অনাহিতা সারাভাই খুব আত্মবিশ্বাসী হয়েই বললেন, ‘এগারো বছর বয়স থেকেই আমি সমকামী।’ আহমেদাবাদের মতো রক্ষণশীল শহরে বেড়ে ওঠার ফলে, পারিবারিক বংশমর্যাদার কারণে কিছু সুযোগ-সুবিধা পেলেও বহু বাস্তব অভিজ্ঞতা অনাহিতার অধরাই থেকে যায়। যেমন তিনি জানতেনই না তাঁর মতো আর কেউ ওই শহরে বাস করেন কি না! উচ্চশিক্ষার জন্য নিউ ইয়র্ক সিটির উপকণ্ঠে সারা লরেন্স কলেজে পড়তে এসে এই বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা আমূল বদলে যায়। ওই কলেজে তখন সমকামী ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় গোষ্ঠী ছিল। এমনই এক গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে নানা অভিজ্ঞতা কুড়োন অনাহিতা। উপলব্ধি করেন আহমেদাবাদের জীবনে তাঁর কী কী অভাব ছিল। আবার আহমেদাবাদে ফিরে এসে তাঁর মনে হয় আমেরিকাতেই যেন পরিবার ছেড়ে এসেছেন। শহরে সমকামীদের নিজস্ব গোষ্ঠীর অভাবই অনাহিতাকে কুইয়ারাবাদ গড়ার অনুপ্রেরণা জোগায়। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের জায়গা দেওয়া ছাড়াও, এটি তাঁকে অন্যদের সঙ্গে ভাবনার আদান-প্রদানেও সাহায্য করে।
ক্যাফেতে বসেছিলাম রোহিত গুপ্তা আর অনুকৃতি গর্গের সঙ্গে। প্রশ্ন করলাম, ‘এতদিন যা ছিল দেরাজবন্দি, একান্ত গোপন, কুইয়ারাবাদের মাধ্যমে কি সেই গোষ্ঠীই আত্মপ্রকাশ করল?’ সহমত না হয়ে রোহিত বললেন, ‘একেবারেই নয়। শহরে যা আদৌ ছিল না, তাই এনেছে কুইয়ারাবাদ। তাঁঁরা সমকামী মানুষদের কথা বলার, ভাবনার আদান-প্রদান করার একটা মঞ্চ গড়ে দিয়েছে।’ ডেটিং অ্যাপের বাইরে এইসব মানুষের কোনও খোলামেলা আড্ডাস্থল ছিল না। কিন্তু ডেটিং অ্যাপের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একটি গোষ্ঠীর সঙ্গে ভাবনা ও কল্পনার মিশেলে তৈরি আরেকটি গোষ্ঠীর চরিত্রগত পার্থক্য তো থাকবে অনেকটাই। কামনা-বাসনার উপর ভিত্তি করে এই গোষ্ঠী গড়ে ওঠেনি। এর মূলে রয়েছে এক বিশ্বাস, এক মূল্যবোধ এবং এক প্রয়োজন। কুইয়ারাবাদে এসে সমকামীরা যেমন কণ্ঠস্বর ও মঞ্চ, দুই পেয়েছেন, যে কেউ (যে লিঙ্গের প্রতিই তাঁর আকর্ষণ থাক না কেন) এখানে এসে অন্য মানুষের চোখ দিয়ে পৃথিবীকে দেখতে আর বুঝতে পারেন। কুইয়ারাবাদের যুগ্ম প্রতিষ্ঠাতা অনাহিতা সারাভাই ও শামিনী কোঠারি তাঁদের অণুপত্রিকা ‘টিল্ট’এর প্রথম সংখ্যায় বলেই দিয়েছেন, ‘কুইয়ারাবাদ হল এক অন্য পৃথিবী ও অন্য জীবনচর্চায় ঢোকার প্রবেশপথ, যা সোজা তো নয়ই বরং ট্যাঁড়াব্যাঁকা।’
ভারতে ফিরে কিছু সমকামী গোষ্ঠী আয়োজিত অনুষ্ঠান নিয়ে নানা কানাঘুষো শুনেছিলেন অনাহিতা। এমনই এক গোষ্ঠীতে যোগদানের জন্য তাঁকে গোপনে আমন্ত্রণও জানানো হয়। কিন্তু তিনি সেখানে গিয়ে দেখেন নারীরাই সংখ্যালঘু। মাঝেমধ্যে পটলাক পার্টির আয়োজন করা ছাড়া, গোষ্ঠীটি ছিল নিতান্তই আত্মকেন্দ্রিক; একটা সংকীর্ণ গণ্ডিতে ছায়ার মধ্যে বসবাস করে আর নিজেদের ঝগড়া নিয়ে দিব্যি তাদের দিন কেটে যাচ্ছিল। সদস্যদের কেউ কেউ আবার হিংস্রও হয়ে ওঠে। রূপান্তরকামীদের প্রতি অনেকের ঘৃণাও প্রকাশ্যে চলে আসে। স্পষ্ট বোঝা যায়, এরা আদতে একটা রক্ষণশীল গোষ্ঠী হয়েও উদার হওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এটি এমনই এক গোষ্ঠী যেখানে রাজ্যের ৯৯ শতাংশ সমকামীরই প্রবেশ নিষিদ্ধ। অনাহিতার মনে হল, দেরাজবন্দি হওয়ার আগের দিনগুলো আবার এসে কড়া নাড়ছে।
রোহিত বললেন, ‘সমকামের ক্ষেত্রে এক জায়গায় সমবেত হওয়াও যথেষ্ট ভয়ের।’ কত রকম বাধা আসে— রাজনৈতিক, আর্থিক, সামাজিক, মানসিক। এর ভিত্তিতেই ঠিক হয় কারা এই বৃত্তে স্বাগত, কারা নয়। কুইয়ারাবাদের কাজ হল এই বাঁধগুলোকে ভেঙে দেওয়া। এখানকার যে কোনও অনুষ্ঠান আয়োজনের পিছনে গভীর চিন্তাভাবনা থাকে। কোন ধরনের দর্শক আসবেন, তাই নিয়ে কুইয়ারাবাদ কড়াকড়ি না করলেও, অনুষ্ঠান একেবারেই খোলামেলা করে দিলে, কিছু দর্শকের যে অস্বস্তি হতে পারে, সে-ব্যাপারেও তাঁরা ওয়াকিবহাল। কিন্তু কারা আসছেন, কাদের সঙ্গে আসছেন দেখলে তাঁদের আগ্রহের কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। দর্শক হিসাবে অনুকৃতি যেমন তাঁর প্রথম অনুষ্ঠানে মা’কে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং কিছুটা রক্ষণশীল এই পরিবেশে, সব কিছুর আগল খুলে যাওয়া কি নিরাপদ? অনলাইন-জগৎই বা কতটা সুরক্ষিত? ডিজিটাল দুনিয়ায় অজ্ঞাতপরিচয় থাকার কিছুটা সুবিধা পাওয়া যায় বটে কিন্তু সেখানেও প্রবেশাধিকার একমাত্রিক। তবে, রোহিত ও অনুকৃতি, দুজনেই মনে করেন, অনলাইন দুনিয়ায় নজরদারি বেশি। আত্মনিয়ন্ত্রণের পাল্লাও সেখানে ভারী। সাধারণত দেখা যায়, কিছু সমমনস্ক গোষ্ঠী যখন জড়ো হয়, তাদের মধ্যে নানা ভাষায় আলোচনা চলে, দরকারমতো সেগুলি চটজলদি অনুবাদও হয়ে যায়। কারও আচরণ বা বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মন বুঝে নেওয়া, এই সব মিলেই তো যোগাযোগের সহজ পাঠ শুরু হয় আমাদের দেশে। অনলাইনে এই সহজ-সরল ভাবটা বজায় রাখাই মুশকিল।
সেই ছোট এলজিবিটি+ গোষ্ঠী ছেড়ে অনাহিতা, তাঁর তৎকালীন পার্টনার শামিনী এবং আরও কয়েকজন মিলে গড়ে তোলেন কুইয়ারাবাদ। এই নাম অনাহিতার অবচেতনে বাসা বেঁধে ছিল অনেকদিন। ‘টিল্ট’কে উদ্ধৃত করেই বলা যাক, ‘নামটার মধ্যে শহরের অনুষঙ্গ তো ছিলই। আবাদের আক্ষরিক অর্থ যেখানে চাষবাস হয়। আবার আবাদ বলতে মার্জিত রুচির চর্চাকেও বোঝায়।’
এই গোষ্ঠীকে ঢেলে সাজানোরও প্রয়োজন ছিল। এর জন্য আহমেদাবাদ ছিল আদর্শ স্থান, কারণ এখানে এই নিয়ে আগে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ভেবেচিন্তেই এখানে কোনও শ্রেণি বিভাজন বা পদমর্যাদাও রাখা হয়নি। গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল কিছু মূল্যবোধকে, যা গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিতে পারবেন। এই একতা চিরন্তন হলে তখনই যোগাযোগ দৃঢ় হয় এবং নতুন কণ্ঠস্বর শোনা যায়। তাই ‘এক দেশ-এক কার্ড’এর ধাঁচে এখানে কোনও সদস্যপত্র প্রয়োজন হয়নি।
নারীর সমানাধিকারে বিশ্বাস রাখাই হল কুইয়ারাবাদের মূল প্রেক্ষিত। কিন্তু আজও অনেকে বিষয়টির গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারেন না। পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীগুলির মধ্যে থাকা এই বিভাজনরেখা বুঝতে কোনও রকেট বিজ্ঞানের দরকার হয় না। কিন্তু আমাদের রক্ষণশীলতার শিকড় এতটাই গভীরে যে, অবস্থা অনেকটা একই রকম থেকে গিয়েছে। কেউ সমকামী হলেই সে উদারমনা হবে, এমন মনে করার কোনও কারণ নেই। যে কোনও প্রতিষ্ঠানের মতো, সমকামী গোষ্ঠীগুলিও বৈচিত্রে ভরা।
অনুকৃতির দেওয়া ‘টিল্ট’এর কপির মধ্যে ছিল ‘কুইয়ার এবিসি’জ’ নামাঙ্কিত একটি লিফলেট। এটি আসলে ২৫টি পরিভাষার তালিকার সটীক সংস্করণ। প্রথম তিনটি (যৌনতা, লিঙ্গ ও যৌন লক্ষণ) ছাড়া বাকি সব ক’টি বিশেষ লিঙ্গ ও যৌন লক্ষণ সংক্রান্ত পরিচিতি নিয়ে। এর কিছু আমার কাছেও অপরিচিত, আবার কয়েকটি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলা ছিল। রোহিত হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘নিজেকে বোঝাতে ক’টি সর্বনাম ব্যবহার করো?’ কুইয়ারাবাদের সবাই যাতে পরস্পরকে চিনতে পারে, তাই এই প্রশ্নটি তাদের শিক্ষাক্রমেও রাখা আছে। সাধারণত, নিজের পরিচয় দেওয়ার সময় এগুলি ব্যবহার করা হয়। তাই থেকে অন্যদেরও একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়ে যায়। যেমন রোহিতের সঙ্গে পরিচয় করানোর সময় ব্যবহৃত হয় ইংরেজি দে/দেম অথবা হি/হিম। আবার অনুকৃতির সঙ্গে মানানসই শি/হার। বিশেষ ভাবনাচিন্তা না করেই আমি হি/হিম বলাতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এ-প্রশ্ন আগে আমাকে কেউ কখনও করেনি। সেই মুহূর্তে ব্যক্তিগত ভাষ্য বদলে গেল রাজনৈতিক ভাষ্যে। কারণ আমাকেও লিঙ্গ-নিরপেক্ষ ভাবে শুধু ব্যক্তিগত সর্বনামের মাধ্যমে নিজের পরিচয় দিতে বলা হয়।
রোহিতের মতে, প্রথমে যে কোনও বিষয়ে কুইয়ারাবাদ রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষই থাকত। এখন কিন্তু সেই অবস্থান সরাসরি রাজনৈতিক। উপস্থিতি ও স্বর থাকা এক জিনিস আর সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে নিপীড়ন, শোষণ, হিংসার বিরুদ্ধে সমালোচনায় সোচ্চার হওয়া আরেক জিনিস। সমকামী গোষ্ঠী আর আড়ালে থাকবে না। তাদের দেখতে হবে, শুনতে হবে আর সব হিসাবের মধ্যেও রাখতে হবে। সব অস্বস্তি কাটিয়ে, পারস্পরিক সংহতি গড়ে তুলতে পারলে এই গোষ্ঠী আরও উন্নত, আরও ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে। কিন্তু একদিকে ভিতর থেকে এই গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন, অন্যদিকে তাকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে নিরাপদ রাখা, দুটি কীভাবে সম্ভব?
অনলাইন মাধ্যমেই আত্মপ্রকাশ করে কুইয়ারাবাদ। সমকামী সাহিত্য থেকে কবিতা পাঠের মাধ্যমে এর প্রথম অফলাইন অনুষ্ঠান হয় ২০১৬ সালে। তখন অবশ্য আন্দাজ ছিল না সেখানে কত দর্শক হবে। এখন অবশ্য দর্শক সংখ্যা বেড়েছে অনেকটাই। বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান যেমন বার্ষিক প্রাইড মার্চ, মেলা, কনসার্ট এবং অর্থ সংগ্রহ করার অনুষ্ঠানে জনসমাগম ভালই হয়। এ ছাড়া নিয়মিত অনুষ্ঠানের ডালি তো আছেই।
এমনই একটি সিরিজ, ‘আস্ক হোয়াট ইউ উইল।’ এর লক্ষ্য, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে গোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক স্থৈর্য এবং স্বনির্ভরতা গড়ে তোলা। এই অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞদের না ডেকে, বরং চেষ্টা করা হয় আহমেদাবাদ/গুজরাত/ভারতে এই গোষ্ঠীর যে সম্পদ আছে সেগুলির সেরা উদাহরণ ও সম্ভাবনাগুলিকে কাজে লাগানো। অংশগ্রহণকারীদের বলা হয় কাগজের টুকরোয় নিজেদের নাম না দিয়ে শুধু তাঁদের প্রশ্নগুলি লিখতে। এর পর সব প্রশ্ন জড়ো করে শুরু হয় আলোচনা। গোষ্ঠীর অনেক সদস্য তাঁদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে নানা উদাহরণ তুলে ধরেন। এর থেকে উপকৃত হন অন্যান্য সদস্যও। এর ফলে একদিকে গোষ্ঠীর গ্রহণযোগ্যতা যেমন বাড়ে, অন্যদিকে প্রত্যেক সদস্য অন্যের সমস্যা সম্পর্কে আরও সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা পান। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে আলোচনা। ব্যক্তিগত স্তর থেকে রাজনৈতিক হয়ে বিমূর্ত, কিছুই বাদ যায় না। পরিবার, ধর্ম, একাকিত্ব, জোর করে বিয়ে দেওয়ার মতো বিষয়গুলি বার বার উঠে আসে।
এক সময় কুইয়ারাবাদ বুঝল, তারা একটা স্তর পর্যন্তই তাদের গোষ্ঠীকে নিরাপত্তা দিতে পারে। কখনও কখনও এমন মুহূর্ত আসে যেখানে চার দেওয়ালের সুরক্ষা পাওয়া যায় না। সেই কারণেই চালু হয় ‘রাখড়পট্টি।’ গুজরাতিতে এর অর্থ উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়ানো। এক্ষেত্রে গোষ্ঠীর সদস্যরা প্রকাশ্যে বেরিয়ে অন্যের উপস্থিতি থেকে সাহস অর্জন করেন। এর লক্ষ্য, জনসমক্ষে নিজেকে সমকামী হিসাবে চিহ্নিত করা এবং এই গোষ্ঠীকে সমাজেরই এক অংশ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা।
এক মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ প্রয়াস হিসাবে শুরু হয় ‘ইন কনফিডেন্স।’ এখানে একজন মনোবিদ এবং কুইয়ারাবাদের এক সদস্য মিলে অংশগ্রহণকারীদের ভাল শ্রোতা এবং অন্যকে বলার সুযোগ দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেন। গোপনীয়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়াও, এই প্রকল্পের ভিত্তিই হল বৃহত্তর গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস। এর মূলে রয়েছে অনাহিতার একটি ধারণা। তিনি মনে করেন, ভাল শ্রোতা তৈরি হলে, মানুষের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগির জায়গাটা আরও সৎ, আরও আন্তরিক হয়ে উঠবে। সবটাই থেরাপিস্টদের উপর ছেড়ে না দিয়ে এইভাবে চললে গোষ্ঠীর সদস্যরা যে কোনও প্রয়োজনে অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারবেন। ত্রৈমাসিক এই অনুষ্ঠান লকডাউনের আগে মাত্র দু’বার করা সম্ভব হয়।
এই অনুষ্ঠানগুলির মাধ্যমে কুইয়ারাবাদ সব ধরনের মানুষের মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে। এর ফলে স্বাভাবিক ভাবেই আয়োজক ও যোগদানকারী, দু’পক্ষই খুশি। রোহিতের কাছে এটা হল ‘গার্ডেন এফেক্ট’ বা বাগিচার প্রভাব। ভাল লাগবেই, সে ভিতরে ঢুকুন আর নাই ঢুকুন।
তবে লকডাউন চালু হওয়ার পর নিয়মিত অনুষ্ঠানগুলি, গোষ্ঠী সদস্যদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ আপাতত বন্ধ। এই পরিস্থিতিতে সমকামীদের বাইরে বেরোনোও ঝুঁকির। কুইয়ারাবাদ অবশ্য এই সময় এক নতুন ভূমিকা পালন করছে। সাহায্যের আবেদনের স্রোত সামলাতে তারাই এখন মুশকিল আসান। কেউ গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হলে তাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, সেটা কখনও অন্য শহরেও হতে পারে। রূপান্তরকামী ও তার সঙ্গীকে নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি, ক্ষেত্র বিশেষে তাদের পাকা চাকরিরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশে মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতেও এগিয়ে এসেছে কুইয়ারাবাদ। এইসব ঘটনা থেকে ভারতে সামাজিক বৈষম্য ও বিভাজনগুলি প্রকট হয়ে ওঠে। শুধু সমকামী গোষ্ঠীর মধ্যেই নয়, এই আড়াআড়ি ভাগে কোথাও লেগেছে রক্তের রঙও। অনাহিতাও খুশি কারণ তাঁর গোষ্ঠী কোনও বাছবিচার না করেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে তাঁর খেদ যে মানুষকে কাছাকাছি আনতে, বিপদের সময় কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে লড়তে শেষে একটা অতিমারীর দরকার হল!
‘এখন সব থেকে কঠিন হল কাজ করার ফাঁকে আশা জিইয়ে রাখা। বহু লোক এমন কাজ করছেন যেখানে চাকচিক্যই প্রধান। গাড়ি করে সেলেব্রেটি না আনলেই, সম্মানহানি। অন্য দিকে, আমরা আমাদের গোষ্ঠীর সদস্যদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাবার চেষ্টা করছি। এর ফলে আমাদের বিশ্বাসের ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হয়েছে। রোজকার জীবন এই সুযোগ আমাদের দেবে না।’
অনাহিতার এই বক্তব্য কোভিড-কণ্টকিত বিশ্বে কুইয়ারাবাদের নতুন দিকনির্দেশও করে দেয়। অতিমারী আমাদের মানবিকতার নতুন পাঠ দিল কি না, তা সময়ই বলবে। তবে সবার ভবিষ্যৎ যে একই সুতোয় গাঁথা, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এখনই সময় জাতি, বর্ণ, লিঙ্গকে সামগ্রিক ভাবে দেখা। সেখানে আমি-তুমির বিভাজন টানলে নিজেদেরই ক্ষতি। লকডাউনের সময়ই কুইয়ারাবাদ শুরু করে ‘কুইয়ারান্টাইন ফ্রাইডে’ শীর্ষক অনলাইন অনুষ্ঠান। সামাজিক আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা নিজেদের সমস্যার সুরাহার ব্যবস্থা করেন। পরস্পরকে বুঝতে পারলে জীবনও সুন্দর হয়ে ওঠে।
শিক্ষাদানের নিত্যনতুন পদ্ধতিতে অনাহিতার আগ্রহ থাকায় গড়ে উঠেছে কুইস্যা, অর্থাৎ কুইয়ার ইউথ সলিডারিটি সাপোর্ট অ্যান্ড আফার্মেশন। তাঁর পরিচিত মানুষজনের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই এর ভিত্তি। গার্হস্থ্য হিংসার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় এদের মনে ভয় ঢুকে যায়। অন্য দিকে কুইস্যা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি দু’মাসে একবার। বয়স পঁচিশের কম হলে এতে অংশগ্রহণ করা যায়। অনাহিতার নেতৃত্বে অল্পবয়সিরা এখানে পরস্পরকে দেখাশোনার সুযোগ পান। তাঁদের আশ্বাস দেওয়া হয় যে, অস্তিত্বের কোনও সঙ্কটে তাঁরা যেন না ভোগেন। এখনও পর্যন্ত যে-তিনটি অধিবেশন হয়েছে, সেখানে সাতটি শহর থেকে প্রতিনিধিরা এসেছিলেন। দুজন আসেন বিদেশ থেকেও। এই প্রসঙ্গে অনাহিতা সরাসরি বলে দেন, ‘এইসব হাবিজাবি বেড়ার বাইরেও আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারব।’
গত পাঁচ বছরে সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিজেদের কথা ও ভাবনা শোনা এবং এই গোষ্ঠীর লক্ষ্য সম্পর্কে ভাবনাচিন্তা করা। তার জন্য ডুব দিতে হয়েছিল সদস্যদের নেতিবাচক দিকগুলির উপর— যেমন লজ্জা, ভয়, নিজের প্রতি ঘৃণা। অনাহিতার কথায়, ‘এই গোষ্ঠীকে ভিতর থেকে বোঝার চেষ্টা করা কোনও কঠিন সফরের থেকে কম ছিল না। আমরা যদি নিজেদের নিয়েই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি এবং পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়া না থাকে, তাহলে অন্যদের পক্ষপাতশূন্য হয়ে কাজ করতে বলব কীভাবে?’
গত কয়েক বছরে আহমেদাবাদে যে ক’টি অভিনব প্রচেষ্টা দেখা গিয়েছে, তার অন্যতম এই কুইয়ারাবাদ। এই উদ্যোগ তরুণ আহমেদাবাদীদের, যাঁদের কয়েকজন বিদেশফেরত, আর কয়েকজন এই শহরেরই বাসিন্দা। এঁদের মাধ্যমেই শহরের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জগতের ফাঁকগুলি ভরাট করা সম্ভব হয়েছে। যেখানে নিপীড়নের মাত্রা বেশি, সেখানে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপও বেশি। সেই যে বলে, ‘সিমেন্টের ফাঁক দিয়েই তো বেরিয়ে আসে চারাগাছ।’ এই সব উদ্যোগ, কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই তথাকথিত ‘সাদা-কালো’ শহরটাকে উজ্জ্বল রঙে ভরিয়ে দিতে পেরেছে।
তবে এই মুহূর্তে অনাহিতা ও তাঁর সঙ্গীসাথিরা তাঁদের উদ্যোগগুলি নিয়ে কিছুটা চিন্তিত। বিভিন্ন বিষয়ে সোচ্চার হয়ে, কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে এবং সময় বিশেষে অ-সমকামী গোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়ে, তাঁদের ভিতরে-বাইরে অবরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে কুইয়ারাবাদ গোষ্ঠীর অণুপত্রিকা ‘টিল্ট’কে উদ্ধৃত করা যেতেই পারে। ‘এমন একটি গোষ্ঠী গড়ে তোলার পিছনে অনাহিতা ও শামিনীর অনেক স্বপ্ন, ভাবনা, দূরদৃষ্টি ও কিছু সুবিধাও ছিল।’ অনাহিতা যেমন বললেন, ‘আমাদের অনেকের কাছেই আর কোনও বিকল্প ছিল না।’
এমন একটি উক্তি অনেকের কাছেই ভাবগম্ভীর ও শান্তির। কিন্তু যেটা একই সঙ্গে চিন্তার, আবার আশারও—সেটা হল, ভারতের অন্তঃস্থল থেকেই উঠে আসছেন অল্পসংখ্যক কিছু সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণির মানুষ যাঁরা নিজেদের মধ্যে অনাহিতার কথার প্রতিধ্বনি শুনতে পান।
‘সত্যিই আমাদের আর কোনও বিকল্প নেই।’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র