কলকাত্তা… এই জাদুনগরীর কথা ভাবলে, প্রথমেই চলে আসে পার্সি থিয়েটারের স্টেজের স্মৃতি। সেখানে আমার দিদি মুখতার বেগমের গান শুনে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ। মনে পড়ে এমন অনেক পার্টির কথা, যেখানে উপস্থিত থাকতেন কে এল সায়গল, চন্দ্র মোহনের মতো অভিনেতা ছাড়াও বহু বিখ্যাত শিল্পী। আমোদ-প্রমোদ, সঙ্গীত আর শিল্পের প্রতি অফুরান ভালবাসা, সবই ফুটে উঠত সন্ধেগুলোয়।’ কলকাতায় ফেলে আসা দিনগুলির কথা বলছিলেন পাকিস্তানের প্রবাদপ্রতিম গায়িকা ফরীদা খানুম। ‘আমি তখন নেহাতই বাচ্চা মেয়ে। ওইসব পার্টিতে ঢোকার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি ছিল। তাই পর্দার আড়াল থেকে মাঝে মাঝে উঁকিঝুঁকি দিতাম। দেখতাম আমার দিদি, জামাইবাবু হাসান কাশ্মীরি ও তাঁদের বন্ধুরা কীভাবে হই-হুল্লোড় করছেন।’
ফরীদার জন্ম কলকাতায়, শিল্পে নিবেদিতপ্রাণ এক পরিবারে। খুব অল্প বয়স থেকেই সুকণ্ঠী ফরীদা গান দিয়ে তাঁর দিদি এবং গুণীজনদের মুগ্ধ করে রাখতেন। অল্পবয়সেই এমন প্রতিভা দেখে ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খান, ওস্তাদ আশিক আলি খানের কাছে ছোট্ট ফরীদার গান শেখার ব্যবস্থা করে দেন। এর পরই শুরু হয় ‘বাবাজি’র কাছে কঠিন সব রাগের তালিম।
ফরীদার কথায়, ‘তখন হয়তো ইচ্ছে করছে পাশের বাড়ির ছোট ইংরেজ মেয়েটার সঙ্গে একটু সাইকেল চালিয়ে আসি, কিন্তু বাবাজি সেটা হতে দিলে তো!’
বছরগুলো ঘুরতে থাকে। ফরীদার পরিবারও তাঁদের সময় ভাগ করে নেন অমৃতসর আর কলকাতার মধ্যে। কখনও কখনও যাওয়া হত দিল্লিও। ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের সেটা স্বর্ণযুগ। কিশোরী ফরীদা তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওর দৌলতে কাছাকাছি আসছেন কিংবদন্তি গায়িকা সিদ্ধেশ্বরী দেবীর গানের, কখনও বিখ্যাত ওস্তাদদের গান, আবার কখনও বিচিত্রবীণা শিল্পীদের বাজনার। ফরীদা তখনই বুঝেছিলেন সঙ্গীতই তাঁর ভবিষ্যৎ, আর এক দশকের মধ্যে এই তারকাদের তালিকায় তিনিও থাকবেন।
সাতচল্লিশের অগাস্টে সেই সব স্বপ্ন বদলে গেল। ‘আমরা যখন পাকিস্তানের শৈলশহর মররিতে বেড়াচ্ছি, ঠিক তখনই আসে দেশভাগের খবর। যেসব শহরে বড় হলাম, সেই কলকাতা, দিল্লি, অমৃতসর চলে গেল কাঁটাতারের ওপারে, আর যেখানে থিতু হলাম সেই লাহোর আমার কাছে এক অপরিচিত শহর।’ তাঁর প্রজন্মের লক্ষ লক্ষ মানুষের মতো ফরীদা খানুমও চলমান ইতিহাসের এক বোড়ে হিসাবে রয়ে গেলেন। কিন্তু ধন্য, তরুণী এই গায়িকার উদ্যম! নতুন শহরে, নতুন পরিবেশে ঠিক গড়ে নিলেন নিজের চলার পথ।
ফরীদা খানুম বললেন, ‘প্রথম যখন লাহোরে আসি, তখন আমাদের ভাগে পড়ল এক বিরাট হাভেলি। কিন্তু মা তখন একেবারে নিশ্চিত, হাভেলির পিছনের কুয়োতে অতৃপ্ত রুহ (আত্মারা) বাস করে। তাই অপেক্ষাকৃত ছোট একটা বাড়িতে আমরা চলে এলাম।’
জীবনের এই ওঠাপড়া কিন্তু ফরীদা খানুমকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। খুব শীঘ্রই তিনি তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি পেলেন। পাঁচের দশকের গোড়া থেকেই তিনি রেডিও পাকিস্তানের নিয়মিত শিল্পী। তাঁর সমসাময়িক কয়েকজনের মতো, ফরিদ খানুমও বিখ্যাত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের সঙ্গে কাজের মাধ্যমে শিল্পী হিসেবে নিজেকে আরও উন্নত করলেন।
ফরীদা খানুমের কথায়, ‘ফয়েজ সাব-এর সঙ্গে প্রথম দেখা লাহোরের এক অনুষ্ঠানে। সেখানে আমি গেয়েছিলাম তাঁর বিখ্যাত গজল ‘শাম-এ-ফিরাক’। আমার গান ওঁর খুব ভাল লাগে। তখন যৌথভাবে আরও কিছু কাজের জন্য তিনি আমাকে করাচি আসার প্রস্তাব দেন। যদিও আমি তখন কিছুটা ছটফটে স্বভাবের, বুদ্ধিটাও পাকেনি, কিন্তু ফয়েজ সাব-এর মধ্যে এমন একটা গুরুগম্ভীর ব্যাপার ছিল, আর সরকারি আমলারাও তাঁকে এত মান্যিগণ্যি করতেন যে, প্রস্তাবটা আমি নিয়েই ফেলি।’
ফয়েজের বহু গজল গাওয়ার পাশাপাশি, ফরীদা খানুম কবি ও তাঁর স্ত্রী অ্যালিস ফয়েজের সঙ্গে কিছু সুন্দর সময়ও কাটিয়েছিলেন। মৃদু হেসে বললেন, ‘একবার তো গাড়িতে যেতে যেতে আমাকে একটা গজল দিয়ে তিনি বললেন, ‘এটা কিন্তু আজ সন্ধ্যাতেই গাইতে হবে এক অনুষ্ঠানে।’ আমি তো কোনও রকমে, দুদ্দাড়িয়ে তাতে ধুন বসালাম, সন্ধ্যায় গাইলামও।’
একদিকে ফরীদা খানুমের জনপ্রিয়তা যেমন সব সীমানা পেরোল, অন্য দিকে দিনবদলের অভিঘাত তাঁর যাত্রাপথে মাঝে মাঝে বাধাও সৃষ্টি করে। যেমন জেনারেল জিয়া-উল-হকের আমলে পাকিস্তান টেলিভিশনে (পিটিভি) ফরীদা খানুমের অনুষ্ঠান করাই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। অপরাধ? কোনও একটি রেকর্ডিংয়ে তিনি স্লিভলেস পোশাক পরে এসেছিলেন। নিষেধাজ্ঞার পরেও তাঁর অনুষ্ঠানের উৎকর্ষে এবং ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তায় একটুও ভাটা পড়েনি। পরবর্তী দশকগুলিতে ফরীদা খানুমের নাম পাকিস্তানের মার্গসঙ্গীত ও গজলের এক বিশেষ যুগের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে যায়। এই যাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন আসাদ আমানত আলি, ইকবাল বানো, মেহদি হাসান, গোলাম আলি ও আরও কয়েকজন।
সীমানার এপারে, ভারতে, ফরীদা খানুমের গান প্রথম পৌঁছয় পঞ্জাবে, আবছা বুস্টার হুক-আপের সাহায্যে (আটের দশকে ঠিক এই ভাবেই ঢাকার কিছু চ্যানেল পৌঁছে যেত কলকাতার বৈঠকখানায়)। তারপর সেই গান চলে এল ক্যাসেটেও।
‘আজ যানে কি জিদ না করো’র জন্য ফরীদা খানুমের আজ বিশ্বজোড়া নাম। এই আবেগ-গলানো গজলকে বলা হয় ‘পাকিস্তানের প্রেমগীতি’। ফরীদা খানুমের এই গান প্রথম গাওয়া-মাত্রই সেটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। কিন্তু মীরা নায়ারের ‘মনসুন ওয়েডিং’ ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হওয়ার পর এটি ভারতবাসীর মনোজগতেও পাকাপাকি ভাবে স্থান করে নেয়।
আজ ফরীদা খানুমের মূল গানটি যখন ইউটিউব এবং অন্যান্য মিউজিক অ্যাপে সলিটেয়ারের মতো জ্বলজ্বল করছে, একাধিক শিল্পীর গাওয়া এই গানের কভার ভার্সনও জনপ্রিয় হয়েছে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন অরিজিৎ সিং (২০১৩ সালে ‘বরফি’তে অরিজিতের গান শুনে ফরীদা খানুম বলেছিলেন, ‘এই ছেলেই ভবিষ্যতের তারকা’), এ আর রহমান ও শিল্পা রাও।
ফরীদা খানুমের বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ভারতে একবার আসার। সেই স্বপ্ন সফল হয় ২০১৪ সালের কলকাতা লিটারারি মিটে। সেই সাহিত্য উৎসবে যোগদানের পাশাপাশি ফরীদা খানুম শহরে একদিন অনুষ্ঠানও করেন। তবে চার দশক আগে কলকাতার এক বিশিষ্ট নাগরিকের অনুরোধ রাখতে না পারার আক্ষেপ আজও তাঁর মনকে ভারাক্রান্ত করে।
ঘটনাটা এইরকম। ফরীদা খানুম বললেন, ‘যখন ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’র কথা ভাবা হল, তখন সত্যজিৎ রায় চেয়েছিলেন আমি এই ছবিতে গাই। তাঁর ইউনিট যখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে, তখন আমি তো এই সম্মান পেয়ে উত্তেজিতও বটে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ওই মানুষটার সঙ্গে দেখা হবে, তাঁর সঙ্গে কাজ করব! এমন সুযোগ জীবনে একবারই আসে।’ কিন্তু ফরীদার ইচ্ছাপূরণ হয়নি। পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার তাঁকে ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট না দেওয়ায় তাঁর আর সীমানা পেরোনো হয়নি। এর ফলে রবিশঙ্কর, আলি আকবর খান, বেগম আখতার ও বিলায়েত খানের মতো সঙ্গীতগুণী, যাঁরা সত্যজিতের বিভিন্ন ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, সেই তালিকায় ফরীদা খানুমের নাম আর উঠল না।
সেই স্মৃতিই বোধহয় ফরীদা খানুমকে ২০১৪ সালের কলকাতা লিটেরারি মিটে আসতে উৎসাহ জোগায়। আর্থ্রাইটিস, অন্যান্য আধিব্যাধিকে তুচ্ছ করে তিনি এই সাহিত্য উৎসবে আসতে রাজি হন। বাধাবিপত্তি কিছু ছিল বটে, কিন্তু ‘আনে কি জিদ’-এর চালে সবাই মাত। অনিয়মিত উড়ানের ফলে ফরীদা খানুমকে হেঁটে ওয়াঘা সীমান্ত পার হয়ে অমৃতসর পৌঁছতে হয়। বিধাতা বোধহয় চেয়েছিলেন অশীতিপর ফরীদা খানুম তাঁর মেয়েবেলার খেলার মাঠ দুটো আবার একবার ঘুরে আসুন! ‘অমৃতসরে মোটে একদিন ছিলাম। তারই মধ্যে গাড়ি চেপে বদলে যাওয়া শহরটায় খুঁজে বেড়ালাম লুকিয়ে থাকা স্মৃতিগুলো।’ কিছুটা আক্ষেপের স্বরে বললেন ফরীদা খানুম।
এই সফরে ফরীদা খানুমের সঙ্গী ছিলেন তাঁর দুই কন্যা, নাতনি এবং বিশিষ্ট লেখক আলি শেঠি। ফরীদা খানুমের স্মৃতিদর্পণে চোখ রেখে তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁরাও কিছুটা ভাগ করে নেন। অমৃতসরের ঝটিকা-সফর প্রসঙ্গে শেঠি বললেন, ‘এক একটা গলি, রাস্তা দেখিয়ে উনি বলছিলেন, তাঁদের সময় ওখানে কী কী ছিল।’
তবে কলকাতায় ফেরাই ছিল ফরীদা খানুমের বহুদিনের স্বপ্নপূরণ। জানুয়ারির কনকনে ঠান্ডায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে অনুষ্ঠিত সাহিত্য উৎসবের এক সন্ধ্যায় ভক্তদের মুখোমুখি হন তিনি। পরদিন জি ডি বিড়লা সভাঘরে শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রাখেন তাঁর অনায়াস গায়নভঙ্গি, রসিক মন আর লাবণ্য দিয়ে।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ঘাসে পা ফেলা, চৌরঙ্গি-ময়দান দর্শন গানের এই কিংবদন্তিকে যেন আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছিল। স্মৃতির বন্যায় ভেসে গেল সফরের ক্লান্তি, রাজনৈতিক মিছিল নিয়ে বিশৃঙ্খলা, এমনকী আর্থ্রাইটিসের ব্যথাও। যুগ যুগ বাদে ঘরে ফেরার অভিজ্ঞতা কখনও কি ভোলা যায়? এখনও পর্যন্ত শেষবার গজলের রানি যখন ভারতে অনুষ্ঠান করতে আসেন, সেটা হয়েছিল তাঁর জন্মস্থান কলকাতাতেই।