কে যে কবে একটা রটিয়ে দিয়েছিল, শান্তিনিকেতনে গরুরা পথ আগলে বসে থাকে! তাদের সরাতে নাকি বলা হয়, ‘এই গরু সরে যা। ফুল ছুঁড়ে মারব!’ শান্তিনিকেতনের রাস্তাঘাটে, বিশেষত শান্তিনিকেতন থেকে শ্রীনিকেতন যাওয়ার পথে আর পূর্বপল্লীর লাগোয়া পৌষমেলার মাঠের পাশে, রাস্তা জুড়ে আমি বহু বেপরোয়া, নির্বিকার, অলস, কর্মহীন, স্থূলকায় গরুদের দল বেঁধে রাস্তায় বসে থাকতে দেখেছি। এদের দেখে ‘সরে যা, ফুল ছুঁড়ে দেব’ বলতে কিন্তু কাউকে শুনিনি। কান পাতলে শান্তিনিকেতনে শোনা যায় এরকম অনেক আজেবাজে গল্প। সব কাহিনি কিন্তু সত্যি নয়। কোনও দুষ্টু লোক, মনে হয় খারাপ মতলবে, এই গল্প রটিয়েছে। তারপর সেটাই মুখে মুখে চলে আসছে।
অতিকায় প্রাণীদের প্রতি আমার একটা অদ্ভুত ভাল-লাগা আছে। গরু আদর করতেও আমার ভাল লাগে, বিশেষত ওদের টানা টানা মায়াভরা চোখগুলোর জন্য। তা ছাড়া গরুর শক্ত, টানটান চামড়ার নীচে এক আশ্চর্য হিল্লোল থাকে, যা ছুঁলে শরীরে কেমন একটা তরঙ্গ খেলে যায়! শান্তিনিকেতনের রাস্তায় বসে থাকা কয়েকটা শিংহীন গরু আমি চিহ্নিত করে রেখেছি, যাদের আমি নির্বিঘ্নে কিছুক্ষণ আদর করতে পারি। তাদের প্রতিবাদ অথবা আক্রমণের তেমন ক্ষমতা অথবা আগ্রহ নেই। বড়জোর আমাকে উপেক্ষা করে তারা অন্যত্র চলে যেতে পারে।
আমার মায়ের কাছে শুনেছি, খুব ছোটবেলায় একবার পাড়ার এক ঘরোয়া দুর্গাপুজোয় যাওয়ার পথে, সংকীর্ণ এক গলিতে, একটা বিরাট মোষ আমাকে শিং দিয়ে মাথায় তুলে নেয়। মা কান্নাকাটি শুরু করলে আবার নামিয়ে দেয়। প্রশ্ন হল, এত গরু শান্তিনিকেতনের খোলা জায়গায় চরে বেড়াচ্ছে কেন? দেখা যাচ্ছে, শান্তিনিকেতনের আশেপাশে যারা গরু পোষে, তাদের পর্যাপ্ত ঘাসের অভাব। উন্মুক্ত মাঠে-ঘাটে তারা গরুগুলো ছেড়ে দিয়ে যায়। গরুগুলো ঘাস খায়। দিনশেষে বাড়ি ফিরে যায়। সমস্যা এই যে, তারা পিচ রাস্তার উপর বসে থাকে। জোরে গাড়ি চালাতে বাধা পেতে হয়। শুনেছি পাকা রাস্তার উত্তাপ গরুদের ভাল লাগে, তাই সরাসরি রাস্তায় বসে থাকে। এর মধ্যে আমাকে একজন বললেন, ‘দেখবেন, ওর মধ্যে কিছু মোটা মোটা লাল গরু আছে। ওগুলো প্রতিষ্ঠানের কেনা গরু। পুরনো কাল থেকে আছে।’ আমি যদিও এর কোনও প্রমাণ পাইনি। যখনই যাই, দেখি, যত্রতত্র একগাদা গরু একত্রিত হয়ে শুধু জাবর কাটছে।
এবার সাপের কথা। শান্তিনিকেতনে সাপের অভাব নেই। এখানে ছোট-বড় বাগান প্রায় বাড়িতে বাড়িতেই। ঝরা পাতা, ঝোপ-জঙ্গল, ভাঙাচোরা বাড়িঘর প্রচুর। সাপের থাকার পক্ষে উপযুক্ত। একটা বিশ্বাস লোকের মনে এখানে গাঁথা— শান্তিনিকেতন আশ্রমে কাউকে সাপ কামড়ায় না, আর মাথায় বাজও পড়ে না কখনও। নিছক বিশ্বাস হলেও, দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি। ‘আশ্রম’ বলতে শান্তিনিকেতনে একটা এলাকা চিহ্নিত আছে। তার বাইরে যেমন সাপ রয়েছে প্রচুর, তাদের কামড়াতেও দেখা গেছে। লোকের মাথায় বাজও পড়েছে আশ্রমের বাইরে। তবে আশ্রমে অনেক বড় গাছের মাথা বাজে মুড়িয়ে গেলেও, মানুষ অথবা অন্যান্য প্রাণীর মাথায় বাজ পড়েছে— শুনিনি।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা চাকরিতে যোগ দিয়ে আমার মাঝেমধ্যে হুড়ুমদুড়ুম চিঠি লেখার প্রবণতা ছিল। নিয়মমতে এইসব সরকারি চিঠি উপরতলায় পাঠাতে হলে কয়েকটা সিঁড়ি ভাঙতে হয়। সরাসরি চিঠি পাঠানো যায় না। সরকারি পরিভাষায় ব্যাপারটাকে বলা হয় ‘যথাযথ মাধ্যম’। আমার কপালে জুটেছিলেন এমন একজন ঊর্ধ্বতন আধিকারিক যিনি তাঁকে না দেখিয়ে উপরে চিঠি দিলে ভয়ানক রাগ দেখাতেন। এক সময়ে বিরক্ত হয়ে গেলাম। একদিন প্রতিষ্ঠানের বাগানে একটা বেড়ার ধার থেকে মালিরা ধরে ফেললেন সদ্য জন্মানো দশ-বারোটা বিষাক্ত খরিশের বাচ্চা। কী তাদের তেজ! তাঁরা বললেন, ‘এই সাপগুলো নিয়ে এখন কী করব?’ আমি বললাম, ‘মারা যাবে না। একটা স্বচ্ছ্, কাচের শিশিতে ভরুন। মুখটা আটকে হাওয়া ঢোকার মতো কয়েকটা ফুটো করে দিন।’ তাঁরা সত্যি সত্যি একটা কাচের শিশি আমার টেবিলে নিয়ে এলেন। কয়েকটা জেদি আর বিষাক্ত খরিশের বাচ্চা তার ভিতর ফোঁসফোঁস করছে। ছোবল লাগলেই ভুবন অন্ধকার! তাঁরা বললেন, ‘এবার কী করব?’ আমি বললাম, ‘বন দফতরে পাঠিয়ে দিন।’ পাশের ঘরটা দেখিয়ে বললাম, ‘যথাযথ মাধ্যমে পাঠাবেন।’ পাশের ঘর থেকে এরপর আমি শুধু একটা বিকট চিৎকার শুনেছিলাম। সাপগুলো অবশ্য জঙ্গলে ফিরে গিয়েছিল। সেই যথাযথ-মাধ্যম-প্রিয় ঊর্ধ্বতন আধিকারিককে দেখলেই আমার এক মহাপুরুষের একটা মহার্ঘ উপদেশ মনে পড়ে যেত— ‘মাঝে মাঝে ফোঁস করবি!’
শান্তিনিকেতনের কীট, পতঙ্গ, গাছপালা আর ধুলোবালির ভিতর আমরা বড় হয়েছি। ঋতুর গন্ধ চিনতে পারি। বর্ষায় শামুকগুলোকে দেখে খুব কষ্ট হত। গরুদের মতো পথ জুড়ে তারাও বসে থাকে, কিন্তু পলকে সরে যেতে পারে না! মোটরবাইক, সাইকেল, গাড়ি আর পায়ের নীচে পিষে যাওয়া শামুকগুলো দেখলে আমার ভয়ঙ্কর মনখারাপ হয়ে যায় আজও। দু’একটাকে হাতে তুলে মাঝে মাঝে সরিয়েও দিয়েছি। তখন আবার মনে হয়েছে, ও যেখানে যাচ্ছিল তার উল্টোদিকে এগিয়ে দিলাম না তো? আমি বিশ্বাস করেছি, একদিন শামুকের ইচ্ছেও আমি জেনে যাব! ছোটবেলায় স্কুলব্যাগে ভরে কুকুরের ছানা নিয়ে এসেছি। বৃষ্টি ভিজেছি। বালিতে বসানো চন্দ্রমল্লিকার ডাল তুলে তুলে দেখতাম শিকড় গজাল কি না! গুটিপোকা থেকে মথ, তার থেকে প্রজাপতি বানিয়েছি কতবার! স্কুল যাওয়ার রাস্তায় গোল করে মোড়ানো টগরপাতা দেখলেই বুঝেছি, ভিতরে নিশ্চিত লুকিয়ে একটা সবুজ গুটিপোকা। তাদের গায়ের গন্ধ শিশিতে আবদ্ধ পাতার গন্ধের সঙ্গে মিশে আজও নাকে লেগে আছে। শরতে শিউলি গাছ ভরে থাকত শুঁয়োপোকা। কেঁচোর মাটির নরম বাসার মাথায় ভোরের শিশির, হাওয়ায় উড়ে আসা বাবুইয়ের নিপুণ বাসা, শালুকের মাথায় বসা গঙ্গাফড়িং, বর্ষায় রাস্তার জলের ধারায় ভেসে আসা গায়ে ডোরা দাগটানা মাছ, পাতার কঙ্কাল, লাল ধুলো, রাতের পোকার গান— শান্তিনিকেতন আর আমার রক্তে মিশে আছে।
একসময়ে চুরি-ডাকাতির বেশ ভয় ছিল শান্তিনিকেতনে। এক রাতের জন্যেও বাড়ি ফাঁকা রেখে কেউই যেতেন না বাইরে। আমাদের শিক্ষকরা কোথাও গেলে আমরা অনেক সময়ে দল বেঁধে অথবা পালা করে থেকেছি তাঁদের বাড়িতে রাতপাহারায়। একবার কলকাতায় বড় হওয়া, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে সদ্য শান্তিনিকেতনে আসা এক সহপাঠী ছিল তেমনই এক শিক্ষকের বাড়ি। বাথরুমে তার আর্তনাদ শুনে ছুটে গেল তার সঙ্গে থাকা আরও দু’একজন। ‘কী হয়েছে?’ ভিতর থেকে ভেসে এল তার অসহায়, করুণ, ধরা গলার আওয়াজ, ‘আ স্ট্রেঞ্জ সেন্টিনেল ইজ ডুয়িং অ্যারাউন্ড।’ দরজা খুলে দেখা যায়, নিরাপদ দূরত্বে তার তর্জনী স্থির— ভেজা দেওয়ালে এক শ্লথগতি, শীর্ণকায় কেন্নোর অভিমুখে।
শান্তিনিকেতনে হেঁটে যেতে যেতে তারপর বার বার যেন হৃদয়ে ধ্বনিত হয়েছে, ‘আ স্ট্রেঞ্জ সেন্টিনেল ইজ ডুয়িং অ্যারাউন্ড।’ মনে হয়েছে, অন্তহীন ভুবনের খোলা আকাশের নীচে আমিও তো এক আশ্চর্য কীট, কীসব যেন করছি!