বেশ কিছুদিন পরে তিলকের একটা দীর্ঘ মেল পেয়ে মনটা বিশেষ রকম প্রফুল্ল লাগছে প্রভাতের। এমনিতে যে প্রভাতের সঙ্গে তাঁর বন্ধু বা ছাত্রদের খুব বেশি যোগাযোগ আছে তা নয়। প্রভাতেরই উদ্যোগের অভাব তার কারণ। প্রভাত জোর করে যোগাযোগ বজায় রাখার পক্ষপাতী নন। তিনি বিশ্বাস করেন— মানুষে মানুষে সম্পর্কের একটি নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল আছে। সেই আয়ুষ্কালের সীমানা পেরিয়ে গেলে সম্পর্কের মৃত্যু হয়। তা সে যে কোনও সম্পর্কই হোক না কেন। তিলককে প্রভাত খুবই স্নেহ করেন, সেটা তিলক শুধু মেধাবী ছাত্র ছিল সেজন্যই নয়, যদিও প্রভাত সেরকম বিশ্বাস করতেই ভালবাসেন। পরবর্তীকালে তিলকের সঙ্গে তাঁর একটি আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। প্রভাতের একমাত্র শ্যালিকাটিকে তিলক বিয়ে করেছে। প্রেমের বিয়ে, তবে সেই প্রেমে জুঁইয়েরও কিছু প্ররোচনা ছিল। সুচেতনা আর তিলক প্রভাতের একই ব্যাচের ছাত্রছাত্রী। একসময় জুঁই আর তিলকের গভীর বন্ধুত্ব ছিল। জুঁই আভাসে-ইঙ্গিতে একবার এরকমও বলেছিল— যেন তিলক জুঁইকেই স্ত্রী হিসেবে পেতে চেয়েছিল। প্রভাত যে অধ্যাপক হয়েও জুঁই-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, এবং এই আকর্ষণ যে পারস্পরিক, তা জানার পর তিলক নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল। তখনই হয়তো ও শিউলিকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। প্রভাত সঠিক জানেন না। বিভিন্ন মৃত সম্পর্কের কবর খুঁড়ে কঙ্কাল বের করার বাসনা নেই তাঁর। তবে এক-এক সময় মনে হয়, জুঁই বোধহয় তাঁর মতো দোজবরে বৃদ্ধকে বিয়ে না করলেই ঠিক করত। ইদানীং তাঁর শরীর খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। চলাফেরা করতে গেলেই হাঁপ ধরছে। অজ্ঞানও হয়ে গেছিলেন সেদিন। পাড়ার ডাক্তার দেখে ইসিজি করে হার্ট স্পেশালিস্টকে রেকমেন্ড করেছেন। ডক্টর আর এস রায়ের মতো হার্ট স্পেশালিস্টের ডেট পাওয়া মানে প্রায় অসাধ্যসাধন। সোজা পথে গেলে তিনমাস পরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া যায়। প্রভাতের অবশ্য মাত্র চারদিন পরই অ্যাপয়ন্টমেন্ট। ভিতর থেকে জানাশুনো বলে এই অসাধ্যটি সাধন করতে পেরেছে প্রভাতের বন্ধু ও ভ্রাতৃপ্রতিম অশোক। অশোক প্রভাতের সহকর্মী। যে ডাক্তার রায়ের কীরকম আত্মীয় হয়। অ্যাপয়েন্টমেন্টের দিন যত এগিয়ে আসছে প্রভাতের চিন্তা বাড়ছে। হার্ট সার্জারি করতে হলে মুশকিল। যদি অপারেশন থিয়েটারেই ফুড়ুৎ হয়ে যান, তবে কী হবে? মেয়ে দুটো এখনও নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি। জুঁইয়ের মাথায় লোনের বোঝা, সর্বোপরি দশ বছর পর রিটায়ার করে একসঙ্গে বেড়াতে যাবেন— জুঁইয়ের তাই ইচ্ছে। জুঁইয়ের চল্লিশে পৌঁছেও শরীরের বাঁধুনি আঁটোসাঁটো। যতদিন যাচ্ছে, ওর বুক যেন আরও সুডৌল হচ্ছে— কোমর ছিপছিপে নির্মেদ। জুঁইয়ের ভরন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস লুকোন প্রভাত। ভুল হয়ে গেল, ভুল রয়ে গেল জীবনে। ষোলো বছরের ছোটো একটি মেয়েকে জীবনসঙ্গিনী করে দ্বিতীয়বার ঘর বাঁধায় আত্মীয়স্বজনরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁর আগের স্ত্রীর বাপের বাড়ি সব যোগাযোগ ছিন্ন করেছিল তাঁর সঙ্গে। করাই স্বাভাবিক। তাদের মেয়ের জায়গা নিচ্ছে অন্য আরেক মেয়ে, তাদের তো লাগবেই। অথচ প্রভাত জানতেন, কেউ কারুর জায়গা নেয় না। সবাই স্বস্থানে সুস্থিত আছে। জুঁইয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে পুরনো দাম্পত্যের পরিবর্ত হিসেবে কখনও ভাবেননি প্রভাত। জুঁই কী ভেবেছিল জানেন না প্রভাত। জিজ্ঞেস করেননি কখনও। প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই কিছু নিজস্ব, ব্যক্তিগত জায়গা থাকে। সেই ব্যক্তিগতকে নিভৃতির পরিসরটুকু দিতে হয়। সবার সবটুকু জানার অর্থ সেই নিভৃত গোপন জায়গায় অযথা হস্তক্ষেপ করা, কিংবা নিজস্ব অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করা। দাম্পত্য সম্পর্কেও এই ফাঁকটুকু রাখার পক্ষপাতী প্রভাত। না হলে দাম্পত্যের মর্যাদাহানি হয়। তবু কয়েকদিন ধরে প্রভাতের মনে হচ্ছে, জুঁইয়ের মতামত সেভাবে চাওয়া হয়নি কখনও।
অবকাশই হয়নি আসলে। তাঁর আর জুঁইয়ের প্রেমের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল নমিতা বেঁচে থাকতেই। তখন সবে চিকু হয়েছে। মিঠির বেলায় কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু চিকুর বেলা যমে-মানুষে টানাটানি। ক’টা দিন ব্যস্ত থাকায় প্রভাত ইউনিভার্সিটি যেতে পারেননি। জুঁইরা তখন সবে এম.এ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। প্রভাতের অধ্যাপনার জন্য ভাল নাম ছিল। প্রথম সারিতে বসা ফর্সা কাটা-কাটা চেহারার ছাত্রীটিকে তিনি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ার সময় থেকেই লক্ষ করেছিলেন। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খুব সহজ-সরল ব্যবহারই করতেন প্রভাত। খুব পপুলারও ছিলেন সেই কারণে। প্রায়ই ক্যান্টিনে তাঁকে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আড্ডা মারতে দেখা যেত। তখন থেকেই জুঁইকে দেখতে ভাল লাগত প্রভাতের। তবে ওই পর্যন্তই। ঘরে-বাইরে কাজের চাপে তখন নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। জুঁইকে নিয়ে বিশেষ কোনও ভাবনার কথা মাথাতেই ছিল না।
ছোট মেয়ের জন্মের দিন তিনেক বাদে উশকোখুশকো ভাবে প্রভাত ক্যান্টিনে চা খাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন ও আসছে। তীক্ষ্ণ গড়নের মুখচোখ। একটু অহংকার মিশে থাকা চেহারা।
‘বেশ কয়েকদিন দেখিনি আপনাকে। বাড়িতে সব ঠিকঠাক তো?’ বিনা ভূমিকায় বলেছিল ও।
প্রভাত একটু থতমত খেয়েছিলেন। কী বলবেন বুঝতে পারেননি। সন্তান-জন্মের খবর কি ছাত্রীকে বলা যায়? তবু ভিতরে চাপা উত্তেজনা থেকে বলেই ফেলেছিলেন। ‘তেমন কিছু নয়, আমার স্ত্রীর ডেলিভারিজনিত কিছু সমস্যা— তাই একটু আটকে গিয়েছিলাম।’
‘ও, তাই! প্রাউড ফাদার হয়েছেন তাই বলবেন তো! কনগ্র্যাচুলেশনস!’
‘আমার বড় মেয়েটার প্রায় তিন হল।’ প্রভাত একটু লজ্জা-লজ্জা পাচ্ছিলেন।
‘আমরাও দুই বোন। আমি বড়। ছোট মেয়ের নাম কী ঠিক হল?’
‘ভাবছি। পাইনি এখনও। যে যা বলছে লিখে রাখছি।’ প্রভাত হাসছিলেন। একটু বোকা-বোকা লাগছিল নিজেকে।
‘আমিও একটা সাজেস্ট করি? এটাও লিখে রাখবেন। ওর নাম দিন চিত্রলেখা। আমার খুব ভাল লাগে নামটা।’
ক্যান্টিনে ভিড় জমতে শুরু করেছে। প্রভাতের পরিচিত অনেকে হইহই করে এসে অভিনন্দন জানাচ্ছে তাঁকে আরেকটি সন্তানের জনক হবার জন্য। সেই ভিড়ের মধ্যেই প্রভাত দেখেছিলেন আগুনের শিখার মতো মেয়েটি চলে যাচ্ছে।
প্রভাত মনে রেখেছিলেন। ছোট মেয়ের নাম দিয়েছিলেন চিত্রলেখা। সেখান থেকেই শুরু। স্ফুলিঙ্গ থেকে ক্রমশ দাবানলের মতো যার পরিণতি। একসময় ক্যাম্পাসের সর্বত্র কান পাতলেই ফিসফাস-গুঞ্জন, প্রভাত আর সুচেতনার উদ্দাম প্রেম নিয়ে। সর্বত্র একসঙ্গে দেখা যেত তাঁদের। প্রভাত তাঁর আড্ডার ঠেকেও নিয়ে যেতে শুরু করেন জুঁইকে। সেখানে সবাই প্রভাতের সমবয়সি, জুঁই অনেক ছোট একটি তরুণী। এই অসমবয়সি প্রেমকে মেনে নিতে পারছিলেন না কেউই। ক্রমে বিভিন্ন লোকের মুখ ঘুরে খবর পৌঁছে যাচ্ছিল প্রভাতের বাড়িতেও। নমিতার সঙ্গে অশান্তি শুরু হয়েছিল। প্রভাত অস্বীকার করেছিলেন সব। জুঁইকে বাড়িতেও নিয়ে এসেছিলেন দু’একবার। বাড়ির লোকের কাছে বোঝাবার এক দায় কাজ করছিল— যেন— দ্যাখো, হাঁটুর বয়সি মেয়েটার সঙ্গে কোনও সম্পর্কই নেই আমার। শুধু স্নেহ আছে যেমন ছাত্রছাত্রীর জন্য থাক। কিন্তু ততদিনে সম্পর্ক অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এক্সকারশানের নাম করে একবার এক রাতের জন্য জুঁইকে নিয়ে ডায়মন্ডহারবার বেড়াতেও গেছিলেন প্রভাত। সে-খবরও নমিতার কানে তুলে দিয়েছিল কেউ। প্রভাত আর পারছিলেন না। একদিকে বিধিবদ্ধ জীবনের কর্তব্যভার, অন্যদিকে নিষিদ্ধ কামনার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরছিলেন তিনি।
নমিতার অসুখটা এল যেন দৈবপ্রেরিত হয়ে। তখন ভাবতেন না এমন, এখন মনে হয় ওই সময়কার দিনগুলো যেন নিয়তিনির্দিষ্ট ছিল। অনুশোচনায় দগ্ধ হতে-হতে নমিতার প্রচুর সেবা করেছিলেন তিনি। শারীরিক নানা সমস্যায় আস্তে-আস্তে বিছানায় মিশে গেছিল নমিতা। তার উপর হার্ট প্রচণ্ড দুর্বল। সামান্য উত্তেজনাই ক্ষতিকর। তখন নমিতার খুব যত্ন করতেন প্রভাত। কিন্তু ওর ভিতর থেকে তখন বাঁচার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। ডিপ্রেশনের রোগ বরাবরই ছিল। সেটা হঠাৎ মাত্রাছাড়া রকম বেড়ে গেল। চুপচাপ শুয়ে থাকত— আর চোখ দিয়ে জল পড়ত। জুঁইয়ের সঙ্গে তখন কিছুদিন যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। জুঁইও তাই চেয়েছিল। ওর এম.এ পরীক্ষা দেবার আগে থেকে আট’ন মাস জুঁইকে চোখের দেখাও দেখতে পাননি প্রভাত। নমিতার কাজের দিন এল ও। তিলকের সঙ্গে। সাদা খোলের একটা শাড়ি পরে ঘরের এককোণে চুপ করে বসেছিল জুঁই। আত্মীয়রা কানাঘুষো করতে ছাড়েনি। প্রভাতের মা-বাবা মারা গেছিলেন আগেই। অভিভাবক ছিলেন দাদা-বৌদিরা। তাঁরাও মুখ বেঁকিয়েছিলেন। তালতলায় বাসা ভাড়া করে থাকতেন প্রভাত। বহুদিন ধরেই। নমিতা চলে যাবার পরও রয়ে গেলেন সেখানে। জুঁই প্রায় প্রত্যেকদিনই আসত নিয়ম করে। মিঠি আর চিকুকে ভুলিয়ে রাখত মাতৃবিয়োগের যন্ত্রণা। জুঁইমাসিকে চোখে হারাত ওরা।
প্রভাত আর সুচেতনার বিয়ে হয়েছিল রেজিস্ট্রি করে। সুচেতনার মা-বাবা তাতেই খুশি ছিলেন। তবু তো বড় মেয়ের একটা সম্মানজনক গতি হল। প্রভাতের সঙ্গে প্রেমের সময় যে নিন্দের ফোয়ারা ছুটেছিল তার থেকে বাঁচতে পারেননি ওঁরাও। মেয়ে ষোলো বছরের বড় একজন আধবুড়ো অধ্যাপকের সঙ্গে সর্বত্র ঘুরছে— এই চর্চার ভার ওঁরাও নিতে পারছিলেন না আর। খুশি হয়েছিল শিউলি। ওর সঙ্গে তখন তিলকের বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে বিদেশে সংসার পাতার আনন্দে ও তখন মশগুল। বিয়ের পর ইউনিভার্সিটির ফিসফাসটাও কমে গেল অনেক। শুধু আশ্চর্যজনক ভাবে খুশি হতে পারেনি মিঠি। চিকুকে নিয়ে তবু বেশি সমস্যা হয়নি। কিন্তু মিঠি প্রথম কিছুদিন অদ্ভুত গুটিয়ে গিয়েছিল। অথচ একটা সময় ছিল যখন জুঁইমাসি, জুঁইমাসি করে ও পাগল ছিল। ছোটবেলায় মাতৃশোক পেয়ে, নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে যুঝেই কি মেয়েদুটো এমন অদ্ভুত হয়ে গেল?
মিঠি তাও নিজেকে শুধরে নিয়েছে অনেক। এখন ও চলনে-বলনে-আচরণে সুচেতনাকেই অনুসরণ করে। কিন্তু চিকুকে নিয়েই প্রচুর চিন্তা মাথায় ঘোরে প্রভাতের। কয়েকদিন আগেই জুঁই বলেছিল, এবার থেকে চিকুকে নিয়ে তুমি একটু বোসো। ও কেমন যেন আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাচ্ছে। তখন পাত্তা দেননি প্রভাত। তার তিনদিন বাদেই ঘটনাটা ঘটল। কেন যে চিকু ওখানে গিয়েছিল তা প্রভাত বা সুচেতনা দূরে থাক, মিঠির কাছেও স্পষ্ট নয়। ভাগ্যিস ওই ছেলেটি ছিল। তার কয়েকদিন আগেই কলকাতায় এসেছে ও। অভিজিৎ না কী যেন নাম? প্রভাত মনে করতে পারলেন না। কিন্তু তাঁর মনে হল ছেলেটি যেন ছদ্মবেশে ঈশ্বরপ্রেরিত কোনও দেবদূত। কোথায় সেই আমেরিকায় থাকে, ছুটিতে বেড়াতে এল, আর এসেই চিকুর ওই ঘটনা। ওর জায়গায় যদি অন্য কোনও ছেলে থাকত, তবে কী হত! কতজনের কত বদ মতলব থাকে। চিকু যদি গুন্ডা বা মতলববাজ কারুর পাল্লায় পড়ত! প্রভাত ভাবতে-ভাবতে একবার শিউরে উঠলেন। ছেলেটি শুধু চিকুকে উদ্ধার করেছে তাই নয়, প্রবল ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ট্যাক্সি করে বাড়ি পৌঁছেও দিয়ে গেছে। কৃতজ্ঞতায় প্রভাতের চোখে জল এল। আবার তিলকের কথা মনে পড়ছে তাঁর। বিদেশে থাকা ছেলেরাই এমন হয়। রেসপন্সিবল, ভরসা করা যায়, অন্যদের ভার নিতে সক্ষম। তিলক এলে ওর সঙ্গে সব পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করা দরকার।
***
অদ্ভুত মেয়েটা। সেদিনের ঘটনাটা কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না অভিমন্যু। কলকাতায় পা দেবার পর দুটো দিনও যায়নি। গরমে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। অথচ এমন নয় যে কখনও গরমকাল এখানে কাটায়নি। কম্পিউটার সায়েন্সে গ্র্যাজুয়েশন অবধি তো কলকাতাতেই পড়েছে বরাবর। দক্ষিণ কলকাতায় তাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। প্রচুর ছেলেমেয়ে ছিল স্কুলটাতে। একসময় নাকি গিনেসে নামও উঠেছিল বিশ্বে সর্ববৃহৎ ছাত্রসংখ্যার জন্য। দাদু বলত ‘হরি ঘোষের গোয়াল।’ দাদু-দিদানের কথা ভাবলেই অদ্ভুত এক ভাললাগায় ভরে যায় যায় ভিতরটা। পৃথিবীর যে-প্রান্তে থাকুক না কেন, দাদু-দিদানের একটা ডাকে একছুটে কলকাতায় ফেরত চলে আসতে পারে অভিমন্যু। সে ছাড়া বুড়ো-বুড়িরও তো আর কেউ নেই। মেয়ে-জামাই তো কবেই টা টা করে চলে গেছে। অভিমন্যুর কোন ছোটবেলায়। বাবা-মাকে মনেও নেই ওর। যখন কলকাতা থেকে অনেক দূরের এক শহরে গাড়ি দুর্ঘটনায় ওরা মারা গেছিল তখন ওর বয়স তিনও পেরোয়নি। খুব বড় ডাক্তার ছিল দুজনেই— পরে শুনেছে দিদানের কাছ থেকে। কোনও একটা মেডিক্যাল কনফারেন্সে গেছিল দুজনেই, যেমন মাঝেমধ্যেই যেত। আর ফেরেনি। ফিরেছিল কফিনবন্দি দুটো নিষ্প্রাণ দেহ। কালো হয়ে যাওয়া দেহদুটো চেনাও যাচ্ছিল না নাকি। দিদান অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন বার বার। এসব গল্প অনেক পরে শুনেছে অভিমন্যু।
‘আমার খুকুর অমন সুন্দর চেহারা চেনা যাচ্ছিল না। বিশ্বাস হয়নি খুকু আর ফিরবে না।’ দিদান বলেছেন অনেকবার ও বড় হলে। সময়ে সব সয়ে যায়। দাদু-দিদানও মানিয়ে নিয়েছিলেন। একমাত্র সন্তানের না-থাকাকে ভুলতে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলেন অভিমন্যুকে। তখন থেকেই অভিমন্যু ওঁদের আশ্রয়ের মতো। অভিমন্যুর কোনও ইচ্ছেয় কখনও না বলেননি দাদু ৷ মনে মনে ইচ্ছে ছিল নাতিও তার মা-বাবার পেশা নিক। কিন্তু হায়ার সেকেন্ডারির পর ও যখন ডাক্তারি পড়তে চাইল না, তখন কোনও আপত্তি করেননি দাদু। যাদবপুরে কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে ভর্তি হয়েছিল অভিমন্যু। জয়েন্টে একেবারে উপর দিকেই নাম ছিল। অ্যাডমিশনে কোনও অসুবিধে হয়নি। তখনই স্বাধীনতার স্বাদ প্রথম বুঝল ও। বাড়ি থেকে ভিতরের রাস্তা দিয়ে যাদবপুর একেবারেই দূরে নয়। রিকশাতেও যাওয়া যায় এইট বি। অভিমন্যু হেঁটে যেতেই পছন্দ করত ওই পথটা। তার বিশেষ একটা কারণ ছিল। যাওয়ার পথে সুকান্ত সেতুর কাছে চিত্রিতারা থাকত। চিত্রিতার কথা মনে হতেই বুকের ভিতর একটা ফাঁপা শূন্যতা টের পেল অভিমন্যু। আগেও পেয়েছে। অথচ চিত্রিতা ওর প্রেমিকা ছিল না। কী ছিল, বা আদৌ কিছু ছিল কি না এখন আর বুঝতে পারে না ও। তবু চিত্রিতার কথা মনে হলেই বুকের মধ্যে এই খালি-খালি ব্যাপারটা হয়। অথচ চিত্রিতা স্কুলজীবন থেকেই চেনা। অন্য সেকশন। কিন্তু কমন বন্ধুদের মারফত বন্ধু হয়ে গেছিল চিত্রিতা। বেণী-দোলানো চশমা-পরা কিশোরী চিত্রিতার প্রতি কবে থেকে যে অন্যরকম একটা অনুভূতির সঞ্চার হল, নিজেও সঠিক মনে করতে পারে না অভিমন্যু। যাদবপুরে পড়ার সময় থেকেই কি? চিত্রিতাও যাদবপুরে ভর্তি হয়েছিল অন্য অনেক বন্ধুদের মতোই। বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছিল। একই সঙ্গে ক্লাস করা, ক্যান্টিন, ল্যাব, জমজমাট ক্যাম্পাস লাইফ— সব কিছুর সঙ্গে কেমন ওতপ্রোত হয়েছিল চিত্রিতার সঙ্গে বন্ধুত্ব। বাড়ি থেকে ফোন করে রওনা হত অভিমন্যু— পনেরো মিনিট পরে দাঁড়িয়ে থাকিস। সুকান্ত সেতুর উল্টোদিকের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকত চিত্রিতা। ‘এত দেরি করলি যে? রোজই পনেরো মিনিট বলে পঁচিশ মিনিট লাগাস। কুইক, তোর জন্য রোজ দেরি হয়।’ মৃদু বকুনি লাগাচ্ছে চিত্রিতা।
সুকান্ত সেতু থেকে এইট বি-র কাছে ক্যাম্পাসের দু’নম্বর গেট। মুহূর্তে যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে যৌথ যাত্রার পথটুকু। চিত্রিতার গায়ের হালকা সুবাস অভিমন্যুর নাকে। চিত্রিতার গায়ের গন্ধটা এখনও চেষ্টা করলেই মনে পড়ে অভিমন্যুর। কী অদ্ভুত! একটি মেয়ে যার প্রতি একদা গোপন একটা আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল তার গন্ধ এখনও কেন ভুলতে পারে না অভিমন্যু? অথচ চিত্রিতা তো সেভাবে কোনওদিনই আসেনি ওর জীবনে। তেমন প্রবল আকর্ষণ থাকলে কি অভিমন্যু সবকিছু পেছনে ফেলে রেখে নির্দ্বিধায় পাড়ি দিত আমেরিকায়? ওখানে গিয়েও কিছুদিন ইমেলে যোগাযোগ ছিল পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে। চিত্রিতার সঙ্গেও। চিত্রিতা পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করতে গেছিল কানপুর আইআইটিতে। আস্তে-আস্তে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল যোগাযোগ। অভিমন্যুরও তখন কাজের চাপে নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। সেই সময়ই কে যেন, সায়ন্তন না মৈনাক, ইমেলে লিখেছিল— চিত্রিতা কানপুরে একটি অবাঙালি ছেলেকে বিয়ে করেছে। খুব যে দুঃখ হয়েছিল অভিমন্যুর তাও নয়। শুধু ভিতরে ভিতরে একটু ফোঁপরা লেগেছিল। আস্তে-আস্তে অভ্যেস হয়ে গেছে। পুরনো বন্ধুদের মধ্যে যারা বিদেশে পড়াশুনো বা চাকরির সূত্রে গেছে তাদের সঙ্গে তবু যোগাযোগ হয়। বছর তিনেক হল চাকরি করছে অভিমন্যু। এবার মনস্থির করে অবশেষে গ্রিন কার্ডের জন্য অ্যাপ্লাই-ও করে দিয়েছে ও। অফিস থেকেই চাপ দিচ্ছিল। অনেক ভেবে দেখে অভিমন্যু ঠিক করেছে, ভারতে আর ও ফিরতে চায় না। ওর লাইনে কলকাতায় কোনও চাকরি নেই। যদি কলকাতাতে না থাকতে পারে, তবে ভারতে অন্য শহরে থেকেই বা লাভ কী? বরং মার্কিন দেশে থাকতে-থাকতে শিকড় গজিয়ে গেছে একটা। দাদু-দিদান না থাকলে আর কোনও টানই থাকবে না এ শহরের। বেশ কয়েক বছর বিদেশবাসের ফলে কলকাতায় এসে এবারে বেশ অস্বচ্ছন্দ বোধ করছে অভিমন্যু। এসে অবধি প্রথম দু’দিনে বাড়ি থেকে একবারও বেরোয়নি অভিমন্যু। তৃতীয় দিন বিকেল হবার আগেই বেরোতে হয়েছিল অভিমন্যুকে, নেহাতই দায়ে পড়ে। দাদু-দিদান অনেক দিন থেকেই জোর করছেন, ‘এবার বিয়েটা সেরে ফেল দাদাভাই। আমরা তো আর বেশিদিন নেই। তোমাকে সংসারে থিতু না দেখলে মরেও শান্তি পাব না। এসব যাদের করার কথা ছিল, তারা তো আগেভাগেই উপরে চলে গেছে।’
অভিমন্যুর চাকরি পাবার পর থেকে গত কয়েক বছরে রবিবার ফোন করলেই দিদানের মুখের বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর বিয়ে। প্রথমদিকে গা করেনি। কিন্তু মাস ছয়েক আগে অভিমন্যু রাজি হয়েছিল। বিদেশে কোনও মেয়েকেই তেমন ভাল লাগেনি ওর। অথচ পাকাপাকি ভাবে প্রবাসজীবনে থিতু হবার জন্য একটা শক্ত পারিবারিক ভিতও দরকার বলে কিছুদিন যাবৎ ভিতরে-ভিতরে বিশ্বাস করছে ও। নিজের পছন্দে যখন হলই না, তখন দিদানদের পছন্দে বিয়েটা সেরে ফেলাই প্র্যাকটিকাল কাজ। তাছাড়া গ্রিন কার্ড পাবার আগে এরপর বেশ কিছুদিন দেশে আসা যায় না। তার মধ্যে বিয়েটা করে যেতে পারলে মন্দ হয় না। ফোনে রাজি হবার পর বেশ চটপট সব ঠিক করে ফেলেছে দিদান। কাগজ দেখেই সম্বন্ধ। কমলিকাদের বাড়ি সল্টলেকে। ওর দাদাও কানাডায় থাকে। কমলিকা এমবিএ করে একটা কোম্পানিতে মার্কেটিং-এর দায়িত্বে। প্রথমে ওর ছবি, তারপর ক্রমে ইমেলে-স্কাইপে টুকরো সংলাপ। এভাবেই আলাপ। অভিমন্যু জানে কমলিকা নামের এই মেয়েটি শুধু সুন্দরীই না, যথেষ্ট কইয়ে-বলিয়ে, চৌখস। ওর বিদেশে সংসার পাতার পক্ষে আইডিয়াল। অভিমন্যু ফাইনাল অ্যাপ্রুভাল দেবার পরেই পাকা কথা বলেছেন দাদু-দিদান। অভিমন্যু আসার আগে নিজের বিয়ের সময়ে পাওয়া মানতাসা দিয়ে আশীর্বাদও সেরে এসেছেন দিদান। কমলিকার ঠাকুরদা আবার দাদুর শৈশবের গ্রামসম্পর্কে দাদা হতেন। তিনি এখন আর নেই। কিন্তু যশোরের গ্রাম-সম্পর্ক বেরিয়ে যাওয়ায় খুশি আরও বেড়ে গেছে বুড়ো-বুড়ির। ‘দাদুভাই এ মেয়েকে বিয়ে করলে তুই সুখী হবি।’ দিদান ছলছল চোখে বলেছেন ও আসার পর। বিয়ের জন্যই এবার আসা। আসার দু’দিন পরে সেদিন বিকেলে বেরিয়েছিল অভিমন্যু। পাঁচটায় কমলিকার সঙ্গে প্রথম দেখা হবে। সল্টলেকের সিটি সেন্টারে। আসার পরদিনই কমলিকার বাবা-মা এসে আলাপ করে গেছেন অভিমন্যুর সঙ্গে। তখনই কথা হয়েছিল। অভিমন্যু আর কমলিকার পরস্পরের সঙ্গে নিভৃত কথা বলার ব্যাপারটা দু’পক্ষেরই অভিভাবকদের উদ্যোগে। অভিমন্যুর যে প্রচণ্ড ইচ্ছে ছিল তা নয়। ক’দিন বাদেই যে-মেয়ে বউ হয়ে আসবে নিয়তিনির্দিষ্ট ভবিতব্যের মতো— এখন তার সঙ্গে দেখা হওয়া না হওয়ায় কী-ই বা এসে যায়। সে তো আর প্রেম করে বিয়ে করছে না। বিয়ের আগে পূর্বরাগ-টাগ যা কিছু ইমেল আর ফোনেই হয়েছে। এখন যদি কমলিকাকে চাক্ষুষ দেখে তেমন ভাল নাও লাগে, তবুও তো পিছোবার উপায় নেই। দাদু-দিদানের লস অফ ফেস হবে তাতে। একমাত্র নাতির বিয়ে উপলক্ষ্যে কম মেহনত করছেন না বুড়ো-বুড়ি। কন্ট্র্যাক্টার লাগিয়ে পুরো বাড়ি পেন্ট করা হয়েছে, ঘরে-ঘরে বাহারি পর্দা, মনের সুখে নাতির ঘর সাজিয়েছেন দিদান। এবার কলকাতায় এসে বেশ চমকে গেছে অভিমন্যু। রিজেন্ট এস্টেটের চিরচেনা দোতলা বাড়িটা যেন খোলনলচে পাল্টে ঝকঝক করছে। কমলিকাকে সঙ্গে নিয়ে বিয়ের সব বাজারও সেরে ফেলেছেন দিদান। এত কিছুর পর আর পিছিয়ে আসা যায় না। পিছোবার কথা মাথায় আসছে কেন বুঝতে পারছে না অভিমন্যু। সেদিনের ঘটনাটাই সব গণ্ডগোল করে দিয়েছে।
সেদিন তিনটে নাগাদ বেরিয়েছিল অভিমন্যু। মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা চলে যাবে সিটি সেন্টার। কমলিকা ফোনে বলে দিয়েছে কীভাবে যেতে হবে। টুকিটাকি বাজার যা বাকি আছে সেরে রেস্তোরাঁয় খেয়ে রাতে ফিরে আসবে অভিমন্যু। কমলিকার বাড়ি সিটি সেন্টারের খুব কাছেই। ওকে নামিয়ে ওদের বাড়ির গাড়ি অভিমন্যুকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। চারটেয় ট্যাক্সি ধরলে ঘণ্টাখানেকে সিটি সেন্টারে পৌঁছে যাওয়া যায়। কিন্তু অভিমন্যু তিনটে নাগাদই বের হয়েছিল। একবার দক্ষিণ কোণে পার্কটায় বসে যাবে। এই পার্কটার সঙ্গে অভিমন্যুর শৈশব-কৈশোরের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। প্রতিবারই এসে সময় করে একবার পার্কে যেতে ভোলে না অভিমন্যু। তিনটের সময় পার্ক একদম শুনশান। ভিড় শুরু হবে একটু পরে। একদিকে ফুটবল খেলা চলবে। ঝিলের ধারে বুড়োদের আড্ডা শুরু হবে। রবীন দাদু, চল্লিশ নম্বর বাড়ির দাদু, আরও অনেকের সঙ্গে অভিমন্যুর দাদুও আড্ডার অংশীদার। বাচ্চাগুলোর হাত ধরে বা প্যারাম্বুলেটর ঠেলে মা’রাও আসবে। তাদেরও নিজস্ব জমায়েত আছে। স্বাস্থ্যসচেতন প্রৌঢ়, তরুণদের গুলতানিতে বেশ নিটোল জমজমাট একটা ব্যাপার। পাড়া বা কমিউনিটির এই নৈকট্য বেশ ভাল লাগে অভিমন্যুর। বিদেশে এই ব্যাপারটা বিশেষভাবে মিসিং।
বেশ সুন্দর সবুজ ঘাস হয়ে রয়েছে পার্কটায়। ঘাসে বসেই আরাম। তবু আজ একটা পরিষ্কার বেঞ্চেই বসল অভিমন্যু। ঘাসে বসলে যদি প্যান্টে দাগ হয়ে যায়, কমলিকা কী মনে করবে কে জানে? এমনিতেই সে বিশেষভাবে সন্ত্রস্ত হয়ে রয়েছে। কমলিকাকে সে আজই প্রথম দেখবে। কিন্তু তার মন ভাল লাগার বদলে খানিকটা অনিশ্চয়তায় ভরে আছে। আর তিন সপ্তাহ পরে যে-মেয়েটি তার সারা জীবনের সঙ্গী হবে, তার পছন্দ, অপছন্দ, ভাললাগা-মন্দলাগা প্রায় কিছুই জানে না অভিমন্যু। ফোনে কথা বলে কতটুকুই বা বোঝা যায়? এমন হুট করে বিয়েটা কি একটু বেশি ঝুঁকি নেওয়া হয়ে গেল? না মিললে অবশ্য সারা জীবন বাধ্যতামূলক একসঙ্গে থাকার প্রশ্নই নেই। অভিমন্যুর অনেক বন্ধুবান্ধবই ডিভোর্স নিয়েছে। দরকার হলে ওরও সেই রাস্তা খোলা আছে। বিয়ের আগেই ডিভোর্সের চিন্তা আসছে দেখে হাসিই পেল অভিমন্যুর। আচ্ছা, ঝিলটার পাড়টা একবার দেখলে হয়। ভাবামাত্র উঠে পড়েছে অভিমন্যু। ওর পরনে কালো টি-শার্ট আর হালকা নীল জিনস। পায়ে-পায়ে ঝিলের পাড়ে। আরে, এই দুপুরেও একটা মেয়ে রয়েছে। ঝিলের জলে মুখটা প্রায় ঝুঁকিয়ে কী দেখছে ও? এই পাড়ায় ওকে আগে কখনও দেখেছে কি? পনেরো-ষোলো মতো বয়স বোধহয়। নতুন এসেছে এ-পাড়ায়? খুব বিপজ্জনক ভাবে জলে ঝুঁকে রয়েছে মেয়েটা। কী মতলব কে জানে? এই বয়সি ছেলেমেয়েদের ভালনারেবিলিটি একটু বেশি। সুইসাইড করার প্রবণতা বেশি থাকে এ-সময়। বেশি না ভেবে সন্তর্পণে অভিমন্যু এগিয়ে গেল ওর কাছে। মেয়েটা মগ্ন হয়ে কী ভাবছে। দেখতেই পাচ্ছে না অভিমন্যুকে। ঠিক এর পিছনে দাঁড়িয়ে খুব শান্তভাবে অভিমন্যু জিজ্ঞেস করল, ‘এই তোমার নাম কী?’
বড়-বড় চোখ করে মেয়েটা তাকিয়েছে। কোনও উত্তর দিচ্ছে না। অভিমন্যু হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটার দিকে— ‘এসো, ঝিলের ধারটা পিছল। উঠে এসো।’ পার্কের ধারে একটা বেঞ্চে বসে টুকরো কথায় জেনে নিতে চাইছে অভিমন্যু, মেয়েটা কী ভাবছে। একটু অসংলগ্ন, কথা বলার ভঙ্গি— মনে হয় ভিতরের কোনও একটা অন্ধ জেদ ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। অভিমন্যু না থাকলে মেয়েটা কি সুইসাইড করত?
‘সাঁতার জানো তুমি?’ ও মাথা নাড়ল।
‘তবে ওরকম ভাবে ঝিলের ধারে ঝুঁকছিলে কেন?’
‘এমনি। আমার ইচ্ছে করছিল।’ অদ্ভুত রাগী ভঙ্গিতে বলছে ও।
‘ইচ্ছে করলেই যা খুশি করবে? বাড়িতে কে কে আছে তোমার?’
‘কেউ না।’
‘কেউ না মানে? একা থাকো তুমি? কোথায় থাকো?’ বেজায় গোলমেলে কেসে ফেঁসে গেল অভিমন্যু।
‘বলব না। বলতে ইচ্ছে করছে না।’ মেয়েটা কি পাগল না শয়তান বুঝে উঠতে পারছে না অভিমন্যু।
‘বলবে না মানে? আলবাত বলবে। বলতেই হবে তোমাকে।’ বলেই অভিমন্যু বুঝতে পারল, এই অ্যাপ্রোচটা ঠিক হল না।
‘যদি না বলি, কী করবে?’ ফিচেল হাসি ঘোরাফেরা করছে চোখদুটোতে।
অভিমন্যু ভাবছে কী বলা উচিত। গরম কথায় এ-মেয়ের সঙ্গে এঁটে ওঠা যাবে না। ভেবেচিন্তে ও বলল, ‘বলবে কি না বলবে, সেটা তোমার ব্যাপার। আমি শুধু তোমাকে হেল্প করতে চেয়েছিলাম। ভরদুপুরে ঝিলের ধারে ঘুরছিলে— একা-একা। মনে হল তোমার আসলে কোনও বন্ধু নেই। আমি তোমার বন্ধু হতে চেয়েছিলাম। হ্যাভ আই ডান এনিথিং রং?’
মেয়েটা এবার মুখ নিচু করে কী যেন ভাবছে। ‘তুমি ঠিক বলেছ। আমার বন্ধু নেই কোনও। সত্যিকারের বন্ধু।’
‘বাড়িতে মা, বাবা, দাদা, দিদিও আছে নিশ্চয়ই। কাউকে বন্ধু বলে মনে করতে পারো না তুমি?’
মেয়েটা একটু থমকেছে। ‘দিদি আছে। ও আমার বন্ধু নয়। সবসময় সর্দারি করে। ওর অনেক বন্ধু আছে। তদের একজন আজকে আমাকে ঘুরতে দেখেছে এখানে। এতক্ষণে দিদি নিশ্চয়ই রেডি হয়ে আছে আমাকে বকার জন্য। হিহি, আমাকে যে খুঁজেই পাবে না, জানে না তো!’
এই রে, এ-মেয়ে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’-র কেস। এখন একে নিয়ে অভিমন্যু যে কী করে! একে যা হোক করে বাড়ি পৌঁছে দিতে হবে, নাহলে মেয়েটা ফ্যামিলি থেকে মিসিং হয়ে যাবে। এদিকে কমলিকা এসে দাঁড়িয়ে থাকবে সিটি সেন্টারের সামনে। প্রথম অ্যাপয়েন্টমেন্ট। দিনটা একদম বরবাদ হয়ে গেল। কিন্তু কেন জানে না এই ছিটেল মেয়েটার উপর কিছুতেই রাগ করতে পারছে না অভিমন্যু। কী সরল চোখদুটো পাগলি মেয়েটার।
‘জানো, আমাদের বাড়িতে বাবা, মামণি কেউ আমাকে ভালবাসে না। ভালবাসার সময়ই নেই ওদের! দিদিও ভাব দেখায় ভালবাসে, কিন্তু আসলে ভালবাসে না আমাকে। বাসলে অত বকত না।’
আস্তে-আস্তে খোলস ছাড়ছে মেয়েটা। একটু-একটু করে। আস্তে-আস্তে খেলিয়ে বশ করতে হবে মেয়েটাকে। কায়দা করে গল্পচ্ছলে মেয়েটার বাড়ির কথা শুনছে অভিমন্যু। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকের মেয়ে ও। ওদিকেই বাড়ি। মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে এবার। ওইজন্য অমন ছাড়া গরুর মতো ঘুরে-ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মানে ষোলো-সতেরো বছর হবে। বয়সের তুলনায় মেয়েটা সরল খুব। প্রথমে প্রায় কিছুই বলতে চাইছিল না। এখন উসকে দেওয়ার পর অনেক কথা বলছে।
বিকেল ঘন হয়ে এসেছে। গুমোট গরমের পর আকাশে মেঘ করে এসেছে গাঢ় হয়ে। প্রচণ্ড বৃষ্টি আসবে একটু বাদেই। কমলিকা সিটি সেন্টারে অপেক্ষা করে ওকে না দেখে এতক্ষণে নিশ্চয়ই বাড়ি চলে গেছে। বাড়ি ফিরে ফোনও করেছে বোধহয়। ও যে এদিকে বিচিত্র প্রবলেমে ফেঁসে গেছে সে তো দাদু-দিদান জানেন না। ওরা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা শুরু করেছে এতক্ষণে। অভিমন্যুর কলকাতায় সেলফোন নেই। এদিকে এই মেয়েকে ওর বাড়ি না পৌঁছে দিলে সেই বাড়িতে সকলেই খুব দুশ্চিন্তা করবে। কমলিকাকে পরে বুঝিয়ে বললেই চলবে। আপাতত মেয়েটাকে পৌঁছে দিতে পারলে ওখান থেকে দিদানদের একটা ফোন করা দরকার।
সিদ্ধান্ত নেবার ভঙ্গিতে অভিমন্যু উঠে দাঁড়াল। ‘তোমার বাড়ি তো যাদবপুরেই। চলো তোমাকে পৌঁছে দিয়ে বাড়িটা দেখে আসি। ট্যাক্সিতে দশ মিনিটও লাগবে না।’ বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় কাত করে উঠে দাঁড়িয়েছে— ‘যদি দিদি বকে?’
‘কেউ বকবে না। আমাকে বন্ধু বলে যদি ভাবো রেস্ট অ্যাশিওর্ড, কেউ তোমাকে কিছু বলার সাহস পাবে না।’
‘ঠিক তো?’ একটু অনিশ্চিত মেয়েটা। হরিণের মতো চোখদুটোয় সংশয় খেলা করছে।
‘একদম ঠিক। তোমার দিদি আর কখনও বকবে না তোমাকে। দেখে নিও।’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র