একটা লম্বা লাইন চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে। অপেক্ষা। অনন্ত অপেক্ষা। কিলোমিটারখানেক দূর থেকেও চুল্লির অনর্গল ধোঁয়ায় ভেসে আসে কটু গন্ধ। ফিল্টারটা খারাপ হয়ে গেছে বোধহয়— এত শব কোনওদিন দেখেনি সে।
শুনে গা শিউরে ওঠে। ব্যাঙ্গালোরেরই এক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। ওর ঘরের ব্যালকনি থেকে দেখা যায় এই শ্মশান। হোয়্যাটস্যাপে ছবি পাঠায়। শায়িত মরদেহের সারি। মৃত্যুর পরেও দীর্ঘ অপেক্ষা এই পৃথিবীর থেকে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করার।
গত বছর কোভিড যখন ভারতবর্ষের মাটিতে প্রথম ধরা পড়ল, আমি কলকাতায়। তারপর লকডাউন এবং বাড়ি থেকে কাজ করার অনুমতি পেয়ে থেকে গেছিলাম কয়েক মাস। জানুয়ারিতে ব্যাঙ্গালোর ফিরলাম। ছেড়ে যাওয়া শহর যে পাল্টে গেছে অনেকটাই, সেটা এয়ারপোর্টে নেমেই টের পাই। রাস্তায় এ শহরের কুখ্যাত যানজট অনুপস্থিত, কিন্তু কমতে থাকা সংক্রমণে স্বস্তির চিহ্ন মানুষের মধ্যে। পথের দু’পাশে গুলমোহর, আফ্রিকান টিউলিপ আর সোনাঝুরি গাছে বসন্তের ছোঁয়া। উদ্যাননগরী ব্যাঙ্গালোর ফুলে ফুলে রঙিন হয়ে উঠেছে।
আমাদের অফিস খুলে গেছিল। আসা-যাওয়া করছিলাম। ধীরে ধীরে বাড়ছিল যানজট— সিল্ক বোর্ডের মোড়ে অপেক্ষার সময়ও দীর্ঘায়িত হচ্ছিল। সবকিছুতে এভাবেই যে স্বাভাবিকতার রং লাগবে— এই অপেক্ষায় ছিলাম সবাই। চলছিল ভবিষ্যতের নানাবিধ পরিকল্পনা, কাছে-পিঠে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতি। এমন সময় হঠাৎ বদলে গেল কোভিড-আক্রান্তর নিম্নমুখী পরিসংখ্যান। পড়শি মহারাষ্ট্র থেকে প্রবল হারে সংখ্যাবৃদ্ধির খবর আসতে শুরু করল। পদার্থবিদ্যায় ‘মিউচুয়াল ইন্ডাকশন’ নামে একটা শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়, এক্ষেত্রেও যেন সেই। প্রতিবেশী রাজ্য থেকে ‘মিউচুয়াল ইন্ডাকশন’-এর নীতি মেনেই কর্নাটকে বাড়তে থাকল দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা। রাজ্য সরকার নড়েচড়ে বসল। জারি হল আংশিক কার্ফিউ। পথে কমল গাড়ির সংখ্যা। বেড়ে গেল অ্যাম্বুলেন্সের তীক্ষ্ণ সাইরেনের আর্তনাদ। আমরা ধীরে ধীরে আবার নিজেদের অন্তরিন করে ফেললাম। দেশজুড়ে মারণ রোগের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়ল সগর্জনে।
সহনাগরিকদের অসহায়ত্বের সুযোগকে কাজে লাগায় দু’ধরনের মানুষেরা। এক, জীবনে শুধু মুনাফার অঙ্ক যারা কষেছে। তারা এই আপৎকালীন পরিস্থিতিতেও নিজেদের ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্সের কথা ভাবে সর্বাগ্রে— সম্ভবত নিজেদের জীবনেরও আগে। এই শ্রেণির মানুষের অভাব গোটা পৃথিবীতে কোথাও নেই। এদেশে তো নয়ই। এরকমই একদল মানুষ ঠিক এই সময়ে, যখন শহর তথা দেশজুড়ে হাসপাতালের বেডের জন্য হাহাকার, ব্যাঙ্গালোরের বেশ কয়েকটি হাসপাতালের কয়েক হাজার বেডকে দখল করে রেখে মোটা অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করছিল অসুস্থ মানুষের অসহায় পরিজনের কাছে। তারা সঠিক ভাবেই জানত যে, যখন কারোর নিকটাত্মীয়র রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি মুহূর্তে কমতে থাকবে, আর এই মারণ ভাইরাস ধীরে ধীরে কেড়ে নিতে থাকবে তার প্রাণবায়ু— তখন অর্থকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, প্রয়োজন হলে ঋণ নিয়ে হাসপাতালে একটা জায়গা পাওয়ার চেষ্টা মানুষ করবেই। আর তার ফলেই পকেট ভরবে এদের। ব্যাঙ্গালোর কর্পোরেশনের ভিতরেই লুকিয়ে ছিল সমাজের এই ‘ভূত’-রা। গোয়েন্দাদের তৎপরতায় গোটা দলটি ধরা পড়ে যায়— মানুষের স্বস্তি ঈষৎ বাড়ে।
দ্বিতীয় প্রকারের মানুষগুলি একটু অন্যরকম। এদের লাভ-ক্ষতির হিসাব বোধহয় আমাদের সরল পাটিগণিতের হিসাবে বাঁধা পড়ে না। নিখিলভার-ধারকের খাতায় কষা থাকে সে সমস্ত সুদের জটিল যোগ-বিয়োগ। অসুস্থের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া এই মানুষের সংখ্যা এখনও, এই পৃথিবীতে, যথেষ্ট। ব্যাঙ্গালোরও তার ব্যতিক্রম নয়। এই আংশিক কার্ফিউয়ের মধ্যে, যখন আমরা ভাইরাসের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টায় গৃহবন্দি রেখেছি নিজেকে, তখন অনেক অল্পবয়সি মানুষের কথা শুনতে পাচ্ছি, যারা জীবন-মৃত্যুকে আক্ষরিক ভাবেই পায়ের ভৃত্য করে নেমে পড়েছে রাস্তায়। আমারই এক পরিচিত সপরিবারে কোভিড-আক্রান্ত। তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটির অবস্থা খারাপের দিকে যেতে শুরু করে। এমনই এক অনামী ছোকরা বাড়ি এসে অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে তাকে নিয়ে যায় হাসপাতালে— সঠিক সময়ে শুশ্রূষা পেয়ে সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক এখন সুস্থতার পথে। আবার আর এক বন্ধুনীর মুখে শুনলাম আর একটি ঘটনা। সে একাই থাকে এ-শহরে। সপ্তাহখানেক আগে সেও ছিল রোগশয্যায়— নিজের বাড়িতেই, অন্তরিন অবস্থায়। এদিকে ঘরের রসদ প্রায় শেষের মুখে। সে দ্বিধাভরে ফোন করেছিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস যার দোকান থেকে কিনত— সেই ভদ্রলোককে। একটি ফোনেই সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। সেই কন্নড় ভদ্রলোক দায়িত্ব নিয়ে দু’দিন অন্তর তার দরজায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি। টাকা-পয়সার কথা তুলতেই ফোনের ওপারে লম্বা জিভ কেটে বলেছেন, ‘দিদি আপনি আগে সুস্থ হয়ে উঠুন। তারপর না হয় সব হিসেব-নিকেশ করা যাবে। ততদিন পর্যন্ত এসবের কথা মনেও আনবেন না।’— এখনও এরকম মানুষের সংখ্যা যথেষ্ট পরিমাণে আছে বলেই হয়তো সূর্য-চন্দ্র ওঠে, আমাদেরও প্রতিদিন বাঁচতে ভাল লাগে নতুন করে।
এই প্রবাস-জীবনে অনেক কিছুই দেখলাম। ব্যাঙ্গালোরে আসার আগে দীর্ঘদিন ছিলাম চেন্নাইয়ে। সেখানে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছি। বিনা বিদ্যুতে কাটিয়েছি দিন দশেক। মানুষ মানুষের পাশে থেকেছে, এক ডাকেই এগিয়ে এসেছে সাহায্যের জন্য। কিন্তু এবার, বিশেষ করে কোভিডের এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় যখন গোটা দেশেরই স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রায় টলোমলো— তখন মানুষের এক অন্য করুণাঘনরূপ দেখতে পাচ্ছি রোজ। সরাসরি রাস্তায় নেমে, হাসপাতালে গিয়ে সাহায্য করছেন যেমন অনেকে, তেমনই অনেকে ঘরে বসে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে যোগাযোগের এক নিবিড় সেতুবন্ধন হয়ে চলেছেন নিয়মিত। এই মানবসেতু শুধু ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই বা কলকাতা নয়— জুড়ছে পৃথিবীর এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তকে, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মের মানুষকে। এমন বিস্তৃত মানবজমিনই পারে কেবলমাত্র এই অসুখের দিনে জীবনের অক্সিজেন জোগাতে। ব্যাঙ্গালোরের জনহীন রাস্তার দু’পাশের ফুলেভরা গাছেরাও এখন বুঝি সেই অপেক্ষাতেই প্রহর গোনে— তারাও এমন রোদনভরা বসন্ত তো দেখেনি কখনও আগে— দেখেনি তাদের ঝরা-ফুলের আলিঙ্গনে শায়িত মৃতের অনন্ত প্রতীক্ষাও…