সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলোর মধ্যে কোনও একটা সিনেমা আমার খুব প্রিয়, তেমন বলতে পারব না, তবে ‘নায়ক’ আমি অনেকবার দেখেছি। সত্যজিৎ রায় কয়েকটা সিনেমার জন্য মৌলিক চিত্রনাট্য লিখেছেন, ‘নায়ক’ তার অন্যতম, যেখানে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা-কুশলতা আর উত্তরকুমারের মহানায়ক-গ্ল্যামারের একটা টক্কর চলে, আবার একইসঙ্গে সিনেমা-মাধ্যমটার বিষয়েও কথা বলা হয়।
অরিন্দম মুখার্জি (উত্তম কুমার) প্লেনের টিকিট না পেয়ে ট্রেনে করে দিল্লি যাচ্ছে একটা পুরস্কার নিতে। আগের রাতে, কলকাতার একটি অভিজাত ক্লাবে, সে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছিল। এখন প্রেস-কে এড়াতে চাইছে। সাংবাদিক অদিতি সেনগুপ্ত (শর্মিলা ঠাকুর) ট্রেনে তার সঙ্গে যাচ্ছে। অদিতি চলতি-ধারার বাংলা সিনেমা অপছন্দ করলেও, নিজের সম্পাদিত পত্রিকা ‘আধুনিকা’র জন্য অরিন্দম মুখার্জির একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার চেষ্টা করছে। দুজনের মধ্যে কথাবার্তা কিছুক্ষণ গড়াতেই, তাদের মধ্যে একটা সখ্য গড়ে ওঠে। আর অদিতি বুঝতে পারে, তারকা হওয়াটা বাইরে থেকে যেমন মনে হয়, আদতে তা নয়। দিল্লি পৌঁছে অদিতি, তার নেওয়া অরিন্দম মুখার্জির সাক্ষাৎকারের পাতাটা ছিঁড়ে ফ্যালে, কারণ এই বাস্তব হয়তো অরিন্দম মুখার্জির স্টারডমকে কিছুটা নষ্ট করে দেবে। অরিন্দম জিজ্ঞেস করে, অদিতি তার মন থেকে সাক্ষাৎকারটি লিখবে কি না? এর জবাবে অদিতি বলে, ‘মনে রেখে দেব’। এর পর স্টেশনে নেমে অদিতির তার আত্মীয়ের সঙ্গে চলে যায়, আর ফ্যানেরা অরিন্দমকে ঘিরে ধরে।
সিনেমার বিষয়টি পুরনো— জীবন একটি সফর এবং টেনের কামরার মধ্যের ঘটনাবলি আসলে জীবনের প্রতীক। তা সত্ত্বেও সত্যজিৎ রায় প্রতিটি চরিত্রকে এমন বিশদে ফুটিয়ে তুলেছেন যে, চরিত্রগুলির সঙ্গে দর্শকের একটা সংযোগ তৈরি হয়ে যায়। প্রত্যেকটি চরিত্রের যোগ রয়েছে মূল গল্পটির সঙ্গে, কিন্তু তা ছাড়াও প্রতিটি চরিত্রই আলাদা করে নজর কাড়ে, কারণ তারা আসলে বাঙালি সমাজের টিপিকাল প্রতিনিধি। আবার অনেক চরিত্রেরই সিনেমা বিষয়ে অনেক মতামত আছে।
হরেন বোসের মতো একটা বদখত চরিত্রের কথাই ধরা যাক, যাঁর সঙ্গে একই কামরায় অরিন্দম যাচ্ছে। তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে দেখে মনে হয়, হরেন বোসের বয়সের পক্ষে এঁরা বড়ই তরুণ। ছবি এগোতেই আমরা বুঝতে পারি, হরেন আবার সহযাত্রী প্রীতীশ সরকারের স্ত্রী মলির কাছ থেকে বিশেষ সুবিধে পাওয়ার আশা করছেন, যার পরিবর্তে তিনি প্রীতীশকে কিছু কাজ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। প্রীতীশ তার স্ত্রীকে হরেন বোসের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতে বলে, কিন্তু তা বলে মলিকে সিনেমায় অভিনয় করতে অনুমতি দেয় না। হরেন বোস মনে করেন, সিনেমায় কেবল ভারতীয় সমাজের সংকীর্ণতা দেখানো হয়। আবার অন্যদিকে ওই একই কামরার অঘোর চ্যাটার্জির মতে, সমাজের প্রত্যেকের মধ্যেই নীতির অবক্ষয় ঘটেছে।
অদিতি ছাড়া ট্রেনে অন্য যেসব মহিলারা রয়েছে, তারা প্রত্যেকেই অরিন্দমের ভক্ত। এমন গদগদ ভাব তাদের মধ্যে, যেন অরিন্দম দেবতা-তুল্য। এমনকী এ-ও বলতে দেখা যায়, অরিন্দম কৃষ্ণ আর ট্রেনের বাকি মেয়েরা সব গোপিনী।
‘মনে রেখে দেব’ কথাটা আরও তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ অরিন্দমের অন্তর্জগতে প্রবেশ করেছে দর্শকেরাই, অদিতি পারেনি। গোটা সফর জুড়ে মাঝে মাঝেই অরিন্দমের স্বপ্ন ও ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে দর্শক তার অনেক কথা জানতে পেরেছে। সেসবের সামান্য অংশই সে অদিতিকে বলেছে। .
অরিন্দম একটি দুঃস্বপ্ন দ্যাখে, যেখানে সে রাশি রাশি নোটের ওপর দিয়ে খুব আনন্দে দৌড়চ্ছে কিন্তু সেই টাকাগুলো বদলে যায় চোরাবালিতে এবং সে ডুবে যেতে থাকে। অরিন্দমের গুরু শঙ্করদা যদিও তাকে টেনে তুলতে পারতেন, কিন্তু শেষ মুহূর্তে অরিন্দমকে তিনি তলিয়ে যেতে দেন। অরিন্দমের অন্য একটি ফ্ল্যাশব্যাকে, এই শঙ্করদা ফিরে আসেন, যেখানে দেখা যায় পুজোর নাটকের মহলার সময় শঙ্কর বলেন, সিনেমার অভিনেতারা আসলে অন্যের হাতের পুতুল, সত্যিকারের শিল্পী নয়।
অরিন্দমের ফ্ল্যাশব্যাকে মুকুন্দ লাহিড়ির সঙ্গে তার একটি কথোপকথন দেখা যায়। আমরা বুঝি, মুকুন্দ লাহিড়ি একজন অভিনেতা, যিনি সিনেমার নির্বাক যুগ থেকে শুরু করে সবাক ছবির যুগেও তাঁর খ্যাতিটা বজায় রাখতে পেরেছেন, কিন্তু আধুনিক যুগের বাস্তবানুগ অভিনয়টা আয়ত্ত করে উঠতে পারেননি। তাঁর মধ্যে দিয়ে আমরা অরিন্দমের একটা ভয়কে চিনে নিতে পারি, যে, কোনও এক দিন হয়তো সে-ও কাজে ব্যর্থ হবে এবং সাফল্যের তুঙ্গ থেকে যে অবধারিত পতন, তা তাকে গ্রাস করবে।
অরিন্দম এ-ও বোঝে, তারকা হলে বন্ধু হারাতে হয়। বীরেশ যখন অরিন্দমের খ্যাতি ও সাফল্যকে শ্রমিক-ধর্মঘটের সমাবেশে ব্যবহার করতে চায়, তখন অরিন্দম ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ার ভয়ে সেখান থেকে চলে যায়। সে এ-ও ভালই জানে যে, মহিলারা কাজ পাওয়ার আশায় তার কাছে আসে, অনেকে ব্যবহৃত হতেও সম্মত হয়। ছবির শুরুতে ক্লাবে যে মারামারির উল্লেখ আছে, তা আসলে ঘটেছিল অরিন্দমের হিরোইনের স্বামীর সঙ্গে। আর একটা দুঃস্বপ্নে এই মারামারির কথাটা বোঝা যায়, যেখানে একটা পার্টিতে সকলে কালো চশমা পরে আছে, যেমন কালো চশমা পরে অরিন্দমকে আমরা দেখেছি হিরোইনের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে, ছবির শুরুর দিকে।
সাংবাদিক হিসেবে অদিতির দক্ষতা বোঝা যায়, যখন সে তারকার গ্ল্যামারের পর্দা সরিয়ে অরিন্দম সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারে। কিন্তু অদিতি সেগুলো প্রকাশ করার বদলে, গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে অদিতি দক্ষ সাংবাদিকতার চেয়ে মানবিকতাকে বেশি মূল্য দেয়। কারণ সে বুঝতে পারে, অরিন্দমের স্টার-ইমেজের আড়ালে আছে একজন একলা, ভঙ্গুর আর নরম মনের মানুষ। একটা দৃশ্যে অদিতি যখন বোঝে, অরিন্দম মদ্যপ অবস্থায় প্রায় আত্মহত্যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, তখন সে শান্ত ভাবে অরিন্দমকে বাধ্য করে নিজের কামরায় ফিরে যেতে এবং সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে তবেই অদিতি নিজের কামরায় যায়।
সত্য়জিতের পরিচালনা আর সযত্ন প্রকরণ-দক্ষতা তাঁকে সাহায্য করে গ্ল্য়ামার, খ্য়াতি, স্টারডমের ধারণাগুলোর নানাদিক তুলে ধরতে। এতে তিনি সহায়তা পান উত্তমকুমারের, যিনি এমনিতেই মহানায়ক, এই ছবিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করছেন, আর শর্মিলা ঠাকুরের, যিনি তখন হিন্দি ছবিরও স্টার, এখানে সাংবাদিকের ভূমিকায়। তাঁদের চরিত্রের প্রতিটি দিক অত্যন্ত মনোযোগে নির্মাণ করা হয়েছে, শর্মিলার কালো চশমা থেকে শুরু করে, উত্তমের শৌখিন জুতো অবধি।
সত্যজিৎ আমাদের দেখান, আমরা কীভাবে ফিল্মের চরিত্রের সঙ্গে স্টারকে গুলিয়ে ফেলি, যেমন অরিন্দম মুখার্জি চরিত্রটাকে গুলিয়ে ফেলি উত্তমকুমারের সঙ্গে, যিনি অরুণকুমার চ্য়াটার্জির (উত্তমকুমারের আসল নাম) থেকে স্বতন্ত্র এক সত্তা। উত্তমকুমার ঝুঁকি নিয়েছিলেন নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করে, পর্দার আড়ালের মানুষটাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কিছুটা। এই চরিত্রটা উত্তমের মতো করে কেউই ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না। সৌমিত্র চ্য়াটার্জি যদিও অভিনয়ের জগতে কিংবদন্তি, তবে তাঁর গ্ল্য়ামারও জনমানসে এতটা বেশি ছিল না।
সত্য়জিৎ স্টারদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তবে তাঁদের নিতান্ত অভিনেতা হিসেবেই দেখতেন। তাই, ‘চিড়িয়াখানা’ ছবিতে উত্তমকুমার নায়ক ছিলেন, কিন্তু তাঁকে তারকা হিসেবে দেখানো হয়নি, যদি না আমরা তাঁর চরিত্র ব্য়োমকেশ বক্সীকেই তারকা ভাবি। শর্মিলা ঠাকুরকেও সত্যজিৎ অভিনেত্রী হিসেবেই উপস্থাপিত করেছেন, তারকা হিসেবে নয়। সেটা হয়তো অপেক্ষাকৃত সহজ হয়েছে, কারণ শর্মিলা ছিলেন মুম্বই ফিল্ম ইন্টাস্ট্রির স্টার। সত্য়জিৎ যে এই দুটি সিনেমা ছাড়া আর উত্তমের সঙ্গে কাজ করেননি, তার কারণ হয়তো এই: বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে উত্তমের স্টারডম এমন ছিল যে, তা সিনেমার অন্য সব দিকগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে যেত।
সত্য়জিৎ ‘নায়ক’-এ যেভাবে তারকাকে দেখেন, তার বহু সূক্ষ্ম স্তর আছে। তারকাকে বহু লোক সমীহ করে, পুজো করে, কিন্তু তারা তাঁকে ভুল করে তাঁর অভিনীত চরিত্র বলেই, এবং ভাবে তারা তাঁকে বাস্তবেও দিব্য়ি চেনে। অরিন্দম মুখার্জি শুধু একজন এমন মানুষ নন যিনি প্রতিভাবান, রূপবান ও সফল কিন্তু বাস্তবে অসুখী। তিনি একজন বাঙালি জটিল মানুষ, যিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন, পৃথিবীতে তাঁর অবস্থানটা ঠিক কী।
প্রশ্ন জাগতে পারে, উত্তম বাংলা সিনেমার এতবড় স্টার, এত গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, কিন্তু এই জগৎটুকুর বাইরে তাঁর তেমন পরিচিতি নেই কেন? এমন সুপুরুষ, ঝলমলে একজন লোক, যাঁর নরম চোখে এবং অবাধ্য় চুলে শিশুর পবিত্রতা, যাঁর হাসিতে কট্টর পণ্ডিতও গলে যান, তিনি তো সাফল্য পেতে পারতেন অন্যত্রও, ধরা যাক, মুম্বইয়ের ইন্ডাস্ট্রিতেও।
বাংলায় উত্তমের এই অবিশ্বাস্য সাফল্য়ের রহস্যটা কী? তাঁর রূপ আর প্রতিভা ছাড়া? বাংলার ইতিহাসের উথালপাথালের বছরগুলোয়, বাঙালি ভদ্রলোকের প্রতিনিধি হিসেবে উত্তমকুমারের তাৎপর্য কতটা?
সাম্প্রতিক নির্বাচনে বোঝা গেছে, বাকি ভারতের সঙ্গে পশ্চিমবাংলার সম্পর্ক বেশ জটিল, যে-সমীকরণকে হিন্দি সিনেমার ‘সর্বভারতীয়’ বুনোনে অনেক সময়েই জোর করে মসৃণ করে দেওয়ার চেষ্টা চলে। ‘নায়ক’-এ আমরা দেখি কলকাতা থেকে দিল্লিতে এক সফর– আগের রজধানী থেকে, এখনকার ক্ষমতাকেন্দ্রে। তারকাটি পুরস্কারে আগ্রহী নয়, কিন্তু সে সাংবাদিকদের থেকে দূরে থাকতে চায়। আর সে খুঁজে পায় এমন এক সাংবাদিককে, যে তাকে বুঝতে সক্ষম। মনে রাখতে হবে, এই পুরস্কার কিন্তু মুম্বইতে দেওয়া হচ্ছে না, যা ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেন্দ্র। ‘নায়ক’ তাই অত্যন্ত জটিল এক অভিযানের কথা বলে, নিছক পুরস্কারবিজয়ী একজন তারকার সফরে সীমাবদ্ধ থাকে না।