আই অ্যাম আ সিম্পল গার্ল, হিয়ার ফর হার্মলেস ফ্রেন্ডশিপ। নো হুক-আপ, নো ONS। মেয়েটাকে দেখতে ভাল লাগছিল বাপিনের। As opposed to harmful friendship? বাপিন হেসে ফেলল। একবার চোখ বন্ধ করে ভাবার চেষ্টা করল, মেয়েটা কী করছে এখন? ‘সিম্পল’ মানুষরা কী করে সারাদিন, বাপিন ঠিক জানে না। নিজেকে ওর কখনও সিম্পল মানুষ মনে হয়নি। সে সাতপাঁচ ভাবে, ভেবে ভেবে ঘোঁট পাকিয়ে ফেলে মাথার ভেতর।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ পেরিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিল যখন, তখনও স্টেডি প্রেম ছিল না বাপিনের। তখন কিন্তু সে ডেটিং অ্যাপে ঢোকেনি, ঢুকেছিল ম্যাট্রিমনিয়াল সাইটে। বাংলা বাজারে এটা খুব হয়, বাড়িতে দুয়েকটা হাইভোল্টেজ ইমোশনাল এপিসোডের পরে ছেলেমেয়েরা অবধারিত ম্যাট্রিমনিয়াল প্রোফাইল খোলে, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘এই বাড়িতে চাপ দিচ্ছিল, বুঝলি না?’ তবে সে রাস্তা আসলে এক ওয়ান-ওয়ে বোবা টানেল, যার অন্যপ্রান্তে কী, না কনে দেখা আলো। সে আলো দিনের না ট্রেনের, সে কথা পরে। বাপিনের বিয়ে এক বছরের বেশি টেকেনি। এরপর মাস ছয়েকের দীর্ঘশ্বাস পেরিয়ে, গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে, ফোনে টিন্ডার ইনস্টল হল। নিয়ম খুবই সোজাসাপ্টা, পর পর প্রোফাইল আসবে, ভাল লাগলে ডানদিকে সোয়াইপ, অপছন্দে বাঁদিক। যুগপৎ Right Swipe হলে ম্যাচ।
প্রথম যে মেয়েটার সাথে ম্যাচ হল, তার প্রোফাইলে শুধু লেখা, ‘আই লাভ বুকস’। ব্যাস। আড়ষ্ট হাইহ্যালোর পর সেই অমোঘ ফিলার— হোয়াই টিন্ডার? তা সে বলল, সে সদ্য সেপারেটেড, জাস্ট ফ্রেন্ডশিপ, আর কিচ্ছু না। বাপিন দুয়ে দুয়ে চার করল। জাস্ট ফ্রেন্ডশিপ, লাভ বুকস। অতএব সে আর এরপর নিজে থেকে বই ছাড়া কোনও কথাই তোলেনি। অমুক বইটা পড়েছিলাম কিন্তু ঠিক বুঝিনি, তমুকটা বুঝেছি কিন্তু ভাল্লাগেনি, এরকম দুয়েকদিনের পর মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, শুধু বই নিয়ে কথা বলো কেন? বা রে, তুমি যে বললে? আমি তো বলেইছিলাম প্রেম খুঁজতে এসেছি, তুমিই তো বললে?
প্রোফাইলে একটা লাল গোলাপ কি গাছের পাতায় শিশির কি মারকাটারি সূর্যাস্তের ছবি, আর কোথাও কোনও লেখা নেই। অনেকেরই নামে শুধু আদ্যক্ষর আর বয়স— ‘A, 29’… ‘R, 32’ এইরকম হাজার হাজার প্রোফাইল। তাসের দেশের কথাই মনে পড়ে। এইগুলো ডেটিং সাইটের ‘noise’, পেরিয়ে যেতে হয়। লেফট সোয়াইপ করে করে আঙুলে ক্র্যাম্প, কিন্তু এ পুজোর এই-ই মন্ত্র। পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন। মাঝে মাঝে মজা হত, পর পর লেফট সোয়াইপ করতে করতে অভ্যেসবশে কোনও একটা ভাল প্রোফাইল লেফট সোয়াইপ হয়ে গেলে কী আফশোস! যাঃ, যদি তারে না-ই চিনি গো, সে কি…
এরপর কয়েকমাসে টিন্ডারের গলিঘুঁজি কিছুটা চেনা হল। বাপিন লক্ষ করল, অনেকেই দু’চার কথার পরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। প্রথমদিকে এটায় ওর রাগ ধরত, এত কম কথায় কী করে বুঝল যে হবে না? পরে জানল, একে বলে গোস্টিং (ghosting), লোকে বিভিন্ন কারণে করে, মূলত সময় বাঁচায়। হয়তো একবারে পাঁচজনের সঙ্গে কথা হচ্ছে, দুজনকে রেখে বাকি তিনজনের সঙ্গে হঠাৎ কথা বন্ধ। ক্রমে সয়ে গেল, গায়ে মাখত না আর। এক-দু’বার সেও করেছে। পরে একটা মেয়ের সঙ্গে এই নিয়ে কথাও হয়েছিল। ডেটিং অ্যাপে ছেলের সংখ্যা মেয়েদের অনুপাতে অনেক বেশি, অতএব ছেলেদের যদি সপ্তাহে দুটো ম্যাচ হয় সে-ই অনেক। মেয়েদের দিনে ত্রিশটা ম্যাচ, তার মধ্যে আঠাশ জন প্রিডেটর, তাদের ফেলে বাকি দুজনকে ছেঁকে তোলা, এসব অনেক খাটনি, গোস্টিং ছাড়া ম্যানেজ করা যায় না। বাপিন হাঁ হয়ে গেছিল। অল বিজনেস, নাথিং পার্সোনাল?
একটা গোস্টিং-এর কথা অবশ্য ওর এখনও মনে আছে। সে মেয়েটা খুব সদ্য সম্পর্ক থেকে বেরিয়েছিল, ফোনে এক-দু’বার কথা বলেই বাপিনকে তার নাকি দারুণ ভাল লেগে গিয়েছিল, মানে এতদিন বাপিনের মতো কাউকে পায়নি ইত্যাদি। এরপর রোজই দিনে দু’বার করে হোয়াটসঅ্যাপ, ‘খেয়েছ?’ বা ‘কী খেলে?’ দুয়েকদিন বাদে দেখা গেল, সে ফোন তুলছে না, সারাদিনে অন্য কথাও বলছে না, শুধু ওই দিনে দু’বার ‘খেয়েছ?’ বলে মেসেজ। বাপিন ভাবে, হলটা কী! পরে সে একবার লিখেছিল, অ্যাকিউট অ্যাংজাইটি ডিজর্ডার হয়েছে তার, ফোনে কথা বলা অসম্ভব, এক সপ্তাহ পর সাইকায়াট্রিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এর একদিন পর সে অদৃশ্য হয়ে যায়, আর ফেরেনি।
মাঝে ক’দিন OkCupid-এ ছিল বাপিন। সে অ্যাপে আবার ওরাল পরীক্ষার মতো গাদা প্রশ্নের উত্তর দিতে হত। যত উত্তর, তত ভাল ম্যাচ হবে নাকি। নিজেকে মেলে ধরে তবে তো প্রেম। দ্বীপে একাকী আটকে পড়লে কী বই সঙ্গে থাকবে? ডিসেম্বরের শুক্রবার রাতে কি ডিস্কো যেতে ভাল্লাগে, না কি কম্বলের তলা থেকে মাথা বের করে নেটফ্লিক্স দেখতে? রবিবার দুপুরে পাঁঠার মাংস, না লন টেনিস? এইরকম। জুকুবাবুর ফেবু-র দোকানের থেকেও মারাত্মক ডেটা কালেকশন স্কিম সব। তা এতসব পার করে যে-মেয়েটার সঙ্গে বাপিনের চুরানব্বই শতাংশ ম্যাচ হল, দেখা গেল তার প্রোফাইল ম্যানেজ করেন তার বাবা। মেয়ের বিয়ের জন্য তিনি ছেলে খুঁজছেন। এটা খুব সম্ভব বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু বাপিনের মনে তা গভীর রেখাপাত করেছিল। এই ধাক্কা সামলাতে না পেরে সে এর পরেই অ্যাপ ডিলিট করে ফোন থেকে।
কালে কালে এল বাম্বল। এটার হলুদবরণ User Interface, দেখতে শুনতে বাকি অ্যাপের চেয়ে ঝকঝকে। একটু এলিট অ্যাপ এটা, এখনও রামশ্যামযদুমধু সব্বাই এসে মেট্রোরেলকে লোকালট্রেন করে দেয়নি। তার উপর এই অ্যাপে শেষ কথা বলে মেয়েরা। ম্যাচ হওয়ার পরে প্রথম কথা শুরু করতে পারে মেয়েরাই। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কথা শুরু না করলে অটোমেটিক আনম্যাচ। কথা শুরু করার চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর না দিলেও তা-ই। প্রায় যাকে বলে গানপয়েন্টে প্রেম।
অনলাইন ডেটিং এক ধরনের অভিজ্ঞতালব্ধ দক্ষতা, এখন বোঝে বাপিন। এই জন্যই বলে ‘প্রেম করা’। প্রথমদিকে থই পেত না, আজকাল সেও বেশ কথার পিঠে কথা চালে, চ্যাট থেকে ফোন পেরিয়ে সাক্ষাৎ, দৈহিক ঘনিষ্ঠতা, ব্রেক-আপ— সবই হয়েছে। এরও ব্যাকরণ আছে, স্টেপ-জাম্প করা বারণ। ফোনে বেশি চ্যাট করলে বাপিনের চোখ ব্যথা করে, কিন্তু তাই বলে শুরুতেই ফোন নাম্বার চাইলে অনেকে বিরক্ত হয়। এইসব কারণেই কি না কে জানে, আজকাল ডেটিং অ্যাপে ফোন নাম্বার না দিয়েই কল করা যায়। ফোন বা অ্যাপ যা-ই হোক, স্রেফ কথোপকথন বেশিদিন চালানোর অন্য বিপদ আছে। মানুষ ত্রিমাত্রিক, তার ব্যক্তিত্ব মুদ্রাদোষ বাচনভঙ্গি সবকিছু ফোনে ধরা পড়ে না, ভিডিও কলেও না। অনেক সময় ফোনে যার প্রেমে পড়েছে, দেখে তাকে চিনতে পারেনি বাপিন। প্রথমবার দেখা করার আগেও কত কী ভাবতে হয়। এমন জায়গা হলে ভাল যেখানে দু’দণ্ড বসে কথা বলা যায়, মারাত্মক ভিড় নেই, আবার বেশি নির্জনও নয়। কথা বেশি না এগিয়ে থাকলে, প্রথম ডেটে নাটক কি সিনেমা দেখতে গেলেই ভাল, ইন্টারভ্যালের দশ মিনিটে অন্তত কথা ফুরিয়ে যাওয়ার ভয় নেই। গেলেও আর কিছু না-হোক সিনেমা নিয়ে কথা বলা যাবে। সেসব আবার করোনাকালে বন্ধ, তাই সবেধন নীলমণি অমুক ক্যাফে, বা তমুকদার চায়ের দোকান কেন্দ্র করে হাঁটাহাঁটি।
এসব কি আর ফেসবুক হোয়াটস্যাপের মাধ্যমে হত না? সে হবে না কেন, কিন্তু ডেটিং অ্যাপে ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা কম। বাপিন একবার ফেসবুকে একজনকে কফি খেতে যাবে কি না জিজ্ঞেস করেছিল, সে বলেছিল হ্যাঁ। দুয়েকবার কফি খাওয়া হলে বুঝেছিল, কফি মানে কফিই। ডেটিং অ্যাপে সেসব লুকোচুরি নেই, কী চাই তা অস্ফুটে না তুতলে মুখ ফুটেই বলা যায়। ‘লুকিং ফর আ রিলেশনশিপ’ থেকে ক্যাজুয়াল ডেটিং, সবই।
তবে ক্যাজুয়াল বললেই কি ক্যাজুয়াল? বাপিনের অভিজ্ঞতা বলে, বেশিরভাগ সময়েই একপক্ষ অবধারিত ক্যাজুয়াল্টি। বাইরে থেকে যত আলগা মনে হয়, কার্যক্ষেত্রে অনেক সময় তা হয় না। তাছাড়া ক্যাজুয়ালের অন্য ফ্যাকড়াও আছে। মন নিয়ে কারবার কম, অতএব শারীরিক দক্ষতা সর্বদা শানিয়ে রাখতে হয়, কারণ তানানানা করার সময় নেইকো। বাপিন একবার দুঃসাহসী অ্যাডভেঞ্চারের বশবর্তী হয়ে এক ম্যারাথনার-কে ক্যাজুয়াল ডেট করেছিল। কোনও এক আবেশঘন মুহূর্তে সে একলাফে দু’পায়ে বাপিনের কোমর জড়িয়ে ধরে। বাপিনের ভেতোবাঙালি কোমর সে চাপ নিতে পারেনি, ‘এই, এই, বেকায়দা খ্যাঁচ লেগে যাবে’ বলে আর্তনাদ করে সে সটান সোফায় পড়ে গেছিল। এরপর চারদিন ভলিনি-আর্নিকা করে তবে নিস্তার পায়। মেয়েটা খুবই হতাশ হয়েছিল, বাপিনকে কোর স্ট্রং করার উপদেশ দিয়েছিল মুখ আঁধার করে। কিন্তু এই ধর-তক্তা-মার-পেরেক পলিসি বেশিদিন বাপিনের ধাতে সহ্য হয়নি। অতএব ফের সন্ধান।
মানুষ যদি বই হয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় মূলত তার মলাট-টাই থাকে, রংবেরং-এর ছবিসহ। অনলাইন ডেটিং এর প্রথম ধাপে প্রায় পুরোটাই যেন দুই বইয়ের মলাটে-মলাটে কথোপকথন। এরপর ব্লার্ব, ভূমিকা পেরিয়ে উপন্যাসের প্লট অবধি পৌঁছনো হয় কমই। পাড়ার সীমিত লাইব্রেরির সঙ্গে কিন্ডল-এর যা তফাত, গণ্ডিবদ্ধ আদি প্রেমের সঙ্গে অনলাইন ডেটিং-এর ফারাকও খানিকটা তা-ই। দুশো বই নখাগ্রে থাকলে দেখা যায়, কোনওটাই এক প্যারার বেশি পড়া হয়নি। অ্যামাজন বা ফ্লিপকার্টের মতোই সারে সারে ক্যাটালগ সাজানো, চেনা অচেনা আধচেনা রঙিন সাদাকালো সিপিয়া ছবির সারি, কিন্তু তুমি কি কেবলই ছবি?
অনলাইন ডেটিং এসে প্রেমের প্রক্রিয়া সরল হয়েছে, কিন্তু মানুষমাত্রেই তো আর অঙ্ক নয়। বাপিনের মাঝে মাঝে মনে হয়, তার সঙ্গে যাদের দেখা হয় এই গলতায়, তারা যেন সব বাপিনেরই প্রতিচ্ছবি! একই ইকো চেম্বারের লোকজন, প্রোফাইলে পরিচয় ‘লেফট’, ‘লিবার্যাল’, ‘অ্যাগনস্টিক’ কি ‘আথিয়িস্ট’, হ্যানাত্যানা। একই ধাঁচের চিন্তা, প্রায় একই ক্রাইসিস সবার, কতবার দেজা-ভ্যু হয়েছে ওর, কোনও একটা কথা বলতে গিয়ে! আর প্রেম ভেঙে যাওয়া? সেও গুলিয়ে যায়, এতটাই একরকম সেগুলোও। আরও একটা মানুষকে কাছ থেকে না চিনতে পারার দুঃখ নিয়ে বসেও থাকা হয় না বেশিক্ষণ, ট্রিং শব্দে মধ্যরাত্রে বেজে ওঠে ফোন, অবধারিত নোটিস পাঠায় টিন্ডার বা বাম্বল। ‘পুকুরে আরও মাছ আছে, ক’দিন ছিপ ফেলছ না দেখছি?’
বাপিনদের কর্পোরেট চাকরিতে সপ্তাহে পাঁচদিন কাটে এক্সপ্রেস ট্রেনের গতিতে। উইকএন্ড এলেই মাথায় ঘুরতে থাকে, দু’দিনে দুশো মজা করে ফেলতে হবে, নইলে ওই সোমবার আসছে তেড়ে। টাইম ইজ মানি, এই দর্শন সপ্তাহ পেরিয়ে সপ্তাহান্তেও থাবা বসাচ্ছে, সে বেশ বুঝতে পারে। যে-সময়কে পুঁজিতে বদলে ফেলা যায় না, তার দাম নেই। এই ক্রমাগত মানুষকে আলগোছে বাজিয়ে নেওয়া, কখনও বেশ ক্লান্তিকর ঠেকে। কলেজে শমীকদা একবার বলেছিল, ‘মানুষ আসলে সারাদিন ক্যালরব্যালর করতে চায়।’ সে চাইলেই আর দিচ্ছে কে?
দিনের শেষে ফোন হাতে এই নিয়মিত রিচুয়াল, অন্ধকার ঘরে বিভিন্ন হাসিমুখের আলো পড়ে বাপিনের মুখে। সেও ডানদিক-বাঁদিক চালে। কোনও এক ফাঁকে মনে পড়ে যায়, কলেজে প্রথম যে-মেয়েটার হাত ধরেছিল? কান মাথা ভোঁ-ভোঁ, হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক অবধি স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিল, সে শব্দ তার না নিজের, এতদিন পরে আর খেয়াল নেই।
কই, সেইরকম আর কখনও হয়নি তো?