ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বাঞ্ছা করি দেখব তারে


    সাগুফতা শারমীন তানিয়া (March 7, 2021)
     

    ছোট্টবেলায় হুডিনির দুঃখজনক মৃত্যুর পর স্ত্রীর প্ল্যানচেটে তাঁর ফিরে আসার গল্প পড়েছিলাম, জীর্ণ বসনের মতন শরীরটাকে পরিত্যাগ করে গেছেন শরীরী কৌশলের রাজা হুডিনি, অশরীরী হয়ে ফিরে এসে কেবল অনুনয় করছেন ‘বিশ্বাস করো!’ পরে হাতে পেয়েছি এমিলি ব্রন্টির ‘উদারিং হাইটস’—  দুর্যোগময় রাতে এক আগন্তুক এসে আশ্রয় নিচ্ছে হিথক্লিফের দখল নেওয়া ভুতুড়ে বাড়িতে… রাতের জানালায় গাছেদের শাখা আঘাত করছে… ভূতের ভয়ে আগন্তুক চেঁচিয়ে পালাচ্ছে ঘর ছেড়ে… আমিও চিরকালের ভিতু, ভাবছি এইবার বইটা বন্ধ করব। তখুনি হিথক্লিফ এসে জানালা খুলে দিয়ে অসহ্য কষ্টে চিৎকার করে ডাকল— ‘ক্যাথি! ক্যাথি! ফিরে এসো। আমাকে ভূত হয়ে তাড়া করো। প্রেতাত্মা হয়ে ভর করো। তবু এসো।’ বইটা বন্ধ করে তুলে রাখা তো হলই না, আমার মনে উল্কির মতো দেগে গেল হিথক্লিফ, সে এবং তার মতন সেইসব মানুষ, যারা প্রিয়জনের মৃত্যু মানতে পারে না। মৃত্যুর পরে কোন গ্রহে যায় মানুষের আত্মা, ঐ আকাশে ক’টি আত্মহারা চাঁদ? কেমন নিউরোটিক যাতনা তৈরি করে সেইসব চাঁদের জোছনা? আত্মা কি ফারাওদের মতন মৃত চিতায় সওয়ার হয়ে পাড়ি দেয়? মৃত কেন, জীবিত অবস্থাতেই প্রিয়জনরা কত দূরে চলে যায়, জেনারেশন গ্যাপ, কালচারাল গ্যাপ ইত্যাদি পরিখা পাড়ি দিয়ে আমরা আর তাদের কাছে কখনও পৌঁছই না! মৃতের কাছে আর পৌঁছনো যায় না, এ আর এমন কী! 

    ‘প্রিয় পুরুষ’ প্রসঙ্গ এলে অনেকগুলো দুর্গম ল্যাবিরিন্থ পার হয়ে মনে আসে অনেকের ছবি। ছাদের ঘরে শুয়ে যারা ‘আমি কলঙ্কী চাঁদ’ শুনত বুকে রেডিও রেখে, নিতবরের মতো সেজে ঘুরে বেড়াত উৎসবে, বোনদের কাপড় ছাড়বার সময় সে-ঘরে স্বেচ্ছায় ভুল করে ঢুকে যেত, নেমন্তন্নবাড়ির ঢালাও বিছানায় এরা কেউ কেউ গুঁড়ি মেরে বুকে হেঁটে এগিয়ে আসত প্রাচীন সরীসৃপের মতো। বাজার ঘুরে খুঁজে আনত প্রিয় মনোহারী সামগ্রী, কোলে বসিয়ে চন্দ্রপুলি খেতে দিত তারাই— অশেষ আদরে, জামার খুঁটে মুছে দিত এঁটো মুখ, আবার তারাই ‘দেখি দেখি কেমন সুঁইয়ের কাজ করেছিস জামার বুকে’ বলে ওড়না সরিয়ে দিত। তারা এইসব মেয়েদের সাফল্যে উজ্জ্বল হাসত, এইসব মেয়েদের বিয়ের সময় তারাই হতো শুভানুধ্যায়িতার আঢ্য। এরা মেয়েশিশুদের একান্ত স্বজন। জীবজগতে আর কোনও পুংলিঙ্গধারী প্রাণী এত বুদ্ধি আর এত মর্মান্তিক হৃদয়হীনতা একত্রে একই করোটিতে পুষতে পারে কি না সন্দেহ। 

    অতএব কোন পুরুষ মনের মিত্র? দুর্ভাবনায় হৃদয় যখন অহল্যাভূমি, তখন কে দেয় সেচ, কোন আনন্দনির্ঝরিণী? কার বিরাট প্রচ্ছায়া বাকি পৃথিবীর পুরুষের রূপে গ্রহণ লাগিয়ে দেয়? বড় হতে হতে ছোট্টবেলার রাজপুরুষদের জন্য আমরা মেয়েরা মনে মনে যত রাজপোশাক বুনেছি, সেগুলো ওদের সব্বার গায়ে ঢলঢল করে দেখেছি। তবু একটি লোক ছিল, যাকে ওইসব ঢলঢলে জামাতেও খুব মানাত। তার মাফলারে জাম্বাকের গন্ধ, তার ভাষায় বিক্রমপুরের অপিনিহিতি, বিভূতিবাবুর ‘এরিকা পাম’ পড়েছেন যাঁরা, তাঁরা ওইরকম আত্মভোলা পাগল লোক খুব চিনবেন। আমার নানা। যাকে আর একটিবার দেখবার জন্য আমার এখনও চিতার মমিতে চড়ে বিদেহীদের দেশে চলে যেতে ইচ্ছে করে। 

    দেখতে কেমন ছিল? ব্যাকব্রাশ করা চুল, তন্ময় মুখের ভাব, সাধু-সরস-দিব্যকরোজ্জ্বল চোখ হাসির জলে সদাই ভেজা। আড়চোখে দেখতাম, তার সুন্দর হাত-পায়ের পাতা, পরিষ্কার নখ সযত্নে কাটা, বিশখানা আঙুলের কোথাও ছন্দপতন হয়নি। যেন এ-হাত মিথ্যেবাদী-চোর-বাটপাড়-ঘুষখোরদের পৃথিবীতে লেনদেন করেনি, গুল্‌ফে দেবদূতের ডানা আছে বলে পায়ে ধুলি লাগেনি। বসত ললিতাসনে, খবরের কাগজ পড়বার সময় তার মুখ তুবড়ে যেত চিন্তায়, আর শূন্যে তর্জনী দিয়ে কীসব লিখতে লিখতে ভাবত। ‘যাবজ্জীবেৎ সুখং জীবেৎ’ তার জীবনের উদ্দেশ্য হলেও, ঋণ করে ঘি খাওয়ার ঘোর বিরোধী ছিল সে, ‘থাকলে খাব নৈলে উপোস’ ছিল তার জীবনযাপনের শর্ত। ‘কোথায় রানী ভবানী কোথায় বিছানা-মুতুনি’— এর বেশি টিপ্পনী কাটত না কখনও। বর্ণভেদ ছিল তার জীবনে, সুভাষী আর কটুভাষীর ভেদ, সাহিত্যপাঠক আর অপাঠকের ভেদ। পৃথিবীতে তখনও ছিল অজস্র মানুষ যারা অশ্লীল কথা বলত, কাজে ফাঁকি দিত, মানুষকে ইচ্ছে করে ফাঁসিয়ে দিত, স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তুলত… এরা নানার পৃথিবীর বাইরে ছিল, নানা জানত এরা আছে, মানত এরা থাকবে, কিন্তু তার সসম্ভ্রম ভালবাসাময় ভুবনের কোত্থাও এরা ছিল না। 

    নানা খুব বেশি নামাজ-কালাম জানত না, খুব ভোরের জায়নামাজে বসে মৃদুস্বরে গুনগুন করত— ‘নবী মোর পরশমণি’ হয়ে গান কখন ‘ভরসা আমার শ্যামাচরণ’ অবধি চলে যেত, সেটাই তার তর্পণ ছিল। বারান্দায় কালো কাঠের চেয়ার পেতে হাঁটুতে চাপড় মেরে তাল দিয়ে আমার নানা গাইত কানন দেবীর ‘যদি আপনার মনে মাধুরী মিশায়ে এঁকে থাকো কোনও ছবি’, নজরুলের ‘আজ আগমনীর আবাহনে কী সুর উঠিছে বাজি’, অজয় ভট্টাচার্যের ‘এই মহুয়াবনে মনের হরিণ হারিয়ে গেছে খুঁজি আপনমনে’, ধনঞ্জয়ের ‘কেউ আশা লয়ে জাগে রে’…  কিংবা রামপ্রসাদি ‘মা আমায় ঘুরাবি কত/ কলুর চোখবাঁধা বলদের মতো।’ যখন বয়সের ভারে পাকা ডেউয়ার মতো তোবড়ানো আকার নিচ্ছে তার চিবুক, যখন আর নাপিতের দোকানে যেতে পারত না, তখন আমি ছেঁটে দিতাম চুল, ঘাড়ের ব্যথায় সাবধানে লাগিয়ে দিতাম ইস্তিরির সেঁক। সন্ধ্যায় মশার কয়েল জ্বলে জ্বলে বিষাক্ত ঘরে নানার রেডিওতে বাজত আব্দুল আলীম— ‘স্বরূপ তুই বিনে দুখ বলব কার কাছে’, যেন দুখ বলবার বস্তু। 

    তখন লোহার কোলাপ্‌সিবল গেট ছিল না বাড়িতে বাড়িতে, নানাবাড়ির গেটটা খোলাই থাকত দিনমান, রিঠামাছের তরকারি হাতে করে স্নেহভাক প্রতিবেশিনী-কন্যা আসত, কুকুর এসে দুপুরের রোদ থেকে ছায়া খুঁজে নিয়ে ধুঁকত, ফকির এসে পুঁটুলি খুলে খেতে বসত, ফটকের পাশে মেহেদিগাছটা থেকে মেহেদিপাতা কোঁচড়ভরে তুলে নিয়ে যেত বালিকারা। স্কুল-ছুটি হলেই নানাবাড়ি মাতৃভূমির মতো আমাকে টানত। বুড়ো লংফেলো আর শঙ্করাচার্য আউড়াত, আব্বাসউদ্দিনের ‘ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে’ গেয়ে মাত করত পঞ্চাশের দশকের বৈঠক, নজরুলকে শুনিয়েছিল ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’, আমাকে ডাকত কিটসের ‘লা বেল ডম সঁ মার্সি’। ওই একটা সুরেলা লোক আর তার সহজ গার্হস্থ্য দ্বীপরাষ্ট্রের মতো আলাদা ভেসে থাকত আমাদের অতি-রক্ষণশীল পরিমণ্ডলে। 

    তার মৃত্যুর পরে তার ছেলেমেয়েরা তার লেখা চমৎকার সেই ইংরেজি গ্রামার বইটা হারিয়ে ফেলল, ব্রতচারী গানগুলোও মনে রাখল না, বাপ কী হতে পারত তা নিয়ে তারা জল্পনা শেষ করতে পারল না। অথচ আমার নানা কিন্তু হবার অপেক্ষমাণ ছিল না, পুরাঘটিত ছিল, আমূল মানুষ। যে পূর্ণতাকে জেনে জীবনানন্দের প্রসাদ আর তার বউ প্রেমবিথার নিয়ে মাঠের অন্ধকারে পাশাপাশি বসে থাকত, যে পূর্ণতাকে জেনে বিভূতিভূষণ বলেছিলেন— ‘আমার কথা যখন লিখবেন, তখন লিখবেন আমি জীবনে পূর্ণ হয়েছি’, সেইরকম একটা পূর্ণ জীবন যে বাড়ির পেছনের ঢোলকলমি সাফ করে, ছাদে ঝিঙেলতা চড়িয়ে, অবসরে বিনেপয়সায় ইংরেজি পড়িয়ে, ঝোলভাত খেয়ে যাপন করা যায়, তা কেউ দেখতে পেল না। তার দার্শনিকতা সমাজমান্য বা জনগোচর ছিল না। লোকে তাকে মনে রাখল উদাস-অকর্মণ্য-অসফল-অহেতুক ভালমানুষ হিসেবে, যে গান গেয়েছে আর চুপচাপ ভেবেছে, যে ‘বিনষ্ট-সম্ভাবনা’, যে ‘ফলপ্রসূ’ নয়। সমাজ বদলাচ্ছিল, বাড়িগুলোও। 

    একটা সোনালি সময়কে ফিরে না পাওয়ার মনস্তাপ, ওটাই নানার দেওয়া মোহরের ভার হয়ে আমার মনে রয়ে গেছে। শুরু করেছিলাম জীবদ্দশায় প্রিয়জনের কাছে না পৌঁছবার ব্যথা দিয়ে, মৃতজনের কাছে যাবার প্রদীপ্ত বাসনা দিয়ে। ‘উদারিং হাইটস’ দিয়ে। প্রায়ই সুঁইয়ে সুতো গলাবার মতো করে আমি নিজেকে ওইসব অতীতকালে ঢুকিয়ে চালিয়ে নিই, যেখানে বুড়ো আছে, তার গান আছে, করতালি আছে, আছে সকল সুকুমারবৃত্তির প্রতি অগাধ স্নেহ। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook