উত্তরখণ্ডে হিন্দুধর্মের দুটি প্রধান তীর্থস্থান কেদারনাথ ও বদ্রীনাথ শীতকালে বন্ধ থাকে। এই দুটি জায়গার সঙ্গেই যোগসূত্র রয়েছে আদিশঙ্করের, ১২০০ বছর আগে যে পণ্ডিতের হাত ধরে বৈদিক চর্চার পুনরুত্থান। যাবতীয় তীর্থস্থানগুলোকে তিনিই চিহ্নিত করেছিলেন, হিন্দুধর্মের বৌদ্ধিক পরিপ্রেক্ষিত (জ্ঞান মার্গ) এবং আবেগী পরিপ্রেক্ষিতের (ভক্তি মার্গ) মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন তাঁরই কীর্তি। প্রথাগত ভাবে যে দুটি জায়গাকে গঙ্গা ও যমুনা নদীর উৎস বলে ধরা হয়, সেই গঙ্গোত্রী এবং যমুনোত্রীর সঙ্গে কেদারনাথ ও বদ্রীনাথকে বলা হয় ছোটি-চার-ধাম, অর্থাৎ তীর্থস্থলের কনিষ্ঠ চতুষ্কোণ।
এই বদ্রীনাথ, কেদারনাথ, এবং গাড়ওয়ালের গোটা পার্বত্য অঞ্চলের সঙ্গেই ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে মহাভারত মহাকাব্যের গল্প। স্থানীয় মানুষ এখানে পাণ্ডব লীলার অনুষ্ঠান পালন করেন, যাতে এ গল্পের স্থানীয় সংস্করণটি কথিত হয়ে থাকে। এ সংস্করণে যুদ্ধের পরে যুধিষ্ঠির কৌরবদের পাঁচটি গ্রাম দান করেন— যে পাঁচটি গ্রাম তাঁদের দিতে যুদ্ধের আগে কৌরবরাই গররাজি হয়েছিলেন। এই পাঁচটি গ্রাম অর্জন করেন কৌরবদের পাঁচজন— ভগ্নশরীর দুর্যোধন, ছিন্নহস্ত ভূরিশ্রবা, কর্ণ, দ্রোণ, ও অশ্বত্থামা। স্থানীয় দেবতা হিসেবে তাঁরা পূজিতও হন, যদিও পঞ্চপাণ্ডবের প্রতিষ্ঠিত শিব ও বিষ্ণুর মন্দিরই বেশি জনপ্রিয়।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে জয়লাভ করার পরে ভ্রাতৃহত্যা এবং শত শত সৈন্য সংহারের জন্য পাণ্ডবরা অনুশোচনা এবং অপরাধবোধে ভেঙে পড়েন। কৃষ্ণের হাজার বৌদ্ধিক যুক্তি এবং ব্যবহারিক তর্কবিতর্কেও তাঁদের মন মানতে চায় না। একটু শান্তির খোঁজে পাণ্ডবরা তাঁদের যৌথ স্ত্রী দ্রৌপদীর সঙ্গে হিমালয়ে গমন করেন। এখানে বৃষরূপী শিবের সঙ্গে তাঁদের দেখা হয়, এবং তাঁর কাছে এই মনঃকষ্টের হাত থেকে নিস্তার পেতে প্রার্থনা করেন পাণ্ডবরা। বৃষের বেশে শিব কিন্তু পলায়ন করেন, সমস্যার সমাধান পেতে মরিয়া হয়ে তাঁকে তাড়া করেন পাণ্ডবরা। শিব পাতালে পালাতে চেষ্টা করলে ভীম তাঁর কুঁজটি চেপে ধরে তাঁকে ভূগর্ভে প্রবেশ করার পথে আটকে দেন। এই কুঁজটিই হয়ে উঠেছে কেদারনাথে পূজিত শিবলিঙ্গ।
পরবর্তীকালে পৃথিবীতে ধর্মরাজ্যের পত্তন করার পরে পাণ্ডবরা লোকসমাজ ত্যাগ করে আবার ফিরে যান হিমালয়ে। পাহাড়ের পর পাহাড়ে তাঁরা চড়তে থাকেন স্বর্গরাজ্যের বা ইন্দ্রের স্বর্গীয় রাজত্বের প্রবেশপথের খোঁজে। পথে চলতে চলতে এক জায়গায় তাঁরা বদ্রীগাছের নীচে ধ্যানস্থ অবস্থায় ভগবান বিষ্ণুর দেখা পান। এই জায়গাটিই বদ্রীনাথ। এই স্থানেই বিষ্ণু, নর(আদি ছাত্র) ও নারায়ণের(আদি শিক্ষক) দ্বৈত রূপে নিজেকে প্রকাশ করেন, পরবর্তী যুগে যে রূপের প্রকাশ কৃষ্ণ ও অর্জুনের পরিচয়ে। মন্দিরের স্থাপত্য এবং তার দেওয়ালের যে উজ্জ্বল রঙ (যে উজ্জ্বলতা হিমালয়ের বৌদ্ধবিহারে খুব পাওয়া যায়) থেকে কিছু ঐতিহাসিকদের অনুমান, বদ্রীনাথের মন্দিরটি আগে মহাযান বৌদ্ধ মন্দির ছিল, পরে তার সঙ্গে যুক্ত হয় বৈষ্ণবধর্মের ইতিহাস।
শিবের উপাসক এবং বিষ্ণুর উপাসকদের মধ্যে প্রথাগত রেষারেষির কথা আদিশঙ্কর সম্ভবত জানতেন। তিনি জানতেন শক্তির উপাসনায় ত্যাগী সন্ন্যাসী শিব হয়ে উঠেছেন গৃহস্থ, আর নির্লিপ্ত রাজা রামের বেশে এবং ত্যাগী গৃহস্থ কৃষ্ণের রূপে গৃহস্থ বিষ্ণু হয়েছেন সন্ন্যাসী। তিনি জানতেন শিবের ভূষণ ছাই, আর বিষ্ণুর ভূষণ চন্দন-বাটা। শিবের যোগসূত্র রয়েছে অশান্ত, খরস্রোতা গঙ্গার সঙ্গে, আর একাকী, স্তব্ধ, নিঝুম যমুনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিষ্ণুর গল্প। বিষ্ণু ও যমুনা কল্পিত হন কালো রঙে, শিব ও গঙ্গা সাদা রঙে।
এই দুই বিপরীত, দ্বৈত দেবতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুই মন্দির এবং দুই নদীর যোগাযোগ নিজের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সঙ্গে স্থাপন করে আদিশঙ্কর সৃষ্টি করেছিলেন এক নব্য হিন্দু ধর্ম। সে ধর্ম বর্তমান পৃথিবীকে যোগ্য স্বীকৃতি দেয়, স্থানীয় রীতি-বিশ্বাসের সঙ্গে অটুট সম্পর্ক রাখে— নিরুত্তাপ, বিশ্বত্যাগী বৌদ্ধধর্মের থেকে যে ধর্মকে মানুষের পছন্দ করে বেছে নেবার সম্ভাবনাই বেশি।