বেশ সুন্দর দেখতে নির্মলাকে। গায়ের রংটাও ফর্সা। একটা বেশ চমৎকার হাসিখুশি ব্যাপার আছে চেহারার মধ্যে। ভারতের আরও অনেক মেয়েদের মতোই ষোলো বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়, বেনারসের সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে নন্দ কিশোর মালব্যের সাথে। বিয়ের এক বছরের মধ্যেই কোলে প্রথম সন্তানও আসে— পুত্রসন্তান। তার কয়েক বছর পরেই ছোট ছেলের জন্ম। আজ এই দম্পতি দুই প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের পিতা-মাতা। রেভেন্যু সার্ভিসের অফিসার হিসেবে নিজের কর্মজীবন শুরু করেছিলেন এন কে মালব্য, আজ অর্থমন্ত্রকের একজন ভাল রকমের উচ্চপদস্থ কর্তা তিনি। তাঁদের বিয়ের কথা যখন চলছে, তখন নির্মলা এবং এন কে ছিলেন একে অপরের সম্পূর্ণ অচেনা। তবে এতগুলো বছর ধরে যে-সম্পর্কটা তাঁরা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, সে-সম্পর্ক অনেকেরই ঈর্ষার কারণ। নির্মলার এন কে-র প্রতি অগাধ আনুগত্য। ঘর-সংসারের দেখাশোনার কাজে তিনি নিজেকে একমনে সঁপে দিয়েছিলেন। আবার এন কে-ও নির্মলাকে ভীষণ স্নেহ করতেন, তাঁর কোনও চাহিদাই অপূর্ণ থাকতে দিতেন না। ছেলেরা যখন বড় হল, এন কে-র কর্মজীবনের ব্যস্ততাও গেল বেড়ে। তিনিই নির্মলাকে উৎসাহ দিলেন, নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য একটা কিছু শখের জিনিস ধরতে। চিরকাল দায়িত্বশীলা এবং বাধ্য মেয়ে নির্মলা এন কে-কে একটু অবাক করেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিয়ের পরে স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছিলাম, এখন আবার কত্থক শিক্ষাটা শুরু করতে পারি কি না। নাচ? এই বয়সে, দুই সন্তানের মা হবার পরে? প্রশ্নটা করার সময়ে স্বামীর ঈষৎ ভ্রুকুটি চোখ এড়ায়নি নির্মলার। কণ্ঠে একফোঁটা হতাশা নিয়ে তিনি বলেছিলেন, অবশ্য তোমার অমত থাকলে করব না। স্বামীর অটুট বিশ্বাস ছিল, কিছুদিনের মধ্যেই নির্মলার উৎসাহ চলে যাবে, অথবা ঘরকন্নার কাজের চাপে নাচ মাথায় উঠবে। সে-জন্যেই বোধহয় মেনে নিয়ে বলেছিলেন, না না, ঠিক আছে, তুমি করোই না। তাঁর অনুমান যে কতটা ভুল ছিল, তা যদি জানতেন!
এর পরে শিগগিরি এক শনিবারের সন্ধেবেলা, এন কে-কে নির্মলার সঙ্গে যেতে হল রেবতী গুহর সঙ্গে দেখা করতে— ইনি এককালে খ্যাতনামা কত্থক নৃত্যশিল্পী ছিলেন, আজকাল একদল অনুগত ছাত্রদের নাচ শেখানোর পিছনেই তাঁর সময় কেটে যায়। নির্মলাকে তাঁর শিষ্যা হিসেবে গ্রহণ করার আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করতেই সেদিন তাঁর কাছে যাওয়ার তোড়জোড়। এন কে ইতিমধ্যেই গাড়িতে উঠে অপেক্ষা করছেন, এমন সময়ে দেখলেন তাঁদের কাকা-নগরের সরকারি বাংলো থেকে নির্মলা বেরিয়ে আসছেন, উত্তেজনায় গালদুটো লাল হয়ে আছে, চোখ উজ্জ্বল, পিছন পিছন রান্নাঘরের দুজন পরিচারক আসছে, একজনের হাতে বাড়িতে বানানো মিঠাইয়ের দুটি বড় বাক্স, একজনের হাতে নানারকম ফলে ভরা ঝুড়ি! ফলের ঝুড়ির উপর রাখা আছে গোলাপি আর সাদা লিলি ফুলের একটা প্রকাণ্ড তোড়া। নির্মলা গাড়িতে উঠে যখন পরিচারকদের প্রতি কিছু শেষ নির্দেশ ছুড়ে দিচ্ছেন, তাঁর দিকে তাকিয়ে স্নেহে এন কে-র দৃষ্টি নরম হয়ে এল। ড্রাইভারও ইতিমধ্যে মিঠাই, ফল, এবং ফুলগুলো গাড়ির বুটে সাবধানে ঢুকিয়ে ফেলেছে, তাই কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁরা রওনা হয়ে গেলেন রেবতীর ফ্ল্যাটের দিকে— এশিয়ান গেমস ভিলেজে তাঁর বাড়ি, ১৯৮২ সালে খেলা শেষ হওয়ার পর বেশ কিছু শিল্পীর সেখানে অস্থায়ী ভাবে থাকার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয়। গন্তব্যে পৌঁছতেই রেবতীর দুই শিষ্যা তাঁদের খাতির করে ভিতরে নিয়ে গেলেন। একজন জানালেন, মিনিটখানেকের মধ্যেই ‘দিদি’কে খবর দিচ্ছেন, অন্যজন চায় (চা) না ঠান্ডা (কোল্ড ড্রিংক) কী খাবেন তার তদারক করতে এলেন।
কিছু বলার সুযোগ পাওয়ার আগেই নমস্কারের মুদ্রায় হাতজোড় করে ঘরে প্রবেশ করলেন রেবতী। উত্তেজনায় একটা অস্ফুট আওয়াজ করে নির্মলা ছুটে গেলেন তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে। এন কে অপেক্ষা করতে লাগলেন নিজের পালার জন্য। অস্ফুটে ‘আরে, ব্যাস ব্যাস’ বলে নির্মলাকে ধরে উঠে দাঁড়াতে বলে রেবতী এন কে-কে সম্ভাষণ জানাতে ঘুরলেন। এন কে-ও প্রণাম করার জন্যে ঝুঁকছিলেন, মাঝপথেই রেবতী ‘আরে ভাইসাব, কী করছেন? বসুন দয়া করে’ বলে আটকে দিলেন। নির্মলা এবার এক-এক করে মিঠাই, ফল, আর ফুলগুলো রেবতীর হাতে তুলে দিতে লাগলেন, রেবতীও সেগুলো চালান করতে লাগলেন অপেক্ষারত ছাত্রদের হাতে, বাড়ির ভিতরে রেখে আসার জন্য। এবার বসলেন নির্মলা, স্নেহ-গদগদ দৃষ্টিতে রেবতীর দিকে তাকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে বলতে লাগলেন, তাঁর মুখোমুখি বসতে পেরে তিনি যে কী আনন্দ পাচ্ছেন, তা বলার ভাষা নেই। খানিকক্ষণ এসব ধানাই-পানাই করে অবশেষে তিনি বলেই ফেললেন, কত্থক শিক্ষা আবার শুরু করা তাঁর জীবনের লক্ষ্য এবং রেবতী যদি সম্মতি দেন, তিনি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করতে চান। এই অনুরোধে গলা মেলালেন এন কে, দিদি যদি দয়া করে নির্মলাকে একটু শেখান। দুজনের এত উৎসাহের সামনে বেচারি দিদির আর কী-ই বা উপায় ছিল? মেনেই নিলেন। তাঁর নতুন শিষ্যা এবার দক্ষিণা বা মাইনের কুণ্ঠিত প্রশ্নটি তুললেন, তবে দিদি সে-প্রসঙ্গ উড়িয়েই দিলেন। তাঁর বক্তব্য, নির্মলা আপাতত শিখতে শুরু করুন, পরে কোনও সময়ে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও এ সিদ্ধান্তে দিদিকে টলানো গেল না। চোখে জল, আনন্দে আত্মহারা নির্মলা গুরুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়ি ফিরলেন— কত্থকের কর্মী হিসেবে তাঁর জীবনের নতুন যে অধ্যায় শুরু হতে চলেছে, তারই স্বপ্ন বুকে নিয়ে।
এরপরে দু’বছর ধরে সপ্তাহে তিনবার করে নির্মলা রেবতীর বাড়ি নাচ শিখতে যেতেন। কোনও ছাত্রের শিখতে একটু সময় লাগছে দেখে দমে যাবার পাত্রী রেবতী নন, তিনি সহজাত নিষ্ঠার সাথেই তাঁর এই নতুন শিষ্যাকে ঘষামাজা করতে লাগলেন। কিন্তু ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করল, নির্মলা সেই বিরল প্রজাতির প্রাণী, যিনি বিশ্বের যে-কোনও শিক্ষককে ‘আমায় শেখাতে পারলে তো শেখাবে’ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন! পায়ে ঘুঙরু কীভাবে ঠিকঠাক বাঁধতে হয়, একমাত্র এইটুকু ছাড়া কিছুই আর নির্মলাকে শিখিয়ে উঠতে পারলেন না রেবতী। নির্মলাকে নিপুণ হাতে ঘুঙরুর একদিকের সুতো নিজের বুড়ো আঙুলে জড়িয়ে বাকিটা দক্ষভাবে নিজের গোড়ালিতে বাঁধতে দেখে যে কোনও মানুষেরই মনে হত, না জানি ইনি কত অভিজ্ঞ, দক্ষ একজন শিল্পী। কিন্তু যে মুহূর্তে নির্মলা নাচতে শুরু করতেন, ব্যাপারটাকে আদি এবং অকৃত্রিম ভাঁড়ামি ছাড়া কিছু বলা যেত না। যেভাবে তিনি পাগলের মতো পা দাপাতেন, এবং হাঁফিয়ে গিয়ে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলতেন, সে-ব্যাপারটার মধ্যে একটা উন্মাদনা ছিল। আর তাঁর চক্করগুলো (চক্রাকারে ঘোরার শৈলী) নিয়ে কিছু না বলাই ভাল! এলোপাথাড়ি চক্রাকারে ঘুরতেন বেচারি নির্মলা, বেসামাল মাতালের মতো, চোখ-মুখ যেন ভয়ে-আতঙ্কে হাঁ হয়ে থাকত, সেই চক্করের খ্যাপামি থামায় কার সাধ্য? সে-জিনিস যে দেখেছে, তার হাসতে হাসতে পেট ফেটে গেলেও দোষ দেওয়া যেত না, তবু নির্মলার সে বিষয়ে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁর ধারণা তিনি সত্যিই একজন উঁচুদরের নাচিয়ে, ভবিষ্যতের একজন বিদুষী। নাচের স্টুডিওতে কিছু পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের আয়না ছিল, যাতে ছাত্ররা নিজেরাই দেখতে পান কোথায় একটু ঘষামাজা করা দরকার। সেই আয়না ব্যবহার করে রেবতী নির্মলাকে প্রতিটি মুদ্রা, প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতি রকমের চলন ঠিক করে শেখাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন। তাতে লাভ অল্পই হয়েছিল, কারণ যে মুহূর্তে নির্মলা ফের নাচতে শুরু করতেন, আবার সেই একই খ্যাপামির উদয় হত! অবশেষে নাচ শেখাতে শুরু করার দু’বছরের মাথায় রেবতী জানিয়ে দিলেন, তাঁর পক্ষে নির্মলার ব্যাপারে আর কিছু করা সম্ভব নয়। মানুষটা ছিলেন ভারি নরম মনের, তাই প্রাণে ধরে নির্মলাকে মুখের উপর বলতে পারলেন না, নাচটা তাঁর দ্বারা হবে না, বা তাঁকে নাচ শেখানো অসম্ভব। তাই একটু ঘুরিয়ে, একটু মিষ্টি করে বলেছিলেন, নিজের পক্ষ থেকে ছাত্রকে আর কিছু দেওয়ার নেই বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। নির্মলা একথা শুনেই ধরে নিলেন, তার মানে গুরুর কাছ থেকে সাফল্যের সার্টিফিকেট তিনি পেয়ে গেছেন। অনেক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে তিনি রেবতীকে বললেন, অনুশীলন তিনি চালিয়ে যাবেন, এবং মাঝে মাঝেই আসবেন উপদেশ নিতে।
নিজের শিল্প পৃথিবীর সামনে তুলে ধরার সময় এবার উপস্থিত, এই বিশ্বাস নির্মলার মনে বাসা বাঁধল। প্রথমেই তিনি বাড়ির পিছনের দালানটাকে একটা স্টুডিওতে পরিণত করলেন, তার একপাশের দেওয়াল জুড়ে রাখা হল পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের আয়না। এন কে-র পরামর্শ ছাড়া জীবনে কিচ্ছুটি করা তাঁর কল্পনাতীত ছিল, তাই এ স্টুডিও বানানোর অনুমতি এবং সম্মতিও যে বাড়ির কর্তার থেকেই আদায় করা, তা বলাই বাহুল্য। এই স্টুডিওর প্রবেশপথে কৃষ্ণের দৈব নৃত্যকার বা নটবর-রূপের একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, আর তার নীচে ‘গুরবে নমহ’ বা গুরুর প্রতি অভিবাদনের বার্তা হাতে আঁকা। প্রত্যেকদিন সকালে বাড়ির কাজ শেষ করে নির্মলা নিবিষ্টচিত্তে স্টুডিওতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতেন। কোনও ফোন নয়, মনোযোগে কোনওরকম বিচ্যুতি নয়, কেবল রেওয়াজ। নির্মলার রেওয়াজ বলতে অবশ্য আত্ম-পরিচালিত এক উদ্ভট প্রক্রিয়ায় ঘণ্টাদুয়েক দাপানো, লাফানো, হাঁফানো, বিচিত্র সব মুদ্রা আর চলন অভ্যেস করা। মাঝেমধ্যে রেওয়াজে সঙ্গত দেবার জন্যে তিনি যন্ত্রশিল্পীদেরও ভাড়া করতেন। নিজের কল্পনায় এই স্টুডিওতেই নির্মলা হয়ে উঠতেন অনন্যসাধারণ নর্তকী, খ্যাতনামা এক শিল্পী— যিনি ঘর-সংসার-স্বামীর প্রতি সমস্ত কর্তব্য পালন করেও নিজের শিল্পের পিছনে শ্রম দান করতে পারেন। আর এই স্টুডিওতেই প্রথমবার তাঁর মাথায় আসে, বড় করে বাৎসরিক অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা।
সহজাত একরোখামি এবং সঙ্কল্প নিয়েই নির্মলা তাঁর এই বড় অনুষ্ঠানের বন্দোবস্ত করতে উঠে পড়ে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যেই ব্যাপারটা অনেকের কাছে আলোচনার না হোক, রসিকতার বিষয় হয়ে উঠল। তাঁর নাচ নিয়ে, শিল্পী হিসেবে নিজের সম্পর্কে নিতান্তই অবাস্তব ধারণাগুলো নিয়ে সবাই হাসিঠাট্টা করত, আবার তাঁর অনুষ্ঠানগুলোয় না এসেও পারত না। এদের মধ্যে কেউ কেউ আসত এন কে-কে একটু তোয়াজ করতে, যাতে তাঁর কাছ থেকে পরে সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। অন্যরা আসত সবাইকে নিয়ে, এমনকী নিজেদের নিয়েও, হাসিঠাট্টা করতে, কূটকচালি করতে। কিন্তু এদের মধ্যে কয়েকজন মহিলা আসত নির্মলাকে নিজেদের একজন আদর্শ রোল মডেল হিসেবে দেখতে— কীভাবে একজন কোনও রকম অশান্তি না করেই সংসারের দৈনন্দিন একঘেয়েমি থেকে পালাতে পেরেছেন নিজের শখের শিল্পের হাত ধরে। আবার কেউ কেউ মালব্য পরিবারকে নিতান্তই ভালবাসে বলে আসত। নির্মলার শিল্পকে হাস্যকর মনে করতেন না কেবল মালব্য দম্পতি নিজেরাই— নির্মলা গভীর ভাবে নিজেকে একজন ভাল নাচিয়ে হিসেবে বিশ্বাস করতেন বলে, আর এন কে প্রিয়তমা স্ত্রী-র ব্যাপারে খারাপ বা হাস্যকর কিছু দেখতে ইচ্ছুক নন বলে। মালব্যদের দুই ছেলে মায়ের এই তাণ্ডবনৃত্যের ব্যাপারে বড্ড লজ্জা পেত। কত্থক বা শাস্ত্রীয় শিল্প তেমন বোঝে না, গোটা ব্যাপারটাই তাদের ভাঁড়ামি মনে হয়, একথা হতবাক মা-বাবাকে জানিয়ে তারা অনুষ্ঠানে আসা থেকে অব্যাহতি পেয়েছিল। ‘ভাঁড়ামি?’ এন কে রেগেমেগে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মায়ের এই পরিশ্রম তোমাদের ভাঁড়ামি মনে হয়?’ ‘শোনো, ছেড়ে দাও। ঠিক আছে, বেটা। যদি ভাঁড়ামি মনে হয়, তোমাদের আসতে হবে না’, আঘাত পেলেও ভেঙে পড়েননি নির্মলা, প্রয়োজনীয় অন্যন্য কাজে মনোনিবেশ করেছিলেন।
বেশ কয়েক বছর বাৎসরিক অনুষ্ঠান করার পরে নির্মলা টের পেলেন, শেষ কয়েক বছর অনুষ্ঠানে ভিড়টা যেন কম হচ্ছে। বেশ, এই বছর না-হয় নতুন কিছু করা যাক, যাতে সবার চমক লেগে যায়। একটা কোনও থিম-ভিত্তিক অনুষ্ঠান করা যায়? না, থাক। আচ্ছা, আমার শিল্পীদের সঙ্গে যদি লাঙ্গা মাঙ্গানিয়ার বাজনদারদের একটা দলকে জুটিয়ে নেওয়া যায়? উঁহু, আইডিয়াটা খারাপ নয়, তবে লোকে আবার সেক্ষেত্রে তাঁকে লোকনৃত্য-শিল্পী ভেবে বসতে পারে, তা কোনওভাবেই তিনি বরদাস্ত করবেন না। এই নানারকম পরিকল্পনার কথা ভাবতে ভাবতেই তাঁর মাথায় এক সময়ে চিল্লার দুর্দান্ত চিন্তাটা আসে। সঙ্গতের শিল্পীরা প্রথমে কথাটা একটু এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, ভেবেছিলেন পাত্তা না দিলে আইডিয়াটা মুকুলেই ঝরে যাবে। কিন্তু যখন স্পষ্ট বোঝা গেল, এ জিনিস থেকে নিস্তার নেই, তখন প্রথমেই নির্মলাকে নিরস্ত করতে চেষ্টা করলেন গঙ্গাভাইয়া। বললনে, ‘চিল্লা জিনিসটা নিভৃতে করার জিনিস, শয়ে-শয়ে লোকের সামনে নয়। বুঝতে পারছেন, মাইডাম? আন্ডারিশটুড?’
‘বুঝতে পারছি, গঙ্গাভাইয়া’, সপাটে জবাব দিলেন নির্মলা, ‘কিন্তু আমাদের দায়িত্ব এই প্রথাগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরা, এগুলোর বিষয়ে তাদের সচেতন করা। না হলে এমন একটা দিন আসবে, যখন ডিকশনারি দেখে ‘চিল্লা’ কথাটার মানে বুঝতে হবে লোককে। এই তো, আমার নিজের পরিবারে, আমার নিজের ছেলেরা আমাকে বলেছে ওরা কত্থক বোঝে না, শাস্ত্রীয় শিল্পের পরিবেশনা দেখে ওদের ‘ভাঁড়ামি’ মনে হয়! তাই আমরা যদি এ বিষয়ে আরও লোকজনকে সচেতন করা না শুরু করি, লোকে ‘চিল্লা’ মানে ‘চিল’ করা বুঝতে শুরু করবে, এমন দিনেরও আর দেরি নেই! আন্ডারিশটুড, ভাইয়াজি?’
এ-তর্কে আশু পরাজয় দেখে গঙ্গাপ্রসাদ অন্য একটি রাস্তা নিলেন, একটু ঠারেঠোরে নির্মলাকে প্রশ্ন করলেন, টানা ২৪ ঘণ্টা তিনি অবিরাম নাচতে পারবেন বলে নিজে বিশ্বাস করেন কি না। ‘আপনার কী মনে হয়, ভাইয়া? এতদিন তো আমার দলে বাজাচ্ছেন, আপনার মন কী বলছে?’ মাপা অথচ চোখা স্বরে পাল্টা-প্রশ্ন এল, নির্মলার বরফের মতো ঠান্ডা চাহনির সঙ্গে। একটু দমে গিয়েই গঙ্গাভাইয়া চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘তা, আপনি হয়তো পারবেন। তবে আমার বয়সে, ইয়ে মানে, আমি না থেমে কতক্ষণ টানা বাজাতে পারব সে বিষয়ে সন্দেহ হয়।’ চটপট উত্তর এল, ‘বেশ তো, সেক্ষেত্রে আপনি একা বাজাবেন না, আরও সঙ্গতদারদের ভাড়া করতে হবে। ইন ফ্যাক্ট, বীণাকে আমি বলে দেব একটা তালিকা বানিয়ে ফোন করে দেখতে, কারা কারা সেই সময়ে বাজাতে পারবেন। ১২জন তবলচি হলেই হবে তো, কী বলেন? না কি এক-একজনকে দু’ঘণ্টা করে বাজাতে বলাটাও একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে?’
এই চিল্লার সঙ্গে ওতপ্রোত ছিল নির্মলার বাসনা: নাচের গিনেস বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করবেন। অতএব যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হল দুই রণক্ষেত্রে— একদিকে চিল্লা, অন্যদিকে গিনেস বিশ্বরেকর্ড। একটু ফুরসত পেতেই নির্মলা স্বামীকে অনুরোধ করলেন, গিনেস বিশ্বরেকর্ডে দরখাস্ত কীভাবে জমা দিতে হয়, সে বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য কাউকে নিয়োগ করতে হবে। এহেন অনুরোধে একটু থতমত খেয়ে বিশদে জানতে চেয়ে ভদ্রলোক বুঝলেন, তাঁর স্ত্রী পৃথিবীর দীর্ঘতম নৃত্য পরিবেশনায় বিশ্বরেকর্ড করতে চান। শুনে ভদ্রলোক একটু দুশ্চিন্তায় পড়লেন, স্ত্রী-র স্বাস্থ্য এবং ভাল থাকার উপরে এর প্রভাবের কথা তাঁকে একটু শঙ্কিতও করল, তবু নির্মলাকে দুঃখ না দিতে চেয়ে তখনকার মতো মেনে নিলেন। সৌভাগ্যবশত, প্রাথমিক খোঁজখবরেই জানা গেল, নাচের বিশ্বরেকর্ড একটি রয়েছে, এবং সেটি এক ভারতীয় মোহিনীআট্যম শিল্পী প্রায় ১২৩ ঘণ্টা টানা নেচে সৃষ্টি করেছেন। এই রেকর্ড ভেঙে নতুন রেকর্ড করতে গেলে একটানা পাঁচদিনের বেশি নাচতে হবে। এমন কঠিন পরীক্ষার কথা জেনে নির্মলা পিছিয়ে আসবেন, এ আশা এন কে-র ছিল। তবে নির্মলা দমে যাবার পাত্রী নন। খবরটা আত্মস্থ করতে কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন, বিশেষ ভাবে কত্থক নৃত্যের ক্ষেত্রে বিশ্বরেকর্ডের লক্ষ্যে তিনি দরখাস্ত করতে পারেন কি না। এবার এন কে-র সত্যিই বিরক্ত হওয়ার পালা, তিনি ক্লান্ত স্বরে জানালেন, ‘আমি খবর নিয়ে দেখব, তবে এসব রেকর্ডের আমি যেটুকু বুঝি, খুব বেশি প্রাদেশিক ভাবে, বা খুব নির্দিষ্ট একটা ধরন বাছলে চলবে না, সবাই যা জানে-বোঝে, সেরকম কিছু একটা বাছতে হবে।’ নির্মলার মনস্থির করতে এটুকুই দরকার ছিল। কোনও বিষয়ে এন কে যদি অখুশি হন, তবে তিনিও সে বিষয়ে আর এগোতে চান না।
এক মুহূর্তে পিছিয়ে এসে নির্মলা জানালেন, ‘না, ছেড়ে দাও। কোনও মানে হয় না। একজন নৃত্যশিল্পী একটানা কতদিন নাচতে পারছে বা পারছে না, তার নিরিখে প্রতিভার বিচার করার কোনও দরকার নেই। নাচলে এক ঘণ্টা নাচব, তবে ভাল করে নাচব, এই আমার ধর্ম। এইসব বিশ্বরেকর্ড করা নিয়ে আমার কোনও উৎসাহ নেই।’ এন কে-র বুকের উপর থেকে যেন একটা বিরাট ভার সরে গেল, তিনি সোৎসাহে বললেন, ‘হ্যাঁ নিম্মো (স্ত্রী-র আদরের ডাকনাম), এসব বিশ্ব-রেকর্ডে তোমার কীসের দরকার? বিশ্ব-রেকর্ড চুলোয় যাক, তুমি যেটা করছ স্রেফ আনন্দ করে করো।’ তখনই সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, বিশ্বরেকর্ডের ব্যাপারটা মুলতুবি থাক, তবে জনসমক্ষে ২৪ ঘণ্টার চিল্লার পরিকল্পনা নিয়ে মালব্যরা কাজ শুরু করছেন।