রাষ্ট্র এবং আধুনিক ক্রীড়া হচ্ছে উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের যমজ, একে অপরের সাথে তারা সংলগ্ন। ঠিক যে-যুগে সাম্রাজ্য এবং রাষ্ট্র এই দুইয়ের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যটি পাল্টাতে শুরু করল, ১৮৭০ থেকে ১৯১৮ সালের ভিতর জার্মানি, ইতালি এবং জাপান যখন রাষ্ট্র রূপে নিজেদের পুনর্গঠন শুরু করল, ঠিক সে-যুগেই আধুনিক ক্রীড়াও নিজেকে প্রথাবদ্ধ করে, একাধিক নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে শুরু করল— তা মোটেও কাকতালীয় নয়। ক্রীড়াবিদ এবং খেলোয়াড়দের নতুন করে নিজেদের দেশ বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরূপে কল্পিত হয়ে ওঠার এটাই ছিল ঐতিহাসিক সূচনা।
১৮৭৭ সালে ক্রিকেট খেলার ইতিহাসে প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হয়। সেভাবে দেখতে গেলে, এ-খেলা দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে হয়নি, হয়েছিল শাসক দেশ ইংল্যান্ড এবং তার অধীন দেশ অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে। কিন্তু ইংল্যান্ডের ‘বিরুদ্ধে’ তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে খেলোয়াড়রা ক্রিকেট খেলছেন, এ-দৃশ্য অস্ট্রেলিয়ার মানুষকে সাহায্য করেছিল অস্ট্রেলিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে কল্পনা করতে। ঠিক এভাবেই ১৯১১ সালে যে ‘অল-ইন্ডিয়া’ দলটি ইংল্যান্ডে খেলতে গিয়েছিল, তার অন্তরে নিহিত এবং কল্পিত ছিল উদীয়মান ভারত রাষ্ট্রের আত্মপরিচয়। (এই ট্যুরের ব্যপারে প্রশান্ত কিদম্বির ‘ক্রিকেট কান্ট্রি’ নামে একটি চমৎকার বই আছে, আমাদের সকলেরই সে-বই পড়া উচিত)।
কিন্তু সদ্য প্রথাবদ্ধ প্রতিযোগিতামূলক খেলার সঙ্গে রাষ্ট্রের যে-যোগসূত্র, তা শুধু ক্রিকেট দিয়ে বোঝার দরকার নেই। ফিফা, বা ‘ফেদেরাসিয়ঁ ইন্ট্যারন্যাশনাল দে ফুটবল এসোশিয়েশন’, ফুটবলের পরিচালনা করে যে প্রতিষ্ঠানটি— তার পত্তন হয়েছিল ১৯০৪ সালে। এর লক্ষ্য ছিল বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি এবং সুইৎজারল্যান্ডের জাতীয় ফুটবল প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার বন্দোবস্ত এবং তদারক করা। ফুটবল, ক্রিকেট এবং টেনিসের পরিচালনামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি হয় একে অপরের দশ বছরের মধ্যে, ১৯০৪ থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত। এমনকী টেনিসের মতো ব্যক্তিগত স্তরের খেলাকেও ১৯০০ সালে ডেভিস কাপের হাত ধরে জাতীয় প্রতিযোগিতার প্রাঙ্গণে নিয়ে আসা হয়, যে প্রতিযোগিতা জন্ম নিয়েছিল গ্রেট ব্রিটেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটি ট্রান্স-অতলান্তিক টুর্নামেন্ট হিসেবে।
জাতীয়তাবাদ এবং খেলাধুলোর মধ্যে যে বর্ধমান সম্পর্ক, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল অলিম্পিক্সকে জাতীয় রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া। পিয়ের দ্যে কুবের্তঁ যখন এই প্রাচীন খেলার আসরটিকে নবজীবন দান করতে চেয়েছিলেন, তখন তাঁর স্বপ্ন ছিল এই অলিম্পিক্স হয়ে উঠবে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্বের মহোৎসব, এখানে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদরা একে অপরের সাথে খেলার মাঠে প্রতিযোগিতায় শামিল হবেন। ঠিক প্রাচীন অলিম্পিয়ায় ক্রীড়া উৎসবের মতো, যেখানে অলিম্পিক্সের কয়েকটা দিন শত্রু-রাজত্বগুলো পরস্পরের সাথে যুদ্ধে বিরত থাকত। তবে ব্যাপারটা অন্যদিকে চলে গেল।
জাতীয় অলিম্পিক কমিটির অনুমোদন ছাড়া খেলায় অংশগ্রহণ করা যাবে না, এই নিয়ম ১৯০৮ সালের প্রতিযোগিতা পর্যন্ত ছিল না। কিছু দলীয় ক্রীড়ায় মিশ্র দল অংশগ্রহণ করত। কিন্তু ১৯০৮ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোশিয়েশনের (আই ও এ) সদস্য হতে শুরু করলেন মূলত নানা রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। অলিম্পিক্স সবসময়েই শুরু হয় অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রদের কুচকাওয়াজ দিয়ে, প্রত্যেকের হাতে থাকে নিজের রাষ্ট্রের প্ল্যাকার্ড। ক্রীড়া-ইতিহাসবিদ এলান বেয়ার্নার লিখছেন, ‘আধুনিক পৃথিবীতে অন্য যে কোনও সামাজিক কাজকর্মের চেয়ে খেলাধুলোই জাতীয় সঙ্গীত বাজানো এবং জাতীয় পতাকার আস্ফালনকে জায়গা করে দেয় বেশি।’ আর পাঁচটা খেলাধুলোর প্রতিযোগিতার চেয়ে, অলিম্পিক্সের হাত ধরেই সবচেয়ে বেশি ঘটে, ক্রীড়ার সাথে রাষ্ট্রকে এভাবে অবিরাম এক করে দেওয়ার খেলা। সেই ১৯০৮ সাল থেকেই অলিম্পিক্সে ক্রীড়াবিদেরা ব্যক্তি-প্রতিযোগী থেকে হয়ে উঠেছেন নিজেদের রাষ্ট্রের প্রতিনিধি।
নিজেদের জাতীয় পতাকার ছত্রছায়ায় নয়, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন অথবা রাষ্ট্রীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে কোনও ক্রীড়াবিদ খেলায় যোগদান করেছেন, এ দৃষ্টান্ত রয়েছে। তবে এগুলো সবই ব্যতিক্রম, দেশে অন্তর্দ্বন্দ্ব বা সিভিল ওয়ারের ক্ষেত্রে, অথবা এক রাষ্ট্র থেকে আর রাষ্ট্রে পরিবর্তনের সময়ে, বা বয়কটের ক্ষেত্রে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যতবারই কোনও ক্রীড়াবিদ রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি না হয়ে, নিছক ব্যক্তি হিসেবে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছেন, আই ও এ সে-দাবি নাকচ করে দিয়েছে। গায়ানার দৌড়বাজ জেমস গিলকেস যখন প্রতিনিধি নয়, ব্যক্তি হিসেবে ১৯৭৬ মন্ট্রিয়াল গেমসে অংশগ্রহণ করতে চেয়ে অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর লক্ষ্য ছিল তাঁর দেশের প্রতিযোগিতা বয়কট করার সিদ্ধান্তকে পাশ কাটানো। তাঁর দাবি নাকচ করা হয়। অন্য যে কোনও ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের চেয়ে আই ও এ খেলাধুলোর প্রতিযোগিতার সাথে জাতীয়তাবাদকে মিলিয়ে দিতে পেরেছে বেশি।
অলিম্পিক্স নিয়ে নিজের অর্ধশতকেরও বেশি স্মৃতিগুলোর কথা যখন ভাবি, এই উগ্র জাতীয়তাবাদী অনুরাগী সংস্কৃতি নিয়ে অস্বস্তিতে পড়তে হয়। এ কথা স্বীকার করতে কুন্ঠা বোধ করি যে, এই জাতীয় আখ্যানগুলো না থাকলে ব্যক্তিগত লড়াইগুলোর যে উত্তেজনা, যা কুবের্তঁর বড় আদরের জিনিস ছিল, তা আমার দৃষ্টিই আকর্ষণ করত না।
একটু যাঁরা বয়সে বড়, যাঁদের ঠান্ডা মহাযুদ্ধের কথা মনে আছে, তাঁদের এও মনে থাকবে যে ওই যুদ্ধের মতাদর্শগত মেরুকরণের প্রভাবে কীভাবে দর্শকেরা পক্ষ-বিপক্ষ বেছে নিতেন। নাদিয়া কোমানেচি যখন একের পর এক নিখুঁত দশ নম্বর পেয়ে সোভিয়েত জিমন্যাস্ট ওলগা কোরবুতকে হারিয়ে সোনা জিতলেন, তখন আমেরিকানদের ফুর্তি আর ধরে না। কারণ কোমানেচি যে-দেশের মানুষ, সেই রোমানিয়াকে মনে করা হত পূর্ব ব্লকের একটি বিরোধী রাষ্ট্র, মস্কোর শত্রু। তিওফিলো স্টিভেনসন ছিলেন কিউবার জাতীয়তাবাদী গরিমার একজন আইকন। প্রতিযোগিতার মেডেলের র্যাংকে আমাদের দেশের হকি দলটিকে ক্রমশ খারাপ হতে দেখে তখন পাঁজরভাঙা জাতীয় দীর্ঘশ্বাসের আখ্যান তৈরি হচ্ছে। অবশ্য জাতীয়বাদী পক্ষ-বিপক্ষের ঊর্ধ্বে গিয়ে কিছু আশ্চর্য মুহূর্তেরও সৃষ্টি হয়েছিল বটে। যেমন ১৯৬৮ সালে মেক্সিকোতে যখন বব বিমন ৫৫ সেন্টিমিটার বেশি লাফিয়ে লংজাম্পের তৎকালীন রেকর্ডটি ভেঙেছিলেন, অথবা যখন ডিক ফসবেরি হাইজাম্প দেওয়ার পদ্ধতিটিকে পুনরাবিষ্কার করেছিলেন সেই একই প্রতিযোগিতায়, বিচিত্র ফসবেরি ফ্লপ-এর মাধ্যমে। কিন্তু এ মুহূর্তগুলোর বাইরে অলিম্পিক্স আমাদের শিক্ষা দিয়েছে, ব্যক্তিগত ক্রীড়াবিদদের পরিশ্রম মান্যতা পায়, বোধগম্য হয়— একমাত্র জাতীয় গর্বের আখরে।
খাতায়-কলমে প্রতিটি অলিম্পিক প্রতিযোগিতার উপস্থাপনা করার ভার দেওয়া হয় এক-একটি শহরের উপর, প্রাচীন যুগের গ্রিক নগর-রাষ্ট্রগুলোর ইতিহাস মাথায় রেখে। কিন্তু বাস্তবে, এই প্রতিযোগিতা এক-একটি রাষ্ট্রের কাছে সুবর্ণ সুযোগ, বাকিদের তাক লাগিয়ে দেবার জন্য। ১৯৩৬ সালের বার্লিন থেকে ২০০৮ সালের বেইজিং, অলিম্পিক্সে সর্বদাই জাঁকজমক করে আসলে ঘোষণা করা হয়, আয়োজক রাষ্ট্রটি খেলার পৃথিবীতে এক বড় কদম রাখল।
এই লেখাটি মন্থন চ্যানেলের জন্য দেওয়া মুকুল কেসবন-এর একটি বক্তৃতার (জুন, ২০২১) নির্বাচিত অংশ। আগ্রহীদের জন্য নীচে পুরো লিঙ্কটা দেওয়া হল: