পৃথিবীতে মনুমেন্টের মতন অদৃশ্য কি কোনও কিছু হতে পারে?’ রবার্ট মুসিল মন্তব্য করেছিলেন ১৯২৭-এ লেখা এক প্রবন্ধে। ‘মনুমেন্ট তৈরি করার মূল উদ্দেশ্য মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, অর্থাৎ দ্রষ্টব্য হওয়াই তার কাজ। অথচ মনুমেন্টের মধ্যে প্রকৃতিদত্ত এমন কিছু রয়েছে, যার জোরে আমাদের দৃষ্টি তার পৃষ্ঠতল পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই গড়িয়ে পড়ে যায়, যেন অয়েল-ক্লথের ওপর জল, এক মুহূর্তের জন্যও ধরা না দিয়ে।’ কথাটা শুনলে প্রথমে অবাক লাগে। কলকাতা শহরে মনুমেন্ট বা স্ট্যাচুর সংখ্যা বোধহয় মিষ্টির দোকানের থেকেও কিছু বেশি। পাড়ার মোড়ে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, নেতাজী সুভাষচন্দ্র, বিবেকানন্দ, আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত কিছু স্থানীয় ব্যক্তিত্ব, যেমন আমাদের পুরনো পাড়ার পানু মিত্রের স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে আমরা অভ্যস্ত। দাড়িওয়ালা কোনও পুরুষ দেখলে একটু আন্দাজ করে নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, তবে ঋষি অরবিন্দ হলেও হতে পারে। হয়তো এতটাই অভ্যস্ত যে তাকে সক্রিয় ভাবে ‘দেখা’ বলা চলে না, স্ট্যাচুগুলো নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে আমাদের দর্শনক্ষেত্রে।
কলকাতার স্ট্যাচু নিয়ে অনেকেই গবেষণা করেছেন, লিখেছেন। ব্রিটিশ আমলে প্রকাশিত কিছু তালিকা ছাড়াও কমল সরকারের ‘কলকাতার স্ট্যাচু’ (প্রথম প্রকাশ ১৯৯০) এবং শিল্প-ইতিহাসবিদ তপতী গুহঠাকুরতার কাজ বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য। তার থেকে আমরা শুধু যে উপনিবেশিক স্ট্যাচু এবং মনুমেন্টের ব্যাপারে নানান তথ্য জানতে পারি তা নয়, স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে কলকাতার স্ট্যাচু নির্মাতাদেরও হদিশ পাই। বিশেষত অধ্যাপক গুহঠাকুরতার লেখায় পাওয়া যায় সময়ের সাথে সাথে মূর্তির অর্থান্তরের বিশ্লেষণ। কেমন করে কোনও রাজকীয় দম্ভের প্রতীক অস্পষ্ট হয়ে যায় মানুষের মনে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে তাদের আড়ালে আশ্রয় পায় প্রেমিক-প্রেমিকারা। কিছুদিন আগে ‘বামা’ পত্রিকায় প্রকাশিত জিগীষা ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ পড়েও নতুন অনেক কিছু জানবার সুযোগ হয়েছে।
মুসিলের মন্তব্যটা আমার মনে তবু বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকে। পুরনো পাড়ার সেই পানু মিত্রের স্মৃতিস্তম্ভের কথা মনে পড়ে, খুব অল্পদিনের মধ্যেই যার ওপর খোদাই করা নাম-ধাম সব মুছে গিয়েছিল। আমাদের ক্রিকেট খেলার নিয়মাবলিতে কিছু পরিবর্তন আসে বটে, যেমন স্তম্ভের পেছনে বল আটকে গেলে ব্যাটসম্যানের রান নেওয়া নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ মুসিলের কথায়, স্তম্ভটি স্বশরীরে উপস্থিত থাকলেও কার্যত অদৃশ্য। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সেটি নির্মাণ করা হয়েছিল, সেই দায়িত্ব বেশিদিন পালন করতে পারে না। হয়তো বছরে একবার তাঁদের জন্মবার্ষিকীতে গাঁদা ফুলের মালা চাপিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, কিন্তু তা ছাড়া? সেই কয়েকটা বিশেষ মুহূর্তেই কি শুধু এই মূর্তিগুলো তাঁদের স্মৃতিরক্ষার কর্তব্য পারফর্ম করছে?
এবার আমরা একটু অন্যদিক থেকে প্রশ্নটা নিয়ে ভাববার চেষ্টা করি। এই স্ট্যাচুগুলো কি সত্যিই অদৃশ্য? ‘অদৃশ্য’ বলতে আমরা কী বুঝি? তাদের যে একটা শারীরিক উপস্থিতি আছে তা অস্বীকার করা যায় না, অর্থাৎ অদৃশ্যতা তাদের কোনও অন্তর্ভুক্ত গুণ নয়। তারা অদৃশ্য আমাদের চোখে। কিন্তু এই ‘আমরা’ কারা? ‘আমরা’ বলতে কি শুধুই একটা সমজাতীয় গোষ্ঠীর কথা আমরা ভাবছি, যাদের ইতিহাসের সাথে সম্পর্ক একে অপরের সাথে হুবহু মিলে যায়? সেটা তো অসম্ভব একটা দাবি। লিঙ্গ, শ্রেণি, জাত, বর্ণ— এই সমস্ত কিছুর ইন্টার সেকশনেই তো আমরা নিজেদের পরিচয় খুঁজে নিই। এই জায়গাতেই আমাদের সাবজেক্টিভিটি গঠিত হয়।
অতএব, যদি কোনও স্ট্যাচুকে সত্যিই অদৃশ্য হতে হয়, তার মানে এই দাঁড়ায় যে তার সকল দর্শক শুধু যে সমজাতীয় বা গভীর ভাবে হোমোজেনাস হবে তাই নয়, সেই ব্যক্তিত্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথেও তাঁদের সম্পর্ক হরেদরে সমান। অথবা তাঁরা মনে করতে পারেন যে সেই ইতিহাসের অংশীদার তাঁরা নন। সাধারণত এই প্রিভিলেজটা সমাজের প্রান্তিক স্তরের ও সংখ্যালঘু মানুষদের থাকে না।
বিগত কিছু মাসে আমরা দেখেছি কানাডায় একাধিক স্ট্যাচু ভেঙে ফেলা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে রানি ভিক্টোরিয়া এবং দ্বিতীয় এলিজাবেথের মূর্তি। ভিক্টোরিয়ার স্ট্যাচুর শিরচ্ছেদ করা ছবিও আমরা অনেকেই দেখেছি ইন্টারনেটে, লাল হাতের ছাপে ঢাকা। ফিরে যেতে হয় আবার সেই ‘কে দেখছে’-র প্রশ্নে। কিন্তু তার সাথে এবার যোগ হচ্ছে ‘কী দেখছে’-র প্রশ্নও। ভাঙা মূর্তির ছবিতে কেউ কেউ হয়তো দেখছেন তাঁদের বহু প্রজন্মের অতিপ্রিয় এক ক্ষমতার প্রতীককে চোখের সামনে ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে, আবার কেউ কেউ সেই ভাঙা মূর্তির জায়গায় দেখছে উপনিবেশিকতার বীভৎস ইতিহাস, যার তলায় চাপা পড়ে ছিল হাজার হাজার স্বদেশজাত শিশুর অনামাঙ্কিত সমাধি।
মূর্তির প্রতিষ্ঠাতারা হয়তো কল্পনাই করতে পারেননি সমতার লড়াই একদিন এতদূর এগোবে যে ইতিহাস চেতনা ও রচনার ওপর প্রভাবশালীদের একাধিকার আর থাকবে না। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের কণ্ঠস্বরের মূলশ্রোতের সাথে মিশে যাওয়ার আর প্রয়োজনই হবে না। চিনুয়া আচেবের কথায়, সব কিছুই যেন খণ্ডিত হচ্ছে, ভেঙে পড়ছে। কেন্দ্রিক শক্তি অবান্তর।
‘ব্ল্যাক লাইভ্স ম্যাটার’ আন্দোলনের সময়কার কিছু ছবিও আশা করি আমাদের মনে থাকবে, যেমন ব্রিস্টল শহরের বন্দরে এডোয়ার্ড কোলস্টনের মূর্তি মহানন্দে ভাসান দিয়ে দেওয়া। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র-সচিব, প্রীতি পাটেল-সহ আরও অনেকেই তীব্র নিন্দা করেন এই ধরণের ‘ভ্যানডালিজম’-এর। তাঁদের মতে মূর্তি ভাঙলে না কি মানবাধিকারের বৃহত্তর যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার ক্ষতি হতে পারে, বা আলোচনাটা অন্যদিকে ঘুরে যেতে পারে। কিন্তু সেই মূর্তির পাদবেদিতে দাঁড়িয়ে জেন রীডের এক হাত আকাশে তোলা যে মর্মভেদী ছবি আমরা দেখেছিলাম, তার কাব্যিক মূল্যের হিসেব কি এত সহজে করা যায়? আবার এ কথাও ভুললে চলবে না যে, রীডের সেই স্ট্যাচু নির্মাণের মধ্যে থেকেও উঠে এসেছিল জাতিগত রাজনীতির প্রশ্ন। ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের মঞ্চে কি সত্যিই মার্ক কুইনের মতন একজন শ্বেতাঙ্গ শিল্পীর জায়গা দখল করার দরকার ছিল?
হয়তো প্রীতি পাটেলের মতন রক্ষণশীল মানুষেরা যে প্রশ্নটা করছেন, তার গোড়াতেই গলদ। ভাঙা হল কেন বা এই ধ্বংসাত্মক মনোভাবে লাভ কী জিজ্ঞেস না করে হয়তো ভেবে দেখা উচিত সেই মূর্তি আদৌ ছিল কেন। যে ইতিহাসের আমরা উত্তরাধিকার, তা তো নির্ভুল বা পূর্ণতাপ্রাপ্ত কোনও ইতিহাস নয়। সেটাও একটা প্রসেস। এবং সেই ইতিহাসকে আমাদের বর্তমান সামাজিক বিচারবোধের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে বাধা কোথায়?
এইসব মূর্তির দ্বারা একটা বিশেষ ন্যারেটিভের নায়কদের স্মৃতি কোনও দেশ বা শহরের মাটিতে স্থাপিত করার চেষ্টা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুবিধাপ্রাপ্ত গোষ্ঠীর। ফলত সেই শহরের সার্বিক আইডেন্টিটির সাথে মিলেমিশে যায় সেই ব্যক্তিদের মতাদর্শ। সেই পরিচয়ের সাথে বিচ্ছিন্ন বোধ করেন সংখ্যালঘু বা প্রান্তিক মানুষ। অতএব মনে রাখতে হবে যে, যখন কোন স্ট্যাচুকে আক্রমণ করা হয়, সেটা শুধুমাত্র ইতিহাসকে লক্ষ্য করে তা নয়। তার মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই শহরের অধিকারের ওপর বিক্ষিপ্ত মানুষদের দাবি। অন্য কারুর স্বপ্ন দিয়ে তৈরি বা অন্য কারুর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা দেশকে কি সত্যিই নিজের দেশ বলা যায়?
কলকাতায় ঔপনিবেশিক মূর্তি সরিয়ে ফেলা বা ভেঙে ফেলা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলেছে অনেকদিন। ১৮৫৭-এর শতবার্ষিকীর আগে জওহরলাল নেহেরু বাধ্য হন এ সমস্ত মূর্তির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ভাবতে। লোকসভায় আলোচনার সময়ে তিনি বলেন যে, কোনও কোনও মূর্তি ঐতিহাসিক দিক থেকে মূল্যবান, আবার কোনওটা হয়তো নান্দনিক দিক থেকে। সেগুলোকে যদি সরিয়ে ফেলতেও হয়, তাহলে বিনা আড়ম্বরে তা করা উচিত, যাতে নতুন করে ব্রিটেনের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোনও অসদ্ভাব না হয়। কিছু স্ট্যাচু, তাঁর মতে, নান্দনিক বা ঐতিহাসিক— কোন দিক থেকেই মূল্যবান নয়। ইয়ার্কি করে বলেন, সেগুলো তিনি বন্ধুদের দান করে দিতেও রাজি আছেন।
ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার কিন্তু মূর্তি অপসারণের বিরুদ্ধে ছিলেন। ১৯৫৩-এ লেখা, ‘স্ট্যাচুস অফ ফরেনার্স’ বলে একটি প্রবন্ধে দুটো অভিজ্ঞতার কথা তিনি লেখান। পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে বাস থেকে নাকি তাঁর এক বন্ধু দেখেছিলেন কোনও এক উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণির বাঙালি হিন্দু বাবু কিছু মুসলমান ছেলেদের উস্কিয়ে দিচ্ছেন জেমস উট্রামের মূর্তির দিকে চটি-জুতো ছুঁড়ে মারতে। অন্য ঘটনাটি তাঁর নিজের ছোটবেলার স্মৃতি। স্কুলে পড়তে তিনি দেখেছিলেন শিয়া সম্প্রদায়ের একজন লোককে উট্রামের ঘোড়ার পিঠে চেপে চটি-পেটা করতে। ‘আপনিই ওয়াজেদ আলি শাহের থেকে কেড়ে নিয়েছিলেন আমাদের প্রাণের আওধ।’ এই ছিল তাঁর অভিযোগ। যদুনাথ সরকার বলেন যে, প্রতিটি মানুষের মূল্যায়ন করা উচিত দেশের প্রতি, মানুষের প্রতি তাঁদের অবদানের ভিত্তিতে। ঔপনিবেশিক মূর্তি মানেই যে সেটা খারাপ কিছুর প্রতীক, এই ধারণাটা ভুল। কিন্তু তাঁর এই প্রবন্ধে অজ্ঞতার এই দুটো উদাহরণই কেন যে মুসলমানদের কেন্দ্র করে, আমাদের ভেবে দেখা উচিত।
মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’-এ আমরা দেখেছি ১৯৬৯ সালে কলকাতার রাস্তাঘাট থেকে মূর্তি অপসারণের ছবি। কান্দাহারের নায়ক, লর্ড রবার্টসের স্ট্যাচুকে দড়ি দিয়ে বেঁধে অসহায় ভাবে উল্টোমুখে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ময়দান থেকে। চাকার ঘর্ঘর শব্দের সাথে যেন সময়ের পাতাও উড়ে যাচ্ছে পেছনের দিকে, যাতে পুরনোকে মুছে নতুন ইতিহাস লেখা সম্ভব হয়। সেই সব স্ট্যাচুর মধ্যে কিছু স্থান পায় ব্যারাকপুরে ফ্ল্যাগস্টাফ হাউসে, আর কিছু ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে।
তারপর ১৯৭০-এ নকশালপন্থীদের মূর্তি ভাঙার সমর্থনে আমরা পাই সরোজ দত্তের মর্মভেদী কিছু লেখা, যেখানে তিনি বলছেন যে একটা ধারার বুর্জোয়া ইতিহাসবিদ এবং রাজনীতিবিদ মিলে চেষ্টা চালিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনতার প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধের ও তাঁর প্রথম নায়ক, মঙ্গল পাঁড়ের স্মৃতিকে চাপা দেওয়ার। যেসব মূর্তি ধ্বংশ করা হচ্ছে, তা নতুন ইতিহাস গড়ার উদ্দেশ্য নিয়েই।
কিছুদিন আগে সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এক নতুন প্রদর্শনী উদ্বোধন করা হয়। মিউজিয়ামের পুরনো প্রদর্শনীর বহু মূল্যবান জিনিস ডিসপ্লে থেকে সরে গিয়ে জায়গা পায় ভল্ট-এ, আর ভেতরের কিছু মূর্তি ঢেকে দেওয়া হয় আয়না-লাগানো বাক্সে। প্রথমবার কেউ মিউজিয়াম দর্শন করতে গেলে বুঝতে অসুবিধে হতে পারে সেই আয়নার ঘনক্ষেত্রর মধ্যে কী লুকিয়ে আছে। এই ভাবেই হয়তো মুসিলের মন্তব্য সার্থক হচ্ছে। এখন মূর্তিগুলো শুধু অদৃশ্যই নয়, তার বাক্সের আয়নায় নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে দর্শকেরা। অর্থাৎ, ‘কে দেখছে’— সেই প্রশ্নের সাথেও মুখোমুখি হতে বাধ্য করছে আমাদের। এইভাবে কি ইতিহাসকে অদৃশ্য করার আয়নায় শুধু নিজেদেরকে খুঁজে পাওয়া যায়?