ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • ‘নায়ক’ আর আমি


    শর্মিলা ঠাকুর (Sharmila Tagore) (May 22, 2021)
     

    নায়ক’ রিলিজ করেছিল ১৯৬৬ সালে। বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে এই ছবিটাই ছিল ভারতের ‘অফিশিয়াল এন্ট্রি’। মানিকদা চেয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে আমিও বার্লিন যাই, কিন্তু তখন ‘অ্যান ইভনিং ইন প্যারিস’ ছবির শুটিং করছিলাম। দুটো ছবির বিষয় এতটাই আলাদা যে কল্পনাই করা যায় না! তবে মানিকদার সঙ্গে ওই চলচ্চিত্র উৎসবে যেতে পারলে নিশ্চয়ই তা দারুণ সম্মানের ব্যাপার হত, অনেক ভাল স্মৃতিও থাকত। কিন্তু কী আর করা যাবে, যাওয়া হল না।

    ‘নায়ক’ মানিকদার দ্বিতীয় মৌলিক চিত্রনাট্য, প্রথমটা ছিল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। আমায় যখন মানিকদা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-য় একটা পার্ট দিলেন, আমার তখন সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষা, তাই অভিনয় করতে পারলাম না। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তাই মানিকদা যখন বললেন ‘নায়ক’-এ এক সাংবাদিকের চরিত্রে আমাকে বেছেছেন, এত আনন্দ হল যে বলার নয়! ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র মতো, এবারও, উনি কোনও গল্পের সাহায্য ছাড়া, একেবারে সরাসরি চিত্রনাট্যটা লিখেছেন।

    যখন দেখা হল, মানিকদা বললেন, ‘রিঙ্কু, তোমাকে চশমা পরতে হবে, নইলে উত্তমকুমারের পাশে বড্ড কমবয়সি দেখাবে।’ আমি এর আগে সত্যজিৎ রায়ের দুটো অসামান্য ছবিতে অভিনয় করেছি, তারপর কয়েকটা হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছি, তাই সিনেমায় বেশ খানিকটা হাতেখড়ি হয়েছে বলে মনে হয়। বললাম, ‘চশমা তো পরব, কিন্তু আমার কাছের জিনিস দেখতে অসুবিধে হয়, না দূরের জিনিস?’ মানিকদা সেটা বোধহয় ঠিক করে রাখেননি। উনি বেশ খানিকটা অবাকই হলেন। তারপর বললেন, ‘তুমিই সেটা ঠিক করো।’ এতদিন আমি শুধু তা-ই করেছি, যা উনি বলেছেন, নিজে কিছুই ঠিক করিনি বা পরামর্শ দিইনি। উনি বেশ খুশি হলেন, একটু মজাও পেলেন এটা ভেবে যে, আমি ওঁর সঙ্গে বেশ বড়দের মতো কথা বলছি, আর পেশাদার অভিনেত্রীর মতোও।

    এতদিন মানিকদা তাঁর ছবিতে বেশির ভাগ অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই নিয়েছিলেন, এবার উনি বাংলা সিনেমার ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারকে মূল ভূমিকায় নিলেন। যা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হল, এমনকী বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেনও কিছু বিরূপ মন্তব্য করলেন। তখন মোটামুটি এটাই বিশ্বাস করা হত, মূল ধারার ছবি আর সমান্তরাল ধারার ছবি একসঙ্গে মিশতে পারে না, এবং মেশা উচিতও নয়। একদিক থেকে দেখলে, সত্যজিৎ এই প্রথাটা ভাঙলেন। তিনি এই কাজটা করলেন কারণ, ‘নায়ক’ ছবিতে যদি মূল ভূমিকায় একজন সত্যিকারের মহানায়ক অভিনয় করেন, তাহলে দর্শক মুহূর্তেই চরিত্রটিকে বিশ্বাস করতে শুরু করবে। আর উত্তমকুমারের অভিনয়ক্ষমতা সম্পর্কেও উনি নিশ্চিত ছিলেন। উত্তম ছিলেন খুব সফল নায়ক, কিন্তু এই ছবিটার পর, আমার মনে হয়, উনি অভিনেতা হিসেবে আরও ধারালো হয়ে উঠেছিলেন। ছবিটার শেষের দিকে একটা দৃশ্য আছে, যেখানে নায়ক বেশ কিছুটা মদ্যপান করে অদিতির কাছে স্বীকার করে, কেন তার শেষ ছবিটা চলেনি। একজন বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে তার তখন প্রেম চলছিল, এবং কাজে খুব একটা মনোযোগ ছিল না। উত্তম ওই দৃশ্যে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন, আমি ছিলাম নির্বাক দর্শকমাত্র।

    ‘নায়ক’ তৈরি হতে পেরেছিল তিনজন মহাশিল্পীর যৌথ চেষ্টায়, একজন তো মানিকদা বটেই, এছাড়া ছিলেন বংশী চন্দ্রগুপ্ত (শিল্প নির্দেশক), আর সুব্রত মিত্র (ক্যামেরাম্যান)। নায়কের বাড়িতে আমরা দেখতে পাই ফিলিপ’স-এর ইলেকট্রিক শেভার, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ-এর টয়লেট-ব্যাগ, ব্যাডমিন্টন ব়্যাকেট। এগুলো দেখে আমরা বুঝতে পারি, অরিন্দম অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছে, আর খেলাধুলোও করে। বাড়িভর্তি নিজের বিরাট বিরাট ছবি টাঙিয়ে রেখেছে সে, তা থেকে বুঝি, নিজের প্রতি তার ভালবাসাটাও তার একটু বেশিই। তার দামি জুতো আর শৌখিন মোজা জানান দেয়, সে অন্যদের চেয়ে পয়সায়-প্রতিষ্ঠায় বেশ উঁচুতে। বংশী চন্দ্রগুপ্ত-র ডিটেলের প্রতি দৃষ্টি আরও ভাল করে দর্শককে বুঝিয়ে দেয়, অরিন্দম কত বড় তারকা। বাজেট কম থাকা সত্ত্বেও, রাজধানী এক্সপ্রেস ট্রেনের ভেতরটা বংশীদা যেমন করে সাজিয়েছিলেন, তা নিখুঁত।

    এতদিন মানিকদা তাঁর ছবিতে বেশির ভাগ অপেশাদার অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরই নিয়েছিলেন, এবার উনি বাংলা সিনেমার ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারকে মূল ভূমিকায় নিলেন। যা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হল, এমনকী বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেনও কিছু বিরূপ মন্তব্য করলেন। তখন মোটামুটি এটাই বিশ্বাস করা হত, মূল ধারার ছবি আর সমান্তরাল ধারার ছবি একসঙ্গে মিশতে পারে না, এবং মেশা উচিতও নয়। একদিক থেকে দেখলে, সত্যজিৎ এই প্রথাটা ভাঙলেন।

    ছবিটা দেখে মনে হয়, সত্যিই যেন একটা ট্রেন চলছে এবং বিভিন্ন স্টেশনে থামছে। দিনের সময় অনুযায়ী আলোও বদলে যাচ্ছে। এই পুরো জিনিসটা হয়েছিল সুব্রত মিত্রের চেষ্টায় ও পরিকল্পনায়। এই প্রসঙ্গে বলি, মানিকদা, বংশীদা, সুব্রত মিত্র— এই তিনজনেরই সিনেমার প্রতি অবদান অতুলনীয়।

    কলকাতায় ফিল্ম তৈরি করা সবসময়ই একরকম যুদ্ধ, যার প্রধান কারণ হল টাকার অভাব। ছবি বানানো এমনিতেই খুব ঝামেলার কাজ, তার ওপর এই সর্বক্ষণ কম বাজেটে কাজ করার চাপ— এই সব মিলিয়েই বোধহয় মানিকদার হার্ট কমজোরি হয়ে গিয়েছিল। আমার মনে আছে, লাঞ্চ-ব্রেকের সময়, মানিকদা ক্যামেরার পাশে বসে থাকতেন, আর নিজের রুমালটা চিবোতেন! প্রায় প্রতিদিন একটা করে রুমাল নষ্ট করতেন, আর তাঁর স্ত্রী মঙ্কুদি তা নিয়ে রাগারাগি করতেন!

    ‘নায়ক’-এর গল্পটা একজন তারকার মানসিকতা নিয়ে, তার অনুরাগী ও সমালোচকদের মানসিকতা নিয়েও। নায়ক ঠিক করে, ট্রেনে চড়েই দিল্লি যাবে। যে কারণটা এমনিতে সে বলেছে, তা হল, সে একটা পুরস্কার পাচ্ছে, সেটা নিতে যাচ্ছে। কিন্তু আসলে সে সবকিছু থেকে একটু অব্যাহতি চায়, আসলে বোধহয় নিজের থেকে পালাতে চায়। বিবাহিতা মহিলার সঙ্গে তার প্রেম, শেষ ছবিটার বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়া— সবকিছু থেকে। তার নিজেকে মনে হচ্ছে একটা হেরে যাওয়া লোক, তাই সে মনটা মেরামত করার জন্য একটু সময় চায়। 

    আমি অভিনয় করেছিলাম এক তরুণী সাংবাদিকের চরিত্রে। সে একটি মেয়েদের পত্রিকার সম্পাদক, ওই ট্রেনেই যাচ্ছে। তার সহযাত্রীরা বলে, নায়কের একটা একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার চেষ্টা করতে। প্রথমে ব্যাপারটা খুব সুবিধের হয় না, কিন্তু তারপর নায়ক বুঝতে পারে, এই মেয়েটির কাছে তাকে স্টারের ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে না, যেটা যেন ছিল তার কাছে একটা বিরাট মুক্তি। গোড়ার দিকে এই তারকার প্রতি অদিতিরও ছিল এক ধরনের বিরাগ। পরে সে বুঝতে পারে, এও একজন মানুষই, অন্য সকলের মতো। তার প্রাথমিক বিতৃষ্ণা, পরে সহমর্মিতায় বদলে যায়। শেষমেশ অদিতিই হয়ে ওঠে নায়কের বিবেকের রক্ষক। এক দৃশ্যে, অদিতি নায়ককে জিজ্ঞেস করে, ‘কিন্তু… এই যে এত বেশি করে পাওয়া, এর মধ্যে একটা… একটা ফাঁক, একটা অভাববোধ… কোনও রিগ্রেটস নেই?’ আর এক জায়গায়, সে বলে, ‘বিবেকটা কি খারাপ জিনিস?’ অরিন্দম উত্তর দেয়, ‘খারাপ জিনিস নয়, কিন্তু… বড় সাংঘাতিক যে। ওটাকে উচ্ছেদ করতে পারলেই তো—’ অদিতি তখন মনে করিয়ে দেয়, ‘কী বলছেন আপনি? ওটা যতদিন আছে, ততদিনই তো মানুষের মনুষ্যত্ব!’

    ‘নায়ক’ সিনেমার একটি দৃশ্যে উত্তমকুমার ও শর্মিলা ঠাকুর

    ডেভিড ম্যাকাচিয়ন বলেন, ‘ফিল্মটার সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার হল এর কাঠামো— যেভাবে বিভিন্ন বিষয়কে বিন্যস্ত করা হয়। আর তার মধ্যে আমরা নিজেদের চেনা অনেক কিছু খুঁজে পেয়ে আনন্দিত হয়ে উঠি,  যে-জিনিসগুলোকে শিল্প দিয়ে চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে।’ ছবিটা সাধারণ কিছু মানুষকে সুচিন্তিত কৌশলে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় এনে ফ্যালে, এবং তারপর তাদের মধ্যে নাটক তৈরি করে। পরিচালক প্রেমের একটা নিখুঁত পরিস্থিতি তৈরি করেন, তারপর প্রেমটা হতে দেন না। ট্রেনের প্রায় সকলেই অরিন্দমের গ্ল্যামারে একেবারে সম্মোহিত হয়ে থাকে, কেউ তার সঙ্গে স্বাভাবিক ব্যবহারই করতে পারে না, শুধু অদিতি আর একটি ছোট অবাঙালি মেয়ে ছাড়া।

    ছবিটার নৈতিক গভীরতাও খুব শক্তিশালী। ছবিটি মূল নৈতিক প্রশ্নটাকেই বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দ্যাখে— পেশার আদবকায়দা, বন্ধুত্ব, টাকার জন্য নিজের আদর্শের সঙ্গে আপোস, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক ইত্যাদি। আবেগের দিক থেকেও এই ছবি অত্যন্ত সংযত।

    একটি ট্রেনের বদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত পরিসরে, নায়ক তার নিজের অভাববোধ ও অপরাধবোধের সঙ্গে মোকাবিলার চেষ্টা করে। বাকি যাত্রীদের কেউ তাকে মহাতারকা হিসেবে পুজো করে, কেউ আবার পত্র-পত্রিকার কেচ্ছাকাহিনি পড়ে তাকে ঘেন্না করে। সে কখনও একজন মহাতারকা হয়ে ওঠে, কখনও তার সত্যিকারের সত্তাটা ফিরে পায়। একজন স্টার হিসেবে তার কাছে ঠিক কেমন আচরণ প্রত্যাশিত, সে খুব ভাল করে জানে, এবং কাউকেই হতাশ করে না। ট্রেনে যারা আছে, প্রায় সকলেই কিছু না কিছু আদায় করার তালে আছে, আর প্রায় সকলেই এমন কিছু হওয়ার ভান করছে, যা তারা নয়। সেই অর্থে, সকলেই অভিনয় করে চলেছে।

    তারকা সম্পর্কে আমাদের ধারণাটাকেই সত্যজিৎ চ্যালেঞ্জ করেন। ‘নায়ক’-এ তিনি বহু প্রশ্ন তোলেন, কিন্তু কোনও উত্তর দেন না। আমাদের চলতি ধারণাগুলোর নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে তিনি আমাদের বের করে আনেন, এবং অস্বস্তিতে ফেলে দেন—

    নিজের কাজে সফল হওয়া মানে কি একটা গভীর স্তরে ব্যর্থ হওয়া?
    আর্টফিল্ম কি অনেক বেশি ঝুঁকি নিতে রাজি, বাণিজ্যিক ছবির তুলনায়?
    আমরা কি সারাক্ষণ এই দোলাচলে রয়েছি: কতটা নিজেদের ঐতিহ্যে থাকব, আর কতটা আন্তর্জাতিক ধরনধারনের অংশ হয়ে উঠব?
    আমরা কি দর্শকদের মনঃকষ্ট আর যন্ত্রণা থেকে দূরে সরিয়ে রাখব? তাদের দুর্দশা নিয়ে কথা বলার বদলে, তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে  বিনোদনে মজিয়ে রাখব?
    কেউ কি আদৌ শিল্পের গুণগত মান নিয়ে ভাবে?

    ছবিটা শেষ দৃশ্যেও, নির্দিষ্ট ভাবে কিছু বলে না। দিল্লি স্টেশনে নামতে নায়ককে তার অনুরাগীরা ঘিরে ফ্যালে, আর অদিতিকে যিনি নিতে এসেছেন তাঁর সঙ্গে অদিতি চলে যায়, একবারও পিছনে না তাকিয়ে।

    হয়তো এটা ছিল সত্যজিতের নিজের দিকে তাকাবার, আত্মসমীক্ষার সময়। কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ও নিবেদন ছিল তুলনাহীন। তাঁর ছবিগুলোকে তাই সময় বেঁধে রাখতে পারেনি, সেগুলো কালোত্তীর্ণ হয়েছে। বাংলা ছবিতে তাঁর মতো আর কেউ আসেননি এবং আমরা আজও তাঁর অভাব বোধ করি।

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook