ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • এসো তবে, মারো


    সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় (April 24, 2021)
     

    ২০০৪ সালের জুলাই মাসের এক সকালে একদল মাঝবয়সি মহিলা থানার সামনে নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে। তাঁদের অনেকের শরীরেরই ছাঁদ সমাজের মতে বেঢপ, কেউ বেশ মোটা, অনেকের লোল চর্ম, খোলা চুল, কুঁচকে যাওয়া মুখের চামড়া, লালিত্যের লেশমাত্র নেই, আর তাঁদের উন্মুক্ত স্তন এবং নিতম্ব দেখলে বেশ ঠাহর করা যায় তাঁরা বিগতযৌবনা। হ্যাঁ, তাঁরা নগ্ন, প্রকাশ্য দিবালোকে, জনসাধারণের সামনে, মিডিয়ার সামনে, পুলিশ থানার সামনে— তাঁরা গোঙাচ্ছেন আর গগনভেদী চিৎকার করে বলছেন— ইন্ডিয়ান আর্মি! রেপ আস! কিল আস! আমরা সবাই থাংজাম মনোরমার মা, এসো আমাদের ধর্ষণ করো, আমাদের মারো!

    ১৬ জুলাই ২০০৪ সালে সারা ভারতের মিডিয়ায় দেখা গিয়েছিল ইম্ফলের কাংলা ফোর্টের সামনে দাঁড়িয়ে ১২ জন মনিপুরী মহিলা বিবস্ত্র হয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। প্রতিবাদ কেন? কারণ ১০ জুলাই উগ্রপন্থী সন্দেহে থাংজাম মনোরমা নামের অল্পবয়সি একটি মেয়েকে অসম রাইফেলস-এর পুলিশকর্মীরা বাড়ি থেকে মাঝরাতে তুলে নিয়ে যায়। দিন তিনেক বাদে তার বাড়ি থেকে দূরে মনোরমার ধর্ষিত এবং ছিন্নভিন্ন দেহ পাওয়া যায়। তার যোনিতে মেলে বুলেটের চিহ্ন, তার উরুতে মেলে ছুরি চালানোর গভীর ক্ষত। মনোরমার দেহ যারা দেখেছিল, তারা শিউরে উঠেছিল নৃশংসতার বহর দেখে। কতটা অমানুষ হলে হিংসা আর নৃশংসতাকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায়, সেকথা ভেবেই কেঁপে উঠেছিল বহু নারীর অন্তরাত্মা। সেইসব মেয়েদের মধ্যে ১২ জন সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। যে সেনাবাহিনীর সম্পূর্ণ অধিকার আছে, যে কোনও সিভিলিয়ানের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার। বিশেষত, ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোয় এবং কাশ্মীরে। মহামান্য সরকার তাদের এই রকম অধিকার দিয়ে রেখেছে। কারণ আফস্পা বলে একটি আইন প্রয়োগ করা আছে এই সব রাজ্যে। যে-আইনে ভর করে, আইনটিকে অপব্যবহার করতে চাইলে, সেনাবাহিনী যে-কোনও সাধারণ নাগরিককে উগ্রপন্থা ও রাজদ্রোহের অপরাধে যখন-তখন যা খুশি করতে পারে। যা খুশি, যেমন খুশি— গো অ্যান্ড ডু, অ্যাজ ইউ লাইক!

    একবার ভেবে দেখতেই হবে, যন্ত্রণা কত তীব্র হলে মেয়েরা তাঁদের শরীর উন্মুক্ত করে আহ্বান করতে পারেন অত্যাচার। যন্ত্রণা কত তীব্র হলে তাঁরা মান-সম্মান, লজ্জা-সজ্জা ত্যাগ করে, ব্যাপারটার শেষ দেখতে চান, এতটা মরিয়া হয়ে ওঠেন ন্যায়ের আশায়। ন্যায় না পেলেও, অন্তত অন্যায়কে সর্বসমক্ষে তুলে ধরার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চান। যেখানে তাঁদের নিজেদের জীবনের মূল্য, ভালবাসার হাতছানি, সন্তানের প্রতি মায়াকে তুচ্ছ করে প্রতিবাদ করতে উদ্যত হন, প্রতিবাদকে প্রতিষ্ঠা করতে চান রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে শেষ অস্ত্র হিসেবে।

    ফের মণিপুর। ফের প্রতিবাদ। এবার অনশন। ইরম চানু শর্মিলা। ১৬ বছর অনশনে ছিলেন। কেন? ওই যে, ভারতীয় সেনার দুগ্ধপোষ্যরা খামখাই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা সাতজনকে গুলি করে মেরে দিয়েছিল। সন্দেহের বশে। রাষ্ট্রের প্রমাণ দরকার হয় না, রাষ্ট্রের সন্দেহই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ইরম অনশন শুরু করলেন আফস্পা আইনের বিরুদ্ধে। তাঁকে আত্মহত্যা করতে চাওয়ার চেষ্টায় গ্রেফতার করা হল, কিন্তু কোনও সরকারই আফস্পা আইনটি তুলে নিল না। জেলে ইরমকে নাকে নল দিয়ে খাওয়ানো হত। জেল থেকে ছাড়া পেলেই ইরম ফের অনশনে বসতেন। ফের তাঁকে গ্রেফতার করা হত, ফের নাকে নল দিয়ে খাওয়ানো। এমন করে ১৬টা বছর চলেছিল। শেষে ইরম বুঝেছিলেন, একার চেষ্টায় একটা আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা যাবে না। তাই ইরম ২০১৬ সালে অনশন ভঙ্গ করে রাজনীতিতে যোগ দেন, চেষ্টা করেন রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে থেকে যদি কিছু করা যায়। কিন্তু ভোটে হেরে যান ইরম। যাঁদের জন্য লড়েছিলেন, সেই সাধারণ মানুষ হারিয়ে দেন ইরমকে। ইরমের ১৬ বছরের তপস্যা সফল হয়নি, কিন্তু তাঁর প্রতিবাদের মূল্য একটুও কমেনি।

    এবার একটা বিদেশি প্রতিবাদের কথা বলি। সালটা ১৯৬৮। স্থান আমেরিকা। সেই আমেরিকা, যেখানে তখন সিভিল রাইটস আন্দোলন চলছে। আমেরিকার সিভিল রাইটস কিন্তু ফেমিনিস্ট আন্দোলনকে তখন তেমন করে এগিয়ে দেয়নি বা সঙ্গে নেয়নি। তাই মেয়েদের অধিকার, নারীমুক্তি, নারী-স্বাধীনতার কথা চাপা পড়ে গিয়েছিল। নারী-আন্দোলন আমেরিকায় তেমন ভাবে লোকের নজরে আসছিল না। এই সময় মিস আমেরিকা বিউটি পেজেন্ট-এর সময় এক অভিনব প্রতিবাদ নিয়ে আমেরিকার মেয়েরা হাজির হলেন আটল্যান্টিক সিটি, নিউ জার্সি ব্রডওয়াক-এ। প্রায় ২০০ জন মেয়ে ৭ সেপ্টম্বর ১৯৬৮ সালে জড়ো হয়ে ‘ফ্রিডম ট্র্যাশ ক্যান’ অর্থাৎ নারী-স্বাধীনতায় বাধা দেয় এমন জিনিসকে ছুঁড়ে ফেললেন জঞ্জালের পাত্রে। কী কী মেয়েরা ছুড়ে ফেলেছিলেন? মেয়েলি সব প্রসাধন, হেয়ার স্প্রে, নকল চোখের পাতা, চুলের কার্লার, ঘর মোছা ন্যাতা, এবং হ্যাঁ, অন্তর্বাস-ও। এবং শেষের ব্যবহার্য বস্তুটির জন্যই এই আন্দোলনটির নাম হয়ে যায় ‘ব্রা বার্নিং প্রোটেস্ট’।

    কিন্তু এই সব ছুড়ে ফেলে মেয়েরা কী বোঝাতে চাইছিলেন? বোঝাতে চেয়েছিলেন, সমাজের বেঁধে দেওয়া নিয়ম বা পরিভাষা মেনে মেয়েরা বাঁচবে না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ঠিক করে দেবে না, মেয়েরা কেমন দেখতে হবে, কেমন পোশাক পরবে, কেমন করে ঘরকন্নার কাজ করবে, অর্থাৎ কিনা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মনোমত হয়ে উঠবে। এসব থেকে মুক্তির চিহ্ন হিসেবে মেয়েরা এইরকম অভিনব পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় মিস আমেরিকায় সুইমস্যুট রাউন্ডে এমন নির্দিষ্ট কিছু শারীরিক পরিমাপকে উদযাপন করা হত, যা মেয়েদের শরীরকে কেবলমাত্র একটি যৌনবস্তু হিসেবে দেখার দিকেই সকলের নজরকে ঠেলে দেয়। তবে সত্যি কথা বলতে, সে নজর আজও বদলেছে কি না কে জানে!

    ভারতেও এমন ধরনের একটি ক্যাম্পেন হয়েছিল বটে। ‘পিঙ্ক চাড্ডি ক্যাম্পেন’। কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোর শহর থেকে শুরু হয়েছিল এই ক্যাম্পেন। এই ক্যাম্পেন শুরু করেছিল, ‘কনসর্টিয়াম অফ পাব গোয়িং লুজ অ্যান্ড ফরওয়ার্ড উইমেন’। ২০০৯ সালে শ্রীরাম সেনা দলের নেতা প্রমোদ মুথালিক বলেছিলেন, যদি ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে-তে ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে ঘুরতে দেখা যায়, তাহলে তাঁর দলের লোকেরা হলুদ ও মঙ্গলসূত্র নিয়ে ঘুরবে এবং এরকম ছেলেমেয়েদের তৎক্ষণাৎ বিয়ে দিয়ে দেবে। এর আগে ওই বছর জানুয়ারি মাসে একদল মেয়ে একটি লাউঞ্জ-বার’এ একদল ছেলে একদল মেয়েকে হেনস্থা করে। মেয়েদের দোষ ছিল, তারা পাব-এ বসে মদ খাচ্ছে। এমন ব্যবহার ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী এবং চরিত্রহীন মেয়েরাই এমনটা করে, এই মত পোষণ করেছিলেন নেতা প্রমোদ মুথালিক। ভারতীয় মেয়েদের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এই মেয়েরা। তাঁর এই মন্তব্যের প্রতিবাদে দিল্লির সাংবাদিক নিশা সুসান, মিহিরা সুদ, জসমিল পথেজা, ইশা মনচন্দা একটি ক্যাম্পেন শুরু করেন। তাঁরা দাবি করেন, অহিংসার পথ ধরে তাঁরা এই ক্যাম্পেন করবেন। তাঁরা ফেসবুকে আবেদন জানান, ১৪ ফেব্রুয়ারি যেন প্রমোদ মুথালিকের অফিসে প্রতিবাদ হিসেবে গোলাপি প্যান্টি বা চাড্ডি পাঠানো হয়। এই প্রতিবাদে সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু বহু মানুষ— কেবল মেয়েরা নন কিন্তু— প্রমোদ মুথালিকের অফিসে পিঙ্ক চাড্ডি পাঠিয়ে দেন। এই প্রতিবাদের মূল বক্তব্য ছিল, ভারতীয় মেয়েদের একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বেঁধে দিয়ে সেটাকে ভারতীয় ঐতিহ্য হিসেবে চালানোন নারীদের দমিয়ে রাখার উপায় মাত্র। নারী-স্বাধীনতার বিরোধী।

    তবে এই প্রতিবাদ সমালোচিতও হয়েছে অনেক। নারী-স্বাধীনতার মতো বৃহত্তর একটি বিষয়কে এমন একটা ছেলেমানুষি, সস্তার স্টান্ট নাকি লঘু করে দেয়। হয়তো এই সমালোচনারও কিছু যুক্তি আছে।

    তবে এই ঘটনাগুলো থেকে যা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তা হল, অনেক সময় হয়তো প্রতিবাদকে এমন রাস্তা ধরতে হয়, যা প্রচলিত নয়। আলোচনা, অহিংসা, বক্তৃতা, জমায়েত, বিক্ষোভ প্রদর্শন দিনের পর দিন, বছরের পর বছরও যখন সরকার বা সমাজের দৃষ্টিগোচর হয় না, তখন একটা বড় নাড়া দিতে প্রয়োজন হয় এমন কিছু পন্থার, যা সাধারণত দেখা যায় না। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তখন সেই কাজ করে, একটা ঝাঁকুনি দিতে হয় মিডিয়াকে, সমাজকে। এই সবগুলো প্রতিবাদই যে অভীষ্ট ফল পেয়েছে এমন নয়, কিন্তু এই প্রতিবাদের অভিঘাত যে কম নয়, তা বোঝা গেছে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান থেকে। আর বোঝা যায়, যখন লিখতে বসে, ভাবতে বসে, বিভিন্ন আলোচনায় এই প্রতিবাদগুলোর কথা, ছবি ঘুরেফিরে আসে, এবং নিঃসন্দেহে তার বহিরঙ্গের চমকের সঙ্গেই, অন্তরের বক্তব্যও অনেকটাই মানুষের ভেতরে চারিয়ে দেয়।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook