ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2025

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ২৩

    বিমল মিত্র (July 30, 2021)
     

    পর্ব ২২

    বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হল। সন্ধের সময় আমার স্ত্রী সান্তাক্রুজ থেকে পালি হিল-এ ফিরে এলো। মুখে বিস্ময় আর আতঙ্কের ছায়া।

    জিজ্ঞেস করলাম— কি হয়েছে? গীতা কেমন আছে?

    আমার স্ত্রী বললে— গীতার হাত কেটে গেছে—

    — কেটে গেছে মানে?

    আমার স্ত্রী বললে— কাল অনেক রাত্রে গীতা ব্লেড দিয়ে নিজের হাতের শিরা কাটতে গিয়েছিল।

    — সে কি? কেন? গুরু কিছু বলেছিল নাকি?

    আমার স্ত্রী বললে— সে অনেক কথা। এতক্ষণ ধরে সেই সব কথাই শুনছিলাম। এখন রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে। গীতা ভালোই আছে। কিন্তু খুব দুর্বল। বিছানায় শুয়ে আছে। আমাকে আবার কাল সকালে নিয়ে যাবার জন্যে গাড়ি পাঠাবে—

    ঘটনাটা এমন আকস্মিক ঘটল যে আমরা দুজনেই কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে গেলাম। আমরা ও-বাড়িতে অতিথি, তাই ও-বাড়ির অন্দরমহলের সব ব্যাপারে কৌতুহলী হবার অধিকার আমাদের নেই। আমরা আনন্দের ভাগীদার হব, দুঃখেরও সমব্যথী হব, কিন্তু তার বেশি আর কি করতে পারি আমরা!

    গুরুর মানসিক অবস্থাটা আমি কল্পনা করে নিতে পারলুম!

    গুরু আমার স্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করেছিল এই আশায় যে সবাই মিলে আনন্দ উপভোগ করব। আনন্দের উপকরণের যখন অভাব নেই সংসারে, তখন গুরুর আশা করাটাও অন্যায় হয়নি। গুরু সারাজীবন ধরে তাই-ই চেয়েছে। গুরু চেয়েছে শুধু শান্তি। এক কণা শান্তির জন্য সে তার অতুল ঐশ্বর্যের সিংহ-দরজাটা পর্যন্ত খুলে দিতে তৈরি থেকেছে বরাবর। কিন্তু, বড় বেশি তার চাওয়াটুকু। ঈশ্বর তার চাওয়াটাকেই বরাবর আঘাত দিয়ে আশাহত করে দিয়েছে। এখনও মনে আছে বড় ম্রিয়মাণ হয়ে রইল সে কদিন ধরে। গীতাও রইল তার সান্তাক্রুজের বাড়িতে, আর গুরুও রইল তার নিজের ছবির কাজের মধ্যে ডুবে।

    গুরু চেয়েছে শুধু শান্তি। এক কণা শান্তির জন্য সে তার অতুল ঐশ্বর্যের সিংহ-দরজাটা পর্যন্ত খুলে দিতে তৈরি থেকেছে বরাবর। কিন্তু, বড় বেশি তার চাওয়াটুকু। ঈশ্বর তার চাওয়াটাকেই বরাবর আঘাত দিয়ে আশাহত করে দিয়েছে। এখনও মনে আছে বড় ম্রিয়মাণ হয়ে রইল সে কদিন ধরে। গীতাও রইল তার সান্তাক্রুজের বাড়িতে, আর গুরুও রইল তার নিজের ছবির কাজের মধ্যে ডুবে

    পাশে-পাশে আমি থাকতুম। তার মুখের দিকে চেয়ে দেখতুম। কিন্তু হাজার ইচ্ছে থাকলেও আমার সাধ্য কি আমি তাকে সুখী করতে পারি। আমার স্ত্রী প্রত্যেকদিন সকালে সান্তাক্রুজে যায়, সেখানেই খাওয়া-দাওয়া করে আর ফিরে আসে রাত্রিবেলা। গুরুর কাছে কথা বলবার মতো কেউ নেই। গুরুর মা বাসন্তী দেবী এসে বসেন। ছেলের নিঃসঙ্গতার সঙ্গ দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু গুরু কি সেই ছেলে?

    একদিন গুরু এল আমাদের ঘরে। তার ইচ্ছে আমার স্ত্রীর কাছ থেকে শোনে গীতার খবর। গীতা কি বলে, গীতা কেমন আছে, এই সব।

    আমার স্ত্রী বললে— আপনি গীতার কষ্ট বুঝতে পারেন না— তারও তো নানা রকম কষ্ট থাকতে পারে—  

    — গীতা কি তাই বলেছে আপনাকে?

    আমার স্ত্রী বললে— হ্যাঁ—

    — কিসের কষ্ট?

    — গীতার এক ভাই আমেরিকাতে পড়ছে, এই কদিন পরেই তাকে কয়েক হাজার টাকা পাঠাতে হবে, সে টাকার ভাবনাতেই অস্থির—

    গুরু শুনল কথাটা মন দিয়ে। শুনে বললে— কিন্তু আমি তো বলেছি সে আমি পাঠাবার ব্যবস্থা করব— তার জন্যে ভাবতে হবে না—

    — কিন্তু তা বলে কি মানুষ ভাবা বন্ধ করতে পারে!

    গুরু বললে— গীতা আর কি বলেছে? এখানে কবে আসবে, কিছু বলেছে—আমার স্ত্রী বললে— একটু সুস্থ হলেই ফিরে আসবে—

    এর চেয়ে বেশি কিছু বলাও যায় না। দুজনের সম্পর্ককে সুস্থ পরিণতিতে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টায় যেটা বললে ভালো হয়। সেটাই বললে আমার স্ত্রী।

    গুরু মন দিয়ে সব শুনতে লাগল। এ সম্বন্ধে আমিও অনেকবার অনেকভাবে বুঝিয়ে বলেছি। আর তা ছাড়া গুরুই কি ছেলেমানুষ? জীবন সম্বন্ধে গুরুর অভিজ্ঞতাই কি কিছু কম? গুরু কি আমাদের চেয়ে কিছু কম দেখেছে, কম ভেবেছে, কম পড়েছে?

    আজও এক-এক সময় ভাবি সব কিছু থেকেও কেন এমন হল? সব কিছু বুঝেও কেন এমন বিব্রত হয়ে পড়ল গুরু? ভাগ্যের উদয় কিংবা অবনতি সব কিছুকে হাসিমুখে বিগতস্পৃহ হয়ে গ্রহণ করবার উপদেশ তো শাস্ত্রেই আছে।

    সে-শাস্ত্র তো গুরুও পড়েছে। তার সঙ্গে কথা বলে তো আমিও অনেক কিছু শিখেছি। কিন্তু বিপদ-দুঃখ-বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এমন করে মাথা পেতে সব কিছু সহ্য করার ক্ষমতা তো আর কারো দেখিনি। গুরু আমাদের কাছে কিছু গোপন করেনি। তার অকলঙ্ক চরিত্রটা আমাদের সামনে নিরাবরণ করে দেখিয়েছিল। তবু এত অশান্তি কেন অহরহ তাকে পাগল করে তুলত? কেন সে অতিষ্ঠ হয়ে উঠত?

    তিনদিন পরেই আমাদের চলে আসার পালা। ভোরবেলাই উঠেছে গুরু। উঠে বারান্দায় বসে আছে। আমরা সেদিন চলে আসব। সকালবেলার প্লেন।

    যেদিন এসেছিলাম সেদিন এ-বাড়ি দুজনের হাসিতে মুখর ছিল। দুজনে হেসে আপ্যায়ন করেছিল, অভ্যর্থনা করেছিল। সে কি এক আনন্দের দিন। আজ গীতা নেই। গুরু বসে আছে আমাদ্দের বিদায় অভিনন্দন জানাতে।

    আমার মনে হচ্ছিল গুরুর কথা। গুরুর দিকে চেয়েও ভালো করে চাইতে পারছিলাম না। বেচারি হয়তো কদিন ধরে ঘুমোতে পারেনি। সেই মনের সমস্ত অশান্তি ঢেকে আমাদের ওপর স্বাভাবিক করণীয় কর্তব্য করে যাচ্ছে। গুরু বললে— বউদি, জিনিসগুলো একবার দেখে নিন, সব উঠেছে তো গাড়িতে—মনে আছে সে তারিখটা ২৮শে মার্চ, ১৯৬২। আমি কার কাছ থেকে বিদায় নেব? গুরু তো তখন আর মানুষ নয়, পাথর। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর না ঘুমিয়ে তখন যে সে পাথর হয়ে গেছে।

    গাড়িটা পালি হিলের বাগানটা ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায় এসে পড়ল। পেছন ফিরে দেখলাম— গুরু তখনও সেই বারান্দায় চুপ বসে আছে।

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     



 

Rate us on Google Rate us on FaceBook