পরের দিন সকালে স্টুডিওতে যাওয়ার তোড়জোড় চলছে, গুরু ব্রেকফাস্ট সেরে নিজের রুমে গেল তৈরি হতে। আমি আর গীতা দত্ত খাবার টেবিলে বসে আছি। হঠাৎ গীতা দত্ত বললে— আচ্ছা জবার পার্টে কাকে নেওয়া হল জানেন?
বললাম— হ্যাঁ, ওয়াহিদা রেহমান নামের ওই মেয়েটাকে—
— কেন, ও ছাড়া কি আর কোনো নায়িকা নেই বোম্বের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে—
— বললাম— কেন মেয়েটিকে দেখে বেশ ভালো লাগল। গুরু দত্ত যে সেদিন স্টুডিওতে দেখালে তাকে, গুরুর খুব বিশ্বাস আছে ওর ওপর। ওর কাজ নাকি খুব ভালো, গুরু বললে—
গীতা দত্ত চোখদুটো নীচু করে বললে— জানেন, আজ ঐ ওয়াহিদা রেহমানের জন্যই আমার সংসারে যত অশান্তি—
শুনে আমি চম্কে উঠলাম। সমাজের ওপরতলার মানুষদের ভেতরের ছবিটা দেখার চেষ্টা করলাম। স্টুডিওতে বসে আছি, লোকজন গুরুর কাছে আসছে-যাচ্ছে। ঘর একটু ফাঁকা হতেই গুরু দত্তকে একলা পেয়ে বললাম— আচ্ছা গুরুজি, বম্বেতে তো আরো অনেক মেয়ে ছিল, তাদের কাউকে না নিয়ে ওয়াহিদা রেহমানকে ‘জবা’র পার্টে নিলেন কেন?
গুরুর চোখের দিকে চেয়ে মনে হল ও যেন আমাকে সন্দেহ করছে। জানতে চাইছে কথাটা গীতা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছে কি না!
কিন্তু আমি প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলাম। গুরুও আর ও নিয়ে প্রশ্ন করলে না। গুরুর একটা ভালো গুণ ছিল— সে কখনও বেশি কথা বলত না। যখন অন্য লোক চুপ করে থাকত, সে-ও চুপ করে থাকত। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ নিঃশব্দে কখন ঘর থেকে কাউকে না বলে চলে যেত। গিয়ে পাশের ঘরে ঘুমিয়ে পড়ত। কিন্তু সময়ের ঘুমের অনেক দাম। অসময়ের ঘুম শরীরের ওপর বেশি ফল দেয় না।
খানিক পরে গুরু বললে— আসুন, নিচেয় শুটিং আছে— আমার ‘চৌধবী কা চাঁদের’ শুটিং—
গেলাম নিচেয়। সিঁড়ি দিয়ে নেমে একতলায় বিরাট ফ্লোর। তখন অ্যাম্প্লিফায়ারে সমবেত গান চলছে। সেটের ভেতরে রঙিন কাগজের ফুল-পাতা ছড়ানো। কোনও উৎসবের দৃশ্য। গুরু আর আমি যেতেই চারিদিকে সব ব্যস্ত হয়ে উঠল। দুটো চেয়ার এগিয়ে দিল দুজনকে। আমি চারিদিকে চেয়ে অবাক হয়ে গেলাম। এরই নাম স্টুডিও। তিনতলা বাড়ির সমান উঁচু। চারিদিকে এত জায়গা যে ফুটবল খেলার মাঠ হয় তাতে।
গান আরম্ভ করে দিল মেয়েরা। প্রায় বারো-তেরো জন মেয়ে। তারা বিচিত্র পোশাক পরেছে। বাইরে থেকে গানের রেকর্ড বাজছে আর তারাও সবাই মিলে হাত-মুখ-মাথা নেড়ে সুরে সুর মিলিয়ে গান গেয়ে যাচ্ছে।
কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না। মাঝে-মাঝে গুরু ভুল শুধরে দিচ্ছে। একবার, দুবার, তিনবার, চারবার। এমনি করে একই জিনিস প্রায় দশ-বারো বার ক্যামেরায় নেওয়া হল। আমার ক্লান্তি লাগছিল। ঘণ্টা তিনেক পরে বোধহয় জিনিসটা শেষ হল। আমরা আবার এসে ঘরে বসলাম। আবার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নিয়ে কথা শুরু হল।
বললাম— কবে থেকে শুরু করবেন স্ক্রিপ্ট লেখা?
গুরু বললে— বড় ঝামেলায় রয়েছি, একটু গুছিয়ে নিয়েই আরম্ভ করব। তারপর একটু থেমে বললে— একটা অ্যাসিস্টেন্ট দেব আপনাকে, আপনি তার সঙ্গে কাজ করবেন—
— কে সে?
— সে আজকেই আসবে। ছেলেটার নাম অমলেন্দু বোস, বাঙালি— সে সিনেমাতে কাজ করেছে আগে, সত্যেন বোস নামে একজন ডাইরেক্টর আছেন, তার সঙ্গে কাজ করেছে—
কি রকম লোক তিনি, কি রকম তার জ্ঞান, তাও জানি না। তা ছাড়া আমার সঙ্গে বনবে কিনা তাও সন্দেহ। কথা হচ্ছে আর ঘণ্টায়-ঘণ্টায় চা দিচ্ছে রতন। হঠাৎ এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকলেন। ঢুকে গুরুকে নমস্কার করলেন। গুরু আলাপ করিয়ে দিল— এই অমলেন্দু বোস। এর সঙ্গেই আপনাকে কাজ করতে হবে—
ভদ্রলোকের দিকে ভালো করে দেখলাম। বেশ গোলগাল ভোম্বলদাস মানুষ। পান খাওয়া অভ্যেস আছে, সিগারেটও খাচ্ছেন।
গুরু বললে— আপনারা আলাপ করুন, আমি আসছি—
গুরু চলে গেল। অমলেন্দুবাবু বললেন— আমিও কলকাতার লোক, শোভাবাজারে থাকি, আপনি কোথায় থাকেন?
নিতান্ত ঘরোয়া প্রশ্ন। দুজন বাঙালি প্রবাসে একসঙ্গে সাক্ষাৎ হলে যা-যা কথা হয়, সেই সব কথাই হল। তারপর কি রকম দুরবস্থার মধ্যে নিজের দিন কাটছে, তারও সবিস্তার কাহিনী শুনতে হল। ভদ্রলোকের স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-মা সবাই কলকাতায়। মাসে-মাসে তাদের টাকা পাঠাতে হয়। কিন্তু কয়েক মাস টাকা পাঠাতে পারেনি। বড় দুঃসময় চলছে। যারা সিনেমার ব্যবসায় উঁচুর দিকে আছে, তাদেরই নাম আমরা শুনি। তাদের ছবিই খবরের কাগজে ছাপানো হয়। তাদের নাম-ধাম কুলজি নিয়ে আলোচনা হয় বাসে-ট্রামে-ট্রেনে। কিন্তু তাদের আড়ালে আরো লক্ষ-লক্ষ কর্মচারী আছে, যাদের কথা বাইরের থেকে কেউ জানতে পারে না। তাদের দারিদ্র্য, তাদের সমস্যা, তাদের ভাবনা-চিন্তার কথা কেউ জানতেও চায়ও না।
আমাদের অমলেন্দু সেই শ্রেণীর লোক। অত্যন্ত অল্প মাইনে। অতি সাধারণ জামা-কাপড়। মন খুলে সিগারেট খাওয়ার পয়সাটুকুও হাতে থাকে না। অথচ গুরুকে সারা দিন চার-পাঁচ টাকার সিগারেট খেতে দেখি।
অমলেন্দুকে আমি বলতাম— তুমি এত সিগারেট খাও কেন? ওটা ছাড়তে পারো না?
অমলেন্দু বলত— দাদা, আর কিছু বিলাস নেই, ওই একটাই রেখেছি—
— কিন্তু সস্তার সিগারেটে তো তোমার শরীরও খারাপ হয়।
এমনি করে অমলেন্দুকে অনেক বুঝিয়েছি, অনেক শিখিয়েছি, অনেক উপদেশও দিয়েছি। গুরু দত্তকে যেমন তার অমিতব্যয়িতার জন্যে অনুযোগ করেছি, অমলেন্দুকেও তাই। একজন লাখপতি আর একজন নিতান্ত গরিব। কিন্তু স্বভাব দুজনেরই প্রায় এক-রকম। কিন্তু দুজন মানুষই শিশুর মতন। দুজনের মনের মধ্যে কোনও পরশ্রীকাতরতা, খলতা, নীচতা ছিল না।
এক-একসময়ে তাই ভাবি। অনেক সময়ে মানুষের নীচতা দেখে মনে-মনে নিদারুণ বেদনা পেয়েছি। কিন্তু কত ভালো-লোকেরও যে সন্ধান পেয়েছি, তাও গুণে শেষ করা যায় না। পৃথিবীতে এত ভালো লোকও আছে। পৃথিবীটাতে এখনও বেঁচে থাকা যাচ্ছে তার একমাত্র কারণ ওই সৎ-সুন্দর মানুষের দল আছে বলেই।
মনে আছে অমলেন্দুর অনেক দিন হাতে পয়সা ছিল না বলে সিগারেট খেতে পায়নি। মুখ দেখে বুঝেছি সিগারেটের নেশায় ছট্ফট্ করছে অমলেন্দু, অথচ হাতে পয়সা নেই। তখন হয়তো আমার কাছ থেকে টাকা না চেয়ে আর পারেনি। টাকা দিতেই তাড়াতাড়ি সেই টাকা নিয়ে দৌড়ে দোকানে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে তবে হাসি বেরোল মুখ দিয়ে।
গুরু দত্ত দরিদ্র হলে হয়তো সেই অমলেন্দুই হয়ে যেত। আমি দুজনকেই কাছাকাছি থেকে দেখতুম আর বড় মজা লাগত দেখতে।
পরের দিন দুপুর বেলা গুরু দত্ত স্টুডিও থেকে খবর দিলে— তৈরি হয়ে নিন, বিকেলবেলা বেরোতে হবে—
গাড়ি এল স্টুডিও থেকে। গেলাম। দেখি অমলেন্দুও হাজির। কোথা থেকে টাকা সংগ্রহ করে লন্ড্রির কাপড়-জামা ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। গুরু বললে— আপনার যদি কিছু জিনিস এখান থেকে কিনে নিয়ে যাবার থাকে তো বলুন—
আমার আর কি জিনিস নেবার থাকবে! সাধারণত আমার প্রয়োজন অতি সামান্য। দুটো তিনটে কলম, আক শিশি কালি, আর কিছু সাদা কাগজ হলেই চলে যায়।
সুতরাং বিকেল পাঁচটার সময় রওনা দেওয়া গেল। আবার সেই লোনাভালা। আবার সেই আশি মাইল পথ পরিভ্রমণ। গুরু এবার আর গাড়ি চালাল না। আমি আর গুরু পিছনের সিটে। সামনে গুরুর চাপরাশি রতন আর ড্রাইভার। অমলেন্দু চলে গেল ট্রেনে।
যখন পৌঁছোলাম লোনাভালায় তখন বেশ অন্ধকার হয়ে গেছে। গিয়ে দেখি জিপ-গাড়িটা আগেই হাজির হয়ে গিয়েছে। তাতে একজন বাবুর্চি। তার নাম জন্। ইন্ডিয়ান-ক্রিশ্চিয়ান। আর দুজন চাকর। তারা আগেই সেখানে গিয়ে ঘর-দোর পরিষ্কার করে রেখেছে। তিনটে বেডরুম আর একটা বিরাট হল ঘর। টেলিফোনে অর্ডার দিতেই একটা মোটর-বাইকে চড়ে একজন চাল-ডাল-তেল-নুন-ঘি দিয়ে গেল। রান্না চাপাল জন্।
ফ্ল্যাটের ভেতরে আমি আর গুরু। বসে-বসে গল্পই হতে লাগল অনেকক্ষণ পর্যন্ত। সেই লুঙ্গি পরা, সেই গড়গড়া, সেই হাসি-হাসি মুখ। ‘চৌধবী কা চাঁদ’ ছবি শেষ হতে খানিকটা নিশ্চিন্ত ভাব। মনটা প্রশান্ত। লোনাভালা বোম্বাই নয়। চারিদিকে শান্তি। গুরু বললে— এই বাড়িটা আমি ভাড়া করে রেখেছি, এই জন্যেই। যখনই যন্ত্রণায় পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়, তখনই আমি এখানে পালিয়ে আসি। এ জায়গাটা আমার তাই খুব ভালো লাগে—
আমারও বড় ভালো লাগছিল। এ এক অপূর্ব পরিবেশ। কলকাতা থেকে পালিয়ে এসেছি আমিও। আমারও সংসার, আমারও লেখা, আমারও গুরুর মতো অর্থ-চিন্তা আছে। সংসারী মানুষের যা-যা ঝঞ্ঝাট থাকে, আমারও তা আছে। তার ওপরে আছে আমার উপন্যাস গল্পের হাজার-হাজার চরিত্র। তাদের ভালো-মন্দ নিয়ে আমার মাথাব্যথার অন্ত নেই।
হঠাৎ রতন এসে একটা গ্লাসে কী দিয়ে গেল। গুরু আমার দিকে চাইলে।
বললে— ড্রিঙ্ক করবেন বিমলবাবু?
বললাম— না, আপনি খান্—
একটু খান-না— গুরু বললে—
বললাম— আমার শরীরটা ভালো নয়, আপনি তো জানেন—
গুরু আর পীড়াপীড়ি করলে না। বললে— ঠিক আছে, আমি খাই—
বললাম— খান—
গুরু গেলাসে চুমুক দিতে লাগল। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা ঘুমোতে গেলাম। তারপর আমার যে কোথা থেকে রাত কেটে গেল বুঝতে পারলাম না।
ভোরবেলা এসে হাজির হল অমলেন্দু। হাসতে-হাসতে একটা স্যুটকেস নিয়ে ঢুকল। বললে— ট্রেনে বড্ড ভিড় ছিল, সারা রাত ঘুম হয়নি—
থার্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে এসেছে অমলেন্দু। টাকা খরচ হবার আশঙ্কায় সেকেন্ড ক্লাসেও আসেনি। সারা রাস্তা নাকি দাঁড়িয়েই কাটাতে হয়েছে।
বিকেলবেলা আমরা তিনজনে চা খাচ্ছি। হঠাৎ একটা গাড়ি থামবার শব্দ হল বাইরে। কে এল?
গুরু বললে— আব্রার আলভি—
— সে কে?
গুরু বললে — আমার স্ক্রিপ্ট রাইটার—
আমি অবাক হয়ে গেলাম। সিনেমার গল্প যে লেখে তারও নিজের গাড়ি। নিজের গাড়ি চালিয়ে এসেছে সে?
আব্রার আল্ভি বোম্বাইতে ফিল্ম-জগতের নাম করা সিনারিও লেখক। মুসলমান নিজে কিন্তু হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করেছে। ভারি আমুদে লোক। নাগপুর ইউনিভার্সিটি থেকে এম.এ. পাশ করেছে ইংরেজিতে।
গুরু দত্ত আমাকে বলেছিল— ওকে আমিই আবিষ্কার করেছি বিমলবাবু। আমাদের সিনেমা লাইনে এসেছিল অ্যাসিস্টেন্ট হতে, কিন্তু হয়ে গেল সিনেমার স্ক্রিপ্ট-রাইটার। আমিই ওকে প্রথম লেখাতে আরম্ভ করি।