ভীত আর শোকার্ত। ২০০ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য আমাদের দেশের হাজার হাজার মানুষ, যাঁরা বিদেশি শাসক নিয়োজিত পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেও দমে যাননি, কারাবরণ করেছিলেন, প্রাণ দিয়েছিলেন— তাঁদের আত্মদানের মূল্যে পাওয়া স্বাধীনতাকে আজ আমরা কী করে রক্ষা করব? আইনলঙ্ঘনকারী সন্ত্রাসবাদীদের হাত থেকে নয়, সরকার প্রণীত আইনসমূহকে লাগাতার লঙ্ঘন করে চলা স্বাধীনতা-অপহারকদের হাত থেকে?
সমস্ত জীবনে স্ট্যান স্বামী কাউকে আক্রমণ করেননি, কোথাও গুন্ডাদল বা প্রাইভেট আর্মি পাঠাননি, কাউকে কোনও আক্রমণ সংগঠিত করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে পুলিশও বলেনি। গত তিন দশক ধরে শুধু এই কাজটিই করে যাচ্ছিলেন তিনি— প্রশ্ন করা। তাহলে কেন দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারীদের কাছে এমন ভয়ানক শত্রু বলে চিহ্নিত হলেন এই হাসিমুখ, নম্র, প্রবীণ মানুষটি? একথা ঠিক যে, কোনও মানুষেরই ব্যক্তিগত আদর্শবান জীবন এই রাষ্ট্রপ্রধানদের পক্ষে অলঙ্ঘনীয় নয়। আনন্দ তেলতুম্বড়ে, কবি ভারভারা রাও, সুধা ভারদ্বাজ থেকে শুরু করে অধ্যাপক জে ডি অগ্রওয়াল, স্বামী নিগমানন্দের মত সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী পর্যন্ত কারও জীবনের, কথার, আদর্শবাদের কোনও তোয়াক্কা করেন না তাঁরা— যাঁদের হাতে আমাদের সাংবিধানিক ও নাগরিক নিরাপত্তার দায়িত্ব। যাঁরা শপথ করে সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যে মানুষদের এই রাষ্ট্র বিনা বিচারে বছরের পর বছর বন্দি করে রেখেছে, তাঁরা কোনও একটি গোষ্ঠী, জাত বা ধর্মের মানুষ নন। এঁদের মধ্যে অনেকে পরস্পরকে হয়তো চিনতেনও না, যদি না পুলিশ তাঁদের একই ‘মামলা’র ফাঁসে আটকে রাখত। কেবল একটি জায়গায় তাঁদের মিল— তাঁরা দেশের সম্পদ-রক্ষাকারী অথচ অত্যাচারিত দুঃখী মানুষদের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য এগিয়ে এসেছেন। আর হ্যাঁ, আর একটা মিলও আছে— সে হল তাঁদের প্রত্যেককে দেশের শাসক ও শাসকের হাতের যন্ত্রগুলি ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ হিসাবে গণ্য করে। এঁদের প্রায় সকলেরই মতো স্ট্যান স্বামীর কাজ ছিল অত্যন্ত প্রকাশ্য। বরং প্রকাশ্য হওয়াই তাঁর কাজের প্রথম শর্ত ছিল, কারণ তিনি প্রশ্ন করছিলেন স্বয়ং সরকারকে। আর সমস্ত অভিজ্ঞতাটি লাভ করছিলেন দিনের পর দিন প্রত্যক্ষ সম্পর্কে আসা মানুষদের কথা থেকে— কোনও ইস্তাহার বা প্রচার-পুস্তিকা থেকে নয়।
১৯৭৫ সাল থেকে প্রায় ১৬ বছর একটানা তিনি যুক্ত ছিলেন বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইনস্টিটিউট’-এর সঙ্গে। তার মধ্যে ১১ বছর ছিলেন সেখানকার ডাইরেক্টর। কার্যোপলক্ষে বারেবারে এসেছেন ঝাড়খন্ডে। একজন দরদি মানুষ হিসাবে, করুণাধর্মে আস্থাবান একজন সন্ন্যাসী হিসাবে, দিনের পর দিন দেখছিলেন সেখানকার এক বিরাটসংখ্যক মানুষের অকল্পনীয় দুর্দশা। জাতের নামে, ধর্মের নামে, সংস্কৃতির নামে কীভাবে ক্ষমতার হাতে সেই মানুষরা পিষে যাচ্ছিল, যারা শুধু ওই রাজ্যের নয়, সমগ্র সভ্যতার ভিত্তিভূমির রক্ষক। ১৯৯০-এর দশক থেকে তিনি চাইবাসায় থাকতে শুরু করেন, আর যুক্ত হন ‘জোহার’ নামে একটি স্থানীয় সংগঠনের সঙ্গে। ‘হো’ সমাজকে অনেক কাছ থেকে দেখেন ফাদার। অভ্যস্ত হন তাঁদের ভাষায়। জানেন, কীভাবে আদিবাসীদের জীবনযাপনের ধরনের মধ্যেই আছে সেই শিক্ষা, যা আজকের পৃথিবীকে রক্ষা করতে সক্ষম তার সবচেয়ে বড় সঙ্কটের— উষ্ণায়নের, হাত থেকে। যেই জীবনযাপন সকলের সরল সুখের ব্যবস্থায় অভ্যস্ত অথচ তাঁদের জীবন কাটে সমাজের প্রান্তে, ক্ষমতাশালীর কারণবিহীন অত্যাচার ও ধ্বংসাত্মক কাজের নীচে পড়ে থাকা যন্ত্রণায়।
এর মধ্যে দেশে ও বহির্বিশ্বে বাড়তে থাকা পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের চাপে, এদেশেরও বিভিন্ন সরকারকে কিছু কিছু পরিবেশ-বান্ধব আইন তৈরি করতে হয়। কিন্তু দশকের পর দশক চলে গেলেও সেই আইনগুলির বাস্তব প্রয়োগ কোথাও দেখা যায়নি। সরকারের কাজের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখেই স্ট্যান স্বামী বারেবারে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন তুলতে থাকেন যে, শুধু ঝাড়খন্ডে নয়, দেশের কোথাও কেন এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলি পালিত হচ্ছে না। আইন পালন করা একজন নাগরিক হিসাবে তিনি ঠিক তা-ই করছিলেন, যেটা তাঁর করার কথা— আইন কেন পালিত হচ্ছে না সেই কথা জানতে চাইছিলেন, আর আইন না-মানার ফলে যেসব ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে (যেগুলো বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ওইসব আইন চালু করা হয়েছে), সেই বিষয়ে দেশের সর্বোচ্চ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছিলেন।
কী ধরনের আইন লঙ্ঘন বিচলিত করছিল তাঁকে? ২০১৮ সালে ঝাড়খন্ডের আদিবাসীদের এক বড় অংশের পিঠ ঠেকে গেছিল খনি-খাদানের উপদ্রবে। সরকারের হাত থেকে অধিকার নিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি এজেন্সি এসে তাঁদের জঙ্গল কেটে, মাঠ কিংবা ক্ষেত, গ্রামের জমি উপড়ে খুঁড়ে ফেলে খনি করতে আরম্ভ করে। একই অবস্থা ছিল ওড়িশা, ছত্তিসগড়েও। নিরুপায় হয়ে ঝাড়খন্ডের আদিবাসী সমাজ অবলম্বন করে নিজেদের প্রাচীনকালের এক প্রতিরোধ-পদ্ধতি: পাথলগড়ি। গ্রামের পর গ্রাম প্রবেশপথে প্রকাণ্ড পাথরখণ্ডের ওপর তাঁরা লিখে দেন তাঁদের নিজেদের প্রবর্তিত নিয়মাবলি।
যেভাবে যাদের দ্বারা সরকারি আইনসমূহ লঙ্ঘিত হচ্ছিল, তাদের কোথাও থেকে শাসন বা এমনকী নিয়ন্ত্রণেরও কোনও প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। কিন্তু যাঁরা সেই অধিকার রক্ষার দাবি তুলেছিলেন, তাঁদের আন্দোলনকে সমর্থনের ‘অপরাধে’ রাজ্যসরকার স্ট্যান স্বামীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করে! এই সময়ে ফাদার স্ট্যান স্বামী একটি সুসংহত নিবন্ধে সরকারের কাছে তাঁর আদিবাসী অধিকার ও পরিবেশ সংক্রান্ত অধিকারের প্রশ্নগুলোকে তুলে ধরেন। আটটি আলাদা আলাদা অনুচ্ছেদে নির্দিষ্টভাবে তিনি নিজের প্রশ্নগুলোকে সন্নিবিষ্ট করেন। সরকারের নিজের তৈরি গুরুত্বপূর্ণ আইনগুলো কেন সরকার নিজে পালন করছে না? আর যেসব নতুন আইনবলে পুরনো আইন বাতিল করে আদিবাসী বা তপশিলী লোকেদের জমি-মালিকানা পালটে দেওয়া হচ্ছে, সেগুলো সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের কিছুই জানানো হয়নি, কেন? মূলত এই ছিল তাঁর প্রশ্ন। মূল লেখাটির (‘The Wire’ ওয়েব-পত্রিকায় প্রকাশিত) লিংক এই নিবন্ধের শেষে থাকবে, তবু উদাহরণ হিসাবে এখানে আমি তার কয়েকটি অনুচ্ছেদের উল্লেখ করছি। যেহেতু শহরবাসী হিসাবে জমির মালিকানার প্রশ্ন আমাদের সামান্য বসতজমির সঙ্গেই জড়ানো এবং সেগুলির ব্যাপারে কাগজপত্র দলিল আইন বিচারব্যবস্থা, সহজবোধ্য কারণেই, অনেক সুসংহত, তাই আদিবাসী বা তপশিলী লোকেদের জীবনে জমি-মালিকানা ব্যাপারটার গুরুত্ব প্রায়ই আমাদের কাছে ততটা স্পষ্ট নয়। এই মানুষটি নিজের দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতায় সেই কাজটা করছিলেন, যা এদেশের কোনও রাজনৈতিক দল করেনি। দেশের বিরাটসংখ্যক নাগরিকের (আমি বুঝতে পারি না দেশের অধিকাংশ মানুষ যখন বিভিন্ন ধরনের গ্রামে বাস করেন, তাহলে তাঁদের বোঝাবার জন্য ‘নাগরিক’ শব্দটিই কেন ব্যবহৃত হবে! এতে কি শিক্ষিত শহরবাসী লোকেদের, বুদ্ধিজীবীদের, ধারণা ও চিন্তার দৈন্যই প্রকাশ পায় না যে, সিটিজেন-এর আক্ষরিক শব্দান্তর ছাড়া কোনও সঠিক শব্দ ভেবে ওঠার প্রয়োজন বা সাধ্য আমাদের হল না!) বেঁচে থাকার, জীবনধারণ করার প্রাথমিক শর্তগুলো সরকারি ভাবে কেন লঙ্ঘিত হবে, একথা নিয়ে দুই দশকের বেশি সময় ধরে একভাবে প্রশ্ন করে গেলেন। এর ফলে আর কিছু না হোক, সরকারের সঙ্গে ‘লোকদেখানো আইনগুলো’র সম্পর্ক স্বীকার করে রাষ্ট্রকে নিরুত্তর থাকতেই হল। তখন রাজা পথের আঙুলতোলা বালকটিকে জেলখানায় বন্ধ করলেন।
স্বাধীনতার প্রায় ৬০ বছর পর, ১৯৯৬ সালে, ‘পঞ্চায়েত আইন (Extension to Scheduled Areas)-এ সরকার প্রথমবার একথা স্বীকার করে, আদিবাসীদের মধ্যে প্রথাগত ভাবে গ্রামসভার মাধ্যমে স্বশাসনমূলক একটি কার্যকরী ও সমৃদ্ধ সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে। কিন্তু সরকার নিজে এই আইনটিকে অ-কার্যকর করে রাখল। অর্থাৎ সরকার স্বয়ং চাইল না, আদিবাসীরা ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তাঁদের নিজেদের শাসনব্যবস্থার অধিকারী হোন অথবা তাতে কোনও অংশ নিন।
ভারতীয় সংবিধানের ৫ম তফসিলে স্পষ্ট বলা আছে, আদিবাসীদের মধ্য থেকে আসা সদস্যদের সমন্বয়ে একটি ‘ট্রাইবস অ্যাডভাইসরি কাউন্সিল (টি এ সি) গঠিত হবে এবং রাজ্যের আদিবাসীদের সুরক্ষা উন্নয়ন ও কল্যাণ বিষয়ক যে কোনও বিষয়ে ওই কাউন্সিল বা পর্ষদ রাজ্যপালকে পরামর্শ দেবে। বাস্তবে দেশের ন’টি আদিবাসীপ্রধান রাজ্যে এই ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এই আইনে বলা ছিল, কোনও রাজ্যপাল আদিবাসীদের স্বার্থ বা সুরক্ষার পরিপন্থী মনে করলে সংসদ বা রাজ্য বিধানসভা প্রণীত কোনও আইনকে বাতিল করে পর্ষদের পরামর্শে নিজে আইন তৈরি করতে পারেন। এই আইনের প্রয়োগ গত পাঁচ দশকের মধ্যে দেশে কোথাও কোনও উপলক্ষেই দেখেননি কেউ। কেন? এটি ছিল স্ট্যান স্বামীর তোলা অন্যতম একটি প্রশ্ন।
তাঁর আরও প্রশ্ন ছিল, নিজ অঞ্চলের জল জমি জঙ্গলের সঙ্গে আদিবাসী সমাজের যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক, সেই বিষয়ে। বহু মর্মান্তিক লাঞ্ছনা ও ধ্বংস— কেবল আদিবাসীদের জীবনের নয়, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদেরও, বহু আন্দোলন, দুঃখবরণের পর ২০০৬ সালে প্রবর্তিত এক ‘বন অধিকার আইন’-এ এই চিরাচরিত অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বিপুল উৎসাহ দেখা গিয়েছিল দেশময় পরিবেশ-কর্মী এবং আদিবাসীদেরও মধ্যে। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ ছিল, ‘জমির নিচে যদি কোনও খনিজ থাকে, তার মালিকানাও জমি-মালিকের।’ এই আদেশের ব্যাখায় মহামান্য আদালত বলেন, ‘আমরা অভিমত দিচ্ছি যে, আইনে এমন কিছু নেই যা ঘোষণা করে যে রাজ্যের সমস্ত খনিজ সম্পদ জমির মালিকের না হয়ে সরকারের হাতে থাকবে। জমির অধিকার যাঁর হাতে, জমির নিচের খনিজ সম্পদের মালিকানাও সাধারণভাবে তাঁরই হবে, যদি না কোনও বৈধ প্রক্রিয়া দ্বারা জমির মালিক স্বেচ্ছায় এই জমি ছেড়ে দেন।’
বাস্তবের ছবিটা কীরকম? ঝাড়খন্ডে আদিবাসীদের জমির নিচেকার খনিজ, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো বর্বরভাবে লুট করছে। দেশের সরকার যেসব কয়লা-ব্লক বেসরকারি মালিকদের মধ্যে বিতরণ করেছেন— সুপ্রিম কোর্টের মতে, তার ২১৯টা ব্লকের মধ্যে ২১৪টাই বেআইনি। সেই প্রত্যেকটি খনি অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ আসে, এবং এতদিন সেগুলো চালানোর জন্য জরিমানা ধার্য হয়। তারপর? ম্যাজিক রিয়ালিজমের জন্ম হয়। বেআইনি খনিগুলো সরকার নিলাম ডেকে বিক্রি করে দেয়। পুরনো মালিকরা সেগুলো কিনে নিয়ে আবার খোঁড়া শুরু করেন। কেবল চোর দাঙ্গাকারী ও সর্বোপরি ‘নকশাল’ বন্দিতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জেল ও পুলিশ স্টেশনগুলো ভরে ওঠে।
যখন ছত্তিসগড়ে ‘সালোয়া জুড়ুম’-এর আদিবাসীদের দিয়ে অন্য আদিবাসীদের খুন করানো, ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, হাজার হাজার ‘মাওবাদী দমন’ হচ্ছিল, অনেকেরই মনে থাকবে, সেসময় ওই সমগ্র এলাকাটি জুড়ে চলছিল প্রাচীন জঙ্গল কেটে ফেলা। পরবর্তী পর্যায় ছিল খনি খোঁড়ার বিরাট উন্নয়ন। কে ভুলতে পারে সেই ‘দিনের বাণী’— ‘উন্নয়নের শত্রুরা দেশের শত্রু।’ তার আগেকার প্রধানমন্ত্রীর স্বীকৃতি— ‘দেশের সামনে সবচেয়ে বড় বিপদ সন্ত্রাসবাদ।’
২০০২ সাল থেকে ওড়িশার নিয়মগিরিতে আদিবাসীদের সমস্ত অধিকার লঙ্ঘন করে যখন প্রথমে ‘স্টারলাইট’, পরে নাম বদলে ‘বেদান্ত’, কারখানা স্থাপন করে, তখন থেকে আন্দোলন শুরু হয়। বারেবারে কর্পোরেটের সপক্ষে দাঁড়ানো দেশের সরকারের আঘাত নামে ভূমিসন্তানদের ওপর। আবালবৃদ্ধা আদিবাসী জনতার ২০০৬ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত একটানা মরণপণ প্রতিরোধের পর আবার সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নিয়মগিরিতে আদিবাসীদের ঐতিহ্যের অধিকার স্বীকৃত হলে, বক্সাইট খনি বন্ধ হয় তখনকার মতো। যদিও ২০১৭-য় আবার তারা ফিরে এসেছে সংলগ্ন লাঞ্জিগড়ে।
২০০৬-এর আদিবাসীদের জমি অধিকার আইনের সংশোধন ঘটানো হয় ২০১৩ সালে, অবশ্যই দেশের উন্নয়নের কারণে। জল-জমি-জঙ্গলই যে আদিবাসী গোষ্ঠীগুলির সামাজিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের ভিত্তি, এ কথাকে ২০০৬ সালের আইনে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। এই স্বীকৃতি অনুযায়ী, ওইসব জমিতে যে মানুষরা বহুকাল ধরে বসত করছিলেন, সেখানে তাঁদের প্রয়োজনীয় ‘পাট্টা’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়। সে প্রতিশ্রুতি যথেষ্টভাবে কার্যকর করা হয়েছিল এমন কথা সরকারের অতি বড় বন্ধুরাও বলবেন না। সংশোধানীটি কিন্তু দ্রুত কার্যকর হতে দেখা গেল— ‘শিল্প স্থাপনের জন্য’ বিভিন্ন রাজ্য সরকারের মধ্যে শুরু হয়ে গেল জমি ব্যাঙ্ক তৈরির প্রতিযোগিতা। ঝাড়খন্ড সরকার ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা করল, ২১ লক্ষ একর জমি ‘শিল্প স্থাপনের জন্য’ দেওয়ার কথা। কোথা থেকে এল এই জমি? স্ট্যান স্বামী দেখাচ্ছেন, কীভাবে আদিবাসী সমাজের চিরাচরিত ভোগদখলের অধিকারভুক্ত সমস্ত অকৃষি-জমি ‘গাইর-মাজুরওয়া’ (কমিউনিটি ল্যান্ড)-র ওপর হাজার বছর ধরে চলে আসা ভোগদখলের অধিকার সরকার একতরফা ভাবে বাতিল করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট লোকেরা এবিষয়ে কিছুই জানেন না। আইনতই এরকম জমি হস্তান্তর করতে হলে টিএসসি-র নুমতি লাগে। PESA অনুসারে এইজন্য সংশ্লিষ্ট গ্রামসভাগুলোরও অনুমতি দরকার। এর কোনওটাই নেওয়া হয়নি। ফলে দেশে আদিবাসী ও অন্যান্য ‘অপর’ গোষ্ঠীর মানুষদের বেঁচে থাকা ক্রমশই রাষ্ট্রনির্দিষ্ট উন্নয়নের পক্ষে অসুবিধাজনক হয়ে উঠছে। নিজেদের শারীরিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক অস্তিত্ব যাঁরা টিকিয়ে রাখতে চান, ‘দেশের উন্নয়ন’-এর থেকেও যদি কেউ নিজের ও নিজের সম্প্রদায়ের বেঁচে থাকাকে বেশি গুরুত্ব দেন, তাঁরা তাহলে রাষ্ট্রকে ভয় দেখাচ্ছেন বইকী! তাঁদের বেঁচে থাকতে চাওয়াই তো ‘উন্নয়ন’কে, অর্থাৎ রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করা।
দেশের ভূমি অধিগ্রহণ আইনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাগ ছিল অধিগৃহীত জমিতে যে উন্নয়নমূলক কাজ হবে, তার সামাজিক প্রভাব মূল্যায়ন (Social Impact Assessment) করার নিয়ম। এটি রদ করা হল। এর সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে, সরকার যে কোনও কৃষিজমি অধিগ্রহণ করে সেটি কোনও অকৃষিমূলক কাজ— অর্থাৎ খনি কারখানা হোটেল ইত্যাদির জন্য— কোনও কোম্পানিকে দিতে পারে। যদিও ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজেশন’ গত দুই দশক ধরে লাগাতার বিভিন্ন দেশকে কৃষিজমিতে অ-কৃষি কাজে ব্যবহারের বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে চলেছে, বিশ্বে ভয়ংকর খাদ্যসঙ্কট দেখা দেবে বলে। এছাড়া তো আছেই নগরায়ন আর রাস্তা তৈরি।
এইরকম কাজগুলোকে যদি কেউ ক্রমাগত অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রকাশ্যে প্রশ্ন করে যান, রাষ্ট্রের মুখোশকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করাই যদি নিজের বিবেকের দায়িত্ব বলে মেনে নেন, তাহলে তিনি যে ‘দেশদ্রোহী’ বলে আখ্যাত হবেন, তা জানার জন্য রাজনৈতিক গণৎকার হবার দরকার নেই।
বস্তুত, স্ট্যান স্বামীর মৃত্যুতে দেশের বিবেককে আঘাত করেছে তাঁর বয়স ও তাঁর অসুস্থতা। একজন বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষকে তাঁর জল খাওয়ার পাত্রটি না-দেওয়ার বর্বরতাই দেশের হৃদয়কে উদ্বেল করে তুলেছে। না হলে, এরকম ঘটনা এই রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছে নিতান্ত বিরল নয়। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংস করে উষ্ণায়নের পথ প্রশস্ত করা, সে কারণে কোটি কোটি মানুষের জীবনে অকল্পনীয় দুঃখ-দুর্দশা নামিয়ে আনা রাষ্ট্রের পক্ষে এতই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, তার পরিচালকদের কাছে কোনও মানবিকতা কেউ আশা করে না। করার কারণ তাঁরা রাখেননি। মৃত্যুপথযাত্রী একজন বয়স্ক মানুষের ‘মুখে জল দেওয়া’র বাধা কেবল ক্ষমতাসীনরাই সৃষ্টি করতে পারেন, যেহেতু তাঁদের কোনও মানুষী মনোবৃত্তি বা মানুষী স্মৃতি থাকে না। পিতৃপিতামহের মুখ বলে কিছুই তাঁদের মনে নেই।
বরং স্ট্যান স্বামীর ব্যবহারটিই হয়তো তাঁদের মতে অস্বাভাবিক— যখন চূড়ান্ত অসুস্থ অবস্থায় অশক্ত বৃদ্ধ মানুষটি তাঁর শেষ চিঠিতে কবি ভারভারা রাওয়ের অসুস্থতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কোভিডের পরবর্তী অসুস্থতায় জামিনের বদলে রাষ্ট্র যখন তাঁকে জেলের হাসপাতালে ভর্তি করার করুণা প্রদর্শন করলে, তিনি তখন বলেন, সেই নির্জন কারাকক্ষের আরামের চেয়ে ওয়ার্ডের মধ্যে থাকা অন্য বন্দিদের দুঃখের সাহচর্যই তাঁর অধিক আকাঙ্ক্ষিত। আমাদের কাছে এঁরাই শিক্ষক। আমরা নিজেদের সামান্য শক্তি দিয়ে ভালবাসায় বিশ্বাস করি। স্ট্যান স্বামী ও তাঁর চেনা-অচেনা সহযোদ্ধারা, যাঁরা এখনও দেশের বিভিন্ন জেলে বিনা-বিচারে বন্দি হয়ে আছেন কেবল প্রশ্ন করার ‘অপরাধে’— তাঁরা আমাদের স্বজন। আমরা তাঁদের মুক্তি চাই। গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতিষ্ঠার জন্য বহু মানুষের সম্মিলিত স্বর চাই।
লিংক- https://thewire.in/rights/pathalgadi-movement-adivasis-stan-swamy-sedition