তিন টুকরো হালকা নীল রঙের কাগজ, হাতে ছেঁড়া, এবড়োখেবড়ো। তারই মধ্যে নীল পেনের আঁকিবুঁকি আর ছোট্ট, তিনকোনা কমলা ঠোঁট এঁকে নন্দলাল বসু ফুটিয়ে তুলেছেন দুটো পাখির ছানা আর তাদের মায়ের ফ্যামিলি-পোর্ট্রেট। হাঁস না মুরগি, সেটা বিচার করার দায়িত্ব আমাদেরই। মা-পাখির ডানার পালকের সঙ্গে মিশে গেছে নন্দলালের মনোগ্রাম আর তারিখ — ২৭ জানুয়ারি ১৯৫৪। শান্তিনিকেতনের কলাভবন থেকে অবসর নেওয়ার পর, নন্দলাল এরকম একাধিক কোলাজ বানিয়েছিলেন হাতের কাছে পড়ে থাকা কাগজ, খাম, এমনকী ক্যামেরার লাইট মিটারের ওয়্যারান্টি কার্ডের ওপর। নতুন ধরনের এই কাজগুলোর তিনি নামকরণ করেন ‘হেলা-ফেলার ছবি’। কলকাতার কারেন্সি বিল্ডিং-এ ‘ড্যাগ’-এর ‘ঘরে বাইরে’ নামক স্থায়ী প্রদর্শনীতে কাজের সূত্রে নন্দলালের কল্পিত চিরকুট-চরিত্রদের সঙ্গে প্রথম আলাপ হয় আমার।
ছোটবেলায় সহজ পাঠ-এ ‘ট ঠ ড ঢ করে গোল / কাঁধে নিয়ে ঢাক ঢোল’ পড়ার সময়ে কখনও ছবিগুলোর কথা পৃথকভাবে ভেবে দেখিনি। ছাপা অক্ষরের ঊর্ধ্বে যেমন শব্দের সুর আর ছন্দ কানে বাজত, তেমনই কালো-সাদা ছবিগুলো যেন চোখের সামনে ফুটিয়ে তুলত কোন এক ঢাকির সঞ্জীবিত ছায়া। (এইসব কল্পনা করতে গিয়েই বোধহয় তখন বানানের দিকটায় মন দিতে ভুলে গেছিলাম।) অনেক পরে জেনেছি সেগুলো নন্দলালের সৃষ্টি। তারও পরে জানতে পেরেছি জাতীয় স্তরে তাঁর নানা কীর্তিকলাপের কথা। যেমন ভারতীয় সংবিধানের নকশার কাজ, বা ১৯৩৮-এ গান্ধীর অনুপ্রেরণায় হরিপুরায় কংগ্রেস সভার পোস্টার আঁকা— যার মধ্যে থেকে একটি ‘ঘরে বাইরে’-তে আমরা দেখতে পাই।
অবাক হওয়ার কোন কারণ আছে কি — যে নন্দলালের মতন একজন শিল্পী এবং শিক্ষক হঠাৎ ৭১-এ পা দিয়ে নতুন চিত্তবিনোদনের উপায় ভেবে বের করলেন? কাজগুলোয় কী অদ্ভুত স্বতঃস্ফূর্ততা! স্পষ্ট বোঝা যায় তাঁর শিল্পীসত্তা দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো জিনিসের মধ্যেই সৌন্দর্য উপলব্ধি করত। হেলা-ফেলার ছবিগুলো দেখে মনে পড়ে যায়, ছোটবেলায় মেঘের দিকে তাকিয়ে নানা পশুপাখি বা মানুষের মুখ খুঁজে বের করার প্রচেষ্টা। কোথাও তো লেখা নেই যে একটা বয়সের পর কল্পনাশক্তিকে ছুটি দিতে হবে। ‘মাস্টারমশায়’ যেন আমাদের সেই কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। ‘ঘরে বাইরে’-তে যখন আমরা ছোটদের নিয়ে ওয়ার্কশপ করি, কাগজ ছিঁড়ে ছবি বানানোর খেলায় কচিকাঁচাদের সঙ্গে আমাদের মিউজিয়ামের বাকি কর্মচারীরাও কেউ কেউ যোগ দেন। হেলা-ফেলার ছবির সাফল্য বোধহয় এখানেই।
‘ঘরে বাইরে’-র কথা পাঠকদের মধ্যে অনেকেই হয়তো জানবেন। ২০২০-র জানুয়ারি মাসে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’র জীর্ণসংস্কার করা ‘কারেন্সি বিল্ডিং’-এ, ‘মিনিস্ট্রি অফ কালচার’-এর উদ্যোগে ড্যাগ (যার পূর্ব-পরিচিতি ছিল ‘দিল্লি আর্ট গ্যালারি’) এই স্থায়ী প্রদর্শনীটি উপস্থাপনা করে। ড্যাগ-এর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ও সি-ই-ও, আশিস আনন্দ জানিয়েছেন, একাধিক নতুন মিউজিয়াম এবং প্রদর্শনী গঠনের লক্ষ্য: দেশের সকল মানুষের কাছে ভারতবর্ষের চিত্রকলার গৌরবময় ইতিহাস পৌঁছে দেওয়া। এবং সেই ইতিহাসে মুখ্য ভুমিকা নিয়েছিলেন বাংলার শিল্পীরা। অতএব ‘ঘরে বাইরে’ তাঁদের এবং কলকাতার সাধারণ মানুষকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
১২টা গ্যালারি জুড়ে রয়েছে ৬০০-র ওপর তৈলচিত্র, জলরং, প্রিন্ট আর ভাস্কর্য, যার মধ্যে দিয়ে আধুনিক বাংলা চিত্রকলার ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে আগত ভ্রমণকারী ইউরোপীয় শিল্পী— যেমন ফ্রাঁসোয়া বাল্থাসার সলভিন্স, উইলিয়াম হজেস, বা থমাস ও উইলিয়াম ড্যানিয়েল— এঁদের ছবি থেকে শুরু করে আমরা দেখতে পাই উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বাস্তবধর্মী এবং অ্যাকাডেমিক শিল্পের আবির্ভাব। তারই পাশে গড়ে উঠেছে ‘আর্লি বেঙ্গল’ বা ‘ডাচ বেঙ্গল’-এর ধারা, যাতে আমরা দেখছি মুর্শিদাবাদের পেশাদারি মিনিয়েচার শিল্পীদের সঙ্গে ইউরোপীয় ‘ন্যাচারালিস্ট’দের শৈল্পিক আদান-প্রদান।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার চিত্রকলার এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কেন্দ্র করে। ‘বেঙ্গল স্কুল গ্যালারি’তে অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, অসিত কুমার হালদার, আব্দুর রহমান চুঘতাই প্রমুখ শিল্পীদের কাজ ছাড়াও রয়েছে সুনয়নী দেবীর (অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথের বোন) দুটো জলরঙের ছবি আর দুটো বিরল এমব্রয়ডারির নমুনা।
তিনতলার প্রথমার্ধে দ্রষ্টব্য চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোড়, জয়নুল আবেদিনের আঁকা ১৯৪৩-এর মন্বন্তরের ছবি, ভারতের নবরত্নদের মধ্যে ছ’জনের (অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, যামিনী রায়, শৈলজ মুখার্জি) গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ, এবং শান্তিনিকেতনের আধুনিকতার নতুন ধারার বিশেষ দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতা লাভের পরেও হতাশার ছায়া লক্ষ করা যায় বাংলার চিত্রকলায়। রবীন মণ্ডল, বিকাশ ভট্টাচার্য, পরিতোষ সেনের মতন শিল্পীদের কাজ যেন হয়ে ওঠে মন্বন্তর, দেশভাগ, রিফিউজি সমস্যা, নকশাল আন্দোলন ও অন্যান্য সঙ্কটের ভয়াবহতার সাক্ষী। তা ছাড়াও নীচের তলায় রয়েছে আধুনিক ভাস্কর্যের গ্যালারি, আর নিমাই ঘোষের তোলা সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার শুটিঙের অস্থায়ী প্রদর্শনী।
কাজে যোগ দেওয়ার পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ গ্যালারিগুলো ঘুরে ঘুরে আমার অজানা বহু শিল্পীর সঙ্গে আলাপ করতেই কেটে গেছিল। তবে তখনও ঠিক আন্দাজ করতে পারিনি, সাধারণ মানুষের মধ্যে আঞ্চলিক শিল্প-ইতিহাস সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলায় মিউজিয়াম-তুল্য একটা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আমার সহকর্মী, সুমনা চক্রবর্তী, ‘ঘরে বাইরে’-র ডেপুটি ডাইরেক্টর, বারবার মনে করিয়ে দেন, সচেতনতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া একতরফা নয়, ঠিক যেমন নিজের কালেকশনের ব্যাখ্যা করাতেও মিউজিয়ামের একচেটিয়া অধিকার থাকে না। নানান মতামত, বিবিধ দৃষ্টিভঙ্গির মিলনস্থান হয়ে উঠতে পারে একটা মিউজিয়াম, যাতে আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়েই শিল্পকলার নতুন অর্থের অন্বেষণ করা সম্ভব হয়।
কিন্তু বিগত দেড় বছরে এই ধরনের ভাবনাচিন্তা ধারাবাহিক রূপে কারেন্সি বিল্ডিং-এ বাস্তবায়িত করার কাজ বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে অতিমারীর কারণে। উদ্বোধনের পর দু’মাস যেতে না যেতেই লকডাউন ঘোষিত হয়। অন্য অনেক মিউজিয়ামের মতন আমরাও বাধ্য হই সাময়িকভাবে অনলাইন প্রোগ্রামিং-এর পথ অবলম্বন করতে। তাতে অপ্রত্যাশিত কয়েকটা সুবিধেও হয়। যেমন কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অনেক মানুষের কাছে আমাদের মিউজিয়ামের কালেকশন পৌঁছে দেওয়া যায়। অন্যদিকে, ভার্চুয়াল প্রদর্শনীর মাধ্যমে খুব সহজেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলাভবন বা যদুনাথ ভবনের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার ফলে, যেসব শিল্পীদের কাজ একাধিক কালেকশনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেছে, সেগুলো আমরা খুব সহজেই এক জায়গায় প্রদর্শন করতে পারি।
এর কিছু মজার পরিণামও ছিল, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘জিফ ইট আপ’। হেরিটেজ ল্যাব ও ইউরোপিয়ানার সহযোগিতায় আমরা মিউজিয়াম কালেকশনের বেশ কিছু ছবি পাবলিক ডোমেন-এ দিয়ে দিই। সেগুলোর ভিত্তিতে ‘জিফ’, অর্থাৎ ছোট ছোট অ্যানিমেশনের প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। তার দুটো উদাহরণ এখানে দেওয়া হল।
যে ক’টা মাস আমরা মিউজিয়াম খোলা রাখতে পেরেছি, তারই মধ্যে থেকে কয়েকটা বিশেষ স্মৃতি উল্লেখ করি। আগেই বলেছি, মিউজিয়ামে একতরফা শিক্ষাদানের ব্যাপারটা থেকে আমরা সরে আসার চেষ্টা করি। সে-কথা মাথায় রেখে, ‘থিঙ্ক আর্টস’-এর সঙ্গে আমরা ‘মিউজিয়াম অ্যাম্বাসাডরস’ বলে একটি প্রোগ্রাম করি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে। বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রী এবং ‘থট শপ’ নামের এক এনজিও-র কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে ওয়ার্কশপ করা হয়। দু’তিনজন করে দল বেঁধে ‘ঘরে বাইরে’-র এক-একটা গ্যালারি বেছে নিয়ে ওঁরা নানান ধরনের মজার মজার খেলা আবিষ্কার করার চেষ্টা করেন, যাতে সাধারণ দর্শক আর একটু মনোযোগ দিয়ে ওঁদের প্রিয় কাজগুলো দেখেন আর সেই ছবির মধ্যে ব্যক্তিগত অর্থ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেন।
প্রশান্ত রায়ের ছবির সামনে একটা দল কিছু বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে পড়ে। আগত দর্শকদের বলে, একটা কোনও যন্ত্র বেছে নিয়ে, সেটা বাজানোর চেষ্টা করতে, এবং সেই সুরের সঙ্গে ছবি দেখার অভিজ্ঞতা কিছুটা পাল্টে যাচ্ছে কি না খেয়াল করতে। অন্যদিকে থট শপের কয়েকজন কালীঘাট পটের শৈলীতে আঁকা এক বাবু ও তাঁর প্রণয়িনীর একটা সিরিজের ছবি ওলটপালট করে দিয়ে দর্শকদের বলেন, নিজের মতন সিকোয়েন্সে সেগুলো সাজিয়ে একটা নতুন গল্প রচনা করতে।
অন্য অনেক মিউজিয়ামের মতন ‘ঘরে বাইরে’-তে স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং জনসাধারণের জন্য গাইডেড ওয়াক-এর ব্যবস্থা রয়েছে। তার সঙ্গে আমরা চেষ্টা করেছি কিছু অন্য ধরনের ওয়াক-এর কথা ভাবতে, যা মিউজিয়ামের ছবিগুলোর সঙ্গে আমাদের আশপাশের রাস্তাঘাটের কথোপকথনের সূচনা করতে পারে। যেমন শিল্পী আলিশা দত্ত ইসলামের লালদীঘি কেন্দ্র করে নেচার ওয়াক, যেখানে ড্যানিয়েলস বা হেনরি সল্টের ছবির সাহায্যে তিনি দেখান কলকাতার বর্তমান প্রাকৃতিক জগতে ঔপনিবেশিক প্রভাব।
এছাড়াও শহরের উঠতি শিল্পীদের জন্য প্ল্যাটফর্মের অভাব উপলব্ধি করে ‘ঘরে বাইরে স্টুডিও’ শুরু করা হয়। যে কোনও শিল্পী তাঁর শিল্পের মাধ্যমে— তা নাচ, গান, নাটক, ছবি আঁকা, রান্না, যা-ই হোক— এই স্টুডিওর মাধ্যমে কারেন্সি বিল্ডিং-এ তাঁদের কাজ নিয়ে কিছুটা ভাবনাচিন্তা করার, এমনকী সীমিত শ্রোতা বা দর্শকের সামনে পরিবেশন করারও সুযোগ পেতে পারেন। ইতিমধ্যেই একাধিক খুব নতুন ধরনের কাজ আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে, যেমন শ্রেয়া সাহার আমপান-পরবর্তী পৃথিবীতে প্রকৃতি ও শিল্পকলা নিয়ে পরিকল্পিত যৌথ উদ্যোগ। আমন্ত্রিত পারফর্ম্যান্সও হতে থাকে, যার মধ্যে দিয়ে চেষ্টা করা হয় মিউজিয়াম কালেকশনের ন্যারেটিভের ভিন্ন ব্যাখ্যা খুঁজে দেখার। ‘সমূহ’ তাঁদের ‘অথ হিড়িম্বা কথা’ নাটকটি মঞ্চস্থ করে ফেব্রুয়ারি মাসে। মহাভারতে হিড়িম্বার ভূমিকা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, অথচ তাঁর ব্যাপারে আমরা প্রায় কিছুই জানতে পারি না। সেই ‘রাক্ষসী’-র গল্পের মধ্যে দিয়ে কী অদ্ভুত প্রাসঙ্গিক একটা সংলাপ তৈরি হয়ে যায় নন্দলাল, অসিত হালদার বা রাম গোপাল বিজয়বর্গীয়র পৌরাণিক চিত্রের রোম্যান্টিসিজমের সঙ্গে।
‘ঘরে বাইরে’-তে কাজের সূত্রে অনেক নতুন জিনিস শেখার সুযোগ হয়েছে। শুধু বই পড়ে বা গবেষণা করে নয়, আমার সহকর্মী, মিউজিয়ামের দর্শক, বিভিন্ন শিল্পী এবং শিল্প ইতিহাসবিদদের সংস্পর্শে এসে। ছবি দেখতে দেখতেও। আশা করব আরও বহু মানুষ আধুনিক বাংলা চিত্রকলার এই ব্যাপক প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পাবেন আগামী দিনে। অনুপ্রাণিত হবেন নন্দলালের মতন সময়ে-অসময়ে নিজের কল্পনার জগতে আশ্রয় নিতে। এবার লকডাউনটা উঠলে বাঁচা যায়! খুব সাবধানে আবার নতুন করে কারেন্সি বিল্ডিং-এ প্রাণ ফিরিয়ে আনা যাবে একসঙ্গে।