সেবার গুপচুপ করে নয়, বর্ষা এসেছিল রীতিমতো ঝমঝমিয়ে। জুলাই মাসের তেইশ না হলে পঁচিশ ঠিকই ছিল, বিয়ের পাকা দেখাশোনার। মহিদিদির পাকা দেখাশোনার।
আগের বছর রিলিজ করে গেছে ‘পরদেস’। মহিদির কলেজ যাওয়ার সময়টাতেই বেপাড়ার ছেলেদের পাড়ার দোকানে অকারণে দরদাম করা দেখে, ঘোষ জেঠিমা অবধি বলেছেন, ‘না বাপু, তোমাদের মহি সুন্দরী নয় ঠিকই, তবে আলগা চটক আছে।’ তবে আমরা তো জানি, মহিদি কোনও অংশে কমলা চুড়িদার পরা মহিমা চৌধুরীর চেয়ে কম নয়। মায়ের কাছে মহিদি যখন গান শিখতে আসত ,আহা! তখন সামনের উঠোনে ল্যাগব্যাগে লোকাল ইন্ডিয়া (পাড়াই আমাদের দেশ) টিমটার উৎসাহ চোখে পড়ার মতো। পৌনে ছ’বার বেপাড়ায় টুর্নামেন্টে গিয়ে তারক-কাকার এন্ট্রি ফি-র আমরা গাব ছাড়িয়ে দিয়ে এসেছি। পৌনে বললাম কারণ, একবার অকারণ খেস্তাখিস্তির জন্য ম্যাচ বাতিল ছিল। সে যাই হোক, আমাদের তখন বুধনদাই এট্টু বল-ভরসা। না না, তখনও সবার দাদা সৌরভ ক্যাপ্টেন হননি। তবে শুয়ে পড়া সিরিজগুলোতেও সাকুল্যে রান ভালই। ক্যাপ্টেন শচীনের দশা পাড়ার কংগ্রেস লিডার ভূপতি জ্যাঠার মতো, ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। তখন পাড়া লালে লাল। গোপনে নবমীর দিন কংগ্রেস পার্টি-অফিস ভাড়া দেওয়াও হচ্ছে ছাগল রাখার জন্য। আরে পার্টি-অফিসের ইলেকট্রিক বিলটা কে মেটাবে? বুধনদার বাবা ভূপতি জেঠুর তো তার আগের বছর পেসমেকার বসানো হল। পেসটা বুধনদা ভালই খেলত, বাঁ-হাতে খুব সাবলীল। কিন্তু ছোটকা বলত, ‘কংগ্রেসি বাড়ির ছেলে তো, তাই একটু ন্যাদা।’ গিটারটাও মন্দ বাজাত না। মহিদি গরমকালে সকাল-সন্ধে রেওয়াজ করত। মহিদি আসলে পাড়ার ডাকসাইটে ফিমেল ভয়েস। মে দিবস হোক বা শারদ সম্মিলনী— মহিদির উদ্বোধনী সঙ্গীত বাঁধা। না, বুধনদাকে কেউ ডাকত না তেমন স্টেজে গান গাইতে। এট্টু ম্যাদা গোছের ভালমানুষ ছিল। বুধোদা গান গাইলে স্টেজে আলো ফেলবে কে? এমনকী কমরেড সরলাদির নির্দেশে মে দিবসে বুধনদা ‘ও আলোর পথযাত্রী’ গানটা বাচ্চাদের তুলিয়ে গিটারে এট্টু কর্ডও ধরেছিল। আমরা দম আটকে আব গিটছিলুম, জিয়াউল তার ফাটা গলায় চেঁচিয়ে-মেচিয়ে একদিক ধরে রেখেছিল। তখন আমরা-ওরা ওসব সংস্কৃতি ঢোকেনি, তবে পাড়ায় ফুল দমে চলত ‘ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না’। জিজ্ঞেস করেছিলাম বুধনদাকে, এই ওরা কারা? বুধনদা বলেছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। তখন ইতিহাসে চলছিল আকবরের সাম্রাজ্য বিস্তার, ভারি রাগ ধরেছিল ব্যাটার ওপর, কিন্তু এই গান চালালে বা গাইলে আদতে আকবর কি শুনতে পায়, বা তার সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে রাগটা কীসের? কেসটা কী, তা নিয়ে শিওর ছিলুম না!
মহিদি গরমকাল থেকে সকাল-সন্ধে শুরু করেছিল ছাদে রেওয়াজ করা। তখন চারটে ছাদ পরে বুধনদা গিটার টিউন করতে-করতে টান দিতে-দিতে কখন ওই ভরা জ্যৈষ্ঠের গরমে ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল করেছ দান’-এ কর্ড ধরে সুর মিলিয়ে দিত, মাইরি ধরাই যায়নি অনেকদিন। তখন ভরা লোডশেডিং-এর যুগ। লোডশেডিং একটা উৎসব। পাঁচ মিনিটে থমথমে পাড়া গমগমে হয়ে যেত। আমাদের ছাদ থেকে মা ধরল ‘হিমের রাতের ওই গগনের দীপগুলিরে’, ‘আহা’ বলে পাশের ছাদে নগেনদাদু চোখ বুজলেন, ওটা ঝিমুনিতে না সুরের মূর্ছনায় ধরতে পারিনি কখনও। গিটার হাতে টিং টিং করা শ্যামল মিত্রের গানগুলোকে নিজের মতো মিষ্টি করে গাওয়া বুধনদাকে কেউ বিশেষ কলকে দেয়নি। এখন ‘আনপ্লাগড’-এর যুগে ভাইরাল হওয়া বাঁধা ছিল। দেখতাম বুধনদা গান ধরলে তখনই ছোট্ট মনুর ওই লোডশেডিং-এ পায়খানা পেত আর কাকিমা সেই নিয়ে প্রথমে ছাদ আর পরে পাড়া মাথায় করতেন। পুষ্পেনদা বৌদিকে নিয়ে ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’-এর প্রথম দুটো প্যারা তেত্রিশতম বার বলার জন্য তৈরি হতেন। শুধু মনে আছে, পাড়ার কালীপুজোয় অর্কেস্ট্রা উঠতে দেরি করছিল যখন, ওই বুধনদাই লোক বসিয়ে রাখতে এমন সুন্দর ‘সে তো এল না’ গাইল। সামনের সিটে বসা মহিদিকে দেখে ‘ভুল করে তারে মনটি দিয়েছি’ লাইনটা গেয়েছিল এবং… যথারীতি দিয়েও দিয়েছিল নিজের উইকেটটা ছুড়ে।
যাই হোক, বহরমপুর থেকে এল পাকাদেখা দেখতে। সেদিন বৃষ্টি বলার আছি কোথায়! তাও ওরা এসেছিল। আমার ঠিক পাশের বাড়িটাই বুধনদার। সকাল থেকে বুধনদার বিপিএল কোম্পানির টেপরেকর্ডারে চলছে ‘পেয়ার তুমহে ইতনা করতে হ্যায়! তুম ইয়ে সমঝ নেহি পাওগে!’ শাফকাত আমানত আলী গাইছেন দরদ দিয়ে। আর পেয়ার! ছেলে ইঞ্জিনিয়ার! বুধনদা জুলজি অনার্স নিয়ে এই সবে থার্ড ইয়ার, আরশোলা কাটে নাকি কলেজে! তা বুধনদার কোনও বিকার নেই। কিসুই হয়নি। বুধনদা পাঁচ নম্বরের ব্যাটসম্যানের মতো ওপেনিং স্লট-এর দিকে তাকিয়েই থেকেছে, জাস্ট তাকিয়েছে… কর্ড ধরেছে, নিন্দুকের মতে পাড়ার ফিস্ট-এ মহিদির পাতে দুটো নয় তিনটে মাছের চপ দিয়েছে, গোনাগুনতি মাল থেকে। আর দেখে গেছে। আর মাঝে মাঝে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চিলেকোঠায় গান ধরেছে ওই গিটার ট্যাঙস ট্যাঙস করে বাজিয়ে। গানটা চেনা, ‘তবু মনে রেখো… যদি পুরাতন প্রেম’। ছোটকাকাকে গল্প মারতে গেছিলাম, বলেছিল, ‘হ্যাট! পুরাতন প্রেম! মহি বিশ্বকাপ হলে বুধন স্রেফ ইন্ডিয়া… ইয়ে, মানে ফুটবলে।’
মহিদিকে দেখতে এসে বহরমপুরের ছেলের বাড়ির কী লম্বা-লম্বা বুলি! মহিদি কী একটা রজনীকান্ত সেনের গান শুরু করেছিল, তাকে মাঝপথে থামিয়ে ওয়ার্ল্ড মিউজিকের বিপ্লব বোঝাচ্ছিল বিটল্স-এর চাট্টি গানের নাম জানা ছেলের পেছনপাকা ভাই। মহিদির নব্য-বিবাহিতা কাকিমা বুদ্ধি দিলেন, যাও তো, ভূপতি জ্যাঠার ছেলেটাকে ধরে আনো। কী জ্বালা মাইরি! আমরা তাও গেলুম। ওমা, বিপিএল বুধনদার বিপিএলে (টেপ) তখন বেগম আখতার। ‘পিয়া ভোল অভিমান…’ আর বুধনদা ছোলা চিবুচ্ছে আর পড়তে বসেছে। ডাকলুম গিয়ে। কী হ্যাংলা লোক মাইরি, যেন সাতজন্মে গান গায়নি। চলল গিটার নিয়ে! ভাবলুম বলি, কাটলেটগুলো ওরা তোমার জন্য আনায়নি। গিয়ে বিটল্স, এলভিস প্রেসলির জবাবটা বেরোল বব ডিলানের ‘ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড’। মহিদির কাকিমার মুখে অজয় জাদেজা মার্কা হাসি। মহিদিকে দেখতে এসেছে আর পাড়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছে বুধন। লাগাতেই হবে সম্বন্ধটা, পাড়ার সম্মান— এসব ফিসফাস আসছে। হঠাৎ ছেলে নিজে বলে উঠল, ‘ভাই, আমার রিকুয়েস্ট, একটা শানু হোক।’ তারপর ঐতিহাসিক কাণ্ড।
বুধনদা ধরল গিটারের ‘এ’ স্কেল থেকে ‘দো দিল মিল রহে হ্যায়…’। আমরা, উত্তেজিত জনতা, যারা ঘরে ঢোকার চান্স পাইনি, তারা সিটি মারলুম। বুধনদাকে কোনওদিন এত মাথা দুলিয়ে হেসে অমন ফাঁকা চোখে গাইতে দেখিনি। ইঞ্জিনিয়ার মহিদিকে দেখছে, মহিদি হালকা মুখ তুলে ইঞ্জিনিয়ার পাত্রকে দেখছে। এবার বুধনদার চোখ বন্ধ, ওরা দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আটকে গেছে, বুধনদা গেয়েই চলেছে, ‘মগর চুপকে চুপকে’। হ্যাঁ, সবাই বুঝতে পারছে মহিদির ওই হাল্কা দাঁত বের করা হাসিতে বহরমপুরের ছেলেটা গলে গেছে। একটা লাইনে বুধনদা দু’বার ধরে গাইল, ‘কভি কঁহি লগ যায়ে দিল তো কঁহি ফির দিল না লগে’। ছেলের বিটল্স শোনা ভাই সিটি মেরে মাচা স্টাইলে দশ টাকা বুধনদার সাদা জামার পকেটে গুঁজে দিল। জিতে গেল কুমার শানু, নাদিম-শ্রাবণ, জিতে গেল শাহরুখ খান, সৌরভ ও বুধন ঘোষও। সেই ট্র্যাজিক হাসি।
হ্যাঁ, মহিদি আমেরিকা গেছিল ওই বছরেই ডিসেম্বরে বিয়ের পর-পরই। বুধনদার বাবা অগাস্টে মারা যায়, বুধনদা আর জেঠিমারা তখনই বুধনদার মামারবাড়ি চলে যায়। তারপর মামার গ্যারেজে পার্ট টাইম করেও বুধনদা এখন কোন এক কলেজে ওই জুলজিই পড়ায়। আমি গল্প লিখি না। সত্যিকে মিথ্যে করেই বললাম। বুধনদাদের নেমন্তন্ন করার কথাও পাড়ায় কারও মনে ছিল না। শুধু নাক দিয়ে সিকনি গড়ানো একটা ছেলের মনে ছিল। সেই দাদা, যে পেসটা সাবলীল খেলত, খালি ন্যাদা…
কদিন আগে ফেবু-তে বুধনদাকে খুঁজে পেলাম। না বিয়ে করেনি, হ্যাঁ প্রফেসর। আর কভার ফটোয় একটা গিটার, নীচে ক্যাপশন, ‘কভি কঁহি লগ যায়ে দিল তো কঁহি ফির দিল না লগে’… কেউ তাতে হাহা দিয়েছে… মনে পড়ল তাই বললাম। আর বলব না এসব, আমিও হাহা পাব।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র