আমার ওই তখনকার জীবনটা ছিল দাদুময়। আগেই বলেছি দাদু বেজায় রাশভারী আর রাগী মানুষ হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র আমার সম্পূর্ণ বশীভূত ছিলেন। আমার কোনও আবদারই তিনি অন্যায্য মনে করতেন না। কিন্তু দাদুকে আমি পেয়েছি তাঁর একেবারে শেষ জীবনে। দাদুর মোট আট সন্তানের মধ্যে বাবা ছিলেন সপ্তম। ফলে দাদুর সঙ্গে আমার বাবার বয়সেরও অনেক তফাত ছিল। কে জানে কেন, আমার প্রতি দাদুর আশ্চর্য পক্ষপাতে অনেকেই অবাক হত। রাজকুমার মুখুটির মতো রাশভারী মানুষ কী করে রুনুর এত বশ হল, সেটা ছিল গবেষণার বিষয়। আমার হাগা-মোতা-স্নান-খাওয়া-ঘুম সবই ছিল দাদুর কাছে। একবার দাদু জরুরি মোকদ্দমার কাজে তাড়াতাড়ি আদালতে যাবেন বলে তৈরি হচ্ছিলেন, তখন ঠাকুমা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কুয়োতলায় স্নান করিয়ে দিয়েছিলেন। আমি তারস্বরে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তো করলামই, তারপর ঠাকুমার হাত থেকে ছাড়া পেয়েই ছুটে গিয়ে কুয়োতলার পাশে রাখা স্তূপাকৃতি বাসন মাজবার ছাইগাদায় পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগলাম। সর্বাঙ্গ ছাইয়ে মাখামাখি। ঠাকুমা রেগে টং এই বেয়াদবি দেখে। কিন্তু দাদু খুব শান্তভাবে তাঁর জুতো-মোজা আর আদালতের পোশাক ছাড়লেন, বাড়িতে পরার ধুতি ফের পরলেন, তারপর খুবই স্নেহের সঙ্গে আমাকে তুলে সযত্নে স্নান করিয়ে, পোশাক পরিয়ে তবে আদালতে গেলেন। তাঁর এই অন্যায্য প্রশ্রয় দেখে কেউ তেমন খুশি নয়, কিন্তু দাদুর ওপরে কথা বলার সাহসও কারও নেই।
আমি যে বেজায় দুষ্টু, সেটা লোকমুখে ভালই প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল। এমনকী আমাদের চেনাজানা বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে কোনও ছেলে দুষ্টুমি করলে বলা হত, ‘এ তো দেখতাছি রুনুর মতন দুষ্ট হইছে!’ অথচ দাদুর কাছে আমার নামে কেউ নালিশ করলে দাদু একগাল হেসে বলতেন, ‘হ, তোমরা যে কী কও! পোলাপান তো একটু-আধটু দুষ্টামি করবই। হেইটা আবার নালিশ করন লাগে নাকি? বড় হইলেই ঠিক হইয়া যাইব অনে।’
শিশুকাল থেকেই শুনে আসছি আমার বাবা এম.এ, বি.এল পাশ। আজকাল এম.এ, এল.এল.বি কোনও গুরুতর কোয়ালিফিকেশন নয়, কিন্তু সেই আমলে ব্যাপারটা খুব এলেবেলে জিনিস ছিল না। এম.এ দূরে থাক, গ্র্যাজুয়েট শুনলেই লোকে একটু খাতির করত। তখনও ঘরে-ঘরে গ্র্যাজুয়েটের চাষ শুরু হয়নি। আর গ্র্যাজুয়েট হতে হলে যে এলেমের দরকার হত, তাও মিথ্যে নয়। অন্তত সেই আমলের গ্র্যাজুয়েটরা ভুল ইংরেজি লিখত না, গ্রামার জানত, যে কোনও দরখাস্ত লিখতে পারত। বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ইংরেজির মান ছিল ভারি উঁচু, যেটা এখন আর নেই। আমাদের স্কুলের মাস্টারমশাইরা যা পড়াতেন তা তাঁদের অধিগত ছিল। ভুলভাল শেখাতেন না। তা যাই হোক, আমার বাবা কিছুদিন ময়মনসিংহেই ওকালতি করেছিলেন। কালো কোট পরে আদালতে যেতেন। হঠাৎ খবর পাওয়া গেল, বাবা রেলে চাকরি পেয়ে গেছেন। সম্ভবত রেলের চাকরির পিছনে আমার দাদামশাইয়ের কিছু প্ররোচনা ছিল। আমার বাবা দীর্ঘকায়, অতি সুপুরুষ, চমৎকার গানের গলা, দুর্দান্ত খেলোয়াড়, দারুণ স্মার্ট, ইংরেজি বলায় সাবলীল, বুদ্ধিমান এবং কোয়ালিফিকেশনও ফেলনা নয়। ময়মনসিংহে তাঁর তেমন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হয়তো ছিল না। তাই হয়তো দাদামশাই তাঁকে পরামর্শটা দিয়ে থাকবেন। বাবা চাকরিটা পেয়েও গেলেন অনায়াসে। শিয়ালদায় রেলের ক্রু ইনচার্জ। কানাঘুষো শুনেছিলাম তাঁর বেতন আশি টাকা। এবং সেটা নাকি বেশ ঈর্ষণীয় বেতন।
শিশুকাল থেকে আমি একজন লোককেই বেজায় ভয় পেয়ে এসেছি। সেটা হল আমার বাবা। অথচ বাবা আমাকে কদাচিৎ শাসন করেছেন। তিন-চার বছর বয়স অবধি তো বাবার অস্তিত্বই তেমন করে টের পেতাম না। সেটা প্রথম টের পেলাম কলকাতায় এসে। আর এই কলকাতায় আসার ব্যাপারটাও খুব সহজ হয়নি। চাকরি নিয়ে বাবা কলকাতায় চলে যাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে আমরা, অর্থাৎ মা, দিদি আর আমি কলকাতায় যাই। সম্ভবত জ্যাঠামশাই আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। তার আগে অবশ্য বিস্তর কান্নাকাটি, হা-হুতাশের ব্যাপার ছিল। বিশেষ করে আমার জন্য দাদুর হাহাকার। আর আমার ব্যক্তিগত বিরহ ছিল ময়মনসিংহের জন্য। আমার আসল দেশ ঢাকার বিক্রমপুর, মুন্সীগঞ্জ মহকুমার টঙ্গিবাড়ি থানার অন্তর্গত বাইনখাড়া গ্রাম। ময়মনসিংহ আমাদের দেশ নয়, তবু আমার এই জন্মশহর আমাকে এমনই মোহাবিষ্ট করে রেখেছিল যে, আজও সেই তীব্র আকর্ষণ অনুভব করি। বলছি বটে শহর, কিন্তু এখন ভাবি, ময়মনসিংহকে কতটা শহরের তকমা দেওয়া যায়! আমরাই তো থাকতাম মাটির ভিটেওয়ালা টিনের চালের ঘরে, ঘরের পিছনে পুষ্করিণী, তার পাশে বিস্তীর্ণ ঢেঁকি আর কলমি শাকের জঙ্গল। চারদিকে আম, জাম, কামরাঙা, বেল, বাতাবি (আমরা বলতাম জম্বুরা), চালতা আর হরেক গাছগাছালির নিবিড় সংসার। বাজার বা রেলস্টেশনে গেলে একটু শহর-শহর মনে হত বটে, কিন্তু আদতে ময়মনসিংহ তখন একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম ছাড়া কিছুই নয়। পরিবহন বলতে ছ্যাকড়াগাড়ি, সারা শহরে একটি-দুটির বেশি মোটরগাড়ি ছিল না। রাস্তা ছিল লাল সুড়কির এবং অতিশয় এবড়োখেবড়ো। তবু সেই তিন-চার বছর বয়সে মনে হয়েছিল, এই শহর থেকে আমাকে নিয়ে গেলে আমি মরেই যাব। দাদু, ঠাকুমা, বমা, দাদামশাই, দিদিমা, ব্রজমাসি, আমার চার স্নেহশীল জেঠতুতো দাদা, জ্যাঠামশাই, জিষ্ণুমামা, জ্যোতিমামা, এদের ছেড়ে আমি বাঁচব কী করে? বাঁচব কী করে ব্রহ্মপুত্র ছাড়া? আর সব বাদ দিলেও, দাদুকে ছাড়া তো আমার চলবেই না! রাতে মায়ের বুক ঘেঁষে ঘুমটুকু ছাড়া আমার জাগ্রত সারাদিনই যে দাদুময়। দাদুরও শুনেছি, কাছারিতে গিয়ে আমার জন্য মনকেমন করত। নানা ছলছুতোয় মাঝে মাঝে তাড়াতাড়ি চলে আসতেন। তখনও ময়মনসিংহের বাইরে আমার কাছে আর জগৎ নেই। কোথাকার কোন কলকাতায় আমাকে কেন নিয়ে যাওয়া হবে সেটাই আমার বোধগম্য হচ্ছিল না। ব্যাপারটা যে একটা ঘোরতর অন্যায়, সেটা আমার চেয়ে ভাল আর কে বুঝবে! বড়রা যে কেন এত বোকা হয় কে জানে!