আজ সকালেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা ‘লিস্টিক্ল’ বা তালিকা-প্রবন্ধ দেখলাম, যার শিরোনাম ‘পঞ্চাশজন মহিলা, যাঁরা পুরুষতান্ত্রিক বিষয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন যা এখনও স্বীকৃত।’ টোপ গিলে ফেললাম, এই ভেবে— ব্যাপারটা কত আর খারাপ হবে? ইন্টারনেটে অনেক বিষয় নিয়েই একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে থাকে। কিন্তু আমি একেবারেই ভুল ভেবেছিলাম। একটা টুইট-এ কৌতুকাভিনেত্রী আইলিন মেরি ও’কনেল লিখছেন, ‘একবার আমি বলেছিলাম, মারি ক্যুরি (পৃথিবীবন্দিত ফরাসি বৈজ্ঞানিক) আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন, এবং এক যুবক এসে শুধরে দিয়েছিলেন, উচ্চারণটা হবে, মারিয়া ক্যারি (আমেরিকান পপ গায়িকা)’। তালিকাটা এটাই প্রমাণ করে যে আমরা কত কম এগিয়েছি, সমাজ হিসাবে, পুরুষ হিসাবে, এবং আরও গুরুত্বপূর্ণভাবে, নারী হিসাবে।
মার্চ ৮ প্রায় এসে পড়েছে, এবং তার সঙ্গে প্রতীকী নারীবাদের ঢেউও উপচে পড়ল বলে। মহিলাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এই দিনের মূল উদ্দেশ্য লিঙ্গসাম্যের প্রতি মনোযোগ এবং লিঙ্গবৈষম্য মুছে দেওয়ার প্রচেষ্টাকে তরান্বিত করা।
‘আইনের চোখে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও রাজ্যে লিঙ্গের কারণে সমতার অধিকার খারিজ বা সংক্ষিপ্তকরণ গ্রাহ্য হবে না। কংগ্রেস এই আইনের ধারার বিষয়গুলি কার্যকর করার ক্ষমতা রাখবে’— ইকুয়াল রাইটস অ্যামেন্ডমেন্ট, বা ই.আর.এ-র এই সংস্করণ কংগ্রেসে পাশ হয়েছিল ১৯৭২ সালে, কিন্তু ৫০-এর মধ্যে ৩৮-টা রাজ্যে। ২০২১-এও, যুক্তরাষ্ট্রে ১২টা রাজ্যে এই ই.আর.এ অনুমোদন পায়নি, এবং তাই আইন হয়ে ওঠেনি।
‘মিসেস আমেরিকা’ ওয়েব সিরিজটির গল্প গড়ে উঠেছে ইকুয়াল রাইটস অ্যামেন্ডমেন্ট-এর অনুমোদনের ইতিহাস এবং এর বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধ নিয়ে। গল্পের উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই অ্যামেন্ডমেন্টের প্রতিরোধ অনেকটাই করেছিলেন নারীরা। ‘ম্যাড মেন’ টেলিভিশন সিরিজ-খ্যাত প্রযোজক ডাহভি ওয়ালারের লেখা এই ন’পর্বের মিনি সিরিজ কিছু অসাধারণ অভিনেতাদের ব্যবহার করেছে। সিরিজে উঠে এসেছে সেকেন্ড ওয়েভ ফেমিনিস্ট তারকা গ্লোরিয়া স্টাইনেম, বেটি ফ্রিডান এবং বেলা অ্যাবজুগ বনাম ‘স্টপ ই.আর.এ’ (S.T.O.P. ERA) দলের ফিলিস স্খলাফ্লাই (Schlafly)-এর লড়াই।
‘মিসেস আমেরিকা’ বিশেষত স্খলাফ্লাই-এর চরিত্রের দ্বন্দ্বে অসাধারণ আলোকপাত করে। ‘দ্য ফেমিনিন মিস্টিক’-এর লেখিকা বেটি ফ্রিডান, যাঁকে মার্কিন নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ-এর জননী বলা হয়ে থাকে, হেলায় জিজ্ঞাসা করেন, ‘এই ফিলিস স্খলাফ্লাই কে হে?’ জিল রুকেলশাউস এবং বেলা অ্যাবজুগ তৎক্ষণাৎ ফিলিস-এর বিষয়টা উড়িয়ে দেন, তাঁকে ‘প্রান্তিক’ আখ্যা দিয়ে।
কিন্তু আমরা দেখি, ফিলিস আর যা-ই হোন, প্রান্তিক নন। একাধারে নিখুঁত গৃহবধু— একনিষ্ঠ স্ত্রী, ছ’সন্তানের আদর্শ মাতা— কিন্তু অন্যদিকে তাঁর আছে রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষিত মতামত। যে মুহূর্তে এই মতামতগুলোকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয় না, ফিলিস ঘুরে দাঁড়ান এবং ই.আর.এ-র বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। আমরা যখন তাঁকে প্রথম চিনি, দেখা যায় তিনি ই.আর.এ সম্বন্ধে অতটাও বিচলিত নন। এমনকী, সেই সময়, ১৯৭১ সালে, ই.আর.এ-র প্রতি সমর্থন ছিল রিপাবলিকান এবং কনজার্ভেটিভ, দুই রাজনৈতিক দলেরই বেশ কিছু নেতার। ফিলিসের মনোযোগ তখন আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের উপর। কিন্তু গৃহিণীদের প্রতি তাঁর ডাক, ইকুয়াল রাইটস অ্যামেন্ডমেন্ট-এর বিরুদ্ধে তাঁর পাঠানো সংবাদচিঠির মাধ্যমে— যার নাম ফিলিস দিয়েছিলেন ‘স্ত্রী-এর অধিকার’— ই.আর.এ-র অগ্রগতি থামিয়ে দেয়।
এক ইস্পাতকঠিন অবিচলতা নিয়ে ফিলিস-এর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দু’বার অস্কার-বিজয়ী কেট ব্ল্যানচেট। তিনি খেয়াল রেখেছেন, যাতে চরিত্রটি নারীবিদ্বেষী একটি ক্যারিকেচার না হয়ে ওঠে। তিনি অ্যান্টি-হিরোর ভূমিকায় উজ্জ্বল, এবং ফিলিসের ভণ্ডামিটা তুলে ধরেন— যেই ফিলিস দেখেন তিনি নিজের দলে জমি হারাচ্ছেন, তখন নারীকেন্দ্রিক এক বিষয় তুলে ধরে নিজের রাজনৈতিক উপস্থিতি বজায় রাখেন।
সিরিজে দেখা যায়, ফিলিসের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান গ্লোরিয়া স্টাইনেম (যার ভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেছেন রোজ ব্যর্ন), যিনি নারীবাদী আন্দোলনে খ্যাতি এবং প্রাধান্য দুই-ই অর্জন করছেন কিন্তু এর রাজনীতি সম্বন্ধে যথেষ্ট সন্দিহান। এই সিরিজ তুলে ধরে স্টাইনেম, ফ্রিডান এবং অ্যাবজুগ-এর মধ্যে রেষারেষি। হয়তো বন্ধ দরজার পিছনের কথোপকথনগুলোতে সত্যের চেয়ে কল্পনার অংশই বেশি— ঐতিহাসিক কল্পকাহিনির ক্ষেত্রে যা হয়েই থাকে। ফ্রিডান-এর চরিত্রে ট্রেসি উলম্যান এবং শার্লি চিশহল্ম-এর ভূমিকায় উজো আডুবা-র অভিনয়ও অতুলনীয়।
১৯৭১-এর মার্কিন নারীবাদী আন্দোলনের সংগ্রামের সঙ্গে আজকের জগতের ঘটনাবলির এমন নিবিড় সংযোগ আছে, তা অভিভূত করে দেয়। ‘মিসেস আমেরিকা’ আমাদের উপলব্ধি করায়, যেমন নিজেদের পার্থক্য এবং মতবিরোধ সত্ত্বেও নারীবাদী আন্দোলনকর্মীরা ‘ভাল লড়াই’ চালিয়ে যান, তেমনই, একমাত্র অহংবোধ এবং স্বার্থ দূরে রেখেই মহৎ উদ্দেশ্যসিদ্ধি সম্ভব। মনে রাখা উচিত চিশহল্ম-এর উদ্দেশ্যে আবজুগের এই সংলাপ, ‘তোমার পরে যারা আসছে তাদের জন্য দরজা খোলা রাখো।’
খবরের কাগজ পড়লেই বোঝা যায়, এখন ভারতবর্ষে মহিলাদের পরিস্থিতি কতটা কঠিন। নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধ, ধর্ষণ, পারিবারিক হিংসা, খুনের হুমকি, নানা নির্যাতন আজও অব্যাহত। যদি দেখে না থেকে থাকেন, এই ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারীদিবস, হয়তো ‘মিসেস আমেরিকা’ দেখার জন্য আদর্শ দিন। দৃঢ়, ক্ষমতাশালী মহিলাদের জীবন উদযাপনের দিন।